সোহেল রানা : অবধারিত অধ্যায়
‘ড্যাশিং হিরো সোহেল রানা’ নামেই একবাক্যে তাকে চেনে দর্শক। একটা উপাধি পেতে সময় লাগে হুট করে হয় না। ১৯৭৩ সালে ‘মাসুদ রানা’ ছবির জন্য বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছিল পত্রিকায় ছবির নায়ক খোঁজার জন্য। চারজনের টিম গঠন করা হয় বিখ্যাত ‘চিত্রালী’ পত্রিকার সম্পাদক আহমদ জামান চৌধুরী, পরিচালক এস এম শফি, অভিনেত্রী সুমিতা দেবী ও বইটির লেখক কাজী আনোয়ার হোসেনকে নিয়ে।
আগের বছর সোহেল রানা ‘ওরা ১১ জন’ ছবির প্রযোজক থাকাতে তার পরিচিতি ছিলই। সুমিতা দেবী সোহেল রানাকে ছবিটির নায়ক হওয়ার জন্য প্রস্তাব করেন। পাশাপাশি পরিচালনাও করতে বলেন কারণ তিনি সহকারী পরিচালকও ছিলেন। পরিচালক হিশাবে নাম মাসুদ পারভেজ থাকলেও নায়করূপে নাম পাল্টে করা হয় সোহেল রানা।
এক ছবিতে বাজিমাত। পরের বছর ১৯৭৪ সালে ছবি মুক্তি পায় এবং সুপারহিট হয়। ‘দোস্ত দুশমন’ ছবির জনি চরিত্রে ওয়াসিমের বন্ধু হিশাবে সোহেল রানা দর্শকের মাঝে আরো জনপ্রিয়তা পান। অতপর তার ক্যারিয়ারের উত্থানপর্ব চলতেই থাকে।
দেশীয় ছবিতে অ্যাকশনের প্রচলনে একদম গোড়া থেকে বললে সোহেল রানাই ছিলেন কাণ্ডারি। ওস্তাদ জাহাঙ্গীর আলমকে নিয়ে ‘রক্তের বন্দি’ নামের ছবিতে মার্শাল আর্ট নিয়ে এলে ছবিটা তখন সাফল্য পায়নি। পরে ছোটভাই আরেক অ্যাকশন নায়ক রুবেলকে নিয়ে ‘লড়াকু’ ছবি নির্মাণ করেন পরিচালক শহীদুল ইসলাম খোকনকে দিয়ে। সে ছবি মাইলফলক হয়ে যায়।
এমনকি ‘বজ্রমুষ্টি’ ছবিরও একটা বড় অবস্থান আছে এ ক্ষেত্রে। খোকন নিজেও সোহেল রানার ভক্ত ছিলেন। প্রথমদিকে তার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকতেন খোকন পরিচালনার অনেককিছু শেখার জন্য।
সোহেল রানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের ছাত্র ছিলেন। ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধাও। তার প্রতি এ জন্য আলাদা সম্মান আছে দর্শকের। পরে জাতীয় পার্টিতে ছিলেন।
সোহেল রানা একজন সফল প্রযোজকও। তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ছবি ‘ওরা ১১ জন’ প্রযোজনা করেন। পরিচালক ছিলেন চাষী নজরুল ইসলাম। তার কাছের বন্ধু খসরু ছিলেন ছবির মূল নায়ক।
সোহেল রানা খুবই সচেতন পরিচালক ছিলেন। ক্যামেরার বাইরে তিনি ছবি পরিচালনা ছাড়াও সূক্ষ্ম ব্যবস্থাপনা করতেন। শিল্পী ডলি সায়ন্তনীর একটি সাক্ষাৎকারে জানা যায়, ‘উত্থান পতন’ ছবিতে ‘রংচটা জিন্সের প্যান্ট পরা’ গানটি রেকর্ডিং-এর জন্য তাকে সিলেকশন করা হলে প্রথম পরীক্ষাটা দিতে হয়েছিল সোহেল রানার কাছেই। তিনি ডলিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে গানের বিষয়ে জেনে নেন অনেককিছু। ঐ গানটির জন্য ডলি পারফেক্ট হবে কিনা সেটাও তিনি বিবেচনা করেছিলেন। শহীদুল ইসলাম খোকন ডলির গান পছন্দ করতেন তাই তাকে সিলেক্ট করেন। পরে ডলিকে দিয়েই গানটি করা হয় ছবির জন্য এবং সুপারহিট হয় অ্যালবামের মতোই।
তার ছেলে মাশরুর পারভেজও চলচ্চিত্রের সাথে যুক্ত। তার ‘অদৃশ্য শত্রু’ ও ‘রাইয়ান’ নামে দুটি ছবি মুক্তি পেয়েছে। ছবি দুটিতে সোহেল রানাও অভিনয় করেছেন।
সোহেল রানা ডিপজলের সাথে কিছু ছবি করে সমালোচিত হন। বিশেষ করে ‘খাইছি তোরে’ ছবিতে নৃশংসতা দেখানো হয়েছিল যা সমালোচিত হয়।
উল্লেখযোগ্য ছবি : মাসুদ রানা, এপার ওপার, জিন্জির, জীবন নৌকা, ঘরের শত্রু, দোস্ত দুশমন, দাতা হাতেম তাই, রাজা জনি, অত্যাচার, চোখের পানি, দুঃসাহস, অপহরণ, অকর্মা, গাদ্দার, প্রতিহিংসা, রক্তের বন্দি, বারুদ, চোর, হাঙর নদী গ্রেনেড, পরাধীন, জারকা, আসামী হাজির, ওরা ১১ জন, মিন্টু আমার নাম, শরীফ বদমাশ, নাগ পূর্ণিমা, বিশ্বপ্রেমিক, কমান্ডার, দুই প্রেমিক, অভিযোগ, শাহী খানদানি, মারকশা, লড়াকু, টপ রংবাজ, ঘর আমার ঘর, স্ত্রী, হুমকি, বদলা, বড় মা, জনি, বজ্রমুষ্টি, মার্শাল হিরো, তিনকন্যা, অজান্তে, কলমিলতা, গৃহযুদ্ধ, ঘরের শত্রু, মৃত্যুর সাথে পাণ্জা, মায়ের মর্যাদা, জজ ব্যারিস্টার পুলিশ কমিশনার, প্রবেশ নিষেধ, সাহসী মানুষ চাই, ভয়ঙ্কর বিষু, খাইছি তোরে, রাইয়ান, অদৃশ্য শত্রু, টাকা, মোস্ট ওয়েলকাম, স্বামীর সংসার, রিটার্ন টিকেট ও পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী।
‘মাসুদ রানা’ তার ক্যারিয়ার সেরা অন্যতম ছবি। এছাড়া সুপারস্টার ইমেজে দোস্ত দুশমন, লালুভুলু, জীবন নৌকা, মিন্টু আমার নাম, জনি, গাদ্দার, প্রতিহিংসা, হুমকি, আসামী হাজির, জিদ্দি, টপ রংবাজ, দাতা হাতেম তাই ছবিগুলো উল্লেখযোগ্য। ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ ছবির জন্য তিনি প্রশংসিত হন। ‘জারকা’ ছবিতে আরব বেদুঈন চরিত্রে ব্যতিক্রমী পারফরম্যান্স দেখান।
ঢালিউডে নায়কের নামে ছবি আছে এমন নায়কের মধ্যে প্রথম তিনি। ‘সোহেল রানা’ নামেই একটি ছবি আছে তার।
তার জুটি ছিল বেশ উল্লেখযোগ্য। এক বছরে সোহেল রানা-ববিতা জুটির সাতটি ছবি মুক্তির রেকর্ডও ছিল। সোহেল রানা-শাবানা জুটির দুঃসাহস, চোখের পানি, টপ রংবাজ দুর্দান্ত অ্যাকশন ছবি। সোহেল রানা-সুচরিতা জুটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। তাদের ‘জীবন নৌকা’ অনেক সিনেমাপ্রেমীর প্রিয় ছবি। ‘অজান্তে’ ছবিটিও জনপ্রিয়।
কবরীর সাথে জুটি সেভাবে গড়ে না উঠলেও ‘মাসুদ রানা’ ক্লাসিক ছবি। সুবর্ণা মুস্তাফার সাথে অপহরণ, স্ত্রী, আজকের হিটলার, কমান্ডার ছবিগুলো জনপ্রিয়।
‘এপার ওপার’ ছবি করতে গিয়ে ভারতীয় নায়িকা সোমা চ্যাটার্জীর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। সোমাকে বলেছিলেন তার কাছে আসতে। সোমা প্রথমে রাজিও ছিল কিন্তু ছবি মুক্তির পর ভারতে ফিরে গেলে আর আসেননি সোহেল রানার কাছে। হয়তো সমাজ-সংসার-ধর্মের বাধা অতিক্রম করতে পারেননি তিনি।
সোহেল রানার অভিনয়ের বিশেষত্ব ছিল অ্যাকশনে। এ ক্যাটাগরিতে তিনি ঈর্ষণীয়। ফ্যামিলি ড্রামা ঘরানার ছবিতেও তার অভিনয় অসাধারণ ছিল।
সোহেল রানা অভিনীত সিনেমার জনপ্রিয় গানের মধ্যে কিছু :
তুমি যেখানে আমি সেখানে – নাগ পূর্ণিমা
মন রেখেছি আমি – এপার ওপার
ভালোবাসার মূল্য কত – এপার ওপার
মনেরও রঙে রাঙাব – মাসুদ রানা
ও রানা ও সোনা – মাসুদ রানা
তুমি তো এখন আমারই কথা ভাবছ – জীবন নৌকা
ওরে ও জান রে – জীবন নৌকা
মেঘ যদি সরে যায় – জীবন নৌকা
আজকে না হয় ভালোবাসো আর কোনোদিন নয় – মিন্টু আমার নাম
আমার প্রেমের ফুল বাগানে – প্রতিহিংসা
এই বুকে কান পেতে শোনো – অপহরণ
জাপান আমেরিকা লন্ডন – চোর
আমার পৃথিবী তুমি – আসামী হাজির
জনি আমার নাম – জনি
দুনিয়াটা মস্ত বড় – জনি
সুমন মোহন রাজন – জিঞ্জির
এ মালিকে জাহান আমি – দাতা হাতেম তাই
ভালোবাসা জীবন থেকে অনেক বড় – অজান্তে
১৯৯৬ সালে প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার – ‘অজান্তে’ ছবিতে।
২০০৩ সালে পার্শ্ব চরিত্রে জাতীয় পুরস্কার – ‘সাহসী মানুষ চাই’ ছবিতে।
সোহেল রানা বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের স্বর্ণসময়ের আদর্শ নায়ক। নায়ক, অভিনেতা, নির্মাতা, প্রযোজক বিভিন্ন ইমেজে তিনি চলচ্চিত্রের অন্যতম সফল একজন তারকা। তাকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের কোনো সম্পূর্ণ আলোচনা হতেই পারে না।
ছবিতে :
১. বিখ্যাত ‘চিত্রালী’ পত্রিকায় প্রকাশিত ছবিতে
২. ‘মাসুদ রানা’ ছবির দৃশ্যে
৩. ‘তুমি যেখানে আমি সেখানে’ গানের দৃশ্যে
৪. ‘তুমি তো এখন আমারই কথা ভাবছ’ গানের দৃশ্যে