Select Page

স্বপ্নের পৃথিবী, সালমান শাহ ও ইউটোপিয়া

স্বপ্নের পৃথিবী, সালমান শাহ ও ইউটোপিয়া

স্বপ্নের পৃথিবী‘ (১৯৯৬) বাদল খন্দকার পরিচালিত ছবি। সালমান শাহ-র ক্যারিয়ারে উল্লেখযোগ্য একটি ছবি। সালমানের ছবি সিলেকশনের মধ্যে এটি ছিল অত্যন্ত সচেতন একটি পদক্ষেপ।

‘স্বপ্নের পৃথিবী’ মূলত একটি রাষ্ট্রচিন্তার ছবি। ছবির গল্পে রাজতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্রের দ্বন্দ্ব এবং বিপ্লবী ভূমিকা দেখানো হয়েছে। ছবিটি এমন এক রাষ্ট্রের চেতনাকে তুলে ধরে যাকে একটি নির্দিষ্ট মতবাদেও ফেলা যায় সেটি হচ্ছে ‘ইউটোপিয়া’। ইউটোপিয়া হচ্ছে টমাস মুরের লেখা বিখ্যাত ‘ইউটোপিয়া’ নামের একটি বই যেখানে আদর্শ রাষ্ট্রের রূপরেখাকে দেখানো হয়েছে। যেখানে সাম্যের সমাজব্যবস্থায় গঠিত রাষ্ট্রকে স্বপ্নরাষ্ট্র বলা হয়েছে। রাষ্ট্র নিয়ে আমরা সাধারণ জনগণ যে স্বপ্ন দেখে থাকি সেই স্বপ্নকে তুলে ধরেছে ‘স্বপ্নের পৃথিবী’ ছবি।

ইউটোপিয়ান চেতনায়য় ছবিটির গল্পকে তিনভাগে ফেলে বিশ্লেষণ করা যায়।

১. শাসকশ্রেণির দৌরাত্ম্য : ছবির গল্পে দেখানো হয়েছে রাজিব তার রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার উত্থানের জন্য যা খুশি করা শুরু করে। প্রজাদের অত্যাচার করে, ভয়ের রাজ্য কায়েম করে তার একচ্ছত্র আধিপত্য বিরাজ করতে থাকে। প্রজারা সব সহ্য করে কিন্তু ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ নিয়ে থাকে যদি কোনোদিন রুখে দাঁড়াতে পারে।

২. শাসিত প্রজা : ছবির গল্পে ববিতা, রাইসুল ইসলাম আসাদ, শাবনূর, অমল বোসসহ অন্যান্য সাধারণ জনগণ রাজিবের শাসনে শাসিত হয়ে এসেছে। তারা শুধু একের পর এক হারিয়েছে ঘুরে দাঁড়ানোর মতো শক্তি পায়নি।

৩. বিপ্লবী ভূমিকা : ছবির গল্পের সবচেয়ে ইউনিক জায়গাই হচ্ছে শাসক রাজিবের ছেলেই তার বিরুদ্ধে বিপ্লবী ভূমিকা নিয়ে নেয় এবং শাসিত শ্রেণির সাথে যোগ দেয়। রাজপ্রাসাদ ছেড়ে চলে যায় সাধারণ জনগণের সাথে। সেখানে আসাদ-ববিতা দম্পতির ঘরে জায়গা পায়, শাবনূরের সাথে প্রেম এবং রাজিবের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধ ঘোষণার পর শান্তির রাষ্ট্রের সূচনা করে।

সালমান শাহর চরিত্রই ছবিটির মোক্ষম হাতিয়ার যেখানে নিজের শাসক বাবার বিরুদ্ধে তার অবস্থান তৈরি হয় প্রজাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে। ছবির একটা সিকোয়েন্সে দেখা যায় বাবা-ছেলে খোলা মাঠে মুখোমুখি হয়েছে যেখানে সালমান প্রজাদের প্রতিনিধিত্ব করছে এবং বাবাকে সঠিক পথে ফিরে আসতে বলছে। কথোপকথনটি ছিল এমন –

– মাসুম, এটা কিসের সীমানা?

– জমিদার আর প্রজাদের সীমানা।

– মাসুম, তুমি ভুলে যেও না তুমি তোমার পিতার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছ।

– আপনিও ভুলে যাবেন না আব্বাজান, আপনি নির্যাতিত মানুষের একজন প্রতিনিধির সাথে কথা বলছেন।

– পাগলামো কোরো না মাসুম, আমি তোমাকে নিতে এসেছি।

– আমি আমার স্বপ্নের পৃথিবী ছেড়ে কোথাও যাব না, আব্বাজান। এটা আমার কাছে স্বর্গ।

– এই তোমার স্বপ্নের পৃথিবী? এই দুর্গম এলাকাকে তুমি স্বর্গ বলছ? প্রজা কখনো রাজার বন্ধু হতে পারে না।

– ভুল বললেন, আব্বাজান। এরা যদি আপনার ঐশ্বর্য আর ক্ষমতার উৎস হয়ে থাকে তাহলে এরাই আপনার প্রকৃত বন্ধু। উঁচুতলা থেকে নিচুতলায় নেমে আসুন। এদেরকে বন্ধু বলে বুকে জড়িয়ে নিন।

– এদের মতো ছোটলোকদের কি করে শায়েস্তা করতে হয় তা আমি ভালো করে জানি।

– ভুল করছেন, আব্বাজান। আজকের পর আপনার কোনো লোক এদের ওপর অত্যাচার করে ফিরে যেতে পারবে না এটা আমার চ্যালেঞ্জ।

– বেশ আমি তোমার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম।

‘স্বপ্নের পৃথিবী’ ছবির সেরা দৃশ্য। রাজিব ও সালমান শাহ পিতাপুত্রের দ্বন্দ্ব ও চ্যালেঞ্জিং মুহূর্ত। জমিদার রাজিবের ছেলে সালমান শাহ অসহায় প্রজাদের হয়ে তাঁর বাবার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। খোলা মাঠে জমিদার রাজিব ও প্রজার প্রতিনিধি সালমান শাহর সংলাপ যেন বারুদের মতো।

ছবির ক্লাইমেক্সে বাবার সাম্রাজ্যে শেষ আঘাত করার জন্য কমান্ডো স্টাইলে সালমান প্রতিরোধ গড়ে। তার সেই গেটাপ দেশের চলচ্চিত্রের সেরা আধুনিক নায়কের প্রতিচ্ছবি।

‘স্বপ্নের পৃথিবী’ এভাবেই ইউটোপিয়ান স্বপ্নরাষ্ট্র চেতনার ছবি হয়ে ওঠে এবং সেই চেতনার চরিত্রই সালমান শাহ।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র গত শতকে যেভাবে সমৃদ্ধ ছিল সেই সমৃদ্ধির দিকে আবারও যেতে প্রতিদিনই স্বপ্ন দেখি। সেকালের সিনেমা থেকে গ্রহণ বর্জন করে আগামী দিনের চলচ্চিত্রের প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠুক। আমি প্রথমত একজন চলচ্চিত্র দর্শক তারপর সমালোচক হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন দেখি। দেশের সিনেমার সোনালি দিনের উৎকর্ষ জানাতে গবেষণামূলক কাজ করে আগামী প্রজন্মকে দেশের সিনেমাপ্রেমী করার সাধনা করে যেতে চাই।

মন্তব্য করুন