২০২১: অন্যতম ওয়েব সিরিজ ও ফিল্ম
ওয়েব জগতে সবচেয়ে বিকশিত এই বছর জুড়েই ছিল নতুন নতুন কনটেন্ট মুক্তির হিড়িক। ওয়েবে মান ভালো হলেই জনপ্রিয়তা পায়, এটা ভালো দিক। হয়েছেও তাই। দেশীয় ওটিটি প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হয়েছে ‘চরকি’,তারা প্রতি মাসেই মুক্তি দিয়েছে নতুন কাজ। সিনেমাটিক বেশ সফলতা পেলেও কনটেন্ট প্রকাশে নিয়মিত ছিলনি। ভারতের হইচই বরাবরের মত এই দেশেও সাড়া জাগিয়েছে, আরও ছিল জি ফাইভ।
সব মিলিয়ে ওয়েব প্ল্যাটফর্ম নিয়ে দর্শকদের আগ্রহ প্রচুর। বছর জুড়ে ছিল আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। এই বছর মুক্তি পাওয়া দশটি ওয়েব সিরিজ ও ফিল্ম সম্পর্কে জানুন—
১.মহানগর: থানায় ঘটে যাওয়া এক রাতের গল্প নিয়ে এই সিরিজ। জনপ্রিয় নির্মাতা আশফাক নিপুণের প্রথম ওয়েব সিরিজ হলেও সুনিপুণভাবেই গল্প বাঁধিয়েছেন। বরাবরের মতো ছিলেন রাজনীতি সচেতন। সিরিজের মুখ্য চরিত্র ওসি হারুন নিয়ে সবচেয়ে বেশি চর্চিত হয়েছে। এই চরিত্রে মোশাররফ করিম দুর্দান্ত ছিলেন, পেয়েছেন হারানো জৌলুশ। পাশাপাশি এসআই মলয়ের চরিত্রে মোস্তাফিজুর নূর ইমরানের অনবদ্য অভিনয়ে; খায়রুল বাসার, নাসির উদ্দিন খান, শ্যামল মাওলা নিজেদের আরও আলোচিত করে নিয়েছেন, যদিও মম মিশ্র প্রতিক্রিয়া পেয়েছেন। আবহ সংগীত, চিত্রগ্রাহক সব মিলিয়েই পরিপূর্ণ প্যাকেজ। বছরের সবচেয়ে জনপ্রিয় দুটি কাজ ধরলে এটি একটি। কিছু অসামঞ্জস্যের প্রশ্নের উদ্রেক ঘটালেও সবাই অধীর অপেক্ষায় আছেন দ্বিতীয় সিজনের জন্য।
২.নেটওয়ার্কের বাইরে: বছরের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফিকশন। মিজানুর রহমান আরিয়ান ওয়েব ফিল্মে পা রেখেই ছক্কা হাঁকালেন। সত্য ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত এই গল্প গড়ে উঠেছে চার বন্ধুর সমুদ্র ভ্রমণ নিয়ে। শরিফুল রাজ, ইয়াশ রোহান, খায়রুল বাসার নিজ গুণে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন, তাদের তুলনায় জুনায়েদ কিছুটা পিছিয়ে ছিল। ফারিণ, অর্ষা, তুষি, তাসনুভা স্বল্প উপস্থিতিতেও উজ্জ্বল ছিল। অনেক অভিনয়শিল্পীর মিলন ঘটেছিল এই ওয়েব ফিল্মে। রাজু রাজের অসামান্য সিনেমাটোগ্রাফি, সোমেশ্বর অলির লেখায় সাজিদ সরকারের সুরে ‘রূপকথার জগতে’কে বছরের সবচেয়ে জনপ্রিয় গান নির্দ্বিধায় বলা যায়। মুক্তির পরেই কিছু সমালোচনার তীর বেঁধেছিল, তবে তা জনপ্রিয়তায় আঁচ পড়েনি।
৩.লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলম্যান: মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর প্রথম ওয়েব সিরিজ, স্বাভাবিকভাবেই আগ্রহ ছিল অনেক বেশি। সেই তুলনায় প্রত্যাশা মিটেছে কম, তবে ভালোর তালিকায় রাখা যায়। সিরিজের সেরা প্রাপ্তি তাসনিয়া ফারিণের অভিনয়। আফজাল হোসেন অনেক বছর পর আলোচনায় এলেন। হাসান মাসুদ, মারিয়া নূর দুজন বেশ ভালো করেছেন, বাকিদের যথাযথভাবে তেমন পাওয়া যায়নি, পার্থ বড়ুয়া, মোস্তফা মনোয়ার, ইরেশ যাকেরও ছিলেন। এক নারীর শ্লীলতাহানির গল্প, সেইদিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ‘পরবাসী’ গানটা শুনতে ভালোই লাগে।
৪.ট্রল: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেককেই ফাঁদে ফেলা হয়। যার পরিণতি ভয়াবহ। গল্পটা খুব প্রাসঙ্গিক, তবে নির্মাতা সঞ্জয় সমদ্দার আরও ভালোভাবে চিত্রনাট্য সাজাতে পারতেন। অপূর্বের ভালো অভিনয়, বিশেষ করে ভিন্নধর্মী চরিত্রে পাওয়াটা বেশ খুশির সংবাদ। সুপারহিট হওয়া এই ফিল্মে আরও ছিলেন তাসনিয়া ফারিণ, রাশেদ মামুন অপু, জামশেদ, সৈয়দ নাজমুস সাকিব ও শতাব্দী ওয়াদুদ।
৫.বলি: বিজ্ঞাপন নির্মাতা শঙ্খ দাশগুপ্তের প্রথম ওয়েব সিরিজ। সোহরাব-রুস্তমের উপাখ্যান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এক দ্বীপে সাজিয়েছেন গল্প। ওয়েস্টার্ন প্যাটার্নের সিরিজের শুরু থেকেই ছিল চমক জাগানিয়া, ট্রেলারেও ছিল সেই আভাস। তবে সেই অনুযায়ী প্রত্যাশা মিটায়নি। প্রথম কয়েক পর্ব ভালো লেগেছিল। আনারকলি চরিত্রটার প্রতি সুবিচার করা হয়নি, সোহানা সাবাও সেই অনুযায়ী অভিনয় দেখাতে পারেননি। মুখ্য চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরীর খল অভিনয় ভালো লেগেছে, নাসিরউদ্দিন খানকে পাওয়া গেল অন্যরকম। বরং এত তারকার ভিড়ে নবীন সাফা কবির, মৌসুমী মৌরা ভালো করেছে। ইরেশ যাকের, লুৎফর রহমান জর্জ মোটামুটি, সোহেল মণ্ডল ভালো অভিনয় করলেও চরিত্রটা আরও বিকাশ দাবি করে। চোখ জুড়ায় তাহসিন রহমানের সিনেমাটোগ্রাফি আর তানজীর তুহিনের শিরোনাম সংগীত অন্যমাত্রা এনে দেয়।
৬.কষ্টনীড়: আশফাক নিপুণের এই ওয়েব ফিল্মে একটি পরিবারের মাধ্যমে রাজনৈতিক মতাদর্শ দেখিয়েছেন। গতিশীল চিত্রনাট্য না হলেও দেখতে মন্দ লাগে না, বরং বিশেষ বিশেষ কিছু দৃশ্যের জন্য ভালোই লাগে। অভিনয়ে সবচেয়ে ভালো করেছে রুনা খান, এরপর শ্যামল মাওলা, ইয়াশ রোহান, সাবিলা নূর। মুখ্য চরিত্রে তারিক আনাম খান ছাড়াও সাবেরী আলম আছেন।
৭.মরীচিকা। ওয়েব সিরিজে শিহাব শাহীন আগেই পরীক্ষিত। ‘মরীচিকা’ নিয়েও ছিল তুমুল আগ্রহ, বিশেষ করে মডেল তিন্নির হত্যার ঘটনা নিয়ে সাজানো বলে গুঞ্জন উঠেছিল। তবে দর্শকদের কাছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পেয়েছে, আরও ভালো হতে পারতো। সিরিজের সবটুকু অর্জন নিয়ে নিয়েছে আফরান নিশো একাই। এ ছাড়া ছিল সিয়াম, মাহি ও জোভান।
৮.ইউটিউমার: আদনান আল রাজীব ওয়েব ফিল্ম বানাচ্ছেন, এটাই ছিল দর্শকদের জন্য যথেষ্ট। সাম্প্রতিককালের উঠতি কিছু তারকা আর স্যাটায়ার করে বানানো এই ওয়েব ফিল্ম শুরু থেকেই ছিল উপভোগ্য। সিরিয়াস সব কাজের ভিড়ে কমেডি হিসেবে এটা আলাদা মাত্রা এনে দিতে পারতো। কিন্তু এটাও শেষ পর্যন্ত হতাশই করে। আদনান আল রাজীবের আগের কাজগুলোর তুলনায় পিছিয়ে। প্রীতম হাসান গানের মানুষ, অভিনয় স্বাভাবিকভাবেই খুব ভালো করবেন না। গল্পের সঙ্গে খুব গুরুত্বপূর্ণ না হলেও ভালো লেগেছে শরীফ সিরাজের অভিনয়। আর জিয়াউল হক পলাশই ছিলেন বরং মন্দের ভালো।
৯. কন্ট্রাক্ট: প্রচারের আগে সবচেয়ে বেশি আলোচিত থাকা কোন সিরিজ। মোহাম্মদ নাজিমউদ্দিনের বিখ্যাত উপন্যাস থেকে ওয়েব সিরিজটি বানিয়েছেন তানিম নূর ও কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়। উপন্যাস হিসেবে দারুণ হলেও ভালো ওয়েব সিরিজ নির্মাণে ব্যর্থ হয়েছেন নির্মাতারা। যদিও আলোচনা হয়েছে বেশ। প্রাপ্তি বলতে চঞ্চল চৌধুরীর অসামান্য অভিনয়, আর তাকে সঙ্গ দেওয়া জাকিয়া বারী মম। অন্যদের মধ্যে আইশা খান বেশ ভালো, আরিফিন শুভ ও জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় নিজেদের মত করে আলো ছড়িয়েছেন। শ্যামল মাওলাকে পাওয়া যায়নি নিজের ছন্দে, মিথিলা চলনসই। তারিক আনাম, রওনক হাসানসহ অনেক তারকার মেলবন্ধন ঘটালেও চিত্রনাট্যের দোষে কারোর প্রতিই সুবিচার হয়নি।
১০.জানোয়ার ও খাঁচার ভিতর অচিন পাখি: বছরের শুরুতেই রায়হান রাফী হুলুস্থুল বাঁধিয়ে ফেলেছিলেন প্রথম ওয়েব ফিল্ম দিয়ে। সত্য ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এই গল্প সাজানো হয়েছে। এই ওয়েব ফিল্মের বড় প্রাপ্তি রাশেদ মামুন অপুর প্রত্যাবর্তন, বলা যায় ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে ফেলেছেন। আরও ছিল তাসকিন রহমান, এলিনা শাম্মি, রাহুল, ফরহাদ লিমনরা। বেশ কিছু ডিস্টার্বিং দৃশ্য রয়েছে। অনেক দর্শক পছন্দ করলেও আমার ভালো লাগেনি। রাফি এই বছর ওয়েবে বেশ সক্রিয় ছিলেন। তার নির্মিত ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বেশ সাহসী কাজ। তমা মির্জা, ফজলুর রহমান বাবু থেকে ইন্তেখাব দিনার, সুমন আনোয়ারেরাও ভালো অভিনয় করেছেন। কিন্তু চিত্রনাট্যের অতি ধীর গতির কারণে মনোযোগ হারায়। তার আরেকটি কাজ ছিল ‘দ্য ডার্ক সাইড অব ঢাকা’। পাঁচটি গল্প নিয়ে সাজানো এই ফিল্মের একটি গল্প পরিচালনা করেছেন সিমিত রায় অন্তর। অভিনয় করেছেন শরাফ আহমেদ জীবন, তমা মির্জা, মনোজ, তুষি, খায়রুল বাসার, অপুসহ আরও অনেকে।
এ ছাড়া মাদকের ভয়াবহতা নিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা সানী সানোয়ার ও ফয়সাল আহমেদের প্রথম ওয়েব সিরিজ ‘বিলাপ’, ইতিমধ্যেই যারা ‘মিশন এক্সট্রিম’ ছবি বানিয়েছেন। গল্পটা খুবই ভালো, কিন্তু সময় যত বাড়তে থাকে চিত্রনাট্য তত ঝুলে যায়। যদিও শেষে আগ্রহ বাড়ে। তবে ব্যর্থ পুলিশ অফিসারের কাহিনী ভারতবর্ষে লেবু কচলানোর মত হয়ে যাচ্ছে। শরিফুল রাজ বেশ ভালো করেছেন। আরও আছে মম,শবনম ফারিয়া, খায়রুল বাসার,রুনা খানেরা।
শিবব্রত বর্মনের উপন্যাস অবলম্বনে অমিতাভ রেজার প্রথম ওয়েব ফিল্ম ‘মুন্সিগিরি’। মাসুদ মুন্সীকে কেন্দ্র করে এই ওয়েব ফিল্ম, খুব সম্ভবত পরবর্তীতে এর আরও সিক্যুয়েল বেরোবে। খুব ভালো না হলেও চলনসই বলা যায়। চঞ্চল চৌধুরী এমনিতেই ভালো অভিনয় করেন, তবে ব্যতিক্রম কিছু পাওয়া যায়নি। পূর্ণিমাকে অনেক দিন পরে দেখাটা বেশ চমকপ্রদ হলেও তাকে ভালো ব্যবহার করতে পারেননি নির্মাতা। আলো ছড়িয়েছেন শবনম ফারিয়া।