Select Page

হত্যা রহস্য ও কল্পবিজ্ঞানের মিশেলে বাংলা ওয়েব সিরিজে অনন্য সংযোজন ‘কালপুরুষ’

হত্যা রহস্য ও কল্পবিজ্ঞানের মিশেলে বাংলা ওয়েব সিরিজে অনন্য সংযোজন ‘কালপুরুষ’

 [স্পয়লার অ্যালার্ট: বিশ্লেষণের খাতিরে রিভিউতে গল্পের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। সিরিজটি দেখে না থাকলে রিভিউটা এড়িয়ে যেতে পারেন। ধন্যবাদ]

পুলিশ অফিসার জাহাঙ্গীর গাড়িতে করে ঘরে ফিরছেন। হাতে ছোট্ট কাঁচের বোতল, সদ্য শেষ করেছেন একটা খুনের এসাইনমেন্ট; অথচ বিশেষ উচ্ছ্বসিত নন তিনি। এসআই মিরাজ জানেন না, এই সময়ের লুপহোলে তিনি পড়ে গিয়ে যে হাবুডুবু খাচ্ছেন তা শেষমেশ কোথায় গিয়ে ঠেকবে। শেহজাদ ইতোমধ্যে পরিচয় দিয়ে দিয়েছেন নিজের রহস্যময় ক্যারেক্টারের। আর এই সময়ের ভেতর দর্শক এক্সপেরিয়েন্স করে ফেলেছে বাংলাদেশি ওয়েব সিরিজের মার্ডার মিস্ট্রি থেকে সায়েন্স ফিকশনে ট্রাঞ্জিশনের এক মধুর মুহূর্তের। সম্প্রতি ‘চরকি’ তে মুক্তি পাওয়া ওয়েব সিরিজ ‘কালপুরুষ’ এর শেষভাগের কথা বলছি, মার্ডার মিস্ট্রি আর সাইফাইয়ের মিশেলে যা মুক্তি পাওয়া মাত্রই দর্শকের প্রশংসা পাচ্ছে।

‘ফিল্ম সিন্ডিকেট’-এর প্রযোজনায় ওয়েব সিরিজ ‘কালপুরুষ’ এর লেখক ও পরিচালক সালজার রহমান। সালজারের প্রথম এই ওয়েব সিরিজটির গল্প মূলতঃ এক ডিসেম্বরে ধানমন্ডি লেক এ রাতের বেলা ঘটে যাওয়া হত্যাকান্ডে নিহত ফারিয়ার খুনী কে সেটা বের করাকে উপজীব্য করেই। এই মার্ডার মিস্ট্রি সলভ করতে গিয়ে সামনে আসে এক ফিটনেসবিহীন পুলিশ অফিসারের নিজের দাম্পত্য জীবনের গল্প, সেখানে ধর্মীয় বিশ্বাস-অবিশ্বাস নিয়ে বোঝাপড়া, স্পিরিচুয়ালিটির পারস্পেক্টিভ, একটা থানায় অফিসারদের মধ্যকার নানা সমীকরণ থেকে এক পর্যায়ে গল্প মোড় নিতে থাকে টাইম ট্রাভেলের দিকে। এই টাইম ট্রাভেলে গিয়ে উদঘাটিত হয় মার্ডারের কারণ এবং মার্ডারারের পরিচয়। মার্ডার মিস্ট্রি থেকে সাইফাই হয়ে উঠা এই সিরিজটির সাতটি এপিসোড। গড়ে ২৪-২৫ মিনিট ডিউরেশনের এই এপিসোডগুলোয় আপনি নিছক একটা খুনকে ঘিরে তৈরি হওয়া ঘটনাবলীই দেখবেন না, সালজার বেশ মুনশিয়ানার সাথে আমাদের নানা শ্রেণীপেশার মানুষের জীবনের ফিলোসফি আর সেসবের সোসাইটিতে ফাংশন করাটাও ধরেছেন সমান্তরালে। ফলে গল্পটা হয়ে উঠে উপভোগ্য, চিন্তার খোরাক জাগানোরই মতো।

সিরিজ শুরুর ইন্ট্রো ভিডিওটা সুন্দর। ওয়েব সিরিজের ইন্ট্রো ভিডিওতে ভালো ভিএফএক্স করাটাই ক্রেডিট না, সাথে ক্রেডিবিলিটিও থাকা লাগে। ‘কালপুরুষ’ এ সেটা আছে। ‘কালপুরুষ’ শব্দের অর্থ নক্ষত্রপুঞ্জবিশেষ। ইন্ট্রো ভিডিওতেও নক্ষত্রের মুভমেন্ট দেখানো হচ্ছিলো। সৌরজগতের সাথে সময়ের একটা সম্পর্ক আছে৷ রিলেটিভ থিওরির ব্যাপার আছে। সেদিক থেকেও জিনিসটা ইন্টারেস্টিং। ইন্ট্রো ভিডিওটা ভালো কিন্তু ইন্ট্রো ভিডিওতে ক্রেডিট নেইমের ডিউরেশন কম হয়ে গেছে। ক্রেডিট নেইমগুলো ভালোভাবে পড়ার আগেই শেষ হয়ে যাচ্ছিলো যেন।

শুরু থেকেই ঘড়ির কাঁটার একটা টিকটিক আওয়াজ গোটা সিরিজেই টেনশন ক্রিয়েট আর এক্সাইটমেন্ট তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। গল্প একটা ফ্লো-তে আগাচ্ছে, কনভারসেশন তৈরি হচ্ছে ঠিক সে জায়গায় একটা টুইস্ট আসে আর ঘড়ির কাঁটার শব্দ এসে কানে হাজির হয়। এই আসা-যাওয়াটা ‘কালপুরুষ’ সিরিজটাকেই বড় অংশে বিল্ড আপ হতে সাহায্য করেছে। সিরিজটা ট্রাইম ট্রাভেল নিয়ে। আছে সময়ের আপেক্ষিকতার আলাপও। মূলতঃ Time is the protagonist of this series. তাই এপিসোডের নেইমগুলার সাথেও সময়ের মারপ্যাঁচ আনা, থ্রিলার  ভাইব রাখা ইত্যাদি খুব সাহায্য করেছে এই প্রোডাকশনটাকে জনরার সাথে সম্পর্ক প্রেজেন্ট করতে। নতুন নির্মাতারা সচরাচর বড় ধরাটা খান স্টার্টিং থেকে গল্পের ভেতরে এন্ট্রি নিতে। সালজার সে কাজটা যথাযথভাবে করতে পেরেছেন। গল্পতে খুব দ্রুত ঢুকে গেছেন। একেবারে প্রথম সিন থেকেই। কিন্তু  সাবপ্লট আর সাবপ্লটের দীর্ঘ ধারাবাহিকতার কারণে একসময় মূল প্লটটুকু হালকা হয়ে পড়ে। তারপর গল্প আর আগায় না। এর ফলে শেষটা ঠিক কী করতে চেয়েছেন তারা তা স্পষ্ট হয়ে উঠে না।

টাইম ট্রাভেলের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে একসময় গল্পটা হয়ে উঠে মার্ডার মিস্ট্রি থেকে টাইম ট্রাভেলিংয়ের এক সায়েন্স ফিকশন। কিন্তু তা করতে গিয়েও এই সিরিজটা স্মুথ এন্ডিংয়ের দিকে যেতে পারে নি। কিছু কিছু ধোঁয়াশা রেখেই শেষ হয় সিরিজটা। ফলে আমরা জানতে পারি না জাহাঙ্গীরের সাথে শেহজাদ শেষ মুহূর্তে কী করেছেন। আমরা জানতে পারি না এসআই মিরাজ আর শেহজাদের আসল দেখাটা কি প্রেজেন্ট এ হয়েছে নাকি পাস্টে। যেটা হয়ে গেছে সেটাকে চাইলেও পরিবর্তন করা যাবে না বলে মিরাজ আটকা পড়েন, কিন্তু পরক্ষণেই তিনি মুক্ত হয়ে লাশের কাছে ছুটে যান; কোথায় মানুষ টাইম ট্রাভেল ইচ্ছেমতো করতে পারবে, কোথায় পারবে না এই সীমারেখা পরিচালক পরিষ্কার করতে পারেননি। জাহাঙ্গীরের সাথে শেহজাদ কি এমন করেন যে গোটা গল্পই পালটে যায় সেটাও ক্লিয়ার না। তারচেয়েও বড় কথা হলো সময় এবং স্থান দু’টো ফ্যাক্টরই যে এই টাইম ট্রাভেলিংয়ে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ সে দিকটা পুরো সিরিজের ডিসকাশনেই সে অর্থে উপস্থিত নেই। তারপরেও বেনেফিট অব ডাউট দেওয়া চলে পরিচালককে। কেননা, সায়েন্স ফিকশনে সবকিছুই গল্পের মতন। বিশ্বাসযোগ্য এবং দর্শনযোগ্য।

স্টোরিলাইন ও স্ক্রিপ্টের উপর আরেকটু জোর দেওয়া প্রয়োজন ছিলো মনে হয়েছে।  শুরুতেই ইয়াবাখোরদের উপর যে আরোপিত ব্লেইমের কনভারসেশন ওটা বিরক্তিখোর। ফারিয়ার বান্ধবী, সিকিউরিটি গার্ড, মসজিদের ইমামের একসাথে প্যারালাল জিজ্ঞাসাবাদের সিনটা দারুণ৷ সেখানটায় ইমামের ‘শয়তান’ নিয়ে যে কনভারসেশন, কিংবা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা সাসপেক্টদের নিজেদের কথার ভেতর থেকেই সন্দেহজনক কথাবার্তা বের করে আনা এই আইডিয়াটা এত ফাস্ট স্ক্রিনপ্লেতে মিশেল ঘটিয়ে পরিবেশন করার জন্য বাহবা পেতেই পারেন স্ক্রিপ্ট রাইটার। ঘরে ঢুকেই নোভার সাথে মিরাজের কথোপকথনটাও দারুণ৷ যেখানে রুই মাছ আর হত্যামামলা একত্রে আলোচনা হচ্ছিলো। কিন্তু মিরাজের ফোন কলে বা ঠিকানা দেওয়ার কথা বলে কেটে দেয়া কিংবা আবার ফোন নাম্বার কোথায় পেলেন এ ধরনের প্রশ্ন অবাঞ্ছিত। ভাসা ভাসা আইন বুঝানো আর সোশ্যাল সায়েন্সের ডিসকাশন ঘুরেফিরে এসেছে গোটা কাজে। তাই প্রাণবন্তও লেগেছে বেশ। মিরাজের জিজ্ঞাবাদে ফারিয়ার বান্ধবী ফারিয়া প্রায়ই লেকে যেতো বললেও কিসের বেসিসে মিরাজ পরবর্তীতে ফারিয়া লেকে তেমন যেতো না বলেছেন কর্মকর্তাকে সেটা ক্লিয়ার নয়। রেফায়েতের বউয়ের “আই এম এ হোম ম্যানেজার” বলাটা সুন্দর। স্ক্রিপ্টের পাঞ্চলাইনগুলো ভালো। কিন্তু কোনো পুলিশ অফিসারের তদন্তভার পাওয়া, তারপর খেই হারিয়ে ফেলা, তাকে সরিয়ে দেওয়া তদন্তের দায়িত্ব থেকে এসব খুবই কমন গল্প। ‘কালপুরুষ’ এই পুরনো ট্রিক দিয়ে গল্প জমানোর চেষ্টা না করলেও ওয়েব সিরিজটা ভালোই এগোচ্ছিলো।

এস আই মিরাজ এর চরিত্রে অভিনয় করেছেন এফ এস নাঈম। এই সিরিজটির ট্রেলার রিলিজের পর থেকেই নাইমের সিরিজের জন্য মাত্রাতিরিক্ত ওজন বাড়ানোর ঘটনা নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছিলো। সিরিজ দেখার পর সে আলোচনা যে আরো জোরালো হচ্ছে তাতে সন্দেহ নেই। তবে এই শরীরের ওজন বাড়ানোর চেয়ে বেশি আলোচনার দাবীদার মিরাজ চরিত্রের অভিনয়। নাঈম এই চরিত্রটার এত গভীরে ঢুকে পড়েছিলেন যে দর্শক অনেকটাই নাঈমের সাথেই পথ হেঁটেছেন গল্পে। লেকের ধারে দারোয়ানকে খুনের দৃশ্যের বাইরে বাকি পুরোটা সময়েই আপনি নাঈমের অভিনয় উপভোগ করবেন। নাঈমকে একই সাথে একজন পুলিশ অফিসার যার সহকর্মীরা অনেকটাই তার প্রতিকূলে, একজন হাজব্যান্ড যাদের দাম্পত্য জীবনে ইনফার্টিলিটির সমস্যা আছে আর কখনো একজন উদ্ভ্রান্ত হিসেবে হাজির হতে হয়েছে এই মিরাজ চরিত্রে। তিনি সবখানেই ব্যালেন্সটা রেখেছেন ঠিকঠাক।

‘কালপুরুষ’ এ শেহজাদ চৌধুরী চরিত্রে অভিনয় করেছেন চঞ্চল চৌধুরী। চঞ্চল আমাদের দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন অভিনয়ের জগতে। তবে ‘কালপুরুষ’-এ চঞ্চল চৌধুরী এক ভিন্ন মাত্রার অভিনয় নিয়ে হাজির হয়েছেন। চঞ্চলের পরিচিত আর পুরনো এক্সপ্রেশন নেই, ডায়ালগ ডেলিভারি নেই; এক মধ্যবয়স্ক ধূর্ত হিসেবে তিনি হাজির হয়েছেন পর্দায়। তার হেয়ার-কাটিং আর ছোট ছোট দাঁড়ি তার চরিত্রকে কিছুটা রহস্যময়ও বানিয়েছে। শেহজাদ একদিকে ধূর্ত, আবার পলিটিক্যালি কারেক্ট থাকতে চান, কথার মারপ্যাঁচে ফেলে মানুষকে ম্যানিপুলেট করতে পারেন। এই চরিত্রটি খুবই ইউনিক। একই ধাঁচের অভিনয় দেখতে দেখতে দর্শক চঞ্চলের কাছ থেকে এমন কিছু দেখারই অপেক্ষায় ছিলেন। সালজার রহমান চঞ্চল চৌধুরীকে নতুন আঙ্গিকে হাজির করায় বাহবা পেতে পারেন।

এস আই জাহাঙ্গীর চরিত্রটা ‘কালপুরুষ’ এ Stealing the show চরিত্র। জাহাঙ্গীর কথা প্রসঙ্গে তার অধীনস্থ শফিককে জিজ্ঞেস করেন “মানুষ সবচেয়ে বেশি কি চায়?” তারপর নিজেই বলেন “ইমর্টালিটি।” জাহাঙ্গীর চরিত্রটা ইমতিয়াজ বর্ষণকে ইমর্টালিটি না দিলেও এই সিরিজকে ইমর্টালিটি দিয়েছে। বর্ষণের স্ক্রিন প্রেজেন্স খুব বেশি না। কিন্তু যেটুকু সময়ই তিনি ছিলেন, একাই শোকে চালিয়ে নিয়ে গেছেন। একটা ক্ষ্যাপাটে স্বভাবের পুলিশ অফিসার হিসেবে তিনি হাজির হয়েছেন এই সিরিজে। বর্ষণের অভিনয়ের বড় ফ্যাক্ট হচ্ছে তিনি খুবই ফাস্ট এক্সপ্রেশন দিতে পারেন। চটুল ডায়ালগ ডেলিভারি, মুহূর্তের ভেতরেই চোখের অভিব্যক্তি পালটে ফেলতে পারেন। এই সিরিজে বড় বড় সব অভিনেতার ভেতরেও বর্ষণের বিশেষত্ব দর্শক মাত্রই খেয়াল করবেন। গল্প হিসেবে ‘কালপুরুষ’ বেশ স্লো। কিন্তু বর্ষণ ফাস্ট। তার এপেয়ারেন্সের ডিউরেশনটাও তাই খুবই ফাস্ট যাচ্ছিলো। বর্ষণের কৃতিত্ব, তিনি গোটা স্ক্রিন প্রেজেন্স এ আর কাউকে তাকে ছাড়িয়ে যেতে দেননি। পর্দায় এমন অভিনয়ের প্রতিযোগিতা দর্শককে তৃপ্তি দেয়।

‘কালপুরুষ’ এর আরেকটা চরিত্রের কথা বলতেই হয়।  নোভা চরিত্রে তানজিকা আমিনের কথা। নোভার বেশ সুন্দরী। একটা সন্তানের জন্য যিনি চরম আকাঙ্ক্ষায় আছেন। একই সাথে মডারেট মুসলিম মেয়ে যে নামাজ পড়ে কদাচিৎ। নোভা স্মার্ট মেয়ে, কিন্তু ঘরেই যার পৃথিবী, একবিংশ শতাব্দীর career enthusiast empowerment এর যে presentation আমাদের সামনে হাজির করা হয় নোভা সেদিকে যান নাই। তার জীবন নিয়ে পরিমিতিবোধ আছে। আবার আছে ধর্মে অগাধ বিশ্বাস। তার যেটুকু ভালো সবটাই তিনি দিয়ে দেন তার হাজব্যান্ড মিরাজের কল্যাণার্থে। মার্ডার মিস্ট্রি থেকে সাইফাইয়ে ডেভেলপ করা একটা গল্পে বারবার যখন খুন আর ভায়োলেন্স এর কথাবার্তাই হচ্ছে নোভা তখন স্বস্তির পরশ নিয়ে আসেন স্ক্রিনে। ফারিয়ার গর্ভের মৃত সন্তানের জন্য যার প্রাণ কাঁদে। তানজিকা আমিনকে  বহুদিন পর দর্শক কাছে পেলেন।

‘কালপুরুষ’ এ জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় এর ক্যারেক্টার বিল্ড আপ হয়নি। ফারিয়া চরিত্রে প্রিয়ন্তী উর্বি স্বল্প সময়েও ভালো করেছেন। কাস্টিং ডিরেক্টর তানিয়া রহমানকে অনারেবল মেনশন দিতেই হয়।

‘কালপুরুষ’ এর প্রথম সেকেন্ড থেকেই একটা থ্রিলার ভাইব পাওয়া যাচ্ছিলো সাউন্ড আর মিউজিকের মিশেলে। ঘড়ির কাঁটার সাউন্ড কে ক্যারেক্টার বিল্ড আপের জন্য খুবই আকর্ষণীয়ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। লেকে নৌকা চালানোর ফলির সাউন্ড, নিশ্বাসের শব্দ, ডায়ালগের বোল্ড সাউন্ড এসবকিছু মিলিয়ে ঝরঝরে সাউন্ড দেখা যাবে ‘কালপুরুষ’ এ। তবে কোথাও কোথাও ইকো আসে নাই। ধানমন্ডি লেকের এমবিয়েন্স আরো বেটার হতে পারতো। মিরাজের সংবাদ সম্মেলন আরো নয়েজি হওয়া দরকার ছিলো। এ কয়েকটা ব্যাপার বাদ দিলে কাজটা খুঁতহীনই বলা চলে। সাউন্ড ডিজাইনার আদীপ সিং মানকি র কৃতিত্ব। ‘কালপুরুষ’ মার্ডার মিস্ট্রি হলেও এখানে ঝাঁঝালো কোনো মিউজিক ব্যবহার করা হয় নাই। একটা কমন রিদমের মিউজিক গোটা সিরিজজুড়েই দেখা গেছে। মিউজিকের সাথে ডায়ালগের ভলিউমের ভারসাম্য সিরিজটাকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে। এলিটা করিমের কন্ঠে ‘মহাকাল’, অর্ণবের কন্ঠে ‘বেবাক বেবাগী’ আর দ্য ওয়াটসন ব্রাদার্সের ‘আমার নতুন আমি’ এই তিনটি গানই সিরিজের পারফেক্ট মুহুর্তেই প্লেব্যাকে এসেছে।

টেকনিক্যাল দিক থেকে ‘কালপুরুষ’ নিঃসন্দেহে এখন অবধি সেরা বাংলাদেশি ওয়েব সিরিজ। বরকত হোসেন পলাশের ফটোগ্রাফিক ডিরেকশনে এই সিরিজের ক্যামেরাই যেন কথা বলেছে কখনো প্যানশট এ, কখনো হ্যান্ডহেল্ড এ। প্রশংসনীয় ফ্রেম সেন্স পলাশের। ক্লোজ শটগুলা সুন্দর। মিরাজের হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে উপরে উঠা, টংয়ের সামনে কথা বলা ইত্যাদি। শেহজাদের বাড়িতে ক্যামেরার কে স্টিল এ রেখে আস্তে আস্তে চারপাশে ঘোরানো, থানার লকাপের মাঝখানে গ্রিল রেখে ফ্রেম মিরাজ আর শেহজাদের ফ্রেম ধরা, মর্গে শেহজাদের ক্রুর হাসির ওই শট, ধানমন্ডি লেকের ড্রোনশট, সবকিছু মিলিয়ে ‘কালপুরুষ’ যেন ক্যামেরার এক মনোরম উপস্থাপনা। জিজ্ঞাসাবাদের সিনে তিনটা ভিন্ন পার্সনের প্যারালালি শটগুলা কেটে কেটে বসানোটা দারুণ ছিলো। ফ্রেম ধানমন্ডি লেক আর আশেপাশের শ্যুটিংয়ের এত জোস ফ্রেম। টাইপোগ্রাফিতে কয়েক জায়গায় ভূল দেখা গেছে। সাবটাইটেলেও কমার পর স্পেস মিসিং।

‘কালপুরুষ’ এর লাইটিং আর কালার নিয়ে নতুন কিছু এক্সপেরিমেন্ট চোখ পড়েছে। শীতের রাতের কুয়াশা বুঝাতে ধানমন্ডি লেকে যে লাইট এর কাজ সেটা সুন্দর। থানার ভেতরে ডার্কিশ গ্রিটি টোনে ফ্রেমগুলো নেওয়া হয়েছে সেসব সুন্দর। মিরাজ-নোভার ঘরের দেয়ালের কালারের সাথে মিলিয়ে যে লাইটের রেফারেন্স টানা হয়েছে তার কথাও বলতে হয়। শেহজাদের ওই ঘর বা ল্যাবরেটরির কথা তো বলতেই হয়।

মেকাপে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়কে ঠিকঠাক লাগে নি। সাথে ফারিয়া তথা প্রিয়ন্তী উর্বির গলাকাটার সাথে রক্তের যে দাগ মনে হচ্ছে ওটা পানির ছিটা। এর বাইরে বাকিদের মেকাপ আর ইদিলা ফরিদ তুরিনের কস্টিউম ডিজাইন সিরিজকে আরো soothing করতে সাহায্য করেছে। আর মেকআপ আর্টিস্ট ছিলেন রুবামা ফাইরুজ এবং প্রস্থেটিক মেকআপ করেছেন স্বর্ণা ভৌমিক।

ওয়েব সিরিজটি ৭টি এপিসোডের। কিন্তু এপিসোড গুলোর ডিউরেশন সে অর্থে বড় নয়। বর্তমানে ২০-২২ মিনিট ডিউরেশন দিয়ে ওয়েব সিরিজ পুরো পৃথিবীতেই দেখা যায় না। এ ধরণের ছোট ছোট এপিসোড দিয়ে সিরিজের চেয়েও ওয়েব ফিল্ম বানানো বেটার কিনা সে প্রশ্নও সামনে আসে। ওয়েব সিরিজে মিরাজের ধানমন্ডি লেকে পথচারীকে ‘মাস্টারবেশন’ এর মরাল পুলিশিং, জোর করে হাসানোর চেষ্টা এ ব্যাপারগুলো অপ্রয়োজনীয় লেগেছে। স্ক্রিনপ্লেতে ধানমন্ডি থানা ভিজ্যুয়ালি আকাশনগর থানা হলো কীভাবে এ ব্যাপারটাও খোলাসা হয় না। সুন্দর ব্যাপার হচ্ছে ইউজুয়ালি আমাদের মার্ডার মিস্ট্রিগুলায় বারবার তদন্ত কর্মকর্তাকে স্পটে দেখা যায় না। মার্ডার স্পটকে ঘিরেই গল্প তৈরি করাটা কমই দেখা যায়। এখানে গেছে। আর তাতেই ‘কালপুরুষ’ হয় উঠেছে আরো বেশি দর্শক ওরিয়েন্টেড। এক দৃশ্য থেকে আরেক দৃশ্যে যাওয়ার সময় অযাচিত জাম্পকাট নেই। এপিসোডগুলোতেও গল্পের ধারাবাহিকতা রক্ষা করার টেন্ডেন্সি দেখা গেছে। সরাসরি আগের এপিসোডের সাথে রেলিভেন্সি রেখেই গল্পকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন সালজার রহমান। তবে এর ভেতরেও খুব বেসিক কিছু গলদ চোখে পড়েই। অতিরিক্ত মারধরের কারণে শেহজাদকে যদি হসপিটালেই ভর্তি করানো হয় তবে সে রাতে বের হওয়ার সময় এত স্বাভাবিকভাবে কি করে বের হচ্ছে মিরাজের সাথে সে প্রশ্ন আসে। জাহাঙ্গীরের ট্রেন কোনদিক দিয়ে আসবে তার জন্য ২০টাকার বাজির দৃশ্যটা অহেতুক যখন ট্রেন এর সাউন্ড অলরেডি পাওয়াই যাচ্ছে।

এমনসব ছোটখাটো ত্রুটি থাকার পরেও ‘কালপুরুষ’ একটা উল্লেখযোগ্য ওয়েব সিরিজ। টাইম ট্রাভেল নিয়ে ‘ডার্ক’ কিংবা ‘১৮৯৯’ এ কাজগুলোকে সামনে রাখা হলে ‘কালপুরুষ’কেও তেমনই এক জনরায় ফেলতে হবে। সময়ের রেলিভেন্সি এবং সময়কে ঘিরেই যে ঘটনার আবর্তন সেটা পরিচালক খুবই দারুণভাবে তুলে ধরেছেন। যদিও অন্টোলজিক্যাল টাইম ট্রাভেলের সাথে প্রেক্টিক্যালি টাইম ট্রাভেল প্যারালালি দেখাতে গিয়ে শেষমেশ খেইই হারাতে হয়েছে কিছুটা, তবুও আর সবদিক বিবেচনায় ‘কালপুরুষ’ ওয়েব সিরিজ বাংলাদেশি ওয়েব সিরিজে এক অনন্য সংযোজন বলা যায়।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

সাইদ খান সাগর

সিনেমাকর্মী

মন্তব্য করুন