সুইটহার্ট : (সমদ্বিবাহু) ত্রিভুজ প্রেমের ছবি
বাংলাদেশী সিনেমাগুলো হয় ঝালমুড়ির মত- ড্রামা, রোম্যান্স, অ্যাকশন, সোশ্যাল মেসেজ, কমেডি-ট্র্যাজেডি সব মিলিয়ে পাঁচ মিশালী ফ্লেভারে ভরপুর। ক্ষেত্র বিশেষে এত বিপরীতধর্মী সাবজেক্টের সম্মিলন মেনে নিলেও, সব সময় তা দেখতে ভালো লাগে না। শুরুতে এতখানি কথা বলে নিলাম কারণ, রোম্যান্টিক মুভি সুইটহার্ট আগাগোড়া রোম্যান্টিকই থেকেছে। অযথা অ্যাকশন দেখিয়ে কখনো তার জনরার সাথে বেঈমানি করেনি।
জিসান (বাপ্পী) ভার্সিটির সবচে ভালো ছাত্র, ভালো খেলোয়াড়। মেয়েরা তার জন্য পাগল, কিন্তু জিসান কখনো এসবে নিজেকে জড়ায় না। সেই জিসান প্রীলিনাকে (মিম) প্রথম দেখেই প্রেমে পড়ে গেল। এক ক্রীসমাসে দেখা হলো দুজনার, তারপর প্রেম। দুজনের পরিবারও রাজি, বাধ সাধলো রিচার্ড (রিয়াজ), যে কিনা সাত বছর ধরে প্রীলিনাকে পাগলের মতো ভালোবাসে।
সুইটহার্ট ছবির পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার ওয়াজেদ আলী সুমন। দুঃখজনকভাবে চলচ্চিত্র আজ এত বছর পরেও নায়কনির্ভর। কিন্তু সুইটহার্টে নায়কের সাথে নায়িকার প্রেম নয়, বরং নায়ক ও নায়িকার প্রেম দেখানো হয়েছে। বাপ্পী আর মিম ইক্যুয়াল ইম্পর্টেন্স আর স্ক্রীনটাইম পেয়েছেন। ছবির কাহিনীকার এস রেজা। ট্রেইলার দেখে গল্পটা খুব চেনা চেনা লাগলেও, ইন্টারভ্যালের পরে একটা টুইস্ট আছে। অনেকেই বললেন রকস্টারে সাথে কিছুটা মিলে যায়। কিন্তু আমার কাছে এমন মিল খুব একটা দূষণীয় মনে হয়নি। আরেকটা ব্যাপার ভালো লেগেছে। জিসান আর প্রীলিনা দুই ধর্মের হলেও, ছবিতে এটাকে মূল ইস্যু হিসেবে দেখানো হয়নি। বরং চারিত্রিক দ্বন্দ্ব আর সীমাবদ্ধতাই গল্পের গতিপথ নির্ধারণ করেছে।
পুরো ছবিতে একটাও “ওয়া-ঢিশুমাই” মার্কা দৃশ্য নেই। কোন ফাইটিং সিকোয়েন্স ছাড়াই একটা মুভি শেষ হয়ে গেল, অথচ দর্শক ঠাওরও করতে পারলো না। এক্ষেত্রে আমি স্ক্রীপ্টের প্রশংসা করবো, যেটা কিনা দর্শককে এতখানি এনগেজ করে রেখেছিল। ছবির প্রথম ভাগ ঘটনা বহুল এবং গতিশীল। তবে ছবির দ্বিতীয়ভাগ আমার কাছে কিছুটা শ্লথ লেগেছে। বিশেষ করি, ক্লাইম্যাক্সে খোলা আকাশের নীচের সিকোয়েন্সটা আরেকটু ছোট হলে আরো কার্যকরী হতো। বাপ্পী-মিমের প্রথম দেখা হয় ক্রীসমাস পার্টিতে, পরেরদিনই মিম তার ফোন নাম্বার দেয়। কিন্তু বাপ্পী মিমকে ফোন দেয় ২২ জুন। কারণ ২৩ তারিখে তার মার জন্মদিন, শাড়ি কিনতে হবে। নাম্বার দেবার ছয়মাস পর কথা হলো, অথচ তাদের অতি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলা দেখে অবাক হলাম। সিনেমায় প্রচুর ডায়ালগ সম্পূর্ণ ইংরেজিতে ছিল। সংলাপ ভালো আর স্মার্ট হয়েছে। সংলাপ লিখেছেন রফিকুজ্জামান আর আব্দুল্লাহ জহির বাবু (ডায়ালগগুলা অরিজিনাল ছিল)।
অভিনয়ের প্রসঙ্গে আসি। প্রথমেই বলে রাখি বাপ্পী চৌধুরী আমার পছন্দের অভিনেতা নন। কিন্তু এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, শাকিব খানের পরে বাপ্পীই সবচে ব্যাঙ্কেবল স্টার। মাস পিপল তাকে পছন্দ করে আর হল মালিকরাও বাপ্পীর নাম দেখে ছবি বুকিং দেয়। সুতরাং এই ছবিতে বাপ্পীকে নেয়ার কারণটা সহজেই অনুমেয়। বাপ্পীও চেষ্টা করেছেন তার সেরাটা দেবার। বাপ্পীর ডাবিং সম্ভবত কোন একজন রেডিও জকি করেছেন। যেটা কিনা খুবই ভালো একটা ডিসিশন। পরিচালক রূপান্তর ছবিতে ফেরদৌসের আর হৃদয় ভাঙা ঢেউ-তে অনন্ত জলিলের নিজের ভয়েস ব্যবহার করেননি। উপযোগী উন্নতি করার আগ পর্যন্ত বাপ্পী আর সাইমনের ডাবিং অন্য কেউ করলেই মনে হয় ভালো। তবে খেয়াল রাখতে হবে, যিনি ভয়েস দিচ্ছেন, তিনি যেন অতি অভিনয় না করেন। কিছু সংলাপে ওভার অ্যাক্টিং বেশ শ্রুতিকটু ছিল। পিঁপড়াবিদ্যায় শিনা চৌহানের ডাবিং করে দিয়েছিলেন অপি করিম। আমার কাছে তার কাজ দারুণ লেগেছিল।
বিদ্যা সিনহা মিম ওয়াজ ফ্যাবুলাস! অভিনয়ের কথা আর কি বলবো, তাকে দেখেই মাথা নষ্ট হবার যোগাড়। মিমের গেট-আপ যেমন স্মার্ট ছিল, তাকে তেমন গর্জাসলি প্রেজেন্টও করা হয়েছে। মিমের অভিনয়, এক্সপ্রেশন্স আগের চেয়ে বেটার হয়েছে। তবে, স্ক্রীপ্টে মিমের জন্য কাজ দেখানোর প্রচুর স্কোপ ছিল। তার ক্যারেক্টারে ডেপথ আর ভ্যারিয়েশনও ছিল। যেটা কাজে লাগাতে পারলে সহজেই জাতীয় পুরষ্কার পেয়ে যেতে পারতেন।
ছোট্ট একটা চরিত্রেও খুরশীদুজ্জামান উৎপল ভালো অভিনয় করেছেন। এই ছবির আরেকটা ভালো ডিসিশান আমি বলবো মারিয়া রোজারিও চরিত্রে শম্পা রেজাকে কাস্ট করা। তার বেশিরভাগ সংলাপই ছিল ইংরেজিতে। তিনি বাদে সম্ভবত খুব কম বাংলাদেশী অভিনেত্রীই আছেন, যিনি সংলাপগুলো এত নিখুঁত আর বিশ্বাসযোগ্যভাবে ডেলেভারি দিতে পারতেন।
আর ছিলেন রিয়াজ। ছবিটাকে আমি বলছি সমদ্বিবাহু ত্রিভুজ প্রেমের গল্প। কেননা বাপ্পী আর মিম ছবিতে সমান গুরুত্ব পেয়েছেন। ছবিতে রিয়াজের উপস্থিতি ছিল অতিরিক্তের মতো। রিয়াজের ক্যারেক্টার, অভিনয় আর স্বাস্থ্য সবই ছিল মেদবহুল। তার মতো এত সিনিয়র অ্যাক্টরের কাছ থেকে এতটা “নাটুকে” অভিনয় আশা করিনি।
সুইটহার্ট ছবিতে পাঁচটি গান আছে (থ্যাঙ্কফুলি কোন আইটেম সং নেই)। অনেকদিন পর কোন এক ছবিতে সবকয়টা OST ভালো পাওয়া গেল। দেখলাম হৃদয় খানের “এক ঝলকে” গানটা ইতোমধ্যে দর্শকদের ঠোঁটস্থ। ইমন সাহার ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর দারুণ ছিল। কোরিওগ্রাফিও ভালো লেগেছে। কালার গ্রেডিং দারুণ। শুধু “ভালো করে ভালোবাসা হলো না” গানে অতিরিক্ত কালার কারেকশন করা হয়েছে। সিনেমার শেষ দৃশ্যটা আমার কাছে অসাধারণ লেগেছে। ফুলের পাপড়ি ঢালার সময় পয়েন্ট অফ ভিউ শট আর ব্যাকগ্রাউন্ডে ইমন সাহার আবেগী স্কোর; সব মিলিয়ে দারুণ টাচি একটা সিন, ভেরি ওয়েল ক্র্যাফটেড।।
আমি বলছি না ছবিটা দেখলে মনে হবে না, রাতারাতি বাংলা ছবি ইন্টারন্যাশনাল লেভেলে চলে গিয়েছে। কিন্তু ডিফরেন্ট কিছু করার চেষ্টাটা চোখে পড়বে, ভালো লাগবে। সুইটহার্ট খাঁটি বাংলাদেশী কিন্তু শতভাগ রোম্যান্টিক ছবি।