Select Page

অনুদানের এক বিয়োগান্তক কাব্য ‘গলুই’

অনুদানের এক বিয়োগান্তক কাব্য ‘গলুই’

স্পয়লার অ্যালার্ট: ছবিটি না দেখলে বা গল্পের গুরুত্বপূর্ণ টুইস্ট জানতে না চাইলে লেখাটি পরিহার করুন

অনুদানের সিনেমা ‘গলুই’। ছবির শুরুটা দেখে মনে হতে পারে পরিকল্পনাহীন গাছ কাটার বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদের এক ছবি। মনে হতে পারে নৌকা বাইচের সঙ্গে জড়িত মানুষদের জীবন ও জীবিকার ছবি। মনে হতে পারে প্রার্থনা কিংবা বাদ্য গীতের মাধ্যমে বৃষ্টি আনার ‘অবৈজ্ঞানিক’ ছবি। মনে হতে পারে গন্তব্যহীন এক ‘গলুই যাত্রা’র বাণিজ্যিক ছবি। শেষমেষ এটা হিন্দি বা বাংলা সিনেমার বহুকাল ধরে বয়ে চলা ধনী-গরিবের প্রেমের সেই ফর্মুলা ছবি, শেষটা যার বিয়োগান্তক!

ছবিতে নদীর মাঝি পরচুলা পরা সুব্রত। তার স্ত্রী সূচরিতা, সেও পরচুলা আবৃত। তাদের ছেলে লালুরূপী শাকিব খান। সে ক্লাস ফাইভ পাস করেছে। অবসরে সে গাছের সঙ্গে কথা বলে। গাছের কাণ্ড ও বাকল কেটে সেখানে ছবি আঁকে! সেই ছেলেটাই আবার ওই গাছ কেটে ফেলাতে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পায়। গাছ কাটার শব্দ সে নিতে পারে না। নৌকা বাইচের এক প্রতিযোগিতার সময় সুব্রত সাহেবের নৌকাটা ভেঙে যায় বলে ওই গাছ কেটে পরবর্তীকালে নৌকা বানানো হয়! গাছ কাটার পর যে নৌকা বানানো হয় গাছের তুলনায় সেটা বেশ ছোট! এই নৌকা ২০ বছর পরেও তেমন ঝকঝকে তকতকে থাকে, যদিও সেটা ব্যবহৃত হয়নি অনেকদিন, কিন্তু সেটা পড়ে থাকত খোলা আকাশের নিচেই!

একই গ্রামের জমিদারের নাতি মালা যাকে ডাকা হয় রাজকন্যা নামে। নৌকা বাইচে যে দল যেতে সেই দলের দলপতিকে পুরস্কার হিসেবে নিজের হাতে মালা গেঁথে সেই মালা পরিয়ে দেয় রাজকন্যা নিজেই। ‘ভিখিরির কি ডাকাত হতে ইচ্ছে করবে না একদিনও’-এর সূত্র ধরে বা ফর্মুলা ছবির চিরায়ত ধারা অনুসারে এই মালা নিজের গলায় পরবার সাধ জাগে লালু ওরফে শাকিব খানের, তার আরও সাধ জাগে এই মালা সে পরিয়ে দেবে মায়ের গলায়। সে গাছ কেটে নৌকা বানানোর কারণে বাবার মৃত্যুর পর বৈঠা ধরেনি।

সে তার গায়েন চাচা আজিজুল হাকিমের কাছ থেকে ঢোল বাজানো শিখেছিল। লালু ঢোল বাজানের আমন্ত্রণ পায় রাজকন্যার কাছ থেকে। খরার সময় যেন বৃষ্টি নামে সেজন্য গীত বাদ্য হয়, কিন্তু বৃষ্টি নামে না। রাজকন্যার মন খারাপ দেখে দোয়া পড়া শুরু করে শাকিব খান। তখন বৃষ্টি নামে! বাংলা ছবিতে যেমন মাজারে যেয়ে কান্না ও প্রার্থনার দৃশ্য থাকে, দৃশ্য থাকে স্বজনদের ফিরে পাওয়ার, সেই তুলনায় বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা অভিনব মনে হতে পারে।

এরপর শাকিব খানের বৈঠা ধরার দৃশ্য নিয়ে অনেক কসরত ও নৌকা বাইচের দৃশ্য আছে সিনেমাতে। আছে নৌকা বাইচে বিজয়ী হওয়ার দৃশ্য। মালা পরানোর পরে সেই মালা মারূপী সূচরিতা গলায় পরে না বরং আবদার করে এই মালা যে বানিয়েছে সে যেন এসে গলায় পরিয়ে দেয়। ফর্মুলা ছবির নিয়ম অনুসারে জমিদার নানার সাবধান বাণী সত্ত্বেও প্রায় লুকিয়ে শাকিবের বাড়িতে আসে মালা বা রাজকন্যারূপী পূজা চেরি। শাকিবের মায়ের গলায় সে মালা পরিয়ে দেয় কিন্তু মা এবার চায় শাকিব তাকে বাড়ির বউ হিসেবে নিয়ে আসুক!

এরপরের ঘটনাটাও গতানুগতিক। জমিদার নানা শাকিবকে সময় নিয়ে প্রস্তুত হয়ে আসতে বলে। সিনেমার ‘গৎ’ অনুসারে লালু ফিরে আসে, মালার সঙ্গে কথাও বলে না। প্রস্তুত হয়ে যাওয়ার পরে সে জানতে পারে রাজকন্যার বিয়ে হচ্ছে খান বাহাদুর পদবীর এক ব্যারিস্টারের সঙ্গে। শাকিব বিয়ের দিন রাজকন্যা ও তার জামাইকে তার নৌকায় নদী পার হওয়ার অনুরোধ জানিয়ে আসে। পার হওয়ার দৃশ্যে অবশ্য শাকিব খান আর পূজা চেরিকেই দেখা যায়! বিয়োগান্তক এক গানের মাধ্যমে তাদের বিচ্ছেদ হয় যার এক লাইনের কথা এমন-‘তুই আর আমি দুই’! সারা ছবিতে রাজকন্যার সঙ্গে লালুর এই সম্বোধন খুঁজে পাওয়া যায়নি!

শেষমেষ কী দাঁড়ালো তাহলে? অনুদানের সময়ে জমা দেয়া পাণ্ডুলিপির সঙ্গে এই ছবির চিত্রায়িত পাণ্ডুলিপির মিল আছে কি না কেউ না জেনেও এই প্রশ্ন তুলতে পারে। মাঝি বা খেটে খাওয়া মানুষদের এই ছবিতে গরিব মনে হয়নি। শাকিব নিজে যে পোশাক পরেছেন সে সবও দামি! গান, নাচ, নৌকা বাইচ বা সাধারণ দৃশ্যে সবার পোশাক যেমনই হোক সবটা নতুন মনে হয়েছে। সম্ভবত সব কিছু রঙিন দেখাতেই এমন করা হয়ে থাকতে পারে। নৌকাটা যেমন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক দেখানো হয়েছে তেমনি শাকিবের প্রস্তুত হওয়ার শুরু থেকে নতুন ঘর তোলা, দুটো গরু কেনা, বাজারের দোকান করা সময়ের ব্যপ্তি কতটুকু বা কত বছর? সেই ধারাবাহিকতা কী আছে ছবিতে?

এসব প্রশ্ন তোলার বড় কারণ ‘গলুই’ ছবির পরিচালক এস এ হক অলিক নিজেই। তার আগের দুটো ছবি ‘আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা’ বা ‘হৃদয়ের কথা’ প্রচলিত বাংলা ছবির জগতে আশা জাগানিয়া ছবি। এই দুই ছবির গানগুলো আজও সমান জনপ্রিয়।

‘গলুই’তে হাবিব ওয়াহিদের গান কিংবা এস আই টুটুলের কণ্ঠের গানগুলো জনপ্রিয় হবে এমন আশা করাই যায়। সারা সিনেমায় চমকে দেওয়ার মতো অভিনয় করেছেন পূজা চেরি। বয়সের তুলনায় অনেক পরিপক্ক মনে হয়েছে তার অভিনয়। শাকিব সেই তুলনায় ম্লান হলেও শেষের কয়েকটি দৃশ্যে তাকে মনে রাখবে মানুষ। ছবির শেষদৃশ্য সাধারণ দর্শকদের জন্য কান্নাময়। বাঙালি যতটা হাসে তার বেশি অনেক কান্নাময় তাদের জীবন। অনেক দুর্বলতা সত্ত্বেও গান ও ছবির ফটোগ্রাফির জন্য ‘গলুই’কে মনে রাখতে পারে মানুষ।

গলুইর কাহিনি লিখেছেন প্রযোজক খোরশেদ আলম খসরু। সংগীত পরিচালনা করেছেন ইমন সাহা। আলী রাজ, আজিজুল হাকিম, ঝুনা চৌধুরী,সমু চৌধুরীসহ আরও অনেকে অভিনয় করেছেন।

পূজা চেরির অভিনেত্রী হয়ে ওঠা, শাকিবের প্রচলিত ‘হি ম্যান’শিপ থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা, শেষ গানের জন্য ‘গলুই’ দেখতে হলে ফিরুক মানুষ। জয় হোক বাংলা সিনেমার। ফিরে আসার সময় মনে হতে পারে ছবির এক দর্শনময় সংলাপ। গায়েন চাচা আজীবন তার স্ত্রীর কবরের পাশে থাকে। এই কবর দেখিয়ে শাকিব খানের সংলাপ-‘কারও ভাগ্যে হয়তো কবর মেলে! আর কেউ যদি কবরও না পায় তখন’?

এস এ হক অলিকের পরবর্তী সিনেমা ‘যোদ্ধা’র জন্য শুভকামনা রইলো।

*রিভিউটি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

আহসান কবির

অভিনেতা ও লেখক

মন্তব্য করুন