‘সুতরাং’ তার শুরু, এরপর শীর্ষে যাওয়ার গল্প
এমন মজা হয় না গায়ে সোনার গয়না কিংবা তুমি আসবে বলে ভালোবাসবে বলে, নদী বাঁকা জানি থেকে এই যে আকাশ এই যে বাতাস বা পরানে দোলা দিল এ কোন ভোমরা…
১৯৬৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বিখ্যাত সিনেমা ‘সুতরাং’ সিনেমার গান। সুতরাং সিনেমাটি অনেক প্রথমের সঙ্গে যুক্ত, যারা পরে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিচালক সুভাষ দত্তের প্রথম ছবি এটি, মিষ্টি মেয়ে খ্যাত কবরীর অভিষেক এই সিনেমার মাধ্যমে, আর উপরোক্ত গানগুলোর সুর করে অমর হয়ে থাকা সঙ্গীত পরিচালক হিসেবেও এটি প্রথম ছবি। তিনি বাংলা সঙ্গীত জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র কিংবদন্তি সঙ্গীত পরিচালক ‘সত্য সাহা’।
আর্ন্তজাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত ‘সুতরাং’ ছবির গানগুলোর জনপ্রিয়তার রেশ না কাটতেই স্মরণকালের ব্যবসাসফল ছবি ‘রূপবান’-এর আশাতীত সাফল্য পাওয়া গানগুলোর সঙ্গীতায়োজন করে জানান দিয়েছিলেন তিনি বাংলা ছবির গানে রাজত্ব করতে এসেছেন। একে একে সৃষ্টি করেছেন তুমি কি দেখেছো কভু, নীল আকাশের নীচে, গান হয়ে এলে, ঐ দূর দুরান্তে, তুমি যে আমার কবিতা, আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল-সহ অসংখ্য গান স্বাধীনতার আগেই এই বাংলা গানগুলো দর্শকদের মুখে মুখে ফিরেছিল।
এই পৃথিবীর পরে কত ফুল ফোটে আর ঝরে কিংবা দুঃখ করোনো বন্ধু তোমরার মত আলোর মিছিলের এই কালজয়ী গান ছাড়াও স্বাধীন বাংলাদেশে নানী গো নানী, আমার মন বলে তুমি আসবে, মা গো মা, ও আমার রসিয়া বন্ধুরে, ঢাকা শহর আইসা আমার, একদিন ছুটি হবে, তোমার ই পরশে, চিঠি দিও প্রতিদিন, বন্ধু তোর বারাত নিয়া আমি যাবো, আমি কার জন্যে পথ চেয়ে থাকবো-সহ অসংখ্য গান আজো কালের প্রবাহে সমান জনপ্রিয়।
আমি যে আঁধারের বন্দিনী তে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, চেনা চেনা লাগে তবু অচেনা তে শ্যামল মিত্র। সূর্যকন্যা সিনেমার এই বিখ্যাত দুইটি গানে ভারতের দুই প্রবাদপ্রতিম শিল্পীকে ব্যবহার করেছেন। সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লার অনেক জনপ্রিয় গান ই উনার সুরে, শুধু এই দুইজন নয় আঞ্জুমান আরা বেগম, শাম্মী আখতার, আবিদা সুলতানাদের ক্যারিয়ারের ভিত তিনিই গড়ে দিয়েছিলেন। সুবীর নন্দী, আব্দুল জব্বারদের দিয়েছেন দারুণ গান। ‘সুতরাং’ দিয়ে সুভাষ দত্তের সঙ্গে যে জুটি গড়ে উঠেছিল তা থেকেছিল অনেক বছর পর্যন্ত। দিলীপ বিশ্বাস,আজিজুর রহমানদের ছবি মানেই সত্য সাহার সুর, নিজের স্ত্রী রমলা সাহাকে প্রযোজক বানিয়ে স্বরলিপি বানীচিত্রের ব্যানারে নির্মাণ করেছেন অশিক্ষিত, ছুটির ঘন্টা, রাম রহিম জন, পুরস্কারের মতো বিখ্যাত ছবি।
মাস্টার সুমন নামে যেই শিশু তারকা এখনো আমাদের চোখে সমুজ্জ্বল, সে উনারই ছেলে সুমন সাহা। আরেক পুত্র ইমন সাহা এই সময়ের একজন স্বনামখ্যাত সুরকার।
১৯৭৫ সালে শুরু হয়েছিল জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান, কিন্তু অবাক করার ঘটনা হলো উনার মতো মহান সঙ্গীতজ্ঞকে এই পুরস্কার পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল প্রায় দুই দশক। অথচ এর মাঝে তিনি উপহার দিয়েছিলেন দারুণ সব গান, কিন্তু পান নি। অবশেষে ১৯৯৪ সালে হুমায়ূন আহমেদের ‘আগুনের পরশমণি’র সুবাদে প্রথম জাতীয় পুরস্কার পান। পরে অবশ্য অজান্তে ও চুড়িওয়ালা দিয়ে আরো দুইবার জাতীয় পুরস্কার পান, তবে মৃত্যুর পর। ২০১৩ সালে উনাকে দেয়া হয়েছে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক।
১৯৩৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করা এই কিংবদন্তি সংগীতজ্ঞ পৃথিবীকে বিদায় জানান ১৯৯৯ সালের আজকের এইদিনে (২৭ জানুয়ারি) মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল মাত্র ৬৫ বছর।