Select Page

সুবীর নন্দীর গানে পাগল লাখো লাখো শ্রোতা

সুবীর নন্দীর গানে পাগল লাখো লাখো শ্রোতা

প্লে-ব্যাক বা আধুনিক কোন গান, তা যতই কঠিন সুর সৃষ্টি হোক না কেন— সুবীর নন্দীর গলার কারুকাজে সেখানে তৈরি হয়েছে এক নির্মল কণ্ঠ সুধা, যে সুধায় হারিয়ে যেতো বৃদ্ধ যুবা থেকে লাখো গান পাগল শ্রোতা দর্শক। বলছি কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী সুবীর নন্দীর কথা।

সুবীর নন্দী জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৩ সালের ১৯ নভেম্বর হবিগঞ্জ জেলার তেলিয়াপাড়ায়, তবে বেড়ে ওঠা হবিগঞ্জ সদরে। সেখান থেকেই এসএসসি, পরে হবিগঞ্জ কলেজে পড়াশোনা করেছেন তিনি। তারা ছিলেন নয় ভাই-বোন, পরিবার ছিল সংস্কৃতিমনা। চিকিৎসক পিতা সুধাংশু নন্দী ও মা পুতুল রানীর ইচ্ছায় সুবীর নন্দী ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি ঝুঁকে পড়েন।  স্কুলের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গানে অংশ নিতেন।

সুবীর নন্দী শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নেন প্রথমে ওস্তাদ বাবর আলীর কাছে, পরে লোকসংগীতের ওপর তালিম নেন ওস্তাদ বিদিত দাসের কাছ থেকে। তার সঙ্গে তালিম নিতেন আরেক গুণী সংগীতশিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়।

মাত্র ১৪ বছর বয়সে ১৯৬৭ সঙ্গে সুবীর নন্দী সিলেটের আঞ্চলিক রেডিওতে গান করেন। ১৯৭২ সালে ঢাকায় বাংলাদেশ বেতারে গান করেন, তার প্রথম গানটি ছিল মোহাম্মদ মুজাক্কেরের কথা ও ওস্তাদ মীর কাশেম খানের সুরে ‘যদি কেউ ধূপ জ্বেলে দেয়’ এই শিরোনামের।

সুবীর নন্দীর প্রথম জনপ্রিয় গান আসে এই বেতার থেকেই, সেটা ছিল ১৯৭৬ সালে প্রচারিত শেখ সাদীর সুরে ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়’ ও ‘হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে’। গান দুটি সে সময় এতটাই জনপ্রিয়তা পায় যা পরবর্তীতে বুলবুল আহমেদ প্রযোজিত ও অভিনীত আলমগীর কবিরের ‘মহানায়ক’ ছবিতে ব্যবহার করা হয়। বলতে দ্বিধা নেই গান দুটি চলচ্চিত্রে সংযোজিত হওয়ার পর এর জনপ্রিয়তা আরও বহু বহু গুন বেড়ে রায়। মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের লেখা ও সত্য সাহার সুরে আধুনিক গান ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার’ পরবর্তীতে ‘মাটির মানুষ’ চলচ্চিত্রে ব্যবহার হয়।

সুবীর নন্দী প্রথম চলচ্চিত্রে গান করেন এম এ সামাদ পরিচালিত ‘সূর্য গ্রহণ’ (১৯৭৬)-এ। রাজা হোসেন খান ও সুজয় শ্যামের সংগীত পরিচালনায় ‘দোষী হইলাম আমি দয়ালরে, তোমার ভবের মাঝেতে’ গানটি ছিল অনেকটা ফোক ধরনের। প্রথম ছবির গানে তেমন পরিচিতি না পেলেও পরবর্তীতে অনেক জনপ্রিয় গানে কণ্ঠ দেন তিনি। চলচ্চিত্রে সুবীর নন্দীর প্রথম জনপ্রিয় গানটি আসে খান আতাউর রহমানের পরিচালনায়  ‘দিন যায় কথা থাকে’ (১৯৭৭) ছবির মাধ্যমে। ছবিতে ব্যবহৃত দুটি গান ‘দিন যায় কথা থাকে’ ও ‘নেশার লাটিম ঝিম ধরেছে’ সে সময় তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। ছবিটির গীতিকার ও সুরকার ছিলেন খান আতাউর রহমান।

চলচ্চিত্রে সুবীর নন্দীর উল্লেখযোগ্য গান: কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো (উসিলা), এই রাত ডাকে (কাজল লতা), আমার এ দুটি চোখ (মহানায়ক), হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে (মহানায়ক), তোমারই পরশে জীবন আমার ওগো ধন্য হলো (অংশীদার), আমায় অনেক বড় ডিগ্রি দিছে মাগো (বিক্ষোভ), এ দুনিয়ার রাস্তা ঘাটে (অংশীদার), কোন ডালের পাখি (আনন্দ অশ্রু), পিরিতি করিয়া (কুসুম কলি), তুমি এত সুন্দর (কারণ), জীবনের গল্প এত ছোট নয় (রহিম জন), মন রে ওরে মন (দেবদাস), তুমি এমনই জাল পেতেছো সংসারে (শুভদা), বন্ধু হতে চেয়ে তোমার (মাটির মানুষ), সুখ পাখি তোর হইলো না আপন (দেবদাস), অবুঝ নদীর কুল কি নাই (শুভদা), ও আমার উড়াল পঙ্খীরে (শ্রাবণ মেঘের দিন), একটা ছিলো সোনার কন্যা (শ্রাবণ মেঘের দিন), আমি পথে পথে ঘুরি (মা), কেঁদো না তুমি কেঁদো না (শর্ত), মাস্টার সাব আমি নাম দস্তখত শিখতে চাই (অশিক্ষিত), আশা ছিল মনে মনে (হাজার বছর ধরে), তুমি সুতোয় বেঁধেছো শাপলার ফুল (হাজার বছর ধরে), বন্ধু তোর বরাত নিয়া আমি যামু (সমাধি) ও পাখিরে তুই দুরে থাকলে(লাল গোলাপ)।

চলচ্চিত্রের মতো অনেক আধুনিক গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন সুবীর নন্দী, সেসব গানও হয়েছে জনপ্রিয়। তিনি রেডিও ও টেলিভিশনেও নিজের সুনামকে করেছেন আলোকিত। সেখানে করা তার অসংখ্য আধুনিক গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য: চাঁদে কলঙ্ক আছে যেমন, আমার দুচোখে অনন্ত মেঘ অজন্তা তোমার চোখের জল, কথা দাও কথাগুলো ফেরত নিবে না, আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কান্না শিখেছি, বন্ধু হতে চেয়ে তোমার, কেন ভালোবাসা হারিয়ে যায় ও পাহাড়ের কান্না দেখে তোমরা তাকে ঝরনা বলো।

সুবীর নন্দীর খুব জনপ্রিয় একটি গান ছিল সত্য সাহার সুরে ‘অংশীদার’ ছবির ‘তোমারই পরশে জীবন আমার ওগো ধন্য হলো’। একবার স্মৃতিচারণে তিনি গানটিকে খুব গুরুত্বপূর্ণভাবে তুলে ধরেছিলেন। এই বলে যে— তিনি সে সময় প্রচুর পান খেতেন। তো গানটি যখন রেকর্ডিং হচ্ছিল তখনো তার মুখে খানিকটা পান লেগেছিল। আর বারবার তিনি ‘র’ শব্দটায় আটকিয়ে যাচ্ছিলেন। এক গানে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় ব্যয়ে সত্যদা বেশ রেগেও গিয়েছিলেন। এটা বুঝতে পেরে সুবীরদা তৎক্ষণাৎ একটি ব্রাশ ও টুথপেস্ট কিনে দাঁত মেজে এক টেকে গানটি তুলে দিয়েছিলেন এবং সেই থেকে পান খাওয়ার অভ্যাসটিও বাদ দিয়েছিলেন।

আরেকটি স্মৃতিচারণে বলেছিলেন বাংলাদেশ বেতারে (ঢাকাতে) প্রথম গান গাওয়া নিয়ে। এটা স্বাধীনতা পরবর্তী ঘটনা। সিলেট বেতার কেন্দ্রের প্রোগ্রাম প্রডিউসার মোহাম্মদ মোজাক্কের তখন প্রমোশন হয়ে ঢাকা বেতারে এসেছেন, টুকটাক গানও লিখতেন। সিলেটে সুবীর নন্দীর সঙ্গে পরিচয়কালে তিনি তাকে ঢাকায় এসে দু-একটি গান রেকর্ডিং কথা বললেন।

সুবীর নন্দীও তিন-চারদিনের সময় নিয়ে ঢাকায় আসলেন। প্রতিদিন তিনি মোজাক্কের সাহেবের অফিস কক্ষে বসে থাকতেন, কিন্তু গান রেকর্ডের সুযোগ হচ্ছিল না। তো যেদিন তিনি সিলেট চল যাবেন বলে ঠিক করলেন সেদিন দুপুরের দিকে মোজাক্কের সাহেবের রুমে এলেন ওস্তাদ মীর কাশেম খান সাহেব। তিনি সুবীর নন্দীকে দেখিয়ে মোজাক্কের সাহেবকে বললেন ‘এই ছেলেটি প্রতিদিন এখানে বসে থাকে, কারণটা কী?’, তখন পুরোটা শুনে সুবীর নন্দীকে বললেন ‘এই মুহূর্তে সুর তুলে দিলে তিনি গাইতে পারবেন কিনা’, এবং পরবর্তীতে সুবীর নন্দী মাত্র দুই টেকেই গানটি তুলে দিয়েছিলেন।

একজন সুবীর নন্দী গায়ক হিসেবে কত উঁচু মানের ছিলেন তা নিচের দুটি গানকে বিশ্লেষণ করলেই বুঝা যায়।

তার গলায় কত চমৎকার কারুকাজ ছিল তা এক বাক্যে যেন প্রকাশ পায়, শত কঠিন সুর হলেও তার গলায় যেন মলিন হয়ে ধরা দেয়। যার উদাহরণ ‘আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি’ (দেবু ভট্টাচার্য) ও ‘চাঁদে কলঙ্ক আছে যেমন’ (শেখ সাদী খান)। যারা সুর তাল নয় সম্বন্ধে বোঝেন শুধু তারাই বলতে পারবেন গান দুটির ভেতর কত কঠিন সুর লুকিয়ে আছে, যা একজন সুবীর নন্দীর কণ্ঠের জাদুতে পূর্ণতা পেয়েছে।

বাংলা চলচ্চিত্রে গানে অবদানস্বরূপ সুবীর নন্দী পেয়েছেন পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ১৯৮৪ সালে ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়’ (মহানায়ক), ১৯৮৬ সালে ‘তুমি এমনই জাল পেতেছো সংসার’ (শুভদা), ১৯৯৯ সালে ‘একটা ছিল সোনার কন্যা’ (শ্রাবণ মেঘের দিন), ২০০৪ সালে ‌‘ভালোবাসি সকালে, ভালোবাসি বিকেলে’ (মেঘের পরে মেঘ) ও ২০১৫ সালে ‘তোমারে ছাড়িতে বন্ধু’ (রঙিন মহুয়া সুন্দরী) গানে। এ ছাড়া বাচসাসসহ সংগীতে অবদানস্বরূপ পেয়েছেন একুশে পদক।

অনেকেই জানেন না সুবীর নন্দী নজরুল সংগীতকেই প্রাধান্য দিতেন এবং তার মূল বিষয়ই ছিল নজরুল গীতি। মজার ব্যাপার হলো ‘নজরুল সংগীত’ মূল বিষয় থাকলেও পরবর্তীতে তিনি চলচ্চিত্র ও আধুনিক গানেই নিজের কণ্ঠের মাধুর্য ছড়িয়েছলেন। এ ছাড়া বেরিয়েছিল তার বেশ কয়েকটি অডিও অ্যালবাম।

যাই হোক, আমাদের বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করতে একজন সুবীর নন্দীর নাম লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে। বহু কালজয়ী গানের শিল্পী তিনি, দীর্ঘ চার দশকে গেয়েছেন প্রায় আড়াই হাজারের ওপরে গান।

২০১৯ সালের ৭ মে সুবীর নন্দী মৃত্যুবরণ করেন, মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৬ বছর। দেশ বরেণ্য এই কিংবদন্তি সংগীতশিল্পীর প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। একজন সুবীর নন্দী তার কণ্ঠের মাধুর্যে থাকবেন কোটি মানুষের ভালোবাসায়।


Leave a reply