
হেথা নয়, অন্য কোনো খানে
কামার আহমেদ সাইমন-সারা আফরীন দম্পতিকে মনে হয়েছে তারেক মাসুদ-ক্যাথরিন মাসুদ দম্পতির ছায়া। যে স্বপ্ন নিয়ে তারেক মাসুদ-ক্যাথরিন মাসুদ চলচ্চিত্র নির্মাণ করে গেছেন তাদের পরবর্তী পথটা যেন এ কামার আহমেদ সাইমন-সারা আফরীন অনুসরণ করছেন।
তারেক মাসুদ বলেছিলেন-‘আমাদের জীবন হয়তো শেষ হয়ে যাবে ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিবেশ তৈরি করতে করতে।’ তিনি আমাদের মাঝ থেকে চলে গেছেন এখনো ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিবেশ তৈরির লড়াই চলমান রয়েছে। ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণের সেই ধারাবাহিকতার একটি পরিচ্ছন্ন প্রয়াস ছিল ‘অন্যদিন…’। ইতোমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে চলচ্চিত্রটি প্রশংসিত হয়েছে।

‘অন্যদিন…’ ছবিটিকে নির্মাতা কামার আহমেদ সাইমন তার পানি ট্রিলজির দ্বিতীয় কিস্তির ছবি বলেছেন। এর প্রথম কিস্তি ছিল ঘূর্ণিঝড় আইলা দুর্গত এলাকা নিয়ে নির্মিত ‘শুনতে কি পাও’। সেটিও নাম করেছিল। মূলত পানিকে কেন্দ্র করে উপকূলীয় মানুষের টিকে থাকার যে সংগ্রাম তাকেই তুলে ধরেছিলেন। ‘অন্যদিন…’ নামের মধ্যেই গূঢ় অর্থ লুকিয়ে আছে। ঠিক কোন দিনকে নির্মাতা নির্দেশ করেছেন সেটি দর্শক প্রথম যাত্রায় বুঝতে পারবে না, ছবিটি দেখার পর চিন্তার অবকাশ পাওয়া যাবে। নতুন কোনো এক দিনকে নির্মাতা ইঙ্গিত করেছেন যেদিন হয়তো সব শ্রেণিপেশার মানুষের মধ্যে যার যার স্বপ্নের দিনগুলো বাস্তবসম্মতভাবে সত্যি হয়ে ধরা দেবে। কোন সে দিন তা আমরা জানি না, নির্মাতা নিজেও স্পষ্ট করে বলতে চাননি শুধু আভাস দিয়েছেন এবং সেই আভাসটিই ‘অন্যদিন’ নামটিকে ভিন্ন সৌন্দর্য দিয়েছে।
জলপথে একটি জাহাজ চলেছে যেখানে অনেক শ্রেণিপেশার মানুষই উঠেছে। তাদের কথা বলার ধরন যেমন ভিন্ন স্বপ্ন দেখার ধরনে সবাই এক কারণ সবাই অনাগত কোনো ভালো দিনের প্রত্যাশায় রয়েছে। কেউ নিজের জীবনের দুর্দশার কথা বলছে, কেউ সেই দুর্দশার কথা মন দিয়ে শুনছে আবার কিভাবে চলতে হবে সে পরামর্শ দিচ্ছে, তরুণ প্রজন্মের একটা অংশ গীটার বাজিয়ে গান করছে আবার কলোনিয়ানিজমের টপিকে আড্ডাও জমাচ্ছে কিভাবে কলোনিয়ানিজম আমাদেরকে ভেতর থেকে দাসত্ব করতে শিখিয়েছে, এক অন্ধ লোক তার নিজস্ব বাদ্য বাজিয়ে গান ধরেছে, একটা মেয়ে নিজের মতো নাচগান করে বিনোদিত করছে, তরুণ একটা দল ক্যামেরা নিয়ে কেবিনে থাকা রাজনৈতিক নেতাদের সাথে রাজনৈতিক আড্ডা জমিয়েছে যেখানে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সব সমস্যাকে উত্থাপন করা হয়েছে কিন্তু রাজনৈতিক নেতার সেই চিরাচরিত উত্তরমালায় তরুণদলটি হতাশ হয়েছে, কেউ ধর্মীয় কথা বলে সবাইকে মোটিভেট করার চেষ্টা করছে। এভাবে ছবির গল্প এগিয়েছে বহুমুখী দিককে কেন্দ্র করে যেখানে মানুষ অনেকরকম হলেও তাদের গন্তব্য নতুন কোনো শুভ দিনের। এই অনাগত গন্তব্যটিকে জাহাজটির প্রতি পদক্ষেপে কুয়াশাময় পরিবেশে বারবার আটকে যাওয়ার সাথে সিগনিফাই করা হয়েছে যেখানে যাত্রীরা শঙ্কিত সামনে কি অপেক্ষা করছে তার জন্য। অন্য যে দিনের আশায় সবাই অপেক্ষমান সেই অপেক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছে জাহাজটি।

‘অন্যদিন…’ ছবিতে পূর্ণাঙ্গভাবে শক্তিশালী একটা প্যাকেজ কাজ করেছে। এর অভিনয়শিল্পীরা পরিচিত কোনো মুখ না কিন্তু তাদের অভিনয়ে ন্যাচারালিটির যে অসাধারণ প্রকাশ সেটি শুধু প্রশংসার বিষয় না বরং উদাহরণ তৈরিরও বিষয় যে চলচ্চিত্র জনপ্রিয় তারকা ছাড়াও মানসম্মতভাবে হতে পারে। এ ছবির গানের নির্দিষ্ট কোনো ধারা নেই, যাত্রী যেহেতু অনেকরকম তাই তাদের মুখে আসা গানের মধ্যেও বৈচিত্র্য রয়েছে। জাহাজের মধ্যে সবাই যাত্রী মিলে একটাই ক্লাসকে ধারণ করেছে তারা যাত্রী এবং দেশের জনগণ তাই কেবিনের সামনে গিয়ে একজনকে ওয়াশরুম ব্যবহার করা নিয়ে কর্তব্যরত লোকের সাথে ঝগড়া করতে দেখা যায়। এই দৃশ্য আমজাদ হোসেনের ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ ছবির সেই কালজয়ী ‘আমরা সবাই এক কেলাসের’ সংলাপের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আরো স্মরণ করিয়ে দেয় জাহাজরূপী অজানা গন্তব্য ও স্বপ্নের রূপরেখা নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্যামল ছায়া’ বা তৌকীর আহমেদের ‘জয়যাত্রা’ ছবির কথাও। সময় ভিন্ন কিন্তু ছবির উপস্থাপনা ও বার্তার মধ্যে সম্পর্ক চিরন্তন।
নায়ক-নায়িকা ছাড়া আবার ছবি হয় নাকি? প্রচলিত ধ্যান-ধারণার এই স্টাবলিশমেন্টকে ভেঙে নতুন করে চলচ্চিত্রের ভাষাকে দর্শকের কাছে পৌঁছে দেয়ার যে চলচ্চিত্রযুদ্ধ চলমান তার একটা পদক্ষেপ হলো ‘অন্যদিন’। আমরা সময় দেখি তার সাথে অনাগত দিনের স্বপ্নকেও লালন করি কিন্তু জানি না কখন সে দিন আসবে তাই ছবির নামের সাথে কামার আহমেদ সাইমন থ্রি ডট (…) ব্যবহার করেন আর সেখানেই ছবিটি অন্য এক অর্থ পেয়ে যায় যাকে রাবীন্দ্রিক ভাষায় বলা যায় ‘হেথা নয়, হেথা নয় অন্য কোনো খানে’।
রেটিং – ৮.৫/১০