Select Page

সালমান শাহ যে কারণে ঢালিউডের স্টাইল আইকন

সালমান শাহ যে কারণে ঢালিউডের স্টাইল আইকন

একজন সফল অভিনেতা যেমন একটি দেশের রিপ্রেজেন্টেটিভ তেমনি অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি তার পোশাক-পরিচ্ছদ, কথাবার্তা, বাচনভঙ্গি, ব্যক্তিত্ব এমনকি স্টাইলের দিক থেকে তরুণ সমাজের আইডল হতে পারেন। সেলিব্রেটিদের লাইফস্টাইল অনুসরণ করে নিজেকে একটু ট্রেন্ডি করার, স্মার্টলি প্রেজেন্ট করার প্রচেষ্টা তরুণ সমাজের অনেক পুরানো অভ্যাস। এমনকি তাদের পোশাকআশাকও সাধারণ মানুষের জন্য আদর্শ। আবার শুধুমাত্র পোশাক অনুষঙ্গকেই ফ্যাশনের ছোঁয়া থাকেনা সেটা অভিনেতার অঙ্গ প্রত্যঙ্গেও প্রতিফলিত হয়। আর এই অনুষঙ্গগুলো হল একজন অভিনেতার পারসোনালিটির একেকটা সেগমেন্ট যা তার প্রফেশনালিজমের প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বকীয়তা প্রকাশ করে। এভাবে অনেক অভিনেতাই তাদের আনরাইভলড পারসোনালিটির জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন, জনমনে গভীর ছাপ ফেলে একধরনের নস্টালজিয়া তৈরি করে গেছেন। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সালমান শাহ সেই অভিনেতাদেরই একজন।

হলিউড বা বলিউডের বিপরীতে আমাদের স্টাইল আইকনের প্রশ্নে 90 দশকে ডানা মেলা সেই Toyota Sera গাড়ি নিয়ে শো অফ করা বা বাড়ির আঙ্গিনায় Net Cradle এ দোল খেতে থাকা সেই নায়কের নাম সবার আগে আসবে যিনি তার নিত্যনতুন স্টাইল ও ফ্যাশনসেন্সের জন্য তরুণ সমাজের ক্রেজে পরিনত হয়েছিলেন। তিনি আর কেউ নন, ঢালিউডের সাফল্যের বরপুত্র সালমান শাহ। তার সময়ে তিনিই ছিলেন তরুণ প্রজন্মের ক্রাশ। দেশীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বাংলা সিনেমার নায়কদের মধ্যে সালমান শাহ ছাড়া অন্য কারো ফ্যাশন-স্টাইল তরুন প্রজন্ম তার আগে বা পড়ে এতোটা অনুসরণ করেনি। চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী সালমান শাহ সম্পর্কে বলেছিলেন “সিনেমার হিরোদের নানা স্টেরিওটাইপের ভিড়ে সে ছিল অনেক স্বাভাবিক একজন অভিনেতা। তার সময়ের তুলনায় এগিয়ে থাকা এমনকি এখনকার সময়ের তুলনায়ও। শিক্ষাদীক্ষা বা জীবনযাপনের ছাপ মানুষের চলন-বলন এমনকি তাকানোতেও ফুটে ওঠে। মেইনস্ট্রিমের স্টার কারখানার মধ্যেও এই কারনে সে আলাদা আলো ছড়াতো। ” ফারুকীর কথার সাথে টিউনআপ করে বলা যায় এই আলাদা আলো ছড়ানোর কারনেই এত নায়কের ভীড়ে তাকে মার্ক করা গেছে সহজেই। সর্বমহলে তার গ্রহণযোগ্যতার অন্যতম কারণ হল বাস্তবসম্মত অভিনয়ের পাশাপাশি স্বকীয় স্টাইল স্টেটমেন্টের মাধ্যমে আলাদা ফ্যাসিনেশন তৈরি করা।

সালমানের ফ্যাশন!? সেটা আবার কি! সহজ কথায় সিনেমায় এবং বাস্তবে সালমান অভ্যাসগতভাবে যেসব শৈলীতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন সেটাই ছিল তার ফ্যাশন। সাধারণত বহুরৈখিক ডিজাইনারদের ফ্যাশন ফোরকাস্টিংয়ে চক্রাকারে পরিবর্তনের রং রাঙিয়ে নিয়ে আসে নতুন ট্রেন্ড। এই ট্রেন্ডটাই হল ফ্যাশন। আর স্টাইল হল যেটা আপনি করেন বা আমি করি। সালমানের স্টাইল মারাত্মক! মানে হল স্টাইলে সালমানের নিজস্ব ধরন বা ভঙ্গি। ফ্যাশনে নিজস্ব কিছু না থাকলেও স্টাইলে থাকে। আবার কোন স্টাইল কয়েক প্রজন্ম ধরে চলে। আর ফ্যাশন হল সাম্প্রতিক গৃহীত কোন জনপ্রিয় স্টাইল যার অবস্থান খুব বেশি দীর্ঘ হয়না। এক্ষেত্রে সালমান যেটা করেছিলেন, নিজে অনেক স্টাইল ইনভেন্ট করেছেন পাশাপাশি তার সময়ের ট্রেন্ডকে অনুসরণ করে অনেক স্টাইলকে পপুলার করেছেন। দেশীয় আবহের সঙ্গে পশ্চিমা কালচারের মিল রেখে নিত্যনতুন ধারণা যোগ করেছিলেন তার ফ্যাশনে এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিজেকে আপ-টু-ডেট রেখেছেন।

যেকোন ছবিতেই পরিচালক কস্টিউম সিলেকশনের ব্যাপারটা সালমানের উপরে ছেড়ে দিতেন। ফরমাল পোশাক পরবেন নাকি ক্যাজুয়াল লুক নিবেন সেই সিদ্ধান্ত সালমানই নিতেন। যেকোন প্রয়োজনে আউটডোরে গেলে কিংবা শ্যুটিংয়ের জন্য দেশের বাইরে গেলে ফিরে আসার সময় তার সাথে থাকতো নানা ধরনের পোশাকআশাক ভর্তি ৬-৭ টা লাগেজ। অধিকাংশ সময়ে দেশের বাইরেই শপিং করতেন। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই তার ড্রেস-আপ, বডি ল্যাংগুয়েজ, এক্সপ্রেশন, লুক, চরিত্রের সাথে মানানসই গ্লামার এবং স্টাইলে ছিল আধুনিকতার ছোঁয়া। সালমান যেসব স্টাইল করেছেন, যেসব ফ্যাশন অনুষঙ্গ ব্যবহার করেছেন এবং তিন বছরের ক্যারিয়ারে তার ফ্যাশন ট্রানজিশনের কিছু দিক তুলে ধরা হল:–

★★ সালমানের সংগ্রহে দেশি-বিদেশী শত শত ক্যাপ ও হ্যাট ছিল। তার অভিনীত সিনেমায় তিনি যেসব ক্যাপ ও হ্যাট ব্যবহার করেছেন :
1. Baseball Cap: সালমান New Era কোম্পানি সহ বিভিন্ন কোম্পানির Adjustable Backstrap Cap পরতেন। স্টাইলে ভ্যারিয়েশন আনতে এসব ক্যাপের Back Opening এ Ponytail বের করে রাখতেন।

2. Traditional Nepali Cap : কিছুটা ট্রাপিজিয়ামের মত দেখতে নেপালের এক ঐতিহ্যবাহী ক্যাপ আছে। সালমান অনেক সিনেমায় লং পাঞ্জাবীর সাথে এই ধরনের টুপি পরেছেন।

3. Army/Military Peaked Cap: “স্বপ্নের পৃথিবী ” ছবিতে সালমানকে Army Coat এর সাথে এই ধরনের Peaked Cap ব্যবহার করতে দেখা গেছে। ডিফেন্সের লোকেরা এই ধরনের ইউনিফর্ম পরলেও ফ্যাশন অনুষঙ্গ হিসেবে এটা সালমান ব্যবহার করেছেন।

4. Dhakai Topi: অনেক সিমেমায় ঢাকাই গোল টুপি গুলো কোট বা পাঞ্জাবির সাথে পরতে দেখা গেছে সালমানকে। এই টুপি ফ্যাশন অনুষঙ্গ হিসেবে অন্য কেউ ব্যবহার করেনি।

5. Hat: সিনেমায় সালমানকে বিভিন্ন কালারের The Cowboy, Homburg এবং Bowler ক্যাটাগরির Hat পরতে দেখা গেছে।

★★ A selfie a day…. keeps sadness away! আজকাল সেলফি না তুললে অনেকের রাতে ঘুম আসেনা অথচ ২৩ বছর আগে অনেকে সেলফি শব্দটার সাথেই পরিচিত ছিলনা। “অন্তরে অন্তরে ” সিনেমায় সালমান গাছের সাথে ক্যামেরার বেল্ট বেধে Self timer অন করে নিজের ছবি নিজেই তুলেছিলেন। সেলফি যেহেতু Self-Portrait Photograph তাই সেটা সালমানের সেলফি ছিল। সালমানের মধ্য ক্রিয়েটিভিটি ছিল মানতে হবে।

★★ক্যাজুয়াল পোশাকের সাথে সালমান বিভিন্ন ধরনের Headband, Headscarf, Towel, Wrap পরেছেন ফ্যাশন অনুষঙ্গ হিসেবে। এগুলা মাথায় বাধার পাশাপাশি গলায় এমনকি জিন্সেও বাধতে দেখা গেছে সালমানকে। Arabian Shemagh Scarfs যেটা মধ্যপ্রাচ্যর লোকেদের বেশি পরতে দেখা যায় এই Scarf গুলাও সালমান অ্যারাবিয়ানদের মত মাথায় বেধেছেন এবং শীতের দিনে গলাতেও পরেছেন। মরক্কোর লোকেদের মত Head Wrap পরেছেন। শীতের সময়ে স্কার্ফের পাশাপাশি বড় চাদরের মত এক ধরনের পোশাক ঘাড়ে বেধে শরীরের অর্ধেক অংশ পর্যন্ত নামিয়ে পরতেন যেটা কিছুদিন আগে ফ্যাশন ট্রেন্ড হিসেবে বের হয়েছিল।

★★ছেঁড়াফাটা Ripped/Fadded Jeans যা এখন দারুণ ফ্যাশন ট্রেন্ড। ২০ বছর আগে সালমান তার স্টাইলে রাফ এন্ড টাফ একটা ভাব আনতে ডিস্ট্রেসড লুকের এসব ছেঁড়াফাটা জিন্স ব্যবহার করতেন অথচ এই ফ্যাশন ট্রেন্ড আমাদের দেশে পপুলার হয়েছে খুব বেশিদিন হয়নি। সালমান কত আপডেটেট ছিলেন!

★★সালমান ক্যারিয়ারের শুরুতে কিছুটা লম্বা চুল রেখেছেন। মাঝে দিয়ে Short Hair Backbrush স্টাইল করেছেন এবং শেষের দিকে Semi-long, Shoulder Length,Ponytail স্টাইল করেছেন। এক সিনেমায় Long Hair এর সাথে French Cut দাড়ি রাখতেও দেখা গেছে সালমানকে।

★★ সালমানের বাসায় শেলফ ভর্তি শত শত জোড়া সু, লোফার, কনভার্স, হাই বুট এবং কেডস ছিল। তিনি সিনেমার প্রতিটা দৃশ্য জুতা পরিবর্তন করতেন। অল্প দিনের ক্যারিয়ারে সালমান সিনেমায় মোট 300 জোড়া জুতা ব্যবহার করেছেন যা রীতিমত রেকর্ড হয়ে আছে।

★★সালমান শাহ হল বাংলা সিনেমার প্রথম নায়ক যাকে সিনেমায় Dubbell, Cable Pulley Machine দিয়ে Bodybuilding Workout করতে দেখা গেছে। সালমানের Six Pack Abs না থাকলেও Well Shaped Body ছিল।

★★ফরমাল এবং ক্যাজুয়াল উভয় ধরনের ড্রেসের সাথে সালমান বিভিন্ন ধরনের Bracelet ব্যবহার করতেন যেটা কুল বয় লুকস পেতে ফ্যাশনের অন্যতম অনুষঙ্গ। তিনি Stretch Bracelet, Silver Bracelet ব্যবহার করতেন। গলায় Gold Chain এর পাশাপাশি Horn Pendant, Silver Pendant ক্যাটাগরির Mens Necklace ব্যবহার করতেন। কানে Men Stud Earring, Hop Earring পরতেন। আঙ্গুল আবার বাদ যাবে কেন? Gold Ring এর সাথে Stylish Gemstone Finger Ring পরতেন সালমান।

★★ সালমানের ফ্যাশনের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল সানগ্লাস ও আইগ্লাস। সালমানের চেহারা Oval Shape এর ছিল যার কারনে সব ফ্রেমের চশমাতেই তাকে মানাতো। সিনেমায় তাকে Round, Aviator, Club Master এবং Wayfarers ক্যাটাগরির সানগ্লাস পরতে দেখা গেছে। রাউন্ড ফ্রেমের আইগ্লাসও ব্যবহার করতেন তিনি। সানগ্লাস ও আইগ্লাসের পাশাপাশি ডিফারেন্ট কালারের Contact Lense ব্যবহার করতেন সালমান।

★★মনে আছে সালমানের সেই ডানা মেলা গাড়ির কথা? Toyota Sera গাড়িটি সালমানের অনেক পছন্দের ছিল। তার অনেক ছবিতেই গর্জিয়াস লুকের গাড়িটি নিয়ে Show off করতে দেখা গেছে। প্রায়ই শ্যুটিং শেষে রাতে বাসায় ফিরে না যেয়ে গাড়ি নিয়ে মেঘনা ব্রিজে চলে যেতেন, রাতের বেলা গাড়ি নিয়ে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতেন।

★★সালমান শাহ Bike রাইডিং এবং Cycling এ বেশ দক্ষ ছিলেন। সিনেমায় তাকে সেই সময়ের cb550, escort115 Bike ব্যবহার করতে দেখা গেছে। ফোর হুইলের বাইকও তার ছিল। মোটর বাইকের পাশাপাশি ক্যাজুয়াল রাইডিং এর জন্য হাতে Gloves পরে চওয়া হুইলের Mountain/Hybrid Bicycle রাইড করতেন যেটা শুধুমাত্র ওজন কমাতেই সাহায্য করেনা এটা ফ্যাশন অনুষঙ্গও বটে।

★★ছেলেরা বামহাতে ঘড়ি পরলেও সালমান সবসময় ডানহাতে ঘড়ি পরতেন। এদিক থেকেও তিনি ব্যতিক্রম ছিলেন। তিনি যেদিন মারা যান সেদিনও তার হাতে দেড় লক্ষ টাকার Rado Brand এর ঘড়ি ছিল।

★★সালমান সবসময় লেটেস্ট এবং রেয়ার ব্রান্ডের জিনিস পছন্দ করতেন। তিনি মার্লবোরো ব্রান্ডের সিগারেট খেতেন। 90 এর দিকে মার্লবোরো তেমন পপুলার ছিলনা।

★★সিনেমায় অ্যাকশন দৃশ্যে সালমানের ফাইটিং স্কিল ভালো ছিল। মাথা এবং গলায় চাইনিজদের মত স্কার্ফ পেঁচিয়ে ব্লাকবেল্ট হোল্ডারদের মত এগ্রেসিভলি ফাইট করতেন।

তারুণ্য স্থবিরতা পছন্দ করেনা। দর্শক যখন বাংলা ছবির নায়কদের যাত্রাপালার মত একই ধাচের পোশাকে দেখে বিরক্ত হয়ে গেছে তখন সালমান এই প্রচলিত ধারার বিপরীতে পোশাকআশাকে নিয়ে আসলেন আধুনিকতার ছোঁয়া। কখনও হ্যাট ও লং কোটে ডিটেকটিভ লুকে, কাউবয় বা কবি-সাহিত্যিকদের মত পোশাকে, পাঞ্জাবি, টি-শার্ট বা লং শার্টের সাথে নানা রকমের ওয়েস্টকোট পরে, শাহী পোশাকে বা যোদ্ধার বেশে, স্যুট-টাই পরে জেন্টল লুকে, মাঝি, রাখাল বা ঢাকাই রংবাজের গেটআপে, শার্টের কলার খাড়া করে কিংবা হাফহাতা গেঞ্জি,জিন্স উপরের দিকে ভাজ করে, হুডি-শার্ট কখনো ইন করে করে আবার ওপেনে রেখে বিভিন্ন লুকে পর্দায় হাজির হতে দেখা গেছে সালমানকে। ওয়েস্টার্ন লুকে তাকে বেশি গর্জিয়াস লাগত আবার সিম্পল গেটআপেও স্মার্ট দেখাতো।

ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ হল ফ্যাশন আর সেটা সঠিকভাবে বর্ণনা করতে পারা হল সচেতনতা। ফ্যাশন মানে স্রেফ নানা ধরনের পোশাক নয় ; নিজেকে সঠিকভাবে বর্ণনা করতে পারা, প্রেজেন্ট করতে পারা। যেটা অতি অল্প সময়ে সালমান শাহ করতে পেরেছিলেন, সর্বমহলে গ্রহনযোগ্যতা তৈরি করতে পেরেছিলেন। যারা ভালো তারা অল্প সময়েই প্রমাণ করে তারা ভালো। সেপ্টেম্বর মাসে জন্ম ও মৃত্যুবরণ করা Vigro বা কন্যা রাশির এই ক্ষণজন্মা অভিনেতা যেমন বাস্তবসম্মত অভিনয় করেছেন তেমনি স্টাইলে- ফ্যাশনে আধুনিকতার ছোঁয়া দিয়ে একটা পরিচ্ছন্ন লাইফস্টাইল ব্রিং-আপ করে গেছেন। ঠিক যেন হ্যামিলিওনের বাঁশিবাদকের মতই সবাইকে হিপনোটাইজ করে দিয়ে নিজে অনেক দূরে চলে গেলেন কিন্তু তাকে ভূলতে দেননি!

 


Leave a reply