স্বপ্নজাল : যে জালে আটকে যায় দর্শক
বহু আগে গিয়াস উদ্দিন সেলিম নির্মাণ করেছিলেন ‘মনপুরা’ নামের একটি সিনেমা। মানুষ যে একটি ভালো সিনেমার তৃষ্ণায় থাকে– সেটা তখনই টের পেয়েছিলেন এই নির্মাতা। তবু পরের সিনেমায় আসতে নয় বছর সময় নিলেন কেন? এতকাল এর স্পষ্ট কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি এই নির্মাতার কাছে। প্রশ্নের বিপরীতে নীরব ছিলেন তিনি, লাজুক মিষ্টি হেসেছেন কেবল।
যে হাসির উত্তর তখন অস্পষ্ট মনে হলেও ৬ এপ্রিল ‘স্বপ্নজাল’ মুক্তির পর ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠলো সেই মিষ্টি হাসির সেলিম-নীরবতার বিষয়টি। এবারও কি বিচ্ছেদ বেদনা? নাকি প্রেমময় বিজয়—নির্মাতা ঠিক কোন জালে জড়িয়েছেন দর্শকদের। যারা ছবিটি দেখে ফেলেছেন তারা তো জানেনই। তবে এখনও যারা ছবিটি দেখেননি সেই আকাঙ্ক্ষা বাঁচিয়ে রাখলাম তাদের জন্য।
সিনেমার গল্পে চলে আসা জরুরি। যদিও কোনও সিনেমার গল্প নিয়ে খুব বেশি আলোচনার প্রয়োজন পড়ে না। কারণ, গল্পটাই তো সিনেমার প্রধান হাতিয়ার। তাছাড়া আলোচনায় হাজির হয়ে গেলে সিনেমার পিপাসাটা কম হয়ে যায় বইকি। তাই অল্প কথায় গল্পটা বলা যেতে পারে, ‘স্বপ্নজাল’ নব্বই দশকের একটি কৈশোর সময়ের প্রেমের গল্প। চাঁদপুর শহরে নদীর তীরঘেঁষে বাস করা মুসলমান ও হিন্দু পরিবারের গল্প। পাশাপাশি বাড়িতে মুসলমান ঘরের ছেলে আর হিন্দু ঘরের মেয়ের মধ্যে প্রেম হয়। এই কৈশোর বেলার প্রেমে হাজির হয় অন্যরকম সংকট। নায়ক অপু, নায়িকা শুভ্রা। শুভ্রার বাবা নিখোঁজ হন। তারপর এক চিঠিকে কেন্দ্র করে শুভ্রাদের পরিবার পাড়ি জমায় কলকাতা। কলকাতায় শুভ্রা এবং চাঁদপুর শহরে অপু। তারা অপেক্ষা করে একে অপরের চিঠির। আহ্! প্রেমের কী তীব্র আবেদন তৈরি হয় তখন। এরই মাঝে শুভ্রার বাবার আরেকটি পরিণতি হাজির হয় অপুর সামনে। সিনেমায় নেয় নতুন মোড়। যা দেখার জন্য আপনাকে যেতে হবে সোজা প্রেক্ষাগৃহে। এর বেশি বলা প্রয়োজন আপাতত থাক।
স্বপ্নজালের সবচেয়ে দুর্দান্ত দিক কোনটি—এমন প্রশ্ন হাজির হতেই পারে। বলা যায়, ধর্মকে যেভাবে ডিল করেছেন পরিচালক তা এককথায় দুর্দান্ত। প্রেমের ফাঁকে ধর্মকে যেভাবে জায়গা দিয়েছেন, যেখানে ধর্মীয় পরিচয়ে সমাজব্যবস্থায় প্রেম ভালোবাসার স্থান নেই, সে বিষয়টি পরিচালক যেভাবে পর্দায় দেখালেন তা সত্যিই অসাধারণ। আরেকটি বিষয় হলো, এদেশের হিন্দুরা যেভাবে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে দেশান্তরিত হন কিংবা তাদের দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য করে একশ্রেণির প্রভাবশালী মহল–সেই বিষয়টি ফ্রেমে তুলে এনেছেন পরিচালক। শুধু তাই নয়, পুরো সিনেমাজুড়ে দেখা যাবে পাশাপাশি হিন্দু-মুসলমানের বাড়ি। তারা একে অপরের বিপদে পাশে থাকে। আসা যাওয়া হয়। কিন্তু যখন সেখানে প্রেম হাজির হয়, তখন ঠিকই সামনে আসে ধর্মীয় পরিচয়। এই অস্থির সময়ে পরিচালক গিয়াস উদ্দিন সেলিম সাহসের সঙ্গে কাজটি করে দেখালেন। প্রমাণ করলেন, সূক্ষ্মভাবে সিনেমায় সব দেখানো সম্ভব, শুধু গল্পের ফ্রেমটা সাজাতে জানতে হয়।
‘স্বপ্নজাল’-এর গল্প যত না শক্তিশালী, তারচেয়ে শক্তিশালী তার ফ্রেম নির্বাচন এবং শিল্পীদের অভিনয়। নায়ক চরিত্রটির নাম হলো অপু। অভিনয়ে ইয়াশ রোহান। নায়িকা শুভ্রা। অভিনয়ে পরীমনি।
সিনেমার সবচেয়ে সুন্দর দিকটি ছিল অপু-শুভ্রার কেমিস্ট্রি। কিশোর প্রেমে যত মিষ্টি অনুভূতি আছে, সবই যেন ঠাঁই করে দিয়েছেন পরিচালক। সকল বাধাকে পেরিয়ে যে কিশোর প্রেম মাতাল-উন্মাতাল হয়ে ওঠে নানান স্বপ্নজালে। সে সবই আটকা পড়ে অপু-শুভ্রার প্রেমজালে। এই চরিত্রগুলো দেখতে দেখতে দর্শক বুঝতেই পারবেন না, পর্দার ওপারের আসল মানুষটি ঢাকাই ছবির ডানাকাটা পরী-মনি। এই পরীমনি আমাদের কাছে একেবারেই অচেনা, অজানা। এত সুন্দর, এত সাবলীল, এত উচ্ছল, এত বেদনা তার মুখোচ্ছবিতে ফুটে উঠেছে, যেটা ঢাকাই ছবির নিয়মিত দর্শকদের কাছে বিস্ময়কর মনে হবে। আবার একইসঙ্গে তার অভিনয় দক্ষতা দেখে নিশ্চিতভাবে মুগ্ধ হবেন দর্শক-সমালোচক। অন্যদিকে অপু চরিত্রটি নিয়ে বলা যায়, ইয়াশ রোহান ছাড়া ছবিটি হয়তো পূর্ণতাই পেত না। কিশোর প্রেমে ছেলেরা যে মাতাল হয়ে ওঠে, অপু যেন তার ষোলআনা পূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছেন। সব বাধাবিপত্তি টপকে যেতে চায় অপু। এসব নিয়ে ইয়াশ রোহানও অনবদ্য। যদিও সাবলীল পরীর কাছে মাঝে মাঝেই ম্লান লেগেছে ইয়াশের অভিনয়।
একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে জানা যায়, মিশা সওদাগরের অভিনয় করার কথা ছিল অপুর বাবার চরিত্রে, কিন্তু সময়ের অভাবে সে চরিত্রে তিনি কাজ করতে পারেননি। তিনি অভিনয় করেছেন শুভ্রার বাবা হিসেবে ছোট্ট একটি চরিত্রে। অথচ পুরো ছবিটি ছিল শুভ্রার বাবা মিশা সওদাগরকে কেন্দ্র করেই। এত অল্প সময়েও তিনি দেখিয়েছেন নিজের অভিনয় মুন্সিয়ানা। অন্যদিকে আয়নাল চরিত্রে ছিলেন ফজলুর রহমান বাবু। মঞ্চ-টিভি-চলচ্চিত্রের দুর্দান্ত অভিনেতা বাবু, একটি নেগেটিভ চরিত্রে আবার চিনিয়েছেন নিজের জাত। যদিও তার চরিত্রটিও কমিক সৃষ্টি করেছে সিনেমায়। প্রকৃতির শাস্তিতে নাকাল আয়নাল যখন বমি করে, যখন টয়লেটে দৌড়ায়–অসুস্থে কাবু হয়ে যায় তখন দর্শক তার ব্যথায় দুঃখিত হয় না বরং হাসে, তালি বাজায়। এটাই যেন চরিত্রের এক অন্যরকম খেলা। দিনশেষে যে খেলায় জিতে যান বাবু এবং পরিচালক সেলিম।
ছোট্ট চরিত্র অথচ কী দুর্দান্ত হতে পারে, তার প্রমাণ ইরেশ যাকের। এত অল্প সময় পর্দায় থেকেও দর্শক হৃদয়ে ঠিকই তিনি জায়গা পাবেন দীর্ঘ সময়।
স্বপ্নজালে আরও চরিত্র আছে। ইরফান সেলিম, ফারহানা মিঠু, শহিদুল আলম সাচ্চু, শিল্পী সরকার অপুসহ কলকাতার বেশ ক’জন পরিচিত শিল্পী। কারও অভিনয়ে এতটুকু ঘাটতি চোখে পড়েনি।
সিনেমাটির দৃশ্যায়ন হয় বাংলাদেশের চাঁদপুর ও ভারতের কলকাতা শহরে। কলকাতা শহর এবং নদীঘেঁষা চাঁদপুরের জীবন একটু হলেও ধরা দিয়েছে সেলুলয়েডে। স্বপ্নজাল খুব ধীরলয়ে এগুনো সিনেমা, এই ধীরলয় কিছুটা হলেও দর্শকের বিরক্তির কারণ হতো না, যদি গানের শক্তি থাকতো। ‘মনপুরা’য় অন্যতম শক্তি ছিল তার গান। তবে এই সিনেমায় পরিচালক যেন সেই শক্তি ব্যবহার করেননি। গান ছিল, তবে তিনটি। গানগুলো মন্দ নয়, তবে ‘মনপুরা’র মতো শক্তিশালী ছিল না।
একটি দৃশ্যে ইয়াশ রোহান ও পরীমনিএই সিনেমার সিনেমাটোগ্রাফি চমৎকার। এর বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। অন্যদিকে সেরা দৃশ্য’র কথা যদি আসে, তবে শেষের দিকে পুরো ফ্রেমজুড়ে নদী। তীর ঘেঁষে এপাশ থেকে ওপাশে দৌড়ে যায় শুভ্রা, খুঁজে বেড়ায় অপুকে। খুঁজে সে পায় না। ধীরে ধীরে পর্দায় সামনে এসে দাঁড়ায় শুভ্রা। যেন পর্দায় থেকে দর্শক সারিতেও অপুকে খুঁজছিলেন শুভ্রা। কেমন এক প্রেমের অনুভূতি তৈরি হয় দর্শক সারিতে। সবাই নির্বাক তাকিয়ে থাকে শুভ্রার শূন্য চোখে। পরীমনি যেমন মগ্ন হয় শুভ্রা চরিত্রে, দর্শকও মগ্নতায় ছুঁতে পারে বিষাদে ভরা প্রেমকে, যে প্রেম হারিয়ে গেছে অনেকেরই কৈশোরে। আরও একটি দৃশ্যের কথা বলা যেতে পারে, নায়ক অপু তখন নেই। নায়িকা শুভ্রার বিয়ে হচ্ছে। দৃশ্যে দেখানো হয় অপু দৌড়ে আসছে শুভ্রাদের বাড়ির দিকে। পায়ের স্যান্ডেলের আওয়াজ যেন কানে আসে শুভ্রার। সাতপাকে ঘুরার সময় একটু থমকে দাঁড়ায় শুভ্রা, যেন দৌড়ে আসার আওয়াজটা তার কানে আসে। কিন্তু না, দরজায় তাকিয়ে কাউকে দেখতে পায় না শুভ্রা, এগিয়ে যায় সবশেষ পাকে, শুভ্রার সঙ্গে যেন অপুর বিচ্ছেদ ঘটে তখনই। এমনই প্রেম আর বিচ্ছেদের বিষাদের জালে আটকে ঘরে ফিরবেন দর্শক। হৃদয়ে থেকে যাবে অপু-শুভ্রার প্রেম আর বিষাদের গল্পটি।
গিয়াস উদ্দিন সেলিমের প্রথম চলচ্চিত্র ‘মনপুরা’য় নায়ককে এক নির্জন চর কিংবা দ্বীপে নির্বাসনে রাখা হয়। এখানে শুভ্রার বাবাকে চর কিংবা জনমানবহীন দ্বীপে রাখা হয়। মনপুরা’তেও থৈ থৈ জলের খেলা দেখিয়েছেন পরিচালক, এবারও তাই। সমালোচনায় বলতে হয়– ‘মনপুরা’র সঙ্গে অনেক কিছুই মেলানো যায় ‘স্বপ্নজাল’-এর। তবে পরিচালক উতরে গেছেন নির্মাণ দক্ষতায়। পর্দায় চেনা-জানা গল্পটাকেও যে এভাবে বলা যায়, সেটা ‘স্বপ্নজাল’ না দেখলে বোঝা যাবে না। তবে সমালোচনার জায়গা থেকে পরিচালকের কাছে এই আশা করা যেতেই পারে, প্রতিবার একই ধাঁচের গল্প একই পরিচালকের কাছে আশা করেন না দর্শক। চান নতুন করে নতুনভাবে তাকে আবিষ্কার করতে।
স্বপ্নজাল
রেটিং : ৮/১০
পরিচালক : গিয়াস উদ্দিন সেলিম
প্রযোজনা : বাংলাদেশের বেঙ্গল ক্রিয়েশনস ও ভারতের বেঙ্গল বারতা
গল্প, চিত্রনাট্য ও সংলাপ : গিয়াস উদ্দিন সেলিম
অভিনয়ে : পরীমনি, ইয়াশ রোহান, মিশা সওদাগর, ফজলুর রহমান বাবু, শাহানা সুমী, শহিদুল আলম সাচ্চু, শিল্পী সরকার অপু, ইরফান সেলিম, ফারহানা মিঠু, ইরেশ যাকের, মুনিয়া, শাহেদ আলী, আহসানুল হক মিনু প্রমুখ।
সংগীত : রাশেদ শরীফ শোয়েব
চিত্রগ্রাহক : কামরুল হাসান খসরু
মুক্তি : ৬ এপ্রিল, ২০১৮
পরিবেশনা : আশীর্বাদ চলচ্চিত্র