হুমায়ূন ফরীদির সেরা দশ নাটক
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র, মঞ্চ ও নাটকে নিজের অভিনয় দক্ষতা দিয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন হুমায়ূন ফরীদি। দর্শকদের মনে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। চলচ্চিত্রের পাশাপাশি টিভি নাটকেও তিনি যে দ্যুতি ছড়িয়েছিলেন তা অবিশ্বাস্য। ওনার অভিনয় জীবনের অন্যতম সেরা দশ টিভি নাটক নিয়ে এই বিশেষ আয়োজন—
সংশপ্তক (১৯৮৮) : শহীদুল্লাহ কায়সারের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত আব্দুল্লাহ আল মামুন ও আল মনসুরের প্রযোজনায় ধারাবাহিক নাটক ‘সংশপ্তক’ এ কানকাটা রমজান চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান ফরীদি। ইতিহাস নির্ভর এই গল্পে কুটিল নায়েব থেকে জমিদার বনে যাওয়া চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।
হুরমতি কর্তৃক কান কাটার পর থেকে তিনি কান কাটা রমজান নামে পরিচিত হন, দর্শকদের কাছেও এই নাম বেশ পরিচিতি পেয়েছিল। এই ধারাবাহিক নাটকে ওনার সহশিল্পী ছিলেন ফেরদৌসী মজুমদার, সুবর্ণা মুস্তাফা, রাইসুল ইসলাম আসাদ, খলিল, মামুনুর রশিদ, তারিক আনাম খানসহ আরো অনেকে। বিটিভিতে প্রচারিত এই নাটকে অভিনয়ে ব্যাপক পরিচিতির কারণে ‘সন্ত্রাস’ ছবিতে খল চরিত্রে আবির্ভূত হন।
অযাত্রা (১৯৮৭) : একজন গরিব অবসর প্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক অবসর ভাতার জন্য ঢাকায় পরিচিত এক বাসায় উঠেছিলেন। এই বাড়ির ছোট মেয়ে গান গেয়ে গাছে ফুল ফোটানোর চেষ্টা করে। দুজনের মধ্যে সখ্য হয়। ওই দিকে দুর্নীতির কারণে অবসর ভাতা পান না স্কুলশিক্ষক, তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।
হুমায়ূন আহমেদের জীবনঘনিষ্ঠ প্রতীকী এই নাটকে স্কুলশিক্ষকের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন হুমায়ূন ফরীদি। সদ্য ত্রিশ পেরোনো একজন অভিনেতা কীভাবে নিজের অভিনয় গুনে ষাটোর্ধ্ব মানুষের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তা আশ্চর্য হওয়ার মত। এই নাটকে আরো ছিলেন আবুল হায়াত, সারা যাকের ও লোপা।
আরও পড়ুন : হুমায়ূন ফরীদির সেরা দশ চলচ্চিত্র
অচিন বৃক্ষ (১৯৯২) : গ্রামের একজন সাধারণ সহজ সরল শিক্ষক তিনি, গ্রামে অচিন বৃক্ষ দেখতে আসবেন একজন বিখ্যাত লেখক। এই নিয়ে তার অনেক উচ্ছ্বাস। ঐ দিকে স্ত্রী খুব অসুস্থ, টাকার জন্য চিকিৎসা করাতে পারছেন না। অচিন বৃক্ষে ফুল ফুটবে, সে ফুল দিয়ে স্ত্রী সুস্থ হয়ে উঠবে এটাই তার বিশ্বাস। এই বিশ্বাস, আশা নিয়েই হুমায়ূন আহমেদের নাটক ‘অচিন বৃক্ষ’। সহজ সরল স্কুলশিক্ষকের ভূমিকায় ফরীদির মায়াভরা অভিনয় দেখে বোঝার উপায় নেই তিনিই আমাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় খল অভিনেতা। দারুণ এই নাটকে ওনার সহশিল্পী ছিলেন সুবর্ণা মুস্তাফা, আলী যাকের, আবুল হায়াত, শীলা আহমেদ।
ভাঙনের শব্দ শুনি (১৯৮৩) : সেলিম আল দীনের রচনায় নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর প্রযোজনায় ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’ নাটকে গ্রাম্য মোড়ল সেরাজ তালুকদার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন হুমায়ূন ফরীদি। বিটিভির ইতিহাসে অন্যতম বিখ্যাত এই নাটকে খল চরিত্রে ওনার অভিনয় স্মরণীয় হয়ে আছে। আরো অভিনয় করেছেন ফেরদৌসী মজুমদার, সুবর্ণা মুস্তাফা, হানিফ সংকেত, আব্দুল্লাহ আল মামুন।
কোথাও কেউ নেই (১৯৯৩) : বাংলা নাটকে ইতিহাস সৃষ্টিকারী ধারাবাহিক নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’। হুমায়ূন আহমেদের এই নাটকে মূল ভূমিকায় ছিলেন সুবর্ণা মুস্তাফা ও আসাদুজ্জামান নূর। পাশাপাশি উকিল চরিত্রে সমুজ্জ্বল ছিলেন হুমায়ূন ফরীদি, তার করা চরিত্রটিই নাটকটিকে আরো প্রাণবন্ত করে তুলেছিলেন, বাকেরের ফাঁসি ঠেকাতে তিনি অনেক চেষ্টা করেছিলেন। এই নাটকে যখন তিনি অভিনয় করেন,তখন তিনি চলচ্চিত্রে খুব ব্যস্ত, এর মাঝেও তিনি এই চরিত্রটি করেছিলেন। নাটকটি প্রযোজনা করেছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান।
শীতের পাখি (১৯৯১) : মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশ ছেড়ে পাকিস্তানে পাড়ি জমানো এক যুবক অনেক দিন পর ফিরে আসে বাংলাদেশে। আসার পর দেখে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়ে গেছে,নিজের দেশে নিজেকে অতিথি মনে হতে তার, আত্মদহনে ভুগতে থাকে। ফেরদৌস হাসানের রচনায় এই অনবদ্য নাটকে সেই যুবকের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন ফরীদি। এ ছাড়া ছিলেন গোলাম মুস্তাফা, ফেরদৌসী মজুমদার, শম্পা রেজা, খালেদ খান।
দ্বিতীয় জন (১৯৯৯) : হুমায়ূন আহমেদের রহস্য সিরিজের নাটক ‘দ্বিতীয় জন’। দুর্ঘটনার কারণে দশ বছর ধরে হুইল চেয়ারে বাস করতে থাকা একজনের অতৃপ্ত জীবন। তিনি বুঝতে পারেন স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে, কিন্তু কেন! সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার এই নাটকে হুমায়ূন ফরীদির অতুলনীয় অভিনয় এখনো দর্শকদের চোখের সামনে ভেসে উঠে, আর তাকে যোগ্য সঙ্গ দিয়েছিলেন সুবর্ণা মুস্তাফা।
প্রেত (২০০১) : ব্ল্যাক আর্ট বা প্রেত সাধনা নিয়ে অতিপ্রাকৃতিক ধারাবাহিক নাটক ‘প্রেত’। মুহম্মদ জাফর ইকবালের রচনায় নাটকটি নির্মাণ করেন অকালপ্রয়াত নির্মাতা আহির আলম। নাটকে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন আহমেদ রুবেল, তবে নাটকে বেশ কয়েকটি চরিত্রে অভিনয় করে রহস্যের সৃষ্টি করেছিলেন ফরীদি। একজন প্রফেসর থেকে প্রেত সাধক সব চরিত্রে সমান দক্ষতায় অভিনয় করেছিলেন।
সাত আসমানের সিঁড়ি (১৯৮৪) : গ্রাম থেকে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এক সময় জড়িয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। স্বাধীনতার পর দেখেন আপন মানুষেরা সব হারিয়ে গেছে, অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েন। এই নাটকে সেই যুবকের চরিত্রে অভিনয় করেন হুমায়ূন ফরীদি, কাজী মাহমুদুরের রচনায় এই নাটকে আরো অভিনয় করেন সুবর্ণা মুস্তাফা, দিলারা জামান, সৈয়দ আহসান আলী সিডনী।
একদিন হঠাৎ (১৯৮৬) : একটি যৌথ পরিবারে বাড়ির ছেলেকে পড়ানোর জন্য আগমন ঘটে একজন গৃহ শিক্ষকের। দেখতে বোকাসোকা হলেও ছাত্রকে নিয়ে শিক্ষণীয় মজার কাণ্ড করে বসেন, ছাত্রের ফুফু তার প্রেমে পড়ে যান। এমনই গল্প নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের মজার নাটক ‘একদিন হঠাৎ’। এই নাটকে গৃহশিক্ষকের ভূমিকায় অভিনয় করেন হুমায়ূন ফরীদি, এ ছাড়া বোকা মামার চরিত্রে আলী যাকেরসহ ডলি জহুর, অরুনা বিশ্বাস, কাজী খুরশিদউজ্জামান উৎপল, আরিফুল হক অভিনয় করেছেন। পরবর্তীতে এটির সিক্যুয়েল ‘যার যা পছন্দ’ নির্মিত হয়।