সোনালী যুগের সফল নির্মাতা দিলীপ বিশ্বাস
আমাদের মিডিয়ায় দেবাশীষ বিশ্বাস নামে এক পরিচিত তরুণ আছে যিনি একুশে টিভির ‘পথের প্যাচালী’ নামক একটি রোড শো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচিতি পান। এরপর সেই দেবাশীষ বিশ্বাস গত প্রায় ২ দশকে অনেক অনুষ্ঠান নির্মাণ করেছিলেন, ‘শ্বশুরবাড়ী জিন্দাবাদ’ নামের চলচ্চিত্র দিয়ে সিনেমার পরিচালক হিসেবে নাম লিখিয়েছিলেন কিন্তু কখনও এই তরুণটির কোন নির্মিত অনুষ্ঠান, চলচ্চিত্র কোনটা দেখে তাঁকে আমার মেধাবী মনে হয়নি বরং মাঝে মাঝে বেফাঁস কথাবার্তা বলার কারণে বাঁচাল মনে হয় আমার কাছে।
অথচ আপনি যদি তাঁর পিতার পরিচয় জেনে থাকেন তাহলে আপনি বিস্মিত হবেন এই ভেবে যে এমন মেধাবী, সফল ও বিনয়ী পিতার ঘরে এমন সন্তান কিভাবে জন্ম নিলো? কারণ তাঁর পিতার কর্মযজ্ঞ, চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে অবদান ও বিনয়ের কথা সর্বজন বিদিত এবং আজও তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন ও থাকবেন আগামীতে।
বাংলাদেশের সোনালী যুগের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির সাক্ষী যারা তাদের সবার কাছে দিলীপ বিশ্বাস নামটি খুবই পরিচিত। কারণ বহু ব্যবসাসফল সিনেমার পরিচালক, প্রযোজক ও পরিবেশক তিনি। ১৯৪৬ সালে জন্মগ্রহণ করা দিলীপ বিশ্বাস ৬০ এর দশকে বাংলা চলচ্চিত্রের প্রবাদ পুরুষ জহির রায়হানের ‘বেহুলা’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে কণ্ঠশিল্পী হিসেবে। এরপর তিনি কণ্ঠশিল্পি হিসেবে কাজ করেন ‘আনোয়ারা’, ‘মোমের আলো’, ‘দুই ভাই’, ‘আলোমতি’, ‘সন্তান’ ও ‘চেনা অচেনা’ ছবির গানে কণ্ঠ এবং এরপর ‘হাবুর বিয়ে’ নামে একটি চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয়ও করেছিলেন। পরে ঝুঁকে পরেছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালনার দিকে এবং সহকারী পরিচালক হিসেবে ‘আগুন নিয়ে খেলা’ ছবিটি নির্মাণ করেছিলেন।
পূর্ণ-পরিচালক হিহেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন সত্তরের দশকে (১৯৭৬ সালে) ’সমাধি’ ছবিটি পরিচালনার মধ্য দিয়ে। এটি ছিল দারুণ সফল একটি চলচ্চিত্র।
যদিও ‘সমাধি’ ছিলো তাঁর মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম চলচ্চিত্র কিন্তু তিনি ১৯৭৪ সালে ‘দাবী’ নামের একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ শুরু করেন যা মাঝপথে প্রযোজক কাজ বন্ধ করে দেন ও চলচ্চিত্র ব্যবসা থেকে সরে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালে দিলীপ বিশ্বাস তাঁর প্রযোজনা সংস্থা গীতি কথাচিত্র থেকে ছবিটির কাজ শেষ করে মুক্তি দিয়েছিলেন। রাজ্জাক ও উজ্জ্বল অভিনীত ‘সমাধি’ সিনেমার পরিচালক হিসেবে প্রথমেই দারুন সফলতা অর্জন করেন।সুপার ডুপার ‘সমাধি’ চলচ্চিত্রে তিনি বাংলাদেশের সামাজিক অ্যাকশনধর্মী সিনেমার ধারা শুরু করেন যা তাঁকে সফল করে এবং পরবর্তীতে অন্যারাও একই ধারা অনুসরণ করতে শুরু করেন যার মাধ্যমে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে বলিউডের হিন্দি সিনেমার মতো সামাজিক অ্যাকশন ধারার সিনেমার প্রতিযোগিতা শুরু হয়।
১৯৭৬ সালে ‘সমাধি’এর পর একই বছরে মুক্তি পেয়েছিলো ‘অনুরোধ’ সিনেমাটি যা পুর্বের সিনেমার মতোই বক্স অফিসে সুপারহিট ব্যবসা করে ফলে দিলীপ বিশ্বাসের কদর বেড়ে যায় প্রযোজকদের কাছে।
১৯৭৮ সালে মুক্তি পায় ‘বন্ধু’,’আসামি’ ও ‘দাবী’ যার মধ্য উজ্জ্বল ও রাজ্জাকের ‘বন্ধু’ ‘আসামী’ সুপারহিট ব্যবসা করলেও ‘দাবী’ সিনেমাটি ব্যর্থ হয় বা বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে। টানা ৪টি সুপারহিট সিনেমা উপহার দেয়ার পর ‘দাবী’ সর্বপ্রথম ফ্লপ হয়। ‘দাবী’ সিনেমার ক্ষতিটা তিনি পুষিয়ে নিলেন পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭৯ সালে বিশাল ক্যানভাস ও তারকাবহুল ‘জিঞ্জির’ সিনেমা দিয়ে। ‘জিঞ্জির’ সিনেমাতেই সর্বপ্রথম সেই সময়ের তিন সুপারষ্টার রাজ্জাক, আলমগীর ও সোহেল রানাকে পর্দায় দর্শক একসাথে দেখতে পায়। তারকাবহুল ‘জিঞ্জির’ হয়ে যায় পুর্বের অন্যসব চলচ্চিত্রের থেকে বেশি সফল বা মেগাহিট। উল্লেখ্য যে তিনজন নায়ককেই সমান গুরুত্ব দিয়ে ‘জিঞ্জির’ সিনেমাটি এমনভাবে নির্মান করেন যে দর্শকের পয়সা ষোলআনা উসুল হয়ে যায়।
এরপর ১৯৮০ সালে সামাজিক অ্যাকশন ধারা থেকে বেরিয়ে নির্মাণ করেন ইতিহাসভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘আনারকলি’ যা বক্স অফিসে সফল হয়। ‘দাবী’ সিনেমাটা দিলীপ বিশ্বাসের প্রথম প্রযোজিত হলেও সেখানে তিনি ছিলেন সহ-প্রযোজক তাই ১৯৮১ সালে পুর্ন প্রযোজক, পরিচালক ও পরিবেশক হিসেবে আত্নপ্রকাশ করেন ‘অংশীদার’ সিনেমা দিয়ে। উল্লেখ্য যে এই সিনেমাটি মুক্তির আগে রাজ্জাক, শাবানা, সম্পাদক আমিনুল ইসলাম মিন্টু, শব্দগ্রাহক মফিজুল হক কোন সম্মানি নেননি। সিনেমাটি সুপারহিট ব্যবসা সফল হওয়ায় পরবর্তীতে তাঁরা সম্মানি নিয়েছিলেন যা কৃতজ্ঞচিত্তে দিলীপ বিশ্বাস বারবার স্বীকার করতেন। দিলীপ বিশ্বাস বলতেন সেদিন যদি রাজ্জাক,শাবানা ও টেকনিশিয়ানরা না এগিয়ে আসতো তাহলে ‘অংশীদার’ সিনেমাটি তিনি শেষ করতে পারতেন কিনা জানেন না। ‘অংশীদার’ সিনেমার ‘মামা ভাগিনা যেখানে / আপদ নাই সেখানে’ গানটি ছিল তখন দর্শকদের মুখে মুখে। এরপর মাঝখানে বিরতি দিয়ে নিজের প্রযোজনা সংস্থা থেকে শামসুদ্দিন টগর পরিচালিত ‘দখল’ ও ফখরুল হাসান বৈরাগী পরিচালিত ‘সাত রাজার ধন’ নির্মান করে সফল হয়েছিলেন।এরপর দিলীপ বিশ্বাস নির্মাণ করেন ‘অপমান’ সিনেমাটি যা ছিলো দিলীপ বিশ্বাসের দ্বিতীয় ফ্লপ সিনেমা।
১৯৮৫সালে দিলীপ বিশ্বাস আবার পরিচালনায় নির্মান করেন ‘অস্বীকার’ সিনেমাটি যে সিনেমাটির পোস্টারে দিলীপ বিশ্বাসের নাম ছাড়া অন্য কোন তারকার নাম ছিলো না। এ সিনেমায় ছিলেন শাবানা আলমগির সোহেল রানা সুচরিতা, ইমরান, এটিএম শামসুজ্জামান এর মতো তারকারা। দারুণ ব্যবসা সফল হয় সিনেমাটি।
এরপর ১৯৮৬ সালে নির্মাণ করেন ‘অপেক্ষা’ যে সিনেমায় সর্বপ্রথম আলমগীর-শাবানা জুটিকে দর্শক রোমান্টিক নায়ক-নায়িকার চরিত্র থেকে পিতা মাতার চরিত্রে দেখতে পায়। ‘অপেক্ষা’ সিনেমায় আলমগীর-শাবানা ছিলেন জাফর ইকবাল ও ইমরানের বাবা-মা। দারুণ সফল হয় সিনেমাটি এবং শ্রেষ্ঠ অভিনেতা-অভিনেত্রীসহ সর্বমোট ৫টি শাখায় জাতীয় পুরস্কার লাভ করে।
এরপর দীর্ঘ বিরতি দিয়ে ১৯৯৬ সালে দিলীপ বিশ্বাস আবার পরিচালনায় আসেন ‘অজান্তে’ সিনেমার মধ্য দিয়ে। তরুণ প্রজন্মের সালমান শাহ, ওমর সানী, মান্নাদের মতো তারকাদের সময়ে আলমগীর, সোহেল রানা ও শাবানাকে প্রধান করে নির্মিত ‘অজান্তে’ দারুন সফল হয় এবং এই সিনেমার জন্য সোহেল রানা শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে সর্বপ্রথম জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে এছাড়া আরও চারটি শাখায় অজান্তে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছিল। দুর্দান্ত পারিবারিক সেন্টিমেন্ট ও অভিনয় সমৃদ্ধ সিনেমা ‘অজান্তে’ দর্শকদের মুগ্ধ করে।
দিলীপ বিশ্বাস তাঁর মায়ের কাছে শিশুকালে স্বরবর্ণ লিখার স্মৃতিটাকে ধরে রাখার জন্য তাঁর নির্মিত অধিকাংশ সিনেমার নাম রাখতেন ‘অ’ দিয়ে ‘অংশীদার’, ’অপমান’ ‘অস্বীকার’, ‘অপেক্ষা’, ‘অকৃতজ্ঞ’, ‘অজান্তে’। দারুণ মেধাবী এই নির্মাতা ২০০৬ সালের ১২ জুলাই মৃত্যুবরষ করেন।আজ যখন তাঁরই সন্তান দেবাশীষ বিশ্বাস চলচ্চিত্র নির্মাণের নামে দর্শকদের হতাশ করে তখন খুব কষ্ট হয় যে দিলীপ বিশ্বাস নিজের সন্তানটিকে তাঁর মতো করে তৈরি করতে পারেননি বলে।।