জালালের গল্প, বাংলাদেশের গল্প
বন্ধুদের অনেকেই বলেন সিনেমা হতে হবে এন্টারটেইনমেন্ট। আমার মত দর্শকরা ভালো সিনেমা দেখে সেই বিনোদন পূরণ করেন। তবে সিনেমা বা যে কোনো আর্ট ফর্ম থেকে কেবল বিনোদিত হওয়ার বিষয়ে আমার আপত্তি আছে। ভালো সিনেমা আমার কাছে তাই যা মনের মাঝে ছাপ রেখে যায়। আর্টের কাজই তো তাই, যা আপনাকে স্পর্শ করবে, অস্বস্তিতে ফেলবে। যা চিন্তা–ভাবনার খোরাক হবে। ‘জালালের গল্প‘ আমার কাছে এমন একটা সিনেমা যা ভাবায়, কেবল এন্টাটারটেইন করে না। তবে যারা পয়সা উসুলের ছবি দেখতে চান তারাও এই সিনেমার বুদ্ধিদীপ্ত কৌতুকের কারণে বিনোদিত হবেন। তবে এ কথা জোর দিয়ে বলার সময় এসেছে, দর্শকের কিছু দায় আছে সিনেমার সাথে বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে। মানে সিনেমার সাথে যোগাযোগ তৈরি করার জন্য দর্শকের প্রিপারেশনও জরুরি। না হলে বাংলাদেশের সিনেমায় ধর্ষণের দৃশ্য দেখেও অনেক দর্শক কীভাবে শিষ দেয় বা হেসে উঠতে পারে?
আবু শাহেদ ইমন তার প্রথম ফুললেন্থ ফিচার ফিল্ম ‘জালালের গল্প’ নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছেন। তার কনটেন্ট এবং সিনেমার ভাষা বর্তমান বাংলা সিনেমার জন্য বড় অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে। এ সময় একদম তরুণ নির্মাতারা বেশ কিছু সিনেমা তৈরি করছেন যার কনটেন্ট এবং বলার ভঙ্গির কারণে বাংলা সিনেমার নতুন ভাষা তৈরিতে সহায়ক হয়ে উঠছে। আশা করি দর্শক আরো কিছু সিনেমা সামনে দেখতে পাবেন যা মুম্বাই আর তামিল ছবির বাইরে যে সাবকন্টিনেন্টে সিনেমা হয়- তা আমাদের বুঝতে সাহায্য করবে।
নামহীন জালালদের জন্ম, বেড়ে উঠা এবং আরো জালাল তৈরি হওয়ার যে চক্র, যা এই সমাজ আর রাষ্ট্র দিনের পর দিন বজায় রেখেছে, তা থেকে বের হবার কোনো পথ দেখানো নির্মাতার উদ্দ্যেশ্য নয়। বরং এই জালালদের জীবনের গল্পই এই সিনেমার প্রাণ। তার সাথে উঠে এসেছে আরো আরো প্রতিদিনের ঘটনা যা সুবিধাভোগী মধ্যবিত্তরা বাইরে থেকে দেখার কারণে ঢাকা পরে যায়। একটি নামহীন শিশুর জন্ম, ভালোবাসার প্রতি তার আকাঙ্খা আর ক্রোধের যে সম্মিলন তা এই সিনেমার দৃশ্যের পর দৃশ্যে খুব স্বাভাবিকভাবে হাঁটা চলা করেছে। কোথাও আরোপিত নয়। জোর করে দারিদ্রতা আর দুঃখীর প্রতি দুঃখী হওয়া বা আমাদের কী করণীয় জাতীয় দায়বদ্ধতার কথা বের হয়ে আসেনি।
কয়েকটা নোক্তা রেখে পরের কথায় যেতে চাই। এই সিনেমায় নামহীন শিশু, সন্তান ধারণ করা এবং না করার সাথে সমাজ কর্তৃক নির্ধারণ করে দেয়া মাতৃত্ব এবং ক্ষমতাহীন নারীর কণ্ঠে প্রতিবাদ – এই বিষয়গুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ।
নতুন জন্মানো শিশু জালাল বড় পাতিল বা ড্যাগে করে নদী দিয়ে ভেসে আসে এক গভীর গ্রামে। কেউ দায়িত্ব না নিলে এক সন্তানসম্ভবার কোলেই সে এসে পড়ে। একসময় গ্রামের রিচুয়ালের মধ্যে পড়ে সে “বিশেষ রহমতের শিশু” হয়ে ওঠে আর তার প্রথম পালক পিতার ব্যাবসার খুঁটি হয়ে যায়। স্বাভাবিক আর কৌতুকরসের মধ্য দিয়ে এই কাহিনি হাজির হয়। পরে যথারীতি গ্রামের এক ব্যক্তির অর্থলোভ আর ক্ষমতা জালালকে পালিত মায়ের কোল থেকে আবার নদীতে ভাসিয়ে দেয়।
গল্পের দ্বিতীয় অংশ সেই জালালের কিশোর বয়স। শিশুর পাওনা আদরটুকু না পাওয়ার বেদনায় প্রায় নিশ্চুপ হয়ে উঠা এক বালকের গল্পে মোড় নেয়। সেখানে সে একটি পড়ন্ত সামন্তবাড়িতে আশ্রিত অবস্থায় কবুতর, হাঁস, কুকুরের সাথে নিজের নিশ্চুপ জীবন কাটাতে থাকে। বাড়ির অসংবেদনশীল চেয়ারম্যান পদলোভী পালক পিতা (তৌকীর আহমেদ) সন্তানের আশায় একের পর এক বিয়ে করে। ড্যাগে ভেসে আসা জালাল তাকে ‘আব্বা’ সম্বোধন করলেও তার সন্তান নয়, কেবলই একজন চাকর মাত্র। পালক পিতার প্রতি জালালের ঘৃণার প্রকাশ ঘটে যখন চেয়ারম্যানবিরোধী মিছিলে তাকে সবচেয়ে আগে নাচতে নাচতে শ্লোগান দিতে দেখা যায়। সে যেহেতু প্রতিবাদ করার মত সাহসী হয়ে উঠতে পারেনা তাই তাকে জনগণের অংশ হয়েই প্রতিবাদের মুখটা খুলতে হয়। কিন্তু চেয়ারম্যানের আশ্রিত জালাল আবারো ভালোবাসা খুঁজে পায় চেয়ারম্যানের নতুন বৌয়ের (শর্মীমালা) মাঝে। ‘পুরুষ কখনো বন্ধা হয় না’ – এই বিশ্বাসের চেয়ারম্যান নতুন বৌকে বাচ্চা পয়দা করানোর জন্য ওঝার কাছে নিবেদন করে। যেখানে সেই ওঝা তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করে বাচ্চা পয়দার জন্য চেয়ারম্যানের আড়ালে। হয়তো পুরো আড়ালও নয়, ক্ষমতালোভী চেয়ারম্যান তার ‘সম্মান’ দিতে রাজি থাকে। এইখানে একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় চোখে পড়ে – ওঝা জানে তার দৌঁড় কতটুকু, তাই সে তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে নানা ভংচং দেখালেও শেষ পর্যন্ত তার বীর্যই চেয়ারম্যানের স্ত্রীর শরীরে প্রবেশ করিয়ে সন্তান উৎপাদন করতে চায় যেখানে এখনকার বিশ্বের রাজনীতির একটা ছায়া দেখা যায়। লোভের কারণে সব জেনেও “সন্ত্রাস দমনের নামে অনন্ত যুদ্ধ” চালিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ার মতন। যা হোক, জালাল তা জানালার ফাঁক দিয়ে দেখে ফেলে এবং ওঝার হাতে জালালের প্রিয় হাঁসদের একের পর এক হত্যা ঘটনায় সে একটা হাঁসকে ছেড়ে দেয়। ফলে ওঝা এবার জালালের কারণে বাড়িতে খারাপ জিনের আসর (পড়ুন-সাদ্দাম/গাদ্দাফী) হয়েছে বলে জানায়। ফলে এই বাড়িতে বাচ্চা (পড়ুন গণতন্ত্র!) হয় না বলে জালালকে হাতপা বেঁধে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। এখানেও একমাত্র চেয়ারম্যানের স্ত্রীই সত্যিকারের প্রতিবাদী হয়ে উঠে কিন্তু ক্ষমতার অভাবে সে জালালকে রক্ষা করতে পারে না। কিন্তু শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত সেই নারী তার স্বামীর চোখের দিকে তাকিয়ে না বলা ভাষায় বলে দেয় আসলে বন্ধ্যা কে, আর চেয়ারম্যানও তা নিরবে চোখ নামিয়ে স্বীকার করে নেয় যেন।
জালালের গল্পের তৃতীয় ভাগে জালাল তরুণ। এখানেও সে চুপচাপ কিন্তু স্নেহবঞ্চিত। ফলে অন্য কারো প্রতিও তার আর মায়ার অবশিষ্ট থাকে না। যে তাকে আশ্রয় দিয়েছে তার প্রতিই শুধু কুকুরের মতন পূর্ণ আনুগত্য নিয়ে হাজির থাকে। এই জালালদের দিয়েই তো পেট্রোল বোমার রাজনীতি চলে! ইটভাটার মালিক সন্ত্রাসী মোশাররফ করিম এখানে যেন আরেকজন জালাল। টাকা আর ক্ষমতা তাকে নিষ্ঠুরতম ব্যক্তিতে পরিণত করেছে। ভেসে আসা জালালকে সে সাথে রেখে বড় করেছে সাগরেদ হিসেবে। জালালকে সে আদর করে কিন্তু সেই আদরও যেন নির্যাতন। জালালকে জোর করে চেপে চেপে খাওয়ানো মোশাররফের সাইকোলজি পরিষ্কার করে দেয়। সমাজের মানুষ তার মিথ্যা কথা বুঝে কিন্তু চুপ থাকে, নিরবে চা খায়। সেও ইলেকশনে দাঁড়াতে চায়। (বাংলাদেশ দেখা যায়?) এবং তার যাবতীয় অন্যায়ের সাথে যুক্ত হয় একটি মেয়েকে (মৌসুমী হামিদ) ধরে এনে দিনের পর দিন ধর্ষণ। ধর্ষণ সুখভোগ্য করার জন্য একমসয় মেয়েটির কাছে নিজেকে প্রেমে দুর্বল মানুষ হিসেবে অভিনয় করে মোশাররফ। ফলে মৌসুমী (যে কখনো স্নেহ পায়নি, যেনো আরেক জালাল) – মোশারফকে বিশ্বাস করে ভালোবেসে ফেলে। সে ধরে নেয় মোশাররফ তার প্রেমে পড়েছে এবং সে তার সাথে সাংসারিক হয়ে ওঠে। কিন্তু যখন সে সন্তানধারণ করে, তখন মোশাররফ তাকে প্রশ্ন করে “এটা কার বাচ্চা”, সে সময় চিরাচরিত পুরুষতন্ত্রের লোভী দায়িত্ব নিতে না চাওয়ার ঘৃণ্য চেহারা সামনে এসে দাঁড়ায়। ইলেকশনের কারণ উল্লেখ করে মোশাররফ বাচ্চা নষ্ট করতে চাইলেও মৌসুমী তা হতে দেবে না বলে জানিয়ে দেয়। ফলে ঝামেলা তৈরি না হওয়ার জন্য মোশাররফ তাকে এ্যসিসটেন্ট জালালসহ দূরে একটা বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। যাওয়ার আগে মৌসুমীর সামনে সে হয়তো জীবনে প্রথম সত্যিকারের আবেগ প্রকাশ করে, বলে, যে পানির খোঁজ মেয়েটি করছে এখানে তা নাই। প্রচণ্ড খারাপ মানুষটির ভেতর বিদ্যুত ঝিলিকের মত ভালো মানুষের অন্তরের বিষাদ ধরা পরে।
মৌসুমী জানে কিছু বলার নাই, কিছু বলেও সে কিছু পাবে না। ভুল মানুষকে ভালোবাসার পরও সে তাকে ভালোবাসে, সন্তানকে চায়। সকল প্রকার স্নেহবঞ্চিত হয়ে সন্তানসম্ভবা একজন নারীর দমবন্ধ হয়ে ওঠার জার্নি আমরা দেখি। এখানেও জালাল তার ভালোবাসার তীব্র আকাঙ্খায় মেয়েটির প্রতি ভালোবাসায় আর্দ্র হয়ে উঠে। একজন নারীর প্রতি সেই ভালোবাসায় কামের গন্ধ নাই। তা যেন কেবলই একজন মানুষের প্রতি একইরকম আরেকজন মানুষের ব্যাকুলতা।
ছোটবেলা থেকে সে কেবল প্রকৃত ভালোবাসা পেয়েছে নারীর কাছ থেকেই। সেই ভালোবাসাই যেন ফিরিয়ে দিতে চায়। শেষ পর্যন্ত মেয়েটি মারা গেলেও জালাল শিশুটিকে আপন করে নেয়। কিন্তু মোশাররফের ইলেশনে জেতার জন্য যাতে “ইমেজ সংকট” না হয় তাই সেই শিশুটিকেও মেরে ফেলতে বলে তার অন্য সাগরেদদের। জালালকে না জানিয়ে সেই সাগরেদরা একটা ড্যাগে করে শিশুটি পানিতে ভাসিয়ে দেয়। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি চলে। জালাল শেষ মুহুর্তে এসেও শিশুটিকে ছুঁতে পারে না। নতুন জালাল নতুন জীবনের যাত্রায় রওনা দেয় আর আমাদের চোখের সামনে বেড়ে উঠা জালাল সেই পানিতে হারিয়ে যায়।
সিনেমার সিনেমাটোগ্রাফি এবং ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর নিয়ে এখন কথা বলতে চাই না। অফভয়েস ডায়ালগ একটু বেশি হলেও ট্রিট্রমেন্ট হিসেবে তা সার্থক হয়েছে। বেশ কিছু জায়গায় ইমেজগুলো কথা বলছিল, তারপরও ডায়ালগ বাড়তি মনে হয়েছে। এ্যাক্টর সিলেকশনে নির্মাতা মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। প্রতিজন অভিনয় শিল্পী ভালো পারফরমেন্স করেছেন। বিশেষ করে কিশোর জালালকে (দশ বছর বয়সী মোহাম্মদ ইমন) মনে হয়েছে এই সিনেমার সবচেয়ে সফল অভিনয় শিল্পী। শর্মীমালা আর মিতালী দাস অসাধারণ। মৌসুমী হামিদ আবারো নিজেকে প্রমাণ করে জানান দিলো কোন ধরনের সিনেমার জন্য সে উপযুক্ত। একজন অভিনয় শিল্পীকে নির্মাতা কীভাবে কাজে লাগাতে পারেন তা মৌসুমী সবচেয়ে ভালো উদাহরণ। তরুণ জালাল আরাফাত রহমান খুব ভালো করেছেন।
সিনেমায় প্রাণীর উপস্থিতি আর তাদের পারফরমেন্স দেখার মতন। ডকুমেন্ট্রি সিনেমায় সাধারণত আমরা আকস্মিকভাবেই বিশেষ কোনো মুহূর্ত পেয়ে যাই, ‘জালালের গল্প’ ফিকশন হবার পরও এমন কিছু ম্যাজিক মুহূর্ত পেয়ে গেছে এবং ইমন দারুণভাবে তা পর্দায় নিয়ে আসতে পেরেছে। বিশেষ করে ওঝা – চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীর স্ত্রীকে ধর্ষন করে এলোমেলোভাবে ঘর থেকে বের হয়ে যাবার পর দুইটা কুকুর হাজির হয় দরজার সামনে এবং দর্শকদের দিকে তাকিয়ে যেন জানান দেয়, তোমরা আমাদের সম্মান নষ্ট করো, পরিচয় নষ্ট করো, তোমাদের প্রতি অভিশাপ!
সবকিছু মিলিয়ে ‘জালালের গল্প’ দর্শকদের পছন্দের একটি সিনেমা হবে বলে আশা করি। সিনেমা হলে এই সিনেমা নিশ্চয় সাফল্য পাবে। আর প্রযোজক প্রতিষ্ঠান ইমপ্রেসকেও ধন্যবাদ তারা এমন একটি সিনেমা নির্মাণ করেছে। নিশ্চই তারা বাংলাদেশের গল্প বাংলাদেশের নতুন সিনেমার ভাষায় বলে উঠতে পারে এমন সিনেমাকে প্রযোজনা করবে। ইমন এবং তার টিমকে অনেক শুভেচ্ছা!
তাসমিয়াহ্ আফরিন মৌ, চলচ্চিত্র নির্মাতা