Select Page

সিনেমা ব্যবসা ও অনলাইন কেন্দ্রিক ‘রুচিশীল দর্শক’-এর মধ্যে সম্পর্ক

সিনেমা ব্যবসা ও অনলাইন কেন্দ্রিক ‘রুচিশীল দর্শক’-এর মধ্যে সম্পর্ক

অনলাইনে সিনেমা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা হয়। এর মধ্যে বড় একটি অংশ জানায়, রুচিশীল সিনেমা তৈরি হয় না। তাই তারা হলে যান না। কিন্তু সিলেটের নন্দিতা সিনেমা হল কর্তৃপক্ষ বলছে ভিন্ন কথা। নিয়মিত দর্শকই সিনেমা হলে যায়, অনলাইন কেন্দ্রিক ‘রুচিশীল’ দর্শক হলে যায় না। তারা ব্যস্ত থাকে খুঁত ধরায়। নইলে অনেক ভালো সিনেমা ‘ফ্লপ’ হতো না।

আসুন পড়ে নিই সিনেমা হলটির ফেসবুক পাতায় দেওয়া দীর্ঘ পোস্ট—

যারা ‘দুলাভাই জিন্দাবাদ’ সিনেমার ট্রেইলার দেখে অলরেডি ফ্লপ/বস্তাপচা ট্যাগ লাগিয়ে দিয়েছেন তাদের উদ্দেশ্য কিছু কথা।

গত কোরবানীর ঈদে ‘অহংকার’ সিনেমার ট্রেইলার দেখেও এমন অনেকে বস্তাপচা/ফ্লপ ট্যাগ লাগিয়ে দিয়েছিলেন। আমরা ঈদে ‘অহংকার’ চালাবো দেখে অনেকে পেজের কমেন্টে আমাদের গালাগালি পর্যন্ত করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল হাইপ জাগানো অন্য সিনেমাটি হাইপের জোরে কয়েকদিন ভালো চললেও কিছুদিন পর এটার সেল ড্রপ শুরু হয় এবং ২য় সপ্তাহ থেকেই ‘অহংকার’ এর হল বাড়া শুরু হয়। হ্যা, অহংকার এর মেকিং দুর্বল ছিল কিন্তু গল্প ভালো হওয়াতে (যদিও গতানুগতিক গল্প ছিল) দর্শক এটি গ্রহন করেছে এবং এটি ভালো ব্যবসা করেছে। নন্দিতায় চলেছে টানা ৩ সপ্তাহ। সিনেমাটি ৫ম সপ্তাহে এসেও এই সপ্তাহে চলছে দেশের ৭০টি হলে।

সুতরাং আগেভাগে কোন সিনেমাটি কেমন হবে এবং কেমন ব্যবসা করবে সেটা বলা খুব কঠিন। দর্শক কোন সিনেমাটি গ্রহন করবে সেটা রিলিজের আগে কেউ বলতে পারবে না, কাজেই ট্রেইলার দেখে আগেভাগে উপসংহার টানা বাদ দিন। সিনেমাটা আগে রিলিজ হতে দেন। ট্রেইলার দেখে সিনেমা বিচার না করে সিনেমা দেখেই সিনেমা বিচার করেন। এমন অনেক সিনেমা আছে যেগুলো ট্রেইলারে চমক দেখিয়েছে কিন্তু সিনেমা ভালো হয় নি। আবার অনেক সিনেমা আছে যেগুলোর ট্রেইলার আহামরি মনে না হলেও সিনেমা ভালো ব্যবসা করেছে।

আরেকটা কথা, ‘অহংকার’ বা ‘দুলাভাই জিন্দাবাদ’ সিনেমাগুলো তাদের উদ্দেশ্যই বানানো হয় যারা হলের রেগুলার দর্শক। যারা প্রতি শুক্রবার এলেই প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা দেখতে আসেন। যেসব দর্শক বছরে বা দুই বছরে একবার সিনেমা হলে আসেন তাদের জন্য এই সিনেমা নয়। যারা হলের রেগুলার দর্শক তাদের পছন্দকেই হল মালিকেরা প্রাধান্য দিয়ে থাকেন এবং সেটাই স্বাভাবিক।

যারা ফেসবুকে সমালোচনা করছেন তাদের ১০% ও যদি তাদের পছন্দের ভালো সিনেমাগুলো সিনেমা হলে এসে রেগুলার দেখতেন তবে ইন্ডাস্ট্রির চেহারাই বদলে যেতো। এই বছরেই অনেকগুলো ভালো সিনেমা (তাদের পছন্দের) রিলিজ পেয়েছে, কিন্তু সেগুলোতে তেমন দর্শক হয় নি। নাম বলছি না, সিনেমাগুলোর প্রযোজক হয়তো আপত্তি করবেন। তবে যারা ইন্ডাস্ট্রির খোজখবর রাখেন তারা জানেন কোন কোন ভালো সিনেমা ফ্লপ হয়েছে।

এই ফেসবুক সমালোচকদের সন্তুষ্ট করা খুব কঠিন কাজ। তারা কমার্শিয়াল সিনেমার সমালোচনা তো করবেই, সাথে খুজে খুজে তাদের পছন্দের সিনেমারও খুঁত বের করবে। অলরেডি বলা শুরু হয়েছে ‘ডুব’ এর কালার গ্রেডিং ভালো হয় নি, ‘ডুব’ এ তিষার ডায়লগ ক্ষেতমার্কা, ‘ঢাকা অ্যাটাক’ এর ভিএফএক্স এর কাজ ভালো হয় নি ইত্যাদি ইত্যাদি। সিনেমাগুলো রিলিজের পর দেখা যাবে ফেসবুক ভরে গেছে খালি খুঁত আর খুঁত ধরতে ধরতে। তাদের পছন্দের সিনেমাটি আনলেও যে তারা দেখতে আসবে সেই নিশ্চয়তা নাই। এই শ্রেনীর দর্শকদের উপর হলমালিকদের ভরসা তাই খুব কম।

কোয়ালিটি বিবেচনায় নিলে গত দুই ঈদ মিলে সবচেয়ে ভালো সিনেমা ছিল ‘রাজনীতি’। কিন্তু এটি মোটামোটি চলেছে, সিনেমাটি কোয়ালিটি বিবেচনায় যতটা ভালো ব্যবসা করার কথা সেভাবে ব্যবসা করতে পারে নি। এই ঈদের ‘সোনাবন্ধু’ সিনেমাটার গল্প ভালো ছিল। কিন্তু সেল খুব খারাপ গেছে। দর্শকের অভাবে নন্দিতায় টানা ৫ দিন নাইট শো বন্ধ ছিল। আপনি মানেন আর নাই মানেন এটাই সত্য যে আমাদের দেশে ভালো সিনেমার দর্শক নাই।
কলকাতার ‘বেলাশেষে’ ও ‘পোস্ত’ সিনেমা দুটি সেখানে শতাধিক হল পেয়েছিল। টানা চলেছিল ১০০ দিনের উপর। বাংলাদেশে এই সিনেমা দুটি হল পেয়েছিল ২০টার মতো, কোনরকমে চলেছিল ১ সপ্তাহ। কমলেশ্বরের ‘চাঁদের পাহাড়’ যদি কলকাতায় রিলিজ না হয়ে বাংলাদেশে রিলিজ পেতো তবে ২০ কোটি বাদ দেন, ২কোটি উঠতো কিনা সন্দেহ।

এগুলোর কথা বাদ দিন। ইউটিউবে রিলিজের পর সাড়া জাগানো সিনেমা ‘অজ্ঞাতনামা’ বলাকা সিনেমা হলে এমন খারাপ সেল গিয়েছিল যে মাত্র ৫ জন দর্শক নিয়েও শো চালাতে হয়েছিল। এরকম উদাহরণ চাইলে অনেক দেয়া যাবে।

আরেকটা কথা, প্লিজ সিনেমা দেখতে না আসার কারণ হিসেবে হলের পরিবেশের কথা বলবেন না। বলাকা, শ্যামলি, মধুমিতার পরিবেশ নিশ্চয়ই ভালো। তবুও যখন বলাকায় ৫ জন দর্শক নিয়ে শো চালাতে হয় তখন বুঝতে হবে সমস্যা পরিবেশে নয়, সমস্যা অন্য জায়গায়।

ফেসবুকের বেশীরভাগ দর্শক মূলত সিনেমার ইউটিউবের দর্শক। এরা অপেক্ষায় থাকে সিনেমাটা কখন ইউটিউবে আসবে আর ফ্রিতে নামিয়ে দেখবে। পাইরেসি হলে তো কথাই নেই। ‘আয়নাবাজি’ পাইরেসির আগের দিনেও যা সেল হয়েছিল পাইরেসি হওয়ার পর নন্দিতায় পরের সারা সপ্তাহে সেই সেলের অর্ধেকও হয় নি। আমাদের দেশে এখনো সেই শ্রেনীর দর্শক তৈরী হয় নি যে ঘরে পাইরেটেড প্রিন্ট রেখে হলে সিনেমা দেখতে আসবে। যেটা ভারতে অহরহ হয়। তাদের সিনেমা রিলিজের পরের দিনই হলপ্রিন্ট বের হয়ে যায়। কিন্তু তাতে সিনেমা হলে দর্শকের অভাব হয় না।

আপনি পরিবর্তন চান, খুব ভালো কথা। সেজন্য ফেসবুকে কিবোর্ডে ঝড় না তুলে সিনেমা হলে আসতে হবে। আপনি যখন আপনার পছন্দের ভালো সিনেমাগুলো হলে এসে রেগুলার দেখবেন তখন এমনিতেই সবকিছু পরিবর্তন হবে। আগামি মাসেই বিভিন্ন টাইপের অনেকগুলো সিনেমা রিলিজ পাচ্ছে। তখনই দেখা যাবে আপনি শুধু ফেসবুকে সমালোচনাই করেন নাকি সিনেমা হলে এসে আপনার পছন্দের ভালো সিনেমাগুলোও দেখেন।

সোজাসাপ্টা কথার জন্য দুঃখিত। সত্য অনেক সময় তিতা হয়। তবু সত্য সত্যই।

পুনশ্চ- ‘দুলাভাই জিন্দাবাদ’ এর ট্রেইলার ২ দিনে ৩ লক্ষ ৩০ হাজারেরও বেশীবার ইউটিউবে দেখা হয়েছে। সমালোচকদের ধন্যবাদ।


মন্তব্য করুন