
৮৪০: হতাশ, সত্যিই হতাশ!
নীতির রাজা নাকি রাজার নীতি? বাংলা ব্যাকরণের হিস্যায় যতই প্যাঁচ লাগুক বাস্তবে রাজনীতি যে নীতির রাজপথ ছেড়ে প্রায়ই অপনীতির সরু গলিতে ইঁদুর দৌঁড় দেয় তা নিয়ে বিভ্রান্তির সুযোগ নেই। পলিটিক্যাল স্যাটায়ের দীর্ঘ আকাল পেরিয়ে যখন মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর “৮৪০” হলে এলো তখন শীতের ছোট হয়ে আসা বিকালে বড় পর্দার ওমে চাওয়া-পাওয়া হিসাব মেলানোর লোভ সামলানো মুশকিল।

জনাব ডাবলু বিগত দশবছর ধরে ফুলমনিরহাট পৌরসভার মেয়র। প্রথমবার ১০৩ শতাংশ ভোটে, দ্বিতীয়বার ৯৮ শতাংশ। তৃতীয় নির্বাচনে ডাবলুর জন্য কী অপেক্ষা করছে তাই নিয়ে পলিটিক্যাল স্যাটায়ার “৮৪০” এর গল্প। সিনেমার শুরুতেই পর্দায় নাসির উদ্দিন খানকে (ডাবলু) ঘিরে ক্যামেরা ধীরে ধীরে ৩৬০° ঘুরতে থাকে আর নেপথ্যে তার ভয়েসে প্রধান চরিত্র আর প্রধানতম কনফ্লিক্ট কী তা জানানো হয়। সাধারণত একটা প্লটের প্রথম ভাগে রাখা হয় একটা inciting ঘটনা যেটাকে ভিত্তি ধরে পরে ধাপে ধাপে ক্লাইম্যাক্সে চড়ে চিত্রপরিচালক। কিন্তু “৮৪০” inciting incident টাই কনফ্লিক্ট হয়ে বসায় গল্পটা হয়ে গিয়েছে আগাগোড়া ম্যাড়মেড়ে ও অনুমানযোগ্য। পুরো গল্পে কোন ক্লাইম্যাক্স নেই, এমন কোন মোচড় নেই যা দর্শককে চমকে দিতে পারে; আড়াই ঘণ্টা মনোযোগ ধরে রাখতে পারে। প্রধান চরিত্রকে চ্যালেঞ্জ করার কেউ নেই।
জঁ লুক গদার নাকি ট্র্যাকিং শট নিতেন ট্রলি না বসিয়ে হ্যান্ডহ্যাল্ড শটের মাধ্যমে। ফারুকীও বোধ হয় একই টেকনিক ব্যবহার করেছেন এই সিনেমায়। বেশ ক’বার নাসির খানকে ক্যামেরা ফলো করেছে পেছন থেকে। হ্যান্ডহ্যাল্ড শটের ঝাঁকুনির জন্যই শটগুলো জীবন্ত মনে হয়েছে। তবে একই রকম শটের বারবার প্রয়োগ বিরক্তিকর। ছবির কালার গ্রেডিং বেশ ডার্কিশ, একটু ভাইব্রেন্ট। সিনেমার কালার গ্রেডিং দেখে মনে হলো এই দায়িত্বে থাকা তথাগত ঘোষ খুব সম্ভবত ভারতীয় ফটোগ্রাফার তথাগত ঘোষ। সিনেমার চতুর্থ পর্বের কালার গ্রেডিং এবং প্রথম পর্বের কালার গ্রেডিং বেশ কিছুটা ভিন্নতা ছিল। পলিটিক্যাল স্যাটায়ারে যেমন কালার গ্রেডিং ও ক্যামেরার গতি আশা করেছিলাম তা পাইনি। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের সাহায্যে কিছু এল-কাট, কিছু শট-রিভার্স শট ছাড়া চোখে লাগার মতো কোনো নির্মাণ কুশলতাও দেখিনি। সেট নির্মাণ কিছু দৃশ্যে ছিল ত্রুটিযুক্ত। একই সংলাপে ডাবিংয়ের দোষে দুইরকম ভয়েস অন্তত ছয়বার কানে পীড়া দিয়েছে।
সিনেমাতে চরিত্র অনেক, অনেক নামীদামি কাস্ট। তবে গল্প এগিয়েছে নাসির উদ্দিন খানের চরিত্রটাকে ঘিরেই। অনেক চরিত্র কেন পর্দায় এসেছে বা পরিণতি ছাড়া কই মিলিয়ে গিয়েছে তার হদিস পাওয়া মুশকিল। গল্প এতোটাই এক চরিত্র নির্ভর যেন এ এক অটোবায়োগ্রাফি। ইন্টারভ্যালের টাইমিং জঘন্য। অবশ্য সিনেমাতে ইন্টারভ্যাল দেওয়ার মতো সাসপেন্স মুহূর্ত ছিল কিনা সেটাও একটা প্রশ্ন বটে। সিনেমার সবচেয়ে ইতিবাচক বলতেও ওই নাসির উদ্দিন খানেরলং অভিনয়। কিন্তু এই নাসির উদ্দিন খানকেই আমি ওমরে দেখেছি, হাওয়াতে দেখেছি, সিন্ডিকেটে দেখেছি, প্রহেলিকাতেও দেখেছি। একই রকম হাসি, একই রকম সংলাপ ডেলিভারি। সেই একই নেতিবাচক চরিত্র উইথ কমিক রিলিফ। অথচ চতুর্থ অধ্যায়ের শেষ দিকের কিছু দৃশ্য সাক্ষ্য দেয় নাসির উদ্দিন খান অন্য চরিত্রেও সফল হওয়ার সামর্থ্য রাখেন। নাজিম শাহরিয়ার জয়কে অনেকদিন পর পর্দায় দেখেছি, ভালোই করেছেন। মারজুক রাসেল, জাকিয়া বারী মম, ফজলুর রহমান বাবুসহ আর যারা পর্দায় এসেছেন তাদের আসলে ভালো কিছু দেখানোর মতো অবকাশ ছিল অল্প। তবে এর মাঝে খারাপ দেখিয়েছেন কেউ কেউ, যেমন: জায়েদ খান। ইনার কাছে বোধহয় একটা চরিত্র করা মানে স্রেফ ডায়লগ আউরে যাওয়া।
“প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই, কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না…” নাহ বরং বলা উচিত “দৃশ্য মিলবে দৃশ্যের সাথে ঠিকই কিন্তু সিনেমা হবে না, হবে না, হবে না…” জাস্ট কয়েকটা বহুল প্রচালিত সংলাপ দিলাম, কিছু গালিকে একটু উলটে পালটে দিলাম..একটু আমাদের রাজনীতির খণ্ডচিত্র গুলে দিলাম। নেই গল্পের দরকার, দরকার নেই কোন পাঞ্চ লাইন দিয়ে দর্শককে হাসানো। হয়ে গেল পলিটিক্যাল স্যাটায়ার!! আমি হতাশ!! সত্যিই হতাশ!! পলিটিক্যাল স্যাটায়ারের পরিচালক ফারুকূর উপর যে ভরসা ছিল তা ডুবেছে।