পোড়ামন ২: সালমান শাহের প্রথম চলচ্চিত্রের মতো ভক্তের ট্র্যাজিক পরিণতি
চলচ্চিত্র : পোড়ামন ২
চিত্রনাট্য ও পরিচালনা : রায়হান রাফি
শ্রেষ্ঠাংশে : সিয়াম আহমেদ, পূজা চেরি, বাপ্পারাজ, নাদের চৌধুরী, সাঈদ বাবু, আনোয়ারা ও ফজলুর রহমান বাবু।
প্রযোজনা : জাজ মাল্টিমিডিয়া
রেটিং : ৩/৫
‘ভালোবাসা কি পাপ? যদি ভালোবাসা অন্যায় হইয়া থাকে, ক্যান তুমি মানুষের বুকে এত ভালোবাসা দিলা?’
পাপ-পুণ্যের বিচার করতে নয়, বরং একটি নিটোল প্রেমের গল্প দেখতে প্রেক্ষাগৃহে যাওয়া। কারণ ‘পোড়ামন ২’ ছবিটির প্রচারণায় বলা হয়েছে, এটি ‘ভালোবাসার চেয়ে বেশি কিছু’। এছাড়া রয়েছে প্রয়াত চিত্রনায়ক সালমান শাহকে শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদান ও নতুন সব কলাকুশলীদের কাজ।
সালমান শাহ বাংলাদেশের তরুণ-যুবকদের কাছে ফ্যাশন ও স্টাইল আইকন। বর্তমান চিত্রতারকারাও তার স্টাইলে মজেছে। এই বিষয়টি এই চলচ্চিত্রের অংশ হয়ে গেল। গ্রাম্য যুবক সুজন সালমান শাহের পাঁড় ভক্ত। সবকিছুতেই গুরুর অনুকরণ চাই, এমনকি নামের পরে সে গুরুর মত ‘শাহ’ অংশটিও যুক্ত করে হয়ে ওঠে সুজন শাহ। সে গ্রামবাসীকে সালমান শাহের ছবির অভিনয় দিয়ে বিনোদন দিয়ে থাকে। কিন্তু প্রণয় দৃশ্যে ঢিল ছুড়ে বাধা প্রয়োগ করে পরী। কারণ সে ছেলেবেলা থেকে সুজনকে ভালোবাসে এবং অন্য কাউকে তার সাথে দেখতে পছন্দ করে না। কিন্তু সুজন তাকে ছেলেবেলার একটি ঘটনার জন্য ঘৃণা করে। সুজন পরে তার ভুল বুঝতে পারে এবং পরীকে কাছে টেনে নেয়। কিন্তু বাধ সাধে পরীর বাবা ও ভাই। পরবর্তীতে পালিয়ে যাওয়া, ধরা পড়া ও করুণ পরিণতি।
ছবির গল্পের কিছু অংশের তামিল ছবি ‘পারুথিভিরান’-এর সাথে মিল পাওয়া যায়। কিন্তু সেটা তেমন আহামরি কিছু নয়, যেখানে প্রায়ই আমরা পুরা ছবিই সিন বাই সিন কাট-কপি-পেস্ট দেখে থাকি। বরং একে ‘পারুথিভিরান’-এর ছায়া অবলম্বনে দেশীয় কনটেক্সটে নির্মিত বলা যায়। যেমন বছরের শুরুতে দেখেছি মারাটি ভাষার ‘সৈরাট’ ছবির গল্প অবলম্বনে নির্মিত ‘নূর জাহান’। এক্ষেত্রে ছবির কাহিনিকার ও চিত্রনাট্যকার রায়হান রাফিকে ধন্যবাদ দেওয়া যেতেই পারে।
কিন্তু গল্পের দৈর্ঘ্যের বিষয়টিও মাথায় রাখার দরকার। অযাচিত কিছু বিষয় মাঝে মাঝে গল্পের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কেও গুরুত্বহীন করে তুলে। শুরুর দিকে সুজন ও তার ভাইয়ের (বাপ্পারাজ) কমেডি অংশটুকু হাস্যরসের জন্ম না দিয়ে বরং আগের দৃশ্যের আত্মহত্যার ট্র্যাজিক অংশকে গুরুত্বহীন করে দেয়। ‘সুজন শাহের শো’টি সালমান শাহের ভক্ত এই বিষয়টি বুঝাতে গুরুত্বপূর্ণ হলেও এর দৈর্ঘ্য কমানো যেতে পারতো। আর প্রতিবার একই রিহার্সাল না করে সালমান শাহের অন্য ছবি নিয়েও কাজ করা যেতো। যেহেতু প্রেক্ষাগৃহে ‘বিচার হবে’ ছবি চলছে এমন দেখানো হয়েছে, অর্থাৎ ততদিনে সালমান শাহের বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে।
পিরিয়ড-ড্রামার ক্ষেত্রে প্রায়শই কাহিনিকাররা সেই সময়ের ফ্যাশন, স্টাইল ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়কে গুলিয়ে ফেলে। এই ছবিতেও তাই হয়েছে। গল্পটি সালমান শাহ যখন চলচ্চিত্রে কাজ করছিলেন অর্থাৎ ১৯৯০-এর দশকের, সে সময়ে রঙচটা ব্লু জিন্স ও সাদা কেডসের প্রচলন ছিল, কিন্তু সুজনকে আধুনিক ফ্যাশনের প্যান্ট ও জুতা পড়তে দেখা যায়। আর সুজনের দুই সহচর বস্তা-কাঠিদেরও অত্যাধুনিক পোশাকে দেখা যায়। এছাড়া সে সময়ে প্রেক্ষাগৃহে ডিজিটাল ব্যানার ছিল না। এমনকি এখনো কোথাও কোথাও ডিজিটাল ব্যানার দেখা যায় না।
চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র সুজন শাহ ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সিয়াম আহমেদ। এটি চলচ্চিত্রে তার প্রথম কাজ। গ্রাম্য-শহুরে মিশেল ভাষায় কথা বললে তাতে খুঁত ধরার উপায় নেই। গ্রাম্য চরিত্রে ভালোভাবেই মানিয়ে গেছেন ছোটপর্দার এই তারকা। সালমান শাহর অভিনয়, গ্রামভর দুষ্টামি, হঠাৎ প্রেমিক বনে যাওয়া ও দায়িত্ববান হওয়া, এবং শেষের দিকে ছেলেবেলার এক ঘটনায় পরিপ্রেক্ষিতে দ্রুত একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ অনন্যভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। সালমান শাহ ভক্ত হিসেবে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’-এর ট্র্যাজিক গল্প দিয়েই সিয়াম চলচ্চিত্র অভিনয় শুরু করলেন। সামনে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। সুজনের বিপরীতে পরী চরিত্রে অভিনয় করেছেন পূজা চেরি। পূজা ইতোমধ্যে ‘নূর জাহান’ চলচ্চিত্রে প্রধান অভিনেত্রী হিসেবে কাজ করেছেন এবং বিপুল প্রশংসা পেয়েছেন। এই ছবিতেও তার অভিনয় প্রশংসার যোগ্য। আগের ছবিতে তাকে শহুরে চরিত্রে দেখা গেলেও এই ছবিতে গ্রাম্য চরিত্রেও তিনি মানিয়ে নিয়েছেন। তার এই অভিনয় দক্ষতা, নাচ ও ডায়লগ ডেলিভারি ধরে রাখতে পারলে তিনি দীর্ঘদিন এই ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে থাকবেন।
পার্শ্ব চরিত্রগুলোর মধ্যে সাঈদ বাবু আর ফজলুর রহমান বাবু ছাড়া আর কারো অভিনয় তেমন নজর কাড়েনি। সাঈদ বাবুর রাগান্বিত অভিনয় ও তার সিগনেচার ডায়লগ ‘ভাল্লাগছে, খুব ভাল্লাগছে’ তার চরিত্রের খল ভাব ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করেছে। অন্যদিকে ফজলুর রহমান বাবু তার নামের প্রতি আবারও সুবিচার করলেন। নির্বাক থেকেও যে অনেক কিছু বলা যায় তা তার কাজ না দেখলে বুঝা যাবে না। বাপ্পারাজ দীর্ঘদিন পরে চলচ্চিত্রে ফিরলেও তাকে আগের মতো পাওয়া যায়নি। গ্রাম্য সংলাপ বলতে তাকে জড়িয়ে ফেলতে দেখা যায়। অথচ, তার কাছ থেকে আমরা পূর্বে কত ভাল কাজ পেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই।
সাইফুল শাহীনের চিত্রগ্রহণে চিরায়ত গ্রামের রূপ ফুটে ওঠেছে বারবার। ধানের ক্ষেত, গ্রাম্য বাড়িঘর, পুকুর, শুরুর দিকে রাতে জেসমিনের আত্মহত্যার দৃশ্য— সবকিছুতেই যত্নের ছাপ ছিল। পোড়ামন ২ ছবির অন্যতম দিক হল এর আবহ সঙ্গীত। রাজ নারায়ণ দেবের আবহ সঙ্গীত পুরো সময় আচ্ছন্ন করে রাখে। সাথে রয়েছে ইফতেখারুল আলমের বাঁশির মূর্ছনা। শুরুতেই ‘কেন পিরিতি বাড়াইলা রে বন্ধু’ গানটি মোহাচ্ছন্ন করে। সালমান শাহকে ট্রিবিউট দেওয়া ‘নাম্বার ওয়ান হিরো’ গানটি সুজনকে সালমান শাহের ভক্ত হিসেবে দেখাতে সাহায্য করে। বাকি দুটি গান ‘ও হে শ্যাম’ ও ‘সুতো কাটা ঘুড়ি’ শ্রুতিমধুর।
এই ছবিতে গল্পের খাতিরে ধনী-দরিদ্রের প্রেমে বাধা, নায়ককে মারধর, নায়িকাকে ঘরে আটকে রাখা এই ধরনের ক্লিশেগুলো বর্জনের সুযোগ নেই, তবে বেরিয়ে আসা দরকার। পুরনো গল্প দেখে এখন আর মন ভরে না। সর্বোপরি, রায়হান রাফি নতুন পরিচালক হিসেবে যত্ন নিয়ে ছবিটি নির্মাণ করেছেন এবং তার সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। সেজন্য তিনি প্রশংসার দাবীদার।