সিঙ্গেল স্ক্রিন কমছে, বাড়ছে মাল্টিপ্লেক্স: সিনেমা কোথায়?
বছরের পর বছর বিনিয়োগের অভাবে জরাজীর্ণ অবকাঠামো, সেই সঙ্গে ভালো চলচ্চিত্রের অভাব এবং করোনাভাইরাস মহামারির প্রভাবে দেশের সিঙ্গেল স্ক্রিন সিনেমা হলে এখন প্রায় ‘বিলুপ্তির’ কাছাকাছি গিয়ে ঠেকেছে। অন্যদিকে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মাল্টিপ্লেক্সে বিনিয়োগ। এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ডেইলি স্টার। সেখান থেকে কিছু তথ্য নিয়েছে বিএমডিবি।
বিনিয়োগকারীরা বলছেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি রুচি বোধের পরিবর্তনের কারণে দেশের সিনেমার দর্শকের কাছে মাল্টিপ্লেক্সের জনপ্রিয়তা বেড়েছে।
তাদের মতে, দর্শকরা সুন্দর ও আরামদায়ক পরিবেশে সিনেমা দেখতে চায়। তাই মাল্টিপ্লেক্স দিন দিন সিনেমা প্রেমীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
তবে মাল্টিপ্লেক্সে দেশি সিনেমার চাহিদা বরাবরই কম। হলিউড সিনেমার ব্যবসা এখানে বাড়বাড়ন্ত। অনেক দিন ধরে বিনিয়োগকারীরা চাইছেন ভারতীয় ছবি একই দিনে মুক্তির অনুমতি দেওয়া হোক।
রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি শপিং মলে ২০০২ সালে যাত্রা শুরু করে স্টার সিনেপ্লেক্স। দেশের প্রথম এ মাল্টিপ্লেক্সে বিনিয়োগ ছিল ৫ কোটি টাকা, কর্মী ছিল ৪০ জন। ২০২১ সালে এর বিনিয়োগ ১২ গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬০ কোটি টাকা। আর কর্মীর সংখ্যা বেড়ে এখন ৪০০ জনেরও বেশি।
স্টার সিনেপ্লেক্সের চেয়ারম্যান মাহবুব রহমান রুহেল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমাদের সিঙ্গেল স্ক্রিনের মালিকেরা টেকনোলজি চেঞ্জের সঙ্গে এডাপ্ট করতে পারেনি। যার কারণেই তাদের এই দুরাবস্থা। তারা পিছিয়ে পড়েছে।’
বর্তমানে রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি শপিং মল ছাড়াও ঢাকার ধানমন্ডি, মিরপুর ও মহাখালীতে তাদের শাখা আছে। সামনে বগুড়া, রাজশাহী, চট্টগ্রামে চালু হচ্ছে আউটলেট। স্টার সিনেপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ জানায়, দেশব্যাপী তাদের ১০০টি স্ক্রিন চালুর পরিকল্পনা আছে।
রুহেল বলেন, ‘প্রথম দুটো বছর বেশ কষ্ট করেছি। দেউলিয়া হওয়ার মতো অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। তবে আশা হারাইনি। ভেবেছি বাংলাদেশ ভালো ছবি বানাবে। আর আমরা হলিউডের ওপর নির্ভরশীল হব।’
বসুন্ধরা শপিং মলে ৩টি প্রেক্ষাগৃহ দিয়ে যাত্রা শুরু করে স্টার সিনেপ্লেক্স। প্রথম ২ বছর ক্ষতি গুণতে হলেও, হলিউডের গ্ল্যাডিয়েটর ও বাংলাদেশের মোল্লা বাড়ির বউ সিনেমা দুটি দিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় সিনেপ্লেক্স।
তিনি বলেন, ‘আমরা যেটা করেছি ওই সময় লেটেস্ট প্রযুক্তি এনে দেশে ব্যবসা শুরু করেছি। টেকনোলজিক্যাল অ্যাডভানটেজটা পেয়েছি।’
এ দিকে প্রেক্ষাগৃহ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৮ সালে দেশে ১ হাজার ২৩৫টির মতো সিনেমা হল ছিল। দুই যুগের ব্যবধানে হলের সংখ্যা কমতে কমতে বর্তমানে সচল আছে ৬০টির মতো হল।
তবে ঈদের সময় এই সংখ্যা বেড়ে কখনও কখনও ১২০টি হয় বলে সমিতি জানায়। সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি মিয়া আলাউদ্দিন বলেন, ‘আমরা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারিনি। যার কারণে এই খাতে বিনিয়োগ করে লসের মুখ দেখেছি।’
তিনি বলেন, ‘দেশের এখন অনেক জেলা এমনকি বিভাগীয় শহর আছে, যেখানে একটিও সিনেমা হল নেই। গত ১০ বছরে এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ৮০ শতাংশ কর্মী পেশা ছেড়ে দিয়েছেন।’
এদিকে দেশে এখন হলিউডের সিনেমা মুক্তি পেলেও, প্রতি বছরই কমছে মুক্তিপ্রাপ্ত দেশীয় সিনেমার সংখ্যা।
সেন্সর বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত দেশে বিদেশি ছবি সেন্সর ছাড়পত্র পেয়েছে ৩২৮টি। একই সময়ে দেশি সিনেমা ছাড়পত্র পেয়েছে যথাক্রমে ৩২১টি।
তবে মাল্টিপ্লেক্সে হরেদরে বাংলা ছবি প্রদর্শনের সুযোগ নেই। কারণ সারা বছরের যে সব ছবি মুক্তি পায় তার অল্প কটিই সেখানকার দর্শকদের উপযোগী। এ কারণে হলিউডের সুপারহিরো বা মারাদাঙ্গা ছবিই মাল্টিপ্লেক্সের ভরসা।
সিনেপ্লেক্সের চেয়ারম্যান রুহেল ভারতীয় ছবির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়ার কথা বলেন। শুধু হিন্দি নয়, তামিল-তেলুগু ছবির কথাও বলেন তিনি।
২০১৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর যমুনা ফিউচার পার্কে যাত্রা শুরু করে যমুনা গ্রুপের ব্যয়বহুল ‘ব্লকবাস্টার সিনেমাস’। ব্লকবাস্টারের হেড অব অপারেশন জাহিদ হোসেন চৌধুরী ডেইলি স্টারকে জানান, তাদের আধুনিক প্রযুক্তির ৭টি সিনেমা হল আছে। এগুলোর মোট আসন সংখ্যা ১ হাজার ৮৮০টি। তাদের মোট কর্মীর সংখ্যা ৭৫ জন। এই খাতে তাদের ভবিষ্যতে বিনিয়োগের পরিকল্পনা আছে।
ঢাকার পর চট্টগ্রামে ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে যাত্রা শুরু করে সিলভার স্ক্রিন। চট্টগ্রামের প্রথম সিনেপ্লেক্স এটি। সিলভার স্ক্রিনের অন্যতম অংশীদার ফারুক আহমেদ বলেন, ‘আমাদের পরিকল্পনা আছে আরেকটি সিনেপ্লেক্স করার। কিন্তু কভিডের কারণে তা থেমে আছে।’
এ ছাড়া বগুড়ার মধুবন, খুলনার লিবার্টিসহ বেশ কিছু পুরোনো হল সংস্কার করে আধুনিক রূপ দেওয়া হয়েছে। এ সব একটি পর্দাতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। তবে মাল্টিপ্লেক্সে রূপান্তরের মতো স্থানীয় ছবির জোগান নেই বললেই চলে। আবার প্রান্তিক জেলাগুলোকে হলিউড সিনেমার দর্শক নেই।
সরকার সিনেমা হল নির্মাণ ও সংস্কারের জন্য তহবিল ঘোষণা করলেও এ নিয়ে সাড়া মেলেছে খুবই অল্প। এ জন্য দেশীয় সিনেমার নির্মাণ কমে যাওয়া ও সাম্প্রতিক সিনেমাগুলো দর্শক গ্রহণ না করার কথা বলছেন অনেকে।