Select Page

সিনেমা হলের স্মৃতি: শাবনূর

সিনেমা হলের স্মৃতি: শাবনূর

এক.

‘নারীর মন’ ছবির সময়কার স্মৃতি। ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো দেখতে গিয়ে দেখি মিছিল আসতেছে।

– নাইকা (নায়িকা অর্থে) আছে রে?

– আছে আছে

– কে? কে?

শাবনূর শাবনূর

ব্ল্যাকে ডিসির টিকিট কেটে দে দৌড়। গিয়ে দেখি ততক্ষণে জাতীয় সঙ্গীত শেষ ছবি শুরু হয়ে গেছে। শাবনূরের এন্ট্রি সিন ছিল মারাত্মক লেভেলের। নাপিত শাবনূরের দিকে তাকাতে গিয়ে চুল কাটতে গিয়ে পুরো মাথাই কামিয়ে ফেলেছে একলোকের আর লোকটি বলছে আমার চুল ফিরায়ে দে।

নায়িকার এন্ট্রি সাধারণত পা থেকে শুরু হয়। হাইহিল পরাই বেশি থাকে। ফুলের পাপড়ি পড়ে আছে রাস্তায় আর শাবনূর সেগুলো না মাড়িয়েই চলে গেল। ব্যাকগ্রাউন্ডে শাবনূরেরই ভয়েস-‘চুমিয়ে দিতে ব্যর্থ হলো ফুল অশ্রু ঝরালো।’ পা দেখানোর সাথে সাথেই মুহুর্মুহু সিটি বাজানো শুরু আর চিৎকারে কান কানের জায়গায় আছে বলে মনে হচ্ছিল না। থাম থাম চিৎকার করে বললেও শোনে না। ওদিকে শাবনূরের এন্ট্রির পরেই গান শুরু হয়ে গেছে ‘জীবনে বসন্ত এসেছে।’ মাইকিং-এর বদৌলতে গান মুখস্থই হয়ে গিয়েছিল, অনেকেই গাচ্ছিল সাথে আমিও। সে কি দৃশ্য! ছবির শেষে শাবনূর, রিয়াজ, শাকিলের ত্রিভুজ প্রেমের দ্বন্দ্বে ছবি যখন জমজমাট তখনও করতালিতে আর সিটিতে কান পাতা দায়।

দুই.

‘কাজের মেয়ে’ ছবির দিন। রিয়াজ-শাবনূরের জুটি তখন জমজমাট। এটাও ব্ল্যাকে টিকিট কেটে ডিসিতে দেখা। কয়েকজন বন্ধু মিলে।

রিয়াজকে পটানোর চেষ্টায় ব্যস্ত শাবনূর কিন্তু রিয়াজ পাত্তা দেয় না, বোঝে না। ডিসি থেকেই একজন বলে উঠল-‘বলদা নায়ক’ আবার আরেকজন বলে উঠল-‘ঐ হুঁশ করে কথা কইস।’ ভয় হচ্ছিল মারামারি লাগে কিনা। ভাগ্যিস হয়নি। তারপর শাবনূর কাজের মেয়ের অভিনয় করার প্ল্যান করল। কাজের মেয়েদের প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য আবার একটা সংস্থাতেও চলে গেল। সেখানে আবার গুণ্ডাদের উৎপাত। ঝামেলা করছিলো তারা। শাবনূর আর নাসরিনের কথা শুনে মনে হচ্ছিল উচিত শিক্ষা দিতে তারাই যথেষ্ট। দর্শকও ততক্ষণে বুঝে ফেলেছে। রিয়াল থেকে একজনের কণ্ঠ আসল-‘লাগা মাইর জানেমান।’ শাবনূর মারপিট শুরু করে দিলো। মারপিটের আওয়াজের থেকে তালির আওয়াজই বেশি। ‘পিট পিটা’ এটাই শোনা যাচ্ছিল বেশি।

শাবনূর চলে গেল রিয়াজের বাড়ি কাজের মেয়ের অভিনয় করতে। রিয়াজের মা শর্মিলী আহমেদের হাতে পায়ে ধরে রাজি করালো। রিয়াজও চলে এলো তারপর তো তার চোখ ছানাবড়া। রিয়াজের ঘরে চলে গেল শাবনূর। রিয়াজ ভয় পেয়ে গেলে শাবনূর ঢং করে বলতে থাকে-‘খালাম্মা, আপনার ছেলে কেমন কেমন জানি করতাছে।’ এ সংলাপের সাথে সাথেই হাসির বন্যা আবার কে জানি বলে-‘বলদা নায়ক নাইকার মনের কথা বোঝে না আমি হইলে বুঝতাম।’ হাসতে হাসতে শেষ। শাবনূর হুমকিও দিলো রিয়াজকে পরিচয় প্রকাশ করলে এমন কলঙ্ক দেবে যে কারো কাছে মুখ দেখাতে পারবে না। শাবনূর চলে গেলে রিয়াজ বলে-‘কী সাংঘাতিক মেয়ে!’

তিন.

‘বস্তির মেয়ে’ ছবির দিন। ডাবল রোলের শাবনূরকে দেখে দর্শক বেশি খুশি। বলে উঠল-‘আজকে দুইটা শাবনূর রে, আজকে আমার শক্তি বেশি।’ বোঝাই গেল শাবনূরের ভক্ত। সহজ-সরল শাবনূর আর চালাক শাবনূর। সরল শাবনূরকে অত্যাচার করে এটিএম শামসুজ্জামান ও রীনা খান। অদলবদল হয়ে একজনের জায়গায় অন্যজন চলে আসে। এটিএম আগের জন ভেবে বাড়ির চাকর ফখরুল হাসান বৈরাগীর দোষ মনে করে, তার জন্যই শাবনূর সাহস পেয়েছে এবং চাবুক মারে। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে শাবনূর চুঁড়ি ফেলে দেয় এটিএমের দিকে। ফোকাস করতেই তালির পর তালি। আওয়াজ আসে দর্শকের-‘এইবার কই যাবি?’ সরল শাবনূর ভেবে এটিএম চাবুকপেটা করতে চায় তখন চাবুক কেড়ে নিয়ে শাবনূর বলে-‘এতদিন চাবুক চালিয়েছিস আজকে নিজে খা দেখ কেমন লাগে।’ চাবুক চলতে থাকে এদিকে তালিও চলতে থাকে। চুঁড়িটা পরতে বলে এটিএম, একজন জোরে বলে ওঠে-‘মইরা যা মইরা যা চুঁড়ি পরস না।’ চুঁড়ি পরিয়েই ছাড়ে এটিএমকে তারপর হাতেপায়ে ধরে রক্ষা পায়। রীনা খানকে মেকাপ করিয়ে দেয়ার সিনটাতে ভাইরে ভাই কোনো ডায়লগই শোনা যায় না এত তালি আর তালি। বলে-‘ভূত বানাইছে ভূত আজকে আর রক্ষা নাই।’ তারপর আফজাল শরীফের আগমন যে সরল শাবনূরকে অত্যাচার করেছিল। বডি মাসাজ করে দিতে বলে। দর্শক বলে ওঠে-‘তোরে আজকে বালিশ বানাইব নাইকা খাড়া।’ কী মাইরটাই না দিলো শাবনূর আফজাল শরীফকে। শার্ট ছিঁড়ে একাকার। একজন বলে-‘অরে আমার কাছে পাঠা আরো মারমু, আমার নাইকারে ডিস্টাব করে!’

চার.

‘বউ শাশুড়ির যুদ্ধ’ ছবির দিন। রীনা খানের সাথে শাবনূরের যুদ্ধ। সংসারে দুজনের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। রীনা খানকে দেখামাত্রই একজন বলে-‘বহুত জ্বালাইছোস নাইকাগুলারে আজকে কই যাবি, তোর জন্য শাবনূর একাই একশো তোরে আইজকা পাইছি।’ তুই তোকারি ভাষা তখন দর্শকের মধ্যে কমন ছিল এটা কিন্তু অসম্মানজনক না এটা ছবির সাথে দর্শকের মিশে যাওয়ার জন্য ঘটত। রীনা খান পুত্রবধূ শাবনূরকে ফাঁসাতে নিজে ধাক্কা খেয়ে বলে শাবনূর দিয়েছে। শাবনূর পরে নিজে মাথা ফাটিয়ে বলে-‘আপনি চলেন ডালে ডালে আর আমি চলি পাতায় পাতায়।’ তখন একজন বলে-‘দেখছোস আমার নাইকা চলে পাতায় পাতায়, পারবি আমার নাইকার সাথে?’ দুধের মধ্যে বিষ মিশিয়ে নিজেই খেয়ে ফেলে রীনা খান তখনও একজন বলে-‘তুই আইজক্যা শ্যাষ।’ গালিগালাজও চলে সেগুলো না বলি। জমজমাট একটা ছবি ছিল।

অনেক স্মৃতি আছে সিনেমাহলের তার মধ্যে কিছু বললাম। তখনকার দিনে সিনেমাহলে ছবি দেখাটা ছিল উৎসবের মতো। অনেক দর্শকই অনেকের ফ্যান ছিল কিন্তু ছবি দেখার সময় সবাই এক হয়ে যেত, সবাই সবার ছবি দেখত। সেইসব দিন আর ফিরবে না।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র গত শতকে যেভাবে সমৃদ্ধ ছিল সেই সমৃদ্ধির দিকে আবারও যেতে প্রতিদিনই স্বপ্ন দেখি। সেকালের সিনেমা থেকে গ্রহণ বর্জন করে আগামী দিনের চলচ্চিত্রের প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠুক। আমি প্রথমত একজন চলচ্চিত্র দর্শক তারপর সমালোচক হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন দেখি। দেশের সিনেমার সোনালি দিনের উৎকর্ষ জানাতে গবেষণামূলক কাজ করে আগামী প্রজন্মকে দেশের সিনেমাপ্রেমী করার সাধনা করে যেতে চাই।

মন্তব্য করুন