হাওয়া: পাপ ছাড়ে না বাপকেও!
হাওয়া; পরিচালক: মেজবাউর রহমান সুমন; রচয়িতা: মেজবাউর রহমান সুমন; শ্রেষ্ঠাংশে: চঞ্চল চৌধুরী, নাজিফা তুষি, শরিফুল ইসলাম রাজ, সুমন আনোয়ার, রিজভী রিজু, নাসির উদ্দিন খান প্রমুখ। ধরন: থ্রিলার; মিউজিক: রাশেদ শরীফ শোয়েব; ব্যাপ্তিকাল: প্রায় ১৩০ মিনিট; দেশ: বাংলাদেশ; ভাষা: বাংলা; রেটিং: ৮/১০
ইতিপূর্বে ফিল্মটি নিয়ে বহু আলোচনা-সমালোচনা হয়ে গিয়েছে। তাই সবার মতো করে নয় নিজের মতো করেই নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশের ক্ষুদ্র-প্রয়াস এই লেখা।
সবার আগে বলে নিচ্ছি যারা ১৮ বছরের নিচে কিংবা রগরগে কথাবার্তা শুনতে অভ্যস্ত নন কিংবা যারা বোঝেন না কোনটা প্রয়োজনের তাগিদ কোনটা অপ্রয়োজনের তাগিদ! তারা অনুগ্রহ করে এই ফিল্মটি দেখবেন না, এমনকি আমার লেখাটিও পড়বেন না। অনুগ্রহ করে এতো সতর্কতার পরেও ফিল্মটি দেখে ‘লা হাওলা লা কুয়াতা’ বিভিন্ন জায়গায় লিখে বেড়াবেন না।
তো যাই হোক হাবিজাবি ফেলে ফিল্মে ফিরে যাওয়া যাক। এ ধরনের ফিল্মের সাথে আমাদের সম্পর্ক কম, মানে পুরাণশাস্ত্র (মিথলজি) ধারণার ফিল্ম নেই বললেই চলে। এটা আমাদের ইন্ডাস্ট্রির ভালো কিছু হতে গিয়েও কেনো জানি মনে হলো কমতি কমতি রয়ে গেলো। এর কারণ আছে বৈকি, তবে আগে ভালো দিকগুলোর দিকেই যাওয়া যাক।
পরিচালনা ও বাদবাকি: যেহেতু সিনেমাটি সমুদ্র কেন্দ্রীয় সেহেতু আগেই ধারণা করা যায় এর মেকিং কতোটা কষ্টকর ছিলো। আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে ‘সুমন’ সাহেব প্রতিটা চরিত্র থেকে নিংড়ে সকলের সেরাটা বের করে এনেছেন। হাওয়া ফিল্মের আরো অনেক কিছু নিয়ে হয়তো কথা বলা যাবে কিন্তু সকলের অভিনয় নিয়ে আসলে তেমন কিছুর বলারই নেই। এছাড়া অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফি বোনাসের উপরে বোনাস মনে হবার মতো।
তবে ভাই আর যাই বলেন আমি এমন অসাধারণ ফ্রেমিং লাস্ট কোন সিনেমায় দেখেছি মনে পড়ছে না। প্রতিটা শটের ফ্রেমিং অসাধারণ লেগেছে, এ ছাড়া হ্যান্ডহেল্ড শটগুলোও দৃষ্টিনন্দন ছিলো। আমি হলফ করে বলতে পারি প্রতিটা ফ্রেমের জন্য সিনেমাটোগ্রাফি টিম ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে ছিলো। অন্য দিকে পানির গভীরে যে শটগুলো দেখানো হয়েছে বিশেষ করে নোঙ্গরের শট দেখে আমি অভিভূত, এ ধরনের শট হলিউড মুভি ছাড়া দেখা যায় না সচরাচর।
কিন্তু এতো কিছুর ভিড়ে আহামরি কোনো বিজিএম (ব্যাক-গ্রাউন্ড-মিউজিক) পেলাম না, যা আসলে দুধের মাঝে একফোটা চুনের মতো। ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর আরো ভালো হতেই পারতো। তবে লাস্ট এতোটুকুই বলবো এই ফিল্মের কালার গ্রেডিং, ফ্রেমিং, সিনেমাটোগ্রাফি, মেক-ওভার, পানির রং, বড় বড় ঢেউয়ের শট ইত্যাদি নিয়ে আলাদা আলাদাভাবে দু-কলম লিখে ফেলা সম্ভব। এতো কিছু ভাবার পরেও মনে হচ্ছিলো বিশাল সমুদ্রের আরো কিছু ল্যান্ডস্কেপ শট দেখতে পেলে একদম জমে ক্ষীর হয়ে যেতো।
অভিনয় সংক্ষেপ:
🔹চান মাঝি (চঞ্চল চৌধুরী)
লোকটাকে ব্যক্তিগতভাবে বেশ পছন্দ আমার। উনার ফেসবুক প্রোফাইল আমি নিয়মিত ভিজিট করি উনার সাবলীলতার জন্য। আসলে উনার তুলনা উনি নিজেই। এই ফিল্মের উনার চরিত্র বলতে গেলো চকলেটের মতোন যতোই সময় গেলো, চকলেট গলতে গলতে স্বাদ বাড়ালো। খুব পরিমিত হারে আস্তে আস্তে নিজের চরিত্রে বিল্ড-আপ করেছেন চঞ্চল চৌধুরী। যদিও এখানে পরিচালকের বেশ অবদান থাকার কথা, আবার অন্য দিকে সে জাত শিল্পী। মানে আপনি ধরতেই পারবেন না ভিলেন চাঁন মাঝিকে দেখছেন নাকি হিরো চাঁন মাঝিকে দেখছেন। এটা দারুণ ম্যাজিকের মতো লাগলো। এজন্য প্রথমে বলে নিলাম উনার ক্যারেক্টর খুব আস্তে আস্তে সিনেমায় জানান দেয় উনার স্ক্রিণটাইম খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
🔹গুলতি (নাজিফা তুষি)
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলতে গেলে হট কেক এখন তুষি। আমি উনাকে প্রথম দেখেছিলাম ইয়াশ রোহানের সাথে একটা নাটকে, বেশ সাবলীল লেগেছিলো তখনই, এরপর তো উনার কিছুই দেখা হলো। আসলে উনার অভিনয় যেমন তেমন তার চাহনি অসাধারণ, যা আসলেই ঠিকভাবে কাজে লাগিয়েছেন সুমন সাহেব।
বলতে গেলে হাওয়া ফিল্মে এক্সপ্রেশন দিয়ে কাত করে দিয়েছেন গুলতি। এছাড়া প্রতিটা পদে পদে তুষি দেখিয়েছে কীভাবে নিজেকে সাবলীলভাবে উপস্থাপন করতে হয়। নৌকায় হাটাচলার দৃশ্য দেখে মনে হয়েছে এখানেই তার হয় বসবাস।
🔹ইব্রাহিম (শরিফুল রাজ)
উনাকে যদি এই ইন্ডাস্ট্রি ব্যবহার করতে না পারেন তাহলে সেটা পুরো সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির ব্যর্থতা। রাজকে দিয়ে পরিচালক কমার্শিয়াল সিনেমা থেকে ধারাবাহিক নাটক পর্যন্ত তৈরি করতে পারবেন। হলফ করে বলতে পারি এই লোক এতো দূর যাবে যা অনেকে ভাবতেও পারবেন না। মাই গড এতো অসাধারণ অভিনয় করেন উনি ভাবাই যায় না, ভাবাই যায় না এইতো সেদিন মেন্স অ্যাক্টিভের অডিশন রাউন্ড পাড় করলেন।
🔹নাগু (নাসির উদ্দিন খান)
এই মহাশয়কে নিয়ে আর কতোই বা বলা যায়, উনাকে নিয়ে শুরু করলে প্রশংসা ব্যতীত আর কোনো শব্দ আসবে না। তকদীরে উনাকে আমার কী যে ভালো লেগেছিলো। পলিথিনে করে *দ খাবার দৃশ্য, ওয়াও। চাঁন মাঝির পরে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র উনাকেই ধরা যায় আমার মতে।
এছাড়া উরকেস এবং পারকেস (সোহেল মন্ডল ও রিজভী রিজু), এজারাও করেছেন অসাধারণ অভিনয়। এক কথায় বলা যায় ফিল্মের প্রতিটা কলাকুশলীদের নিজেদের সেরাটাই দিয়েছেন।
এবার চলে যাচ্ছি কিছু বিরক্তিকর দিক! সবচেয়ে বাজে দিক অযথা ফিল্মের রান টাইম বাড়িয়েছে একটা সার্কেলে থেকেই, চাইলে এটাকে আরো বিস্তার করা যেতো। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের প্রোপার ইউস হয় নাই, আর খুব বেশি ট্যাচি ছিলো না বিজিএম। অন্য দিকে গল্পটা একটা পৌরাণিক কাহিনি বুঝলাম কিন্তু এই সামান্য কাহিনি নিয়ে একটা মুভি হয়ে যাওয়াটা আসলে মুভির মানের কাছাকাছি গেলো না, যদি রানটাইম হিসেব করি। অন্য দিকে ধুপধাপ গালি জেলেরা দেয় বুঝলাম কিন্তু এগুলো ‘টুট টুট’ থাকলে ভালো হতো আর কী।
গল্পকে হয় সাসপেন্স আকারে নিয়ে যাওয়া উচিৎ ছিলো নাহলে একদম খুলেছিঁড়ে, মানে হিউমর বোঝাতে গিয়ে হয় নাই আর কী। যাই হোক ধরে নিলাম দর্শকের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন এবার নিজেদের মতো এন্ডিং সাজাতে পারবে যে কেউ, যদি তাই হয় তবে খারাপ না।
কাহিনি সংক্ষেপ: গল্পটা আমাদের সবারই জানা তাই নতুন করে বলার কিছু নেই। ছোটবেলায় অনেকে কবিতায়ও পড়েছেন। গুলতি হলেন বেহুলা-লখিন্দর রূপকথার দেবী মনসা, যদিও ফিল্মের এক পর্যায় গুলতি ‘হায় আল্লাহ’ বলেছিলো এতে আসলে তাঁর জাত নিয়ে একটা সন্দেহ তৈরি হয় আমার ছোট্ট মনে, তবে আবার বেদে পল্লীর যে নির্দিষ্ট ধর্ম নেই সেটা ভেবে মেনে নিয়েছিলাম। সে যাই হোক, বেহুলা লখিন্দর আসলো দেখে আবার ভাইবেন না এদের নিয়ে গল্প, গল্প আসলে গুলতি এবং চাঁন মাঝিকে নিয়ে। গল্প হুট করে আসা এক সুশ্রী সুনয়নাকে নিয়ে।
পরিশেষে ‘হাওয়া’ দেখার মতো এবং উপভোগ্য সিনেমা। পাপ করলে যে শাস্তি পেতেই হয় সেটার নথী বলা চলে। সত্যি বলতে এ ধরনের বিষয় নিয়ে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে আরো কাজ করা উচিৎ। খুব চ্যালেঞ্জিং লেগেছে পুরো সিনেমার কাজ, এমন মুভিগুলো বিভিন্ন উপায় বিভিন্ন গল্পে তৈরি হলে ভালোই লাগবে।
আর হ্যাঁ একটা কথা আছে না! ভালোর মাঝে খারাপ না থাকলে ভালোটা চোখে কম পড়ে! সবাই হলে গিয়ে সিনেমা দেখবেন, জয় হোক বাংলা সিনেমার।