
নীরবতার ভেতর সম্পর্কের প্রতিধ্বনি ‘সাবা’
‘সাবা’ তে নীরবতা কেবল বিরতি নয়, এটি এক জীবন্ত চরিত্র। সংলাপহীন মুহূর্তগুলোতে দর্শক আবেগে ভেসে যায়; কখনো শোক, কখনো অস্বস্তি, আবার কখনো অদ্ভুত মমতায়…

বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে অনেক কাজ আসে ও হারিয়ে যায়, কিন্তু খুব কমই আমাদের মনের গভীরে স্থায়ী আসন গড়ে তোলে। মাকসুদ হোসেন পরিচালিত ‘সাবা’ সেই বিরল ছবিগুলোর একটি। এটি কেবল একটি পরিবারের কাহিনি নয়; বরং মানবিক সম্পর্ক, দ্বন্দ্ব, ও নীরব আবেগের গভীর অনুসন্ধান। সিনেমার কেন্দ্রে রয়েছে মা–মেয়ের সম্পর্ক। কিন্তু এটি কোনো সরল ভালোবাসার গল্প নয়; বরং জটিলতা, ভাঙন এবং আত্মত্যাগের এক ধারাবাহিক যাত্রা। এখানে প্রতিটি চরিত্রই অবস্থান করছে ধূসর বাস্তবতার ভেতরে; কেউ পুরোপুরি সাদা নয়, আবার কেউ সম্পূর্ণ কালোও নয়। এই মানবিক দিকই ‘সাবা’ কে বাস্তব জীবনের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে।
পরিচালক মাকসুদ হোসেন প্রমাণ করেছেন, তিনি চলচ্চিত্রে থাকতে এসেছেন। তার নির্মাণশৈলী ও নান্দনিকতা মুগ্ধ করেছে ভীষণভাবে। তার পক্ষে গল্প বলার নতুন ব্যাকরণ তৈরি করা সম্ভব। সংলাপের সংযম, দৃশ্য বিন্যাসের পরিশীলন এবং আবহসংগীতের মিতব্যয়ী ব্যবহার ‘সাবা’ চলচ্চিত্রটিকে দিয়েছে আন্তর্জাতিক মান। বিশেষ করে আবেগঘন দৃশ্যগুলোতে তার পরিমিত শিল্পবোধ দর্শককে চরিত্রের গভীরে টেনে নেয়। মাকসুদ হোসেন ও ত্রিলোরা খানের গল্প, চিত্রনাট্য বাংলা সিনেমায় নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। মা-মেয়ের গভীর প্রেম নিয়েও যে একটি পূর্ণাঙ্গ বাংলাদেশী সিনেমা হতে পারে, তা ভেবে বার বার মুগ্ধ হই, কৃতজ্ঞ হই।

মেহজাবীন চৌধুরী এই চলচ্চিত্রে যেন অভিনয়ের এক নতুন মানদণ্ড স্থাপন করেছেন। প্রতিটি দৃষ্টি, থেমে যাওয়া, প্রতিটি আবেগ এমন নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে যে মনে হয় তিনি অভিনয় করছেন না, বরং চরিত্র হয়ে বেঁচে আছেন। নিঃসন্দেহে এটি তার ক্যারিয়ারের সেরা কাজ, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারের জন্য যোগ্য দাবিদার। রোকেয়া প্রাচীর চরিত্রে আমরা পাই বাস্তব জীবনের ছায়া; একই সঙ্গে কঠোর ও কোমল, দূরত্ব তৈরি করেও আবার টেনে নেওয়া। তার উপস্থিতি সিনেমাকে দিয়েছে বিশ্বাসযোগ্যতা ও গভীরতা। মোস্তফা মনওয়ার বরাবরই আমার প্রিয় অভিনেতা। তার অভিনয় ‘সাবা’ চলচ্চিত্রে এনেছে ভারসাম্য ও এক ধরনের নীরব শক্তি। তার সংযত পারফরম্যান্স ছবির আবেগঘন মুহূর্তগুলোকে আরও ভারী করেছে। তাকে বেশিরভাগ দৃশ্যে দেখতেও ভীষণ সুদর্শন লেগেছে। এরকম সিনেমায় মোস্তফা মনওয়ারের মত একজন আস্থাভাজন অভিনেতারই ভীষণ প্রয়োজন ছিল। সুমন পাটওয়ারী, অশোক ব্যাপারী, প্রাণ রায়, হাসনাত রিপন, নদী সবাই তাদের অভিনীত চরিত্রে শতভাগ সৎ ছিলেন, যা পর্দায় স্পষ্ট ধরা পড়েছে।
‘সাবা’ তে নীরবতা কেবল বিরতি নয়, এটি এক জীবন্ত চরিত্র। সংলাপহীন মুহূর্তগুলোতে দর্শক আবেগে ভেসে যায়; কখনো শোক, কখনো অস্বস্তি, আবার কখনো অদ্ভুত মমতায়। সিনেমায় নীরবতার এমন ব্যবহার আমাদের চলচ্চিত্রে খুব কমই দেখা যায়। চিত্রগ্রাহক বরকত হোসেন পলাশ এ সিনেমার আরেক নায়ক। তাকে বলা যায় দৃশ্যমান কবি। চলচ্চিত্রটির ভিজ্যুয়াল শক্তি মূলত গড়ে উঠেছে বরকত হোসেন পলাশের ক্যামেরার মাধ্যমে। তিনি শুধু দৃশ্য ধারণ করেননি, আবেগকে রূপ দিয়েছেন ফ্রেমে। আলো–অন্ধকারের ব্যবহার, ক্যামেরার নীরব গতিশীলতা, আর নিখুঁত কম্পোজিশন ‘সাবা’ কে দিয়েছে ভিন্নতর নান্দনিকতা। মা–মেয়ের আবেগঘন দৃশ্যগুলোতে ক্যামেরা কখনো হয়ে উঠেছে নিরব সাক্ষী, আবার কখনো চরিত্রের অন্তর্লীন আর্তনাদ। ঢাকা শহরকে অন্যভাবে দেখিয়েছেন তিনি। সম্পাদক সামীর আহমেদ-ও আবেগকে পাশ কাটিয়ে নির্দয়ভাবে মাত্র দেড় ঘন্টার মধ্যে গল্প শেষ করেছেন। এই দেড় ঘন্টা যেন চোখের পলকে পার হয়ে গেছে। কি সুন্দর, কি নান্দনিক! নান্দনিকতা দেখা গেছে পোশাক পরিকল্পনাতেও। বিজয়া রত্নাবলী এ ক্ষেত্রে পুরোপুরি সফল। সিনেমার আবহ সংগীতও বিশেষভাবে আমার মনে ধরেছে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, ‘সাবা’ শুধু একটি বাংলা চলচ্চিত্র নয়; এটি সাম্প্রতিক সময়ে আমার দেখা বিশ্বের সেরা চলচ্চিত্রগুলোর একটি। ‘সাবা’ আমাদের শেখায় সম্পর্ক নিখুঁত নয়, ভালোবাসা কখনো সরল নয়, তবে কিছু দ্বন্দ্বের পরও আবেগই চূড়ান্ত সত্য। সন্তান আর মায়ের ভালোবাসার নিখাদ, সরল, পবিত্র, সুন্দর। মেহজাবীন চৌধুরী, রোকেয়া প্রাচী ও মোস্তফা মনওয়ারের অনবদ্য অভিনয়, বরকত হোসেন পলাশের চিত্রভাষা এবং পরিচালক মাকসুদ হোসেনের সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গি মিলিয়ে ‘সাবা’ হয়ে উঠেছে এক অসামান্য শিল্পকর্ম; যা দেখা শেষ হলেও দর্শকের ভেতরে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবে। যারা একটি ভালো গল্প দেখতে চান, সেরা অভিনয় দেখতে চান, যারা বাংলাদেশের সিনেমা নিয়ে গর্ব করতে চান, তারা পরবর্তীতে আফসোস না করে, এখনই সিনেমা হলে এসে ‘সাবা’ দেখুন। মা-বাবা, পরিবারের সবাইকে মিলে দেখুন, ভালো লাগবে।