সিনেমার নেপথ্য গল্প: চাষী নজরুল ইসলামের ‘সংগ্রাম’
চাষী নজরুল ইসলাম, যার পরিচালনায় নির্মিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি ‘ওরা ১১ জন’। ১৯৭২ সালের ১১ আগস্ট মুক্তি পাওয়া এ ছবিটি অসাধারণ সাফল্য পায়। এ সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে পরের ছবির জন্য প্রস্তুতি নেন এ নির্মাতা। সেই গল্প বাংলাদেশ প্রতিবেদনে লিখেছেন সিনে সাংবাদিক আলাউদ্দীন মাজিদ।
প্রতিবেদনে অনুসারে, প্রথম ছবিতে চাষী নজরুল দেখিয়েছিলেন সাধারণ জনযোদ্ধাদের মুক্তিযুদ্ধ। এবার চিন্তা করলেন মুক্তিযুদ্ধে সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনী মানে আনসার, বিডিআর (পাকিস্তান আমলের ইপিআর, বর্তমানে বিজিবি), পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের অংশগ্রহণ নিয়ে ছবি বানাবেন। ছবির নামও ঠিক করে ফেললেন-‘সংগ্রাম’।
বীর উত্তম খালেদ মোশাররফকে বলা হয় মুক্তিযুদ্ধে একজন সাহসী ও কুশলী সেনা কর্মকর্তা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ২ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন তিনি। তার হেডকোয়ার্টার মেলাঘর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কিংবদন্তি হয়ে আছে। আর কিংবদন্তি গেরিলা বাহিনী ‘ক্র্যাক প্লাটুন’-এরও নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। তাই মুক্তিযুদ্ধে খালেদ মোশাররফের বীরত্বগাথা বা তার কাহিনিতে সিনেমাটিক ব্যাপার-স্যাপারের কমতি নেই। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় খালেদ মোশাররফ নিয়মিত ডায়েরি লিখেছেন। তাতে সবকিছু সবিস্তারে লেখা- কোথায়, কখন, কীভাবে যুদ্ধ করেছেন, একেবারে তারিখ-সময়-স্থান সমেত লিপিবদ্ধ করা। সেই ডায়েরি থেকেই ছবির কাহিনি রচনা করেন চাষী নজরুল।
ছবিতে যুদ্ধের যত ঘটনা দেখানো হয়েছে প্রায় প্রতিটিই সেখান থেকে নেওয়া। সঙ্গে কেবল কিছু আখ্যান জুড়ে দেওয়া হয়েছে। যেমন ছবির শেষে নায়ক ফিরে এসে দেখে তার স্ত্রী মারা গেছে। এটা কল্পিত।
আলাউদ্দীন মাজিদ লেখেন, একদম শেষ দৃশ্যের শুটিংয়ের গল্পটা চমকপ্রদ। চাষী নজরুলের পরিকল্পনা অনুযায়ী, তাতে স্বাধীন দেশের সামরিক বাহিনী কুচকাওয়াজ করে সশস্ত্র সালাম জানাবে মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সেটা দিয়ে শেষ হবে ছবি। মিনিটখানেকের ব্যাপার। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে রাজি করাবে কে। সেই দায়িত্ব নিলেন ছবির নায়ক খসরু।
খসরু আগে ছিলেন তুখোড় ছাত্রনেতা। মুক্তিযুদ্ধ করেছেন বীর বিক্রমে। বঙ্গবন্ধু তাকে ভীষণ স্নেহ করতেন। সেই সুযোগই নেন খসরু। একরকম জোর করেই রাজি করান নেতাকে। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পিলখানায় শুটিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। সেদিন বাংলাদেশ রাইফেলসের একটি অনুষ্ঠান ছিল। প্রধান অতিথি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ঠিক হয়, তার আগেই করা হবে শুটিং।
সে অনুযায়ী নেওয়া হয় সব প্রস্তুতি। মাঠে প্রস্তুত সুসজ্জিত সেনাদল। একদম সামনের সারিতে খসরু। আর মঞ্চে সবার সামনে বঙ্গবন্ধু। পেছনে সারি বেঁধে সেনাবাহিনীর সব শীর্ষ কর্মকর্তা- কে এম সফিউল্লাহ, খালেদ মোশাররফ, জিয়াউর রহমান প্রমুখ। মূল অনুষ্ঠান শুরুর আগে কয়েক দফা কুচকাওয়াজ চলে। সুসজ্জিত সেনাদলের সঙ্গে পা মেলান খসরুও। পরিচালকের কথামতো স্যালুট নেওয়ার ভঙ্গিতে দাঁড়ান বঙ্গবন্ধু। বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে নেওয়া হচ্ছে শট। একসময় অধৈর্য হয়ে পরিচালককে স্নেহের ধমক দেন বঙ্গবন্ধু, ‘এই, কতক্ষণ হাত তুইলা রাখব রে।’ চাষী নজরুল কাঁচুমাচু মুখে বললেন, ‘আর অল্প কিছুক্ষণ।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আরে কী করস না করস তোরা।’ কিন্তু ঠিকই শুটিং শেষ করেন প্রায় মিনিট দশেক স্যালুট নেওয়ার ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে থেকে।
‘সংগ্রাম’ মুক্তি পায় ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি। কোনো চলচ্চিত্রের জন্য বঙ্গবন্ধুর অভিনয়ের ঘটনা সম্ভবত এই একটিই।