স্মৃতি জাগানিয়া শিশুশিল্পীরা
আশি-নব্বই দশকের বাণিজ্যিক ছবিতে অনেক শিশুশিল্পী নায়ক-নায়িকাদের ছোটবেলার চরিত্রে অভিনয় করেছে। যারা বিটিভি-র ৩:২০ এর পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি দেখার স্মৃতির সাথে জড়িত তাদের অনেকেরই মনে পড়বে সেই পরিচিত ফুটফুটে মুখগুলো। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু শিশুশিল্পীকে নিয়ে এ আয়োজন।
ইংল্যান্ডে নির্দিষ্ট বয়সের শিশুদেরকে ‘মাস্টার’ বলা হয়। সেই নিয়ম থেকে চলচ্চিত্রে শিশুশিল্পীদের নামের আগে ‘মাস্টার’ ব্যবহার করার রীতি আসে। আমাদের চলচ্চিত্রেও এ ব্যবহার হয়েছে তাই বিভিন্ন শিশুশিল্পীদের নামের সাথে এটা দেখা গেছে। তো শুরু করা যাক তাদের মধ্যে কয়েকজনের কথা..
অন্তরা
নায়িকা অন্তরা প্রথমত খুব ভালো শিশুশিল্পী ছিল। শিশুশিল্পী হিসেবে অনেক ছবিতে অভিনয় করেছে। ‘রঙির নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ ছবিতে নবাব চরিত্রে থাকা প্রবীরমিত্রের মেয়ের ভূমিকায় ছিল। এত সুন্দর অভিনয় করেছিল যে কেউ তার অভিনয় দেখে আপ্লুত হবে। ‘স্বামীর আদেশ’ ছবিতে তার সবচেয়ে টাচি অভিনয় ছিল শিশুশিল্পীর চরিত্রে। শাবানার মেয়ে থাকে। শাবানা তার দেবর জসিমের ছেলেকে বাঁচাতে একই হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়াই করা তার মেয়ে অন্তরাকে রক্ত না দিয়ে জসিমের ছেলেকে দেয়। এতে অন্তরা মারা যায়। অন্তরা-র অভিনয় জাস্ট অসাম ছিল। শিশুশিল্পী হিসেবে ততার আরেকটি অসাধারণ ছবি ‘লটারি।’ প্রায় চল্লিশটিরও বেশি ছবিতে শিশুশিল্পী ছিল।
সীমা
খুবই পরিচিত শিশুশিল্পী। সীমা দেখতে খুব সুইট ছিল। বেশিরভাগ ছবিতে শাবানার ছোটবেলার ভূমিকাতে ছিল। বড় হয়ে শাবানা হওয়া তার চাই-ই চাই। ‘সুখের স্বর্গ’ ছবিতে শাবানার ছোটবেলায় থাকে। প্রবীরমিত্রের বাড়িতে কাজ করে। আলমগীরের ছোটবেলার ভূমিকায় থাকা সোহেলের সাথে তার বন্ধুত্ব হয়। সোহেল তাকে স্থানীয় মাস্তানদের হাত থেকে বাঁচায়। ‘চাকরানী, বিদ্রোহী কন্যা’ ছবিগুলোতেও শাবানার ছোটবেলাতে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ‘জজ ব্যারিস্টার’ ছবিতে শাবানার মেয়ের ভূমিকায় ছিল। ‘কাল নাগিনীর প্রেম’ ছবিতে নাগিনীর ভূমিকায় তাকে অসাধারণ লাগে। ‘প্রেমের সমাধি’ ছবিতে শাবনাজের ছোটবেলায় থাকে। বাপ্পারাজের ছোটবেলার ভূমিকায় থাকা শিশুশিল্পীর সাথে বন্ধুত্ব হয়। ‘প্রেমগীত’ ছবিতে লিমার ছোটবেলার চরিত্র করেছে। ‘রূপের রাণী গানের রাজা’ ছবিতেও ছিল। সীমাকে অনেক ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেছে। তাকে ধনী, গরীব, ফোক-ফ্যান্টাসি সব ধরনের ছবির চরিত্রে অভিনয় করেছে। আরো কিছু ছবিতে দেখা গেছে।
প্রিয়াঙ্কা
‘এক দুই তিন চার
আমরা সবাই সবার
এই যে বাঁধন ভালোবাসার’
‘ঘাত-প্রতিঘাত’ ছবির এ গানের শুরুতে যে ছোট্ট মেয়েটি গানটি ধরে সে আমাদের বাণিজ্যিক ছবির অন্যতম প্রধান শিশুশিল্পী। নব্বই দশকের জনপ্রিয় শিশুশিল্পীও বটে। তার নাম প্রিয়াঙ্কা। অনেক ছবিতে অভিনয় করেছে। নব্বই দশকে রাজত্ব করা প্রধান নায়ক-নায়িকাদের ছবিতে তাকে দেখা গেছে।
‘স্ত্রী হত্যা’ প্রিয়াঙ্কা বোবা থাকে। ছবিতে মা শাবানাকে যখন হুমায়ুন ফরীদি হত্যা করে সে ঘরের ভেতর থেকে বাবা জসিমকে ফোন করে ছটফট করতে থাকে। ‘ত্যাগ’ ছবিতে ইলিয়াস কাঞ্চন-চম্পার মেয়ের ভূমিকায় থাকে। বাবাকে শাসন করা তার কাজ। বড়বেলায় এসে প্রিয়াঙ্কা ‘অবুঝ বউ’ নামে একটি ছবিতে অভিনয় করেছে ফেরদৌসের স্ত্রীর ভূমিকায়। অভিনয় ভালো ছিল। শাবানা, জসিম, জাফর ইকবালের সাথে ‘লক্ষীর সংসার’, হুমায়ুন ফরীদি-র ‘লক্ষীর সংসার’ ছবিতে ছিল শাবানার মেয়ের ভূমিকায়। ‘অাণ্ঞ্জুমান’ ছবিতে অভিনয় করেছে শাবনাজের ছোটবেলার চরিত্রে। এভাবে নব্বই দশকের প্রায় সব নায়ক-নায়িকার ছোটবেলার চরিত্রে প্রিয়াঙ্কা অভিনয় করেছে। একবার শহীদুল ইসলাম খোকনের একটা ছবিতে খোকনসাহেব তাকে যে সিকোয়েন্সটিতে অভিনয় করতে বলেছিল সেখানে সে কান্না জুড়ে দেয়। খোকনসাহেব বিপাকে পড়ে তাকে বলল-‘মা তোমার দোহাই লাগে তুমি শুধু একটা শট দাও।’ তারপর কাজটা করেছে।
উপমা
নব্বই দশকীয় বাণিজ্যিক ছবির সুপরিচিত শিশুশিল্পী। অভিনেত্রী আর্জুমান্দ আরা বকুলের মেয়ে। উপমা ন্যাচারালি চমৎকার অভিনয় করত। তার ভয়েস ও লুকে একটা ইনোসেন্ট ব্যাপার ছিল। ডায়লগ ডেলিভারি দেয়ার সময় সুইট লাগত। তার উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে আছে ‘বিদ্রোহী আসামী, আমি এক অমানুষ, আমার প্রতিজ্ঞা, নিরন্তর, বাঙলা, চার সতীনের ঘর’ ইত্যাদি। ‘আমি এক অমানুষ’ ছবিতে ইলিয়াস কাঞ্চন-দিতি জুটির মেয়ে থাকে। দিতি অন্ধ হয়ে গেলে সে ফুল বিক্রি করত। এভাবে বাবাকে একদিন খুঁজে পায়। ‘বিদ্রোহী আসামী’ ছবিতে ইলিয়াস কাঞ্চনের ছোটবেলার অংশে বোনের ভূমিকায় ছিল। তিন ভাইবোনের খুব মিল। ‘আমার প্রতিজ্ঞা’ ছবিতে ছিল মৌসুমীর ছোটবেলার চরিত্রে। মা-বাবাকে বাঁচাতে রাজিব, নাসির খান-দের কাছে সাহায্য চাইতে গেলে তারা নেচে দেখাতে বলে। তাদের কথামতো নাচলেও সাহায্য না করে চাবুকপেটা করে। টাচি ছিল তার অভিনয়। ‘নিরন্তর’ ছবিতে শাবনূরের কিশোরী চরিত্রে ছিল। ম ম মোর্শেদ তাকে বিরক্ত করত। ‘বাঙলা’ ছবিতে ছিল শাবনূরের ননদ ও মাহফুজের বোন। মাহফুজের কাছে পড়া বুঝিয়ে নিত। হারমোনিয়াম দিয়ে গান শিখত ওস্তাদের কাছে। ‘চার সতীনের ঘর’ ছবিতেও ছিল শাবনূরের বোনের ভূমিকায়। নিম্নবিত্ত পরিবারে মেয়ের সংখ্যা বেশি থাকলে বাবা তার মেয়েদের সমাজের দিক থেকে বোঝা হিশেবে দেখে বাস্তবতার জন্য। এই বাস্তবতার একটা অংশ সেও ছিল ছবিটিতে। বড়বেলায় এসে এরকম আরো কিছু ছবি করলে তাকে পূর্ণাঙ্গ অভিনয়শিল্পী হিশেবে আরো কিছু ছবিতে দর্শক পেত পাশাপাশি তারও বলার মতো কাজের সংখ্যা বাড়ত।
সোহেল
‘চিরদিন এই দুনিয়ায় হয়েছে হায়
প্রেমেরই জয়’
‘আত্মবিশ্বাস’ ছবির জনপ্রিয় এ গানে স্টেজ পারফরম্যান্স করে শিশুশিল্পী সোহেল ও সীমা।
সোহেল ছেলে শিশুশিল্পীদের মধ্যে অত্যন্ত পরিচিত ছিল। আলমগীর, ইলিয়াস কাঞ্চন, মান্না, বাপ্পারাজ, রুবেল, সালমান শাহ তাদের ছোটবেলার চরিত্রে অনেক ছবিতে অভিনয় করেছে। ‘সুখের স্বর্গ’ ছবিতে সীমার বিপরীতে ছিল আলমগীরের ছোটবেলায়। সীমাকে স্থানীয় মাস্তানদের হাত থেকে বাঁচাতে তাকে ফাইট করতে দেখা যায়। সোহেলের বিপরীতে সীমাকেই বেশি দেখা যেত। ‘আম্মাজান’ ছবিতে মান্নার ছোটবেলায় থাকে। মা শবনমকে নির্যাতনের জন্য দায়ী দারাশিকোকে শাস্তি দেয়। ‘প্রেমগীত’ ছবিতে ওমর সানীর ছোটবেলার চরিত্রে থাকে বিপরীতে সীমা। ‘প্রতিশোধের আগুন’ ছবিতে ইলিয়াস কাঞ্চনের ছোটবেলাতে ছিল। ‘গ্যাং লিডার’ ছবিতে রানা হামিদের ছোটবেলায় সোহেলকে অ্যাকশন মুডে দেখা যায়। ‘আমার অন্তরে তুমি’ তার আরেকটি ছবি শিশুশিল্পীতে। অনেক ছবিতে শিশুশিল্পী ছিল।
সুমন
‘লাল লাল ঐ গালে একটা চুমু
লাল লাল ঐ ঠোঁটে একটা চুমু
একটা চুমু নরম ঠোঁটে
এমন মিষ্টিমুখ কার কপালে জোটে!’
‘প্রেমযুদ্ধ’ ছবির এই অসাধারণ গানে বাবা সালমান শাহ-র ছেলের চরিত্রে থাকে শিশুশিল্পী সুমন। গানে তার অভিনয় ন্যাচারাল ছিল। ‘অচল পয়সা’ ছবিতে ইলিয়াস কাঞ্চনের ছোটবেলার চরিত্রে ছিল। রাতিন তার সাথে দুষ্টুমি করলে সে সুন্দর একটা হাসি দেয়। ‘নরপিশাচ’ ছবিতে রুবেলের ছোটবেলায় থাকে। রুবেলকে ছোটবেলায় পেট্রোল পাম্পে আগুন লাগানোর দায়ে পুলিশে দেয়া হয় সেই ভূমিকাতে ছিল সুমন। তাকে খুব বেশি ছবিতে দেখা না গেলেও পরিচিত মুখ ছিল।
মাস্টার সুমন
এতটুকু ছেলে আর এক্সপ্রেশন দেয় বড়দের মতো। শিশুশিল্পী হিশেবে রাজ্জাক অামলে নামকরা ছিল। বিখ্যাত সুরকার সত্য সাহা-র ছেলে। ‘ছুটির ঘণ্টা’ তার সেরা কাজ। এ ছবির ‘একদিন ছুটি হবে’ গানে গীটার হাতে মাস্টার সুমনকে স্টাইলিশ লাগে। মা সুজাতাকে স্কুলের ফাংশনে যে গানটা গাইবে সেটা শুনিয়ে দেয়। সুজাতা মনোযোগ দিয়ে ছেলের গান শোনে। ছবির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ সুমন যখন স্কুলের বাথরুমে অাটকা পড়ে দপ্তরি রাজ্জাকের ভুলে। সে বাথরুমে যে কদিন থাকে মৃত্যুর অাগ পর্যন্ত নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করে। এ অংশটি ইউটিউবে ‘heart breaking part’ নামে পরিচিত। ছেলেটি দপ্তরীকে লক্ষ্য করে বাথরুমের দেয়ালে অনেক কথা লিখে রাখে। যেমন – ‘মা কাঁদছে, অামাকে অাটকে রেখেছ কেন?’। নিজে নিজে পণ্ডিতমশাই সেজে ক্লাসের মতো মজা করে। স্বপ্নের মধ্যে বেড়াতে গেলে দেখা যায় জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ তাকে তার শখ পূরণ করাচ্ছে জাদুবিদ্যায় আর সুমন গান করছে ‘আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী।’ গানে তার অভিনয় অনবদ্য। বাথরুমের ভেতর বেঁচে থাকার জন্য যা অবশিষ্ট থাকে তাই খায়। একসময় কলের পানিটুকু শেষ হয়ে গেলে সুমন নিথর হতে থাকে। জীবন বাঁচাতে শেষ পর্যন্ত খপ করে তেলাপোকা ধরেরে খাওয়ার জন্য। বড় মর্মান্তিক সে দৃশ্য। ‘পুরস্কার’ সিনেমায় বুলবুল অাহমেদের ছাত্র থাকে মাস্টার সুমন। খেলায় হেরে বন্ধুদের একজন যে অাগে নিয়মিত জিতত তার খুব অভিমান হয়। বুলবুল অাহমেদ বুঝিয়ে সুঝিয়ে দেন। তখন সুমন অাসে এগিয়ে। গান ধরে ‘হারজিৎ’ চিরদিন থাকবেই’ জীবনমুখী এ গানে তার অভিনয়ও জীবনমুখী। তার অভিব্যক্তিতে সেসব ফুটে ওঠে। ‘অশিক্ষিত’ সিনেমায় মূর্খ রহমত অালি (রাজ্জাক)কে নাম দস্তখত শেখানোর দায়িত্ব নেয় মাস্টার সুমন। রাজ্জাক গানে গানে জানায়-‘ও মাস্টার সাব, অামি নাম দস্তখত শিখতে চাই।’ উত্তরে সুমনও জানায়-‘ও রহমত ভাই, তোমায় নাম দস্তখত শেখাতে চাই।’ছাত্র-শিক্ষকের মধুর সম্পর্কটা জমে ওঠে।
মাস্টার শাকিল
‘মায়ের মতো আপন কেহ নাই
মা জননী নাই রে যাহার
ত্রিভুবনে তাহার কেহই নাই’
‘দিন যায় কথা থাকে’ ছবির কালজয়ী এ গানটি মাস্টার শাকিলের লিপে থাকে। ন্যাচারালি অভিনয় করে গেছে।
‘হারজিত চিরদিন থাকবেই
তবুও এগিয়ে যেতে হবে,
বাধা বিঘ্ন না পেরিয়ে
বড় হয়েছে কে কবে!’
‘পুরস্কার’ ছবির কালজয়ী এ গানে মাস্টার সুমনের পাশাপাশি মাস্টার শাকিলও অভিনয় করেছে।
মাস্টার টাপু
‘বিরোধ’ ছবিতে ছটু নামে যে ছেলেটি করুণ চোখে শাবানার মমতা চায় তাকে কী এত সহজে ভোলা যায়! টাপু বোম্বে থেকে আসা তবে আমাদের সিনেমায় তার অবস্থানটি পাকা ছিল অভিনয়ে। কম কাজ করলেও মনে রাখার মতো। টাপু-র কালজয়ী সেই গান ‘তোর আঁচলে মমতারই ছায়া’ দেখে সেই যে গ্রামের ক্লাবঘরে মায়েদের চোখে জল দেখেছিলাম সে জলের মূল্য অনেক।যখন সে বলে ‘মা গেছে কবে সে বাবাও নেই/ এখন বাসি ভাতও দেয় না রে মোর মুখে তুলে’ নিজের আবেগ তখন ঐ ছোট্ট ছটুর সাথে মিলে যায়। শাবানাকে মা ভেবে তার ছেলের জন্য শুভকামনা দেয় গানে গানে ‘যে তোর প্রাণেরই দুলাল/যেন বাঁচে কোটি সাল’। স্রেফ অসাধারণ। তারপর রাজেশ খান্নার সাথে টাপুর বন্ধুত্বও বেশ জমে ওঠে। ‘রাঙ্গা ভাবী’ সিনেমার কথা আরো মনে পড়ে।আলমগীর তাকে সহ্য করত না সৎ ভাই বলে। ওদিকে টাপু আবার শাবানাকে ছাড়া কিছু বোঝে না। ভাবীকে মা বলে তাই গানে গানে আসে তার মুখ থেকে ‘রাঙা ভাবী মা/ বাঁধন খুলো না।’ঐ সিকোয়েন্সটা খুব মনে পড়ে যখন শাবানা তার সন্তানের অাশায় যায় তাবিজ আনতে। টাপু সব ধরে ফেলে চালাক ছেলে বলে কথা! তাই শাবানাকে বলে ‘তুমি একটা বাচ্চা চাও, তাই না ভাবী মা?’ শাবানা বলে ‘তুই তো আমার বাচ্চা।’ তাদের এ বন্ধনের দৃশ্যগুলো অনবদ্য। আলমগীর নূতনকে পছন্দ করতে থাকলে শাবানার বিরহ বাড়ে। তাই আলমগীর-নূতনের পার্টিতে বিয়ের কথাবার্তা বলতে প্রস্তুতি নিলে টাপু সেখানে হাজির হয়।তারপর গায় এ ছবির নামকরা গান –
‘তোমাদের এই খুশির আসর গানে ভরেছে
আড়ালে এক অভাগিনীর অশ্রু ঝরেছে।’
মাইক হাতে টাপুর পুরো গানের অভিনয় চোখে লেগে থাকে।
মুন্না
‘একটাই কথা আছে বাংলাতে
মুখ আর বুক বলে একসাথে
সে হলো বন্ধু বন্ধু আমার’
‘বন্ধু আমার’ ছবির কালজয়ী এ গানের কিড ভার্সনে অভিনয় করেছে মাস্টার মুন্না।
‘আব্বু আমার বন্ধু আম্মু খেলার সাথী
একটি ঘরে জ্বলে যেন তিনটি সুখের বাতি’
‘দুই জীবন’ ছবিতে মিষ্টি এ গানটি যে শিশুশিল্পীর লিপে থাকে তার নামই মুন্না।
‘আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে
গীটার শিখব আন্টির কাছে
আহা কি মজা দারুণ মজা
বাজে গীটার বাজে
টুংটাং টুংটাং বাজে’
‘স্বামী-স্ত্রী’ ছবিতে শাবানার ছেলের ভূমিকায় থাকে মাস্টার মুন্না। দিতি তার আন্টি থাকে। গীটার শেখানোর আনন্দে নাচে আর গান ধরে। ন্যাচারাল অভিনয় করত। শাবানার উল্লেখযোগ্য ছবি ‘সান্ত্বনা’-তে তার ছেলের চরিত্রে ছিল। আরো ছবি করেছিল মুন্না।
মেহেদি
নায়ক মেহেদি ছোটবেলায় বেশকিছু ছবিতে শিশুশিল্পী ছিল। নায়কের ছোটবেলার চরিত্রের পাশাপাশি নায়কের ছেলের চরিত্রেও দেখা গেছে।
দিঘি
পুরো নাম প্রার্থনা ফাহরিন দিঘি। জন্ম ২০০৩ সালে। বাবা সুব্রত ও মা দোয়েল দুজনই বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের পরিচিত মুখ। সুব্রত-র ভালো কাজ অাছে বেশকিছু তেমনি দোয়েলও ছিল অসাধারণ অভিনেত্রী। সেলিব্রেটি তারকা দম্পতির মেয়ে বলে নয় দিঘি নিজেকে প্রমাণ করেছিল তার নিজের প্রতিভায়। গ্রামীণফোনের ময়না পাখির বিজ্ঞাপনটা তখন সবার মুখে মুখে ছিল। মডেল ফয়সালের সাথে ছোট্ট পুতুলের মতো সুন্দর মেয়ে দিঘি অাধো অাধো বোলে বলতে থাকে-‘জানো বাবা, অামাদের যে ময়না পাখিটা অাছে না সে অাজ অামার সাথে কথা বলেছে।’ বলতে বলতে শেষের দিকে ‘কেমন লাগে বলোতো বাবা!’ এ সংলাপটা খুব জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিল। লোকজন এত পছন্দ করেছিল বিজ্ঞাপনটা যে রিংটোন, ওয়েলকাম টিউন করে রাখত। এমনকি পত্রিকায় দেখেছিলাম কোনো কোনো বাচ্চা তাদের বাবাকে এভাবে ফোন করে ময়না পাখির গল্প শোনাত। দিঘি প্রথম কাজেই হাইপ তুলেছিল। একেবারে জড়তা ছাড়া সাবলীল সুন্দর অভিনয় ছিল। ‘এলিট মেহেদি’-র বিজ্ঞাপনেও দেখা গিয়েছিল দিঘিকে। দিঘি চলচ্চিত্রে অাসে ২০০৬ সালে। প্রথম ছবিই ছিল চ্যালেন্জিং তাও অাবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত গল্প ‘কাবুলিওয়ালা’ থেকে। এ গল্পের মিনি চরিত্রে অভিনয় করে তাক লাগিয়ে দেয়। দিঘির সাথে নায়ক মান্নার বাবা-মেয়ের মতো মমতামাখা সম্পর্ক ছিল ছবির প্রাণ। প্রথম ছবিতেই পায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এরপর ‘চাচ্চু’ ছবিতে হাইপ তোলে দিঘি। এ ছবিটি সুপারহিট হয়েছিল ডিপজলের সাথে রসায়নে। অসাধারণ অভিনয় করেছিল। দিঘির অন্যতম সেরা ছবি ছিল ‘অবুঝ শিশু।’ এ ছবিতে দিঘিকে কারাদণ্ড দেয়া হয় কিশোর অপরাধের জন্য। জেলখানায় গান গায় দিঘি-
‘আমি ছোট্ট একটা মেয়ে
এত ছোট মেয়ে কি Ffর জেল হাজতে যায়!’
মান্না-মৌসুমীর মেয়ে ছিল ছবিতে। অাদালতের দৃশ্যটা ছিল টাচি। ছবিটা সিনেমাহলে দেখার সময় তখন অামার বয়সী ছেলেদের কাঁদতে দেখেছিলাম। অবাক হয়ে ভাবতাম দিঘির অভিনয়শক্তি নিয়ে। ‘এক টাকার বউ’ ছবিতেও ফাটিয়ে দিয়েছিল। শাবনূর-শাকিব খানের মেয়ে ছিল ছবিতে। এ ছবিতে রাজ্জাকের সাথে দিঘির একটা গান ছিল এটা বেশ মজার গান। দিঘির পাকামো দেখে অবাক হতে হয়। ‘দাদী মা’ ছবিতেও দারুণ অভিনয় তার। ইলিয়াস কাঞ্চনের সাথে বাবা-মেয়ের ব্যতিক্রমী রসায়ন নিয়ে ‘বাবা অামার বাবা’ অার একটা অসাধারণ ছবি দিঘির। ‘সাজঘর, স্বামীভাগ্য, দ্য স্পিড, রিকশাওয়ালার ছেলে’ ছবিগুলো তার অারো কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ।
লেখাটি পড়তে পড়তে সুপরিচিত এসব শিশুশিল্পীর স্মৃতিতে নস্টালজিক হয়ে যাবেন পাঠক এটুকু অনায়াসে বলা যায়।