হালদা : ফেসবুক রিভিউতে বাজিমাত!
শুক্রবার সারাদেশের ৮২টি হলে মুক্তি পেয়েছে তৌকীর আহমেদের অতি প্রতিক্ষীত সিনেমা ‘হালদা’। প্রধান তিন চরিত্রে অভিনয় করেছেন জাহিদ হাসান, নুসরাত ইমরোজ তিশা ও মোশাররফ করিম। এখনো পর্যন্ত সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষ করে ফেসবুকে সিনেমাটি ইতিবাচক প্রতিক্রিয়াই পেয়েছে।
আসুন কয়েকটি রিভিউয়ের আংশিক অথবা পুরোটাই পড়ে নিই। আর বিবেচনা করুন ‘হালদা’ দেখবেন কিনা।
………………..
সিমিত রায় অন্তর লিখেছেন—
প্রতিটি নারীরই একটা সময়ে নিজ পরিচয় হারিয়ে ফেলে, হারিয়ে যায় নিজের নামটাও। একটা সময় কেউই আর সেই নাম ধরে ডাকে না।
সুরত বানুও সেইরকম একজন নারী। তারও অন্যের মুখে নিজের নামটা শুনতে খুব ইচ্ছে করে। হাসুকে যখন তিনি (দিলারা জামান) তার নাম ধরে ডাকার জন্য বলেন, আর হাসু (তিশা) যখন ডাকে-সুরত বানু! ও সুরত বানু!
চোখ ভিজে যায় মনের অজান্তেই।
অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে ‘মেঘ নামিলো চোখে, মেঘ নামিলো.. ‘
‘হালদা’ পরিচালক তৌকীর আহমেদের আরেকটি অনবদ্য সৃষ্টি। ভাল পরিচালক হলে একটা কমন জিনিস পাওয়া যায়, তা হলো সবার কাছ থেকে ভাল অভিনয় আদায় করে নেয়া।
হালদাতে সবাই ভাল অভিনয় করেছেন। সবচেয়ে বেশী ভাল ছিল হাসু চরিত্রে আমাদের প্রিয় অভিনেত্রী তিশা। ছবির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাকে প্রতিটি ফ্রেমে অনেক সুন্দর লেগেছে, অথচ খুব বেশি সাজতে হয়নি, পরতে হয়নি দামী পোশাক। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে চোখ আটকে ছিল শুধু তার দিকেই।
সামনাসামনি থেকেই বলতে পারিনি ভাবী, প্রশংসা সামনে করতে হয় না।
এই বছর শুধুমাত্র তিশার। ‘ডুব’ এবং ‘হালদা’র মাধ্যমে তিনি নিজের চিহ্ণ রেখে গেলেন।
‘হালদা’ ছবিটি মূলত নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা গল্প। যেখানে নদী দূষন এবং এর প্রভাবে কিভাবে মানুষের জীবনে নেমে আসে দুঃখ কষ্ট, তা স্পষ্ট। নদীর দূষনের কারনে হালদার মা মাছেরা আর ডিম পারে না। এই সিনেমাতে ‘তিশা’ প্রতীকি মা মাছ। যে তার সন্তানকে বাঁচানোর স্বার্থে সাহসী হয়ে উঠে, প্রতিবাদী হয়ে হালদায় ফিরে যায়, একা!
জাহিদ হাসান অনেকদিন পরে অভিনয় দেখানোর সুযোগ পেলেন। এখানে তাকে কোন ধরনের কমেডি করতে হয়নি, চোখ বাঁকা করে হাসতে হয়নি। তিনি ছিলেন চৌধুরী পরিবারের একমাত্র বংশধর, চেয়ারম্যান। গম্ভীর, বদরাগী চরিত্রে তাকে ভীষন মানিয়েছে। সত্যি বলতে দর্শক হিসেবেও ভয় পাচ্ছিলাম তাকে।
ফজলুর রহমান বাবু ভাইকে নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। ছবি দেখে বাবু ভাইকে সর্বপ্রথম আমিই কনগ্রেটস করে আসছি। তিনি সর্বদাই ভাল অভিনেতা।
মোশাররফ করিম ‘টেলিভিশন’ এর পরে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র পেল সিনেমায়। তবে ‘টেলিভিশন’ এ অনেক স্কোপ ছিল অভিনয়ের। সেক্ষেত্রে ‘হালদা’য় তেমন কিছু করার ছিল না, বা তিনি করতেও পারেননি। এ্যাজ ইজাউল।
পরিচালক হিসেবে তৌকীর আহমেদ এবার ‘জয়যাত্রা’র পরে আরেকটি নদী কেন্দ্রিক সিনেমা বানালেন। যেখানে তিনি হালদা পাড়ের প্রকৃতিকে নান্দনিক ভাবে তুলে ধরছেন। সিনেমাটোগ্রাফি ছিল চমৎকার! সত্যিই অভিভূত মনোমুগ্ধকর দৃশ্যপট! এনামুল হক সোহেলের চিত্রায়নে তিনি প্রতিটি ফ্রেমে তার ছাপ রেখেছেন। বিশেষ করে, লং শট বা ক্লোজ শট যাই হোক না কেন, তিনি স্ক্রীনে স্পেস রেখেছেন। যা অনেকেই করেন না। সিনেমা প্রথম দৃশ্যে মাঝসাগরে ডাকাতির দৃশ্যটাও দারুন ভাবে ধারন করতে পেরেছেন। শব্দশৈলীর নিপুণ কাজ করেছেন পরীক্ষিত রিপন নাথ। কৌশিক রায়ের ডিআই কালার গ্রেডিং আপনাকে বুঝিয়ে দিবে ইহাই সিনেমা!
পিন্টু ঘোষের সংগীত আবহে একধরনের মোহ সৃষ্টি করবে। যার রেশ থেকে যাবে অনেকটা সময়। অমিত দেবনাথের সম্পাদনাও ছিল নিখুঁত।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা হওয়াতে তেমন একটা সমস্যা হয়নি মোটেও। বরঞ্চ উল্টো হলুদ রঙের সাবটাইটেল কিছুটা বিরক্তির কারণ হয়ে গিয়েছিল।
আজ পহেলা ডিসেম্বর থেকে ৮১টি প্রেক্ষাগৃহে চলছে “হালদা”। সময় সুযোগ মতো দেখে নিতে পারেন। সোয়া দুই ঘন্টা বেশ ভালই কেটে যাবে, তা বলে দেয়া যায় অনায়াসেই।
…………………………………………
দীর্ঘ পোস্টের একাংশে মাহমুদুল হাসান রিফাত লেখেন, ‘হালদার মেইন অস্ত্র ছিল ডায়লগ। মন জুড়িয়ে যাবার মতো কিছু ডায়লগ ছিল।ট্রেইলারে বলা মোশাররফের “সাগর ছাড়ি আইলে সাগরের কতা মনে পড়ে…..” এটার পর তিশা যখন মানুষের কথা জিজ্ঞেস করে সেখানে তিশাকে হাইলাইট করে মোশাররফের ডায়লগ জাস্ট মুভিতে ডায়লগ কতটা স্ট্রং তার এক্সাম্পল।এরকম অন্তত ১০টা ভাল ডায়লগের সিক্যুয়েন্স আছে।’
……………………………………………
খায়রুল বাশার নির্ঝর লেখেন, “প্রসঙ্গ হালদা : আঁর বাইচ্ছা বাঁচিবো কোয়ানে?
গ্রাম জুড়ে, নদীর তীর জুড়ে সারি সারি ইটভাটা নিজস্ব চিমনি উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বর্ষাকাল বাদে আর বাদবাকি মাস-রাত-দুপুর-সন্ধ্যা-দিনজুড়ে কালো ধোঁয়া, কখনও সাদা, ছড়িয়ে পড়ছে দানবের মতো। ফ্যাক্টরি থেকে নির্গত অভিশাপ হালদার পানিতে মিশে মাছ মারলেও প্রকৃতপ্রস্তাবে মারছে মানুষ।
‘হালদা’র মাঝামাঝির একটি দৃশ্য কাল সন্ধ্যা থেকে মাথার ভেতর ঘুরছে। যেখানে ‘বাইচ্ছা বিয়ানোর’ জন্য তিশাকে চাপ দেয়া হচ্ছে ক্রমাগত এবং ওই পরিস্থিতিসমূহের এক পর্যায়ে তিশা যখন জাহিদ হাসানকে বলছে- ‘নদীত কারখানার বর্জ্য, বাতাসে বিরিকফিল্ডের ধুঁয়া… আঁর বাইচ্ছা বাঁচিবো কোয়ানে?’ এরপর ক্যামেরা খুব দ্রুত পরপর যে দৃশ্যগুলো পয়দা করে মন্টাজ তৈরি করে, সেইগুলাতে দেখি- নদীতে ভেসে যাচ্ছে পশুর লাশ, পাড়ে মরা গাছ, ইটভাটার অভিশপ্ত চিমনি, একা ট্রলার… আর যা কিছু দেখি সবগুলো একটাই প্রশ্ন তোলে, নিরবে এবং সরবে- ‘আঁর বাইচ্ছা বাঁচিবো কোয়ানে?’
হালদাপাড়ের জীবনবৈচিত্র আমার স্বচক্ষে দেখা নেই। শহর ঢাকায় বসে, বড়পর্দায়, তৌকীর আহমেদের ‘হালদা’ দেখতে দেখতে… পুরো সময়টা জুড়ে, কেবলই মনে হয়েছে- এই প্রশ্নটা কি সার্বজনীন নয়? এটাই কি বাস্তবতা নয়, গ্রাম এবং শহরের? বিশেষ করে ঢাকার?
মানুষ আরও একটু দামি সানগ্লাস কেনার চাহিদায়, গাড়ির চাহিদায়, বাড়ির এবং ঝকঝকে ডিনারের চাহিদায়… ক্রমাগত খুন করে চলেছে। অসংখ্য খুন। অথচ তার এবং তাদের চোখেই পড়ছে না… প্লেটে এইমাত্র যে মাংসের পিসটা সে নিলো, তাতে লেগে আছে তার সন্তানের ভবিষ্যতের গা থেকে ঝরে পড়া রক্তের দাগ।
‘হালদা’ আরও একবার মনে করিয়ে দিলো- প্রতিটি মানুষ তার নিজস্ব সন্তানের আততায়ী।”
…………………………………..
সাদমান সাকিব তুহিনের মতো, ‘আমার কেমন লেগেছে! ভালো ছিলো! শিক্ষণীয়, সচেতনতা জাগানিয়া এবং মনে রাখার মতো একটা মুভি হালদা। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক অসাধারণ ছিল। ডায়লগের ভেতরে ভেতরেই অসাধারণ কিছু বাস্তবিক কথা ছিল যেটা সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে! জাহিদ হাসান, মোশাররফ করিম, তিশা, দিলারা জামান – তাদের কারোর অভিনয়ই আশাহত করেনি। আর ফজলুর রহমান বাবু তো বরাবরের মতোই এক্সট্রা-অর্ডিনারি ছিলেন !! তবে তিশা’র মায়ের চরিত্রটা ঠিক বোধগম্য হয়নি আমার কাছে।’
……………………………………..
হাওলাদার ইমরানের ভাষ্য— ‘হালদা, ছবিকে মার্কিং করা কঠিন। ১০ এ ২০ দিতে হবে। কোথাও কোনো ঘাটতি নেই। সংলাপ আর গল্প, রোমান্টিকতা বা দৃশ্যপট কোথাও কমতি চোখে পড়বে না। মৌলিক গল্প, শেষদৃশ্য পর্যন্ত আপনাকে বসে থাকতে হবে।’
………………………………………
এস রাব্বি লেখেন, “ ব্যাক্তিগত মতামতঃ আমার চোখে পরেছে দুইটা বিষয়; এক) সিনেমাটোগ্রাফী; দুই) অভিনয়।
দুই নম্বর পয়েন্টে সকলেই একমত হবেন। হালদাতে যারা অভিনয় করেছেন তারা কেমন অভিনেতা-নেত্রি তা হাজার বার প্রমাণিত। তবে জাহিদ হাসান!! আমি এমন লুকে/এটিটুডে তাকে কখনও দেখিনি; বেস্ট এভার। আফসোস হয় আমাদের এত শত অভিনেতা রয়েছে কিন্তু এই অভিনয় বের করে আনার ডিরেক্টর খুব কমই আছেন ইন্ড্রাস্ট্রিতে।
পয়েন্ট এক) তেীকির আহমেদকে এবং সিনেমাটোগ্রাফারকে এই একটি বিশেষ পয়েন্টে বিশেষ ধন্যবাদ। এমন ভারী বৃষ্টিতে বিজলী চমকানো আকাশ …বৃষ্টি শেষে এত সুন্দর মেঘলা আবহ; সকাল; গেীধুলী আমার দেখা বাংলা চলচ্চিত্রে এই প্রথম। পুরো সিনেমাতে বৃষ্টি -বিজলী চমকানো-মেঘলাকাশ আলাদা করে নজর কেড়েছে।”
……………………………..
সীমান্ত রেখা লেখেন, ‘আমার ধ্যান জ্ঞান ছিল ছবিটা দেখা। এবং দেখে ফেললাম। তৌকীর আহমেদ কি জিনিশ আল্লাহ ভাল জানেন। এই ছবির গল্পটা খুব সাধারণ এবং অত্যন্ত অসাধারণ। ছবিটি দেখে আপনাকে এর গভীরতা বা আর্ট নিয়ে ভাবতে হবে না। খুব সহজেই ছবিটা আপনার ব্রেনে ঢুকে যাবে। তৌকীর ভাই স্বল্পভাষী মানুষ, কাজেই পরিচয় দেন। একটা মাস্টারপিস। ১০ এ ১০০।’
……………………………….
আরিফ রশীদ লেখেন, ‘সময়ের সাথে একজন নারীর নাম হারিয়ে যায় মা, বউ ডাকের আড়ালে….. নিজের নামের জন্য কী পরিমাণ আকুতি একজন মানুষের থাকতে পারে জানেন?? খুব সাধারণ ঘটনার কী অসাধারণ উপস্থাপন!
এটাই হালদা! সাধারন পরিচিত ব্যাপারকে প্রথম ফ্রেম থেকে শেষ পর্যন্ত কি অসাধারণভাবে উপস্থাপন করা যায় সেটাই দেখালেন তৌকীর আহমেদ স্যার।
অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফি, আর ডিটেইলিংয়ে বিন্দুমাত্র ছাড় না দিয়ে অভিনেতা অভিনেত্রীদদের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা যায় তা দেখলাম।’
………………………….
শোয়েব পাটোয়ারীর ভাষ্যে— ‘আফটার অল পারিবারিক ছবি। আর তৌকীর আহমেদের ছবি নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নাই,সবাই গল্প আর কাজ নিয়ে ধারনা আছে। তিশা, বাবু স্যার, মোশাররফ করিম, জাহিদ হাসান সবাই সবার যায়গায় বেস্ট।কারো যদি গল্প নিয়ে বোরিং চলে আসে তাহলে তাদের অভিনয় দেখে মন ভরে যাবে।’