Select Page

অলিভিয়া ও শবনম: অন্যকে বরণ আর হরণ, দুইজন উদাহরণ

অলিভিয়া ও শবনম: অন্যকে বরণ আর হরণ, দুইজন উদাহরণ

প্রসঙ্গসূত্র

এটা কাকতাল হবার কথা যে অলিভিয়া গোমেজ করাচীতে জন্মে ঢাকায়, এবং ঝর্ণা বসাক ওরফে শবনম ঢাকায় জন্মে লাহোরে ছায়াছবি করেছিলেন। অন্তত দুজন বসে পরিকল্পনা করে এরকম ঘটনা ঘটানোর সুযোগ ছিল না। এটাও কাকতাল হবার কথা যে অলিভিয়া বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ছিলেন, আর শবনম ছিলেন পাকিস্তানের সংখ্যালঘু। তবে এটা একেবারেই কাকতাল নয় যে, অলিভিয়া চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন পাকিস্তান বিভক্ত হবার পরে, ১৯৭২ সালে। [১] শবনম করেছিলেন অখণ্ড পাকিস্তানে ১৯৬১ সালে। [২] এটাও কাকতাল হবে না যে এই পরিচয়ভিত্তিক সূত্রপাতের পরপরই পাঠকদের একাংশ নিদারুণ অস্বস্তিতে পড়বেন; এমনকি বিরক্তও হয়ে যেতে পারেন মারাত্মক। কেউ কেউ পাশে-বসে-থাকা কাউকে বলেও বসতে পারেন “এই পরিচয় টানা/আনা কি খুব জরুরি ছিল?” কিংবা আরো কঠোর কিছু, যেমন: “জানতাম, পেটের মধ্যে এসব নিয়েই বসে থাকে।” কিন্তু ভেবে দেখুন, পরিচয়গুলো আমি বানাইনি। হিসাব করে দেখলে অলিভিয়া বা শবনমও বানাননি। ভারতের চলমান রাজনৈতিক তৎপরতাতে আমির খান কিছু বলে বসলেন কিনা, কিংবা নাসিরুদ্দীন শাহ; কিংবা সালমান খান বরাবরের মতো হিসাবমাফিক চুপ থাকতে পারলেন কিনা ইত্যাদি বসে বসে নিরীখ করবার জন্য তামাম ভারতের লক্ষ লক্ষ লোক যে অপেক্ষা করতে থাকেন, সেটা কি এই খানসাহেবদের নিজেদের বানানো পরিস্থিতি? নাকি সেখানে একাই গদা-হাতে নেমে দু-ঘা লাগিয়ে ভারতবাসীর সাংস্কৃতিক আত্মা বদলানোর কোনো সামর্থ্য তাঁরা রাখেন? লতা মঙ্গেশকরের মৃতদেহে দু’আ পড়ে ফুঁ দেয়াতে শাহরুখ খানের কি হেনস্তা হতে হয়নি? [৩] করণ-অর্জুন [৪] ছায়াছবিতে শাহরুখ খান সালমানের সাথে পুনর্জন্মপ্রাপ্ত চরিত্র করে ফেলাতে কি রক্ষা পেলেন? এসবের সাথে অঞ্জু ঘোষ, সুব্রত চক্রবর্তী বা চঞ্চল চৌধুরীর সামাজিক (-রাজনৈতিক) জীবন এনে পুরা পরিস্থিতির আরো পাকানো চেহারা আপনাদের সামনে হাজির করা সম্ভব। ফলে পরিচয়প্রণালীর প্রসঙ্গ উল্লেখের কারণে আমি বাড়তি কোনো সমস্যায় কাউকে ফেলিনি; বরং যেসব প্রবণতা চলমান তাতে তাঁদের পরিচয় হাজির করে আমি ‘সত্যনিষ্ঠা’, ‘বস্তুনিষ্ঠা’ ও ‘গবেষণা-ইথিকস’-এর কাজ করছি বলে দাবি করতে পারি। অধুনা বিশ্বজগতে আইডেন্টিটি-বিশারদদের এতে সন্তুষ্ট হবার কথা।              

পরিপ্রেক্ষিত: এটা কোনো তুলনামূলক নন্দনতত্ত্ব বা অভিনয়বিদ্যার রচনা নয়

অলিভিয়া আর শবনমের নাম একত্রে নেবার কারণে কেউ কেউ যাতে ভেবে না বসেন যে এই রচনা তাঁদের মধ্যকার অভিনয়-দক্ষতার একটা তুলনামূলক আলোচনা। এই দক্ষতা বিচার করার কোনো যোগ্যতা আমার নাই; আসলে ইচ্ছাও নাই। এঁদের দু’জনের মধ্যে আমার সুষ্পষ্ট পক্ষপাত থাকা সত্ত্বেও সেই পক্ষপাতও এই রচনাতে কোনো আছর ফেলবে না। আমার পক্ষপাতের কারণ খুবই স্পষ্ট। আমি কৈশোরে পর্দায় অলিভিয়াকে দেখেছি এবং তাঁর প্রতি আকর্ষিত ছিলাম। পর্দায় শবনমকে আমি প্রায় কখনোই দেখিনি। তাঁর প্রতি আমার যা-কিছু মুগ্ধতা তা খানিকটা ‘পাকিস্তান বিজয়ের’ (পরদেশ অর্থে, শত্রুপক্ষ অর্থে নয়) গল্পকাহিনির মধ্যে নিহিত। কিন্তু আমি আলাদা করে এই তুলনার প্রসঙ্গটা তুলবার সঙ্গত কারণ পেয়েছি। আমি লাগাতার বহু মানুষের কাছে অলিভিয়ার অবমূল্যায়ন লক্ষ্য করেছি। তাঁর সমসাময়িক অন্তত তিনজন অভিনেত্রীকে সসম্মানে নাম নেবার সময় তাঁর নাম নেয়া হয় না – পত্রপত্রিকায় যেমন, জনজবানেও। আবার কেউ তাঁর নামটা নিলেও সমমানের একটা কাতারে না-রাখবার নিরন্তর মোচড়ামুচড়ি চলতেও দেখেছি। সবচেয়ে কম প্রতিরোধ যাঁরা করেন, তাঁরাও বড়জোর বলেন যে “উনি তো আসলে তেমন আর কাজ করেননি।” এটা প্রমাণ করার কোনো সুযোগ বের করা কঠিন হবে যে, চলচ্চিত্র বিষয়ক আলাপ-আলোচনায় অলিভিয়ার কাতারশামিল না থাকতে পারার প্রধান কারণ মধ্যবিত্তের গভীর পূর্বসিদ্ধান্ত যে অলিভিয়া ‘রুচিসম্মত’ ছবিতে কাজ করেননি। এটাকে আরো খোলাসা করে বললে অলিভিয়ার কথিত ‘আবেদনময়তা’ তাঁকে বোদ্ধা শিবিরে অনুপ্রবেশে বাধা দিয়ে এসেছে। কোলকাতায় গিয়ে ছবিতে অভিনয় করেও [৫] এই রুচিছাঁকনিতে তিনি আটকা না পড়ে থাকতে পারেননি। তবে জনজবান ও মধ্যবিত্ত রুচির চিরুনি অভিযানের বাইরে তিনি তাঁর সমকালীন সহকর্মীদের কারো কারো সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্কে আছেন। অন্তত ববিতার সাথে তো বটেই, ববিতার সাক্ষাৎকার থেকে অন্তত সেরকম জানা যায়। [৬]    

নাদিম ও শবনম

বোদ্ধা-নাগরিকদের ঠিক একই রকমের বর্জনকারী মনোভাব শবনমকে সামলাতে হয়নি। কেউ তাঁকে পর্দায় অধিক দেখুন বা নাই দেখুন, পছন্দ করুন বা নাই করুন, অন্য একটা দেশের নানাবিধ পুরস্কারপ্রাপ্ত-মর্যাদাপ্রাপ্ত জীবনের উচ্চতার চোটে এই বর্জনের মধ্যে তাঁর নামকে পড়তে দেখিনি। বস্তুত, বাংলাদেশের চিন্তক মহলের স্বীকৃতি বা উল্লেখের উপরে শবনমের অতিকায় চলচ্চিত্রীয় ব্যক্তিত্ব নির্ভরই করেনি। শবনমের ক্ষেত্রে বিষয়টা বরং খুব ভিন্ন। তিনি যে একজন বিশালাকার তারকা হয়ে আরেক রাষ্ট্রে বিরাজ করছিলেন সেটা ভালোমত জনসমক্ষে হাজির হবার জন্য তাঁর নিজেরই প্রায় বাংলাদেশে চলে আসতে হয়েছে। বা তাঁর প্রত্যাবর্তনের উছিলায় [৭] তাঁর বিশালাকার তারকামূল্য এদিকে ঠিকঠাক মতো আলোচিত হলো। শবনম হচ্ছেন বাংলাদেশের সেই মৃদুচ্চারিত আশ্চর্য সাংস্কৃতিক সত্তা যাকে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের বাহ্য প্রচারিত সম্পর্কের মধ্যে কোথায় বসানো হবে তা নিয়ে ভদ্রাত্মা চিন্তিত থাকতে পারেন, থাকেনও বটে। এই পরিস্থিতিটা আরো ঘনীভূত হয় তাঁর পাকিস্তানের মহাসেলিব্রিটি জীবনে বিস্ময়কর বৈপরীত্যময় ঘটনাপ্রবাহে, যার সীমানাতে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মানপ্রাপ্তি থেকে সবচেয়ে ভীতিকর নিগ্রহ পর্যন্ত রয়েছে। [৮]

এই রচনার ‘গবেষণাহীনতা’র কথাটাও স্পষ্ট করে জানানো দরকার পড়ছে। আমি একবার ভেবেছিলাম বিশদ করে লিখব যে কীভাবে আমি এই গবেষণাটি সাধিত করেছি। কিন্তু ‘গবেষণা’ বলতে যা-যা বোঝানো হয়ে থাকে সাম্প্রতিককালের লেখাপড়ার জগতে, সেখানে ঢুকে কথাখরচের ক্লান্তি দূর করাই বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত মনে হলো; অন্তত এই রচনাটির বেলাতে। বরং, আমি স্পষ্ট করে ঘোষণা করি যে, আমি এই দুই মহাতারকার কোনো সাক্ষাৎকার নিইনি। অনেক অনেক ইচ্ছা হওয়া সত্ত্বেও দেখা করবার সম্ভাব্য উপায়ের জন্য কারো কাছে আব্দার করার চেষ্টা করিনি। এই রচনা তাঁরা পড়বেন এবং আমাকে ফোন করে সস্নেহ রচনা-উত্তর সাক্ষাৎকারের দাওয়াত দেবেন সেরকম অধিকল্পনা/ফ্যান্টাসিকেও আমি দীর্ঘক্ষণ মাথায় রাখি না। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় যে দুইটা আর্কাইভরূপী সংস্থা আছে বলে আমি জানি – জাতীয় চলচ্চিত্র আর্কাইভ এবং প্রেস ইন্সটিট্যুটের মহাফেজখানা – তার কোনোটাতেই আমি দলিল-দস্তাবেজ খুঁজিনি। এবং সমাজের ও রাষ্ট্রের বাসিন্দাদের কাছে গিয়ে জানতে চাইনি ‘অলিভিয়া-শবনম সম্বন্ধে আপনাদের পারসেপশন কী’। [৯]                    

অলিভিয়ার অন্তর্ধান

সহঅভিনেতা উত্তম কুমারের সঙ্গে ‘বহ্নিশিখা’ চলচ্চিত্রের সেটে অলিভিয়া

অলিভিয়ার পর্দার আড়ালে যাওয়া নিয়ে একাধিক থিসিস আছে। জনজবানের কথাই বলছি। একটা হচ্ছে, তিনি সংসারে মনোযোগ দিয়েছেন। একটা হচ্ছে, তিনি ধর্মকর্মে মন দিয়েছেন। এখন সংসার আর ধর্মকর্মে মন দেয়াকে এক কাতারে রাখা যাবে কিনা তা নিয়ে আমি ভাবছিলাম। রাখা বা না-রাখাতে প্রভেদ নেই সিদ্ধান্তেই আসলাম। তৃতীয় যে থিসিসটা চালু আছে তা হলো তিনি স্বামী এস এম শফির মৃত্যুর পর শোকাতুরভাবে আর চলচ্চিত্র না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন ও সেটা বলবৎ রেখেছেন। নতুন ‘আবেদনময়ী’ নায়িকারা চলচ্চিত্রাঙ্গনে চলে আসার পর তাঁর তারকাখ্যাতি হুমকির সম্মুখিন হচ্ছিল বিধায় তিনি সেই ‘পড়তি’ অবস্থার মধ্যে থাকতে চাননি – এরকম একটা মতবাদও চালু থাকতে শুনেছি আমি। এখন এই রচনার সময়ে খোঁজাখুঁজি করে বুঝলাম যে এসব মতবাদ কেবল জনজবানে নয়, আসলে সাংবাদিকতার জগতেও বিদ্যমান আছে। সেখানেও যুক্তিসূত্র বা থিসিস কমবেশি এগুলো নিয়েই আবর্তিত। এখন এখানে সাংবাদিকতার বিষয়টি নিয়ে একটু বিস্তারিত ও পেঁচিয়ে না বললে নয়। এখানে একটা প্যাঁচ হচ্ছে, যেহেতু আমি পিআইবি-মহাফেজখানাতে দিনের পর দিন কাটাইনি, যেহেতু বিগত বছরগুলোতে নানাবিধ দৈনিকের সাপ্তাহিক চলচ্চিত্রীয় পাতাতে মনোযোগ দিইনি, তাই আসলে অলিভিয়াকেন্দ্রিক সংবাদের হাল-হকিকত বোঝা আমার সুবিধাজনক নয়। এতে প্রামাণ্য কম, ও অনুমান অধিক থাকার কথা। দ্বিতীয় প্যাঁচ হলো, চলচ্চিত্র পাতার সাংবাদিকতাকে মধ্যবিত্ত লোকজন কতটা সাংবাদিকতা জ্ঞান করেন তার বিষয়ে একটা সন্দেহ আমার আছে। তৃতীয় প্যাঁচটা হলো, সাইবার-উত্থান কালে যতকিছু সাংবাদিকতার নামে চর্চিত, তাকে আমিও সাংবাদিকতা বললে বিপদ বাড়বে কিনা। এসব প্রাসঙ্গিক দুর্ভাবনা সত্ত্বেও সাইবার-সংবাদরাজ্যে মোটামুটি ‘কোথায় গেলেন অমুক?’ ‘অমুক এখন কী করছেন?’ সিরিজের যে ভিডিও সংবাদনিবন্ধগুলো সুলভ, সেখানে অলিভিয়াও অনুসন্ধানের বিষয়বস্তু। তুলনামূলক হিট নিয়ে যেহেতু আমি বসিনি, তাই কার তুলনায় কম বা বেশি তা আর খুঁজিনি।

অলিভিয়া যখন পর্দায় আসতেন তখন তাঁকে নিয়ে দর্শকদের মতামতের কোনো ইয়ত্তা ছিল না। তাঁর মধ্যে একটা সত্যবচন শৈশবে দারুণ এক তথ্যের মত কানে এসেছিল। ‘অলিভিয়া তো খ্রিষ্টান’। পাশের দর্শকদের কেউ পরস্পরকে জানাচ্ছিলেন। আরেকটা তথ্য ছিল: ‘সে তো বিদেশী, বাংলা জানে না, অন্য লোকে বলে দেয়।’ দারুণ উত্তেজনার এক তথ্য; বিশেষত চলচ্চিত্রের স্বরযোগসংক্রান্ত সম্পাদনার কিছুই না জানার কালে। আমি অলিভিয়ার কয়টা ছায়াছবি দেখেছি তা এখন আর মনে নেই। এমনও হতে পারে দেখিনি যে ছায়াছবি সেটাও ভ্রান্তস্মৃতি হিসাবে বানোয়াট দেখা দিতে পারে। তবে যাই-ই দেখে থাকি না কেন সবই হলের পর্দায়। ইউট্যুব কালে তাঁর ছবি পাওয়া যায়, দেখা হয়নি। হলে-দেখা ছবির সংখ্যা যাই হোক সেগুলো মেহেরপুরের নীলমণি সিনেমা হলেই [১০] হবার কথা, হিসাবানুযায়ী ১৯৭৮-৮৬ সাল অবধি। [১১] এখন হিসাব করতে বসে তাঁর বাহাদুর (১৯৭৬) আগে দেখেছি নাকি আগুনের আলো (১৯৭৭) তা মনে পড়ছে না। কিন্তু অবরোহী পদ্ধতিতে সিদ্ধান্তে আসা দরকার যে প্রথমটা পর্দায় দেখার লোভসমেত আমি পোস্টার দেখেছি, আর দ্বিতীয়টা পর্দায় দেখেছি। অলিভিয়ার প্রতি আমার শুভনজর [১২] পড়ে আগুনের আলো ছায়াছবিতেই। আর সেটা বলবৎ থেকে গেছে বুলবুল-এ-বাগদাদ (১৯৭৯), শাহজাদী গুলবাহার (১৯৮১), টক্কর (১৯৮৩), কিংবা হিম্মতওয়ালী (১৯৮৪) অবধি। আদৌ তাঁকে পর্দায় দেখি বা পোস্টারে দেখে থাকি। আগুনের আলো ছিল সাদাকালো ছবি যেখানে অত্যাচারী জমিদারের বিরুদ্ধে বিপ্লবাত্মক নায়ক [১৩] আলমগীর ও সোহেল রানা বিজয়ী হন, ‘গ্রামবাসীর’ হক প্রতিষ্ঠা করেন; এবং এসবের মাঝে গ্রামকন্যা অলিভিয়ার সাথে এঁদের একজনের, সম্ভবত সোহেল রানার, পাকাপ্রণয়/হবুবিয়াও ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু অলিভিয়াকে আমি নীলাভ আলোর রঙিন ছবিতে ওয়াসিমের সাথে পর্দায় দেখেছি। এখন সেই ছবির নাম বা কাহিনি হাতড়ানো নিষ্প্রয়োজন। তবে তাঁকে দেখার অনুভূতির একটা আবছায়া রূপরেখা আমি স্মরণ করতে পারি। তা এক দুর্দান্ত অনুভূতি। এর একটা অনুবাদ হতে পারে তাঁকে পর্দায় আরো-আরো দেখার ইচ্ছা হিসাবে। তবে ছায়াছবি দেখার অনুমতি, কিংবা পয়সা কোনোটাই আমার জন্য সুলভ ছিল না। অনুমতির বিষয়টা আরো জরুরি, কারণ নায়িকা অলিভিয়ার কথা হচ্ছে।  

‘দি রেইন’ ছবিতে অলিভিয়া ও ওয়াসিম

আমার শিশুকালে এসব ছবির সকল দর্শকই শিশু ছিলেন না অবশ্যই। আর উপরে যেসব জনবাণী জড়ো করলাম সেগুলোও মুখ্যত বয়োজ্যেষ্ঠদের জ্ঞান-বিতরণ ছিল। আরও অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় কানে এসেছিল বলে মনে পড়ে। বিষয় একটা, ভাষামালা কয়েকটা: ‘ওয়াসিমের সাথে তো অলিভিয়ার প্রেম’; ‘ভাবির সাথেই আসল সম্পর্ক’ ইত্যাদি। তখন এসব শুনে উত্তেজনা লাগত নাকি বিষন্ন লাগত এখন মনে পড়ে না; কিছু বলতে গেলে বানিয়ে বলার সম্ভাবনা থাকবে। তবে পরিণত বয়সে বুঝি চলচ্চিত্র-পত্রিকায় যাকে জুটির কেমিস্ট্রি বা রসায়ন বলা হয়ে থাকে, সেসবেরই একটা খসড়াভাষ্য হিসাবে এসব কথাকে নেয়া ঠিক হবে। আরেকটা গুরুতর সত্যবচন ছিল: ‘সে তো মুসলমান হয়েছে।’ আগের ভাষ্যের সাথে পরের ভাষ্যের সাংঘর্ষিকতা আছে। তবে জনজবান এসব সাংঘর্ষিকতা সমেতই সচল থাকে। তাঁর অন্তর্ধানের পর ‘ড্রিমগার্ল’ আর ‘সংসারে/ধর্মে মনোযোগী’ কোন পরিচয়টা তাঁকে অধিক আন্দোলিত করত, আদৌ কোনোটাই করত কিনা এসব আর জানার সুযোগ নেই। আসলে সুযোগ থাকলেও জানা হতো না। আইকন নিজে বিবরক নন, আমাদের নিরন্তর ব্যাখ্যা ও বিবরণীতেই তিনি বা তাঁরা আইকন। এই যে এখন লোকসমাজে অনেককেই তাঁকে চেনানোর কসরৎ করতে হয় আমাদের, হয়তো এই দশাটিই আইকন-জীবনবৃত্তান্তের সবচেয়ে শিক্ষণীয় অংশ। হতে পারে, তিনি নিজে এটা শিখেই অন্তর্ধানে গেছেন।    

ঝর্ণা থেকে শিশিরকণা

শবনম, যিনি আগে ঝর্ণা বসাক নামে পরিবারে ছিলেন, ছায়াছবিতে নায়িকা হবার জন্য নাম বদলেছিলেন। বা এভাবে বললে সঠিক বলা হবে, তাঁর প্রথম ছবি হারানো দিন (১৯৬১) করবার সময় তাঁকে শবনম নাম বানিয়ে পরিচিত করিয়ে দেন নির্মাতাবৃন্দ। যাঁদের চলচ্চিত্র কারখানা সম্বন্ধে কিছুমাত্র ধারণা আছে তাঁরা নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারেন যে এই জগৎটাতে, তখন কিংবা এখন, ঠিক কবিদের মত নিজের-নাম-নিজে-বানিয়ে-নেবার চর্চা সীমিত। গুগল-অনুসন্ধানে তাঁর অন্তত তিনটা জন্মসন পাওয়া গেল। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরানটাও (১৯৪১) যদি ধরি, তাতে ছবিমুক্তির সময় ঝর্ণা বসাকের বয়স ২০; আর কাজের সময় বয়স ২০-পূর্ব। ছবির প্রযোজক এহতেশাম সেই কালেই প্রবল প্রযোজক। ফলে নামটা প্রযোজক-পরিচালক-নির্মাতাদের তরফেই এসেছে। আর এই প্রক্রিয়াকে জবরদস্তি ভাবার কোনো সুযোগ নেই। বরং, সম্ভাবনা বেশি যে কী নাম তাঁকে দেয়া হবে/যাবে এই নিয়ে প্রযোজক ও তাঁর একান্তজনেরা দীর্ঘ সময় গভীর অনুধ্যান ও স্নেহ নিয়ে কাটিয়েছিলেন। তারপর হলো শবনম। নামটা আমার অতীব পছন্দ, যদিও তাঁর এই নামে আমার কোনো কৃতিত্ব নাই। তবে আমি অনেকদিন ভাবতাম শবনম নামের অর্থ রাত্রি। কেন ভাবতাম, কেন কাউকে জিজ্ঞাসা করে নিইনি, কেন ইন্টারনেট আসার পরও গুগল করিনি – এসবের কোনো ব্যাখ্যা নেই। কিন্তু রাত্রি হোক বা শিশিরবিন্দু, অর্থ মুখ্য কারণ নয়, নামটা আমার পছন্দ এর ধ্বনির কারণেই। অবশ্য বাংলা অঞ্চলের ‘প্রমিত’ জিহ্বা আরবি-ফারসি নামগুলোর যে হাল বানায় [১৪] সেই ধ্বনিতে আমার পছন্দ নয়। যে ধ্বনিতে ‘শ’-এর স্বরধ্বনিটি বাংলা চারকোণা অ-কারান্ত উচ্চারণে নয়, বরং উর্দুর চ্যাপ্টা স্বরধ্বনিটি ধারণ করে সেভাবে পছন্দ।

‘আম্মাজান’ চলচ্চিত্রে শবনম

শবনমের নামধারণ বিষয়ে এই অঞ্চলের জনজবানে, বিশেষত সেক্যুলার পরিচয়বাহীদের, একটা আধো-আধো গল্পযুক্তি আছে। সেটা শুনতে থাকলে মনে হবে যেন বা পাকিস্তানে ‘গিয়ে’ কাজ করতে গিয়েই এরকম একটা নাম তাঁর ‘নেয়া’ লাগে। এই বিবরণীর মধ্যে আরাম আছে, বিশ্বাসের সাধারণ কাঠামোর প্রতি দায়বদ্ধতা আছে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের অধুনা চলমান সাংস্কৃতিক সত্তার ভেদবিচারের বিষয়ে সজাগতা আছে, সেক্যুলার কনশাসনেসও থাকতে পারে; আর অজ্ঞতা থাকাও অসমীচিন নয়। তবে সত্যতা নাই কিছুমাত্র। তাঁর প্রথম ছবি বাংলাভাষাতে, এবং সেটা ঢাকাতেই নির্মিত হয়। পর্দায় পরিষ্কার বড় অক্ষরে রহমান (নায়ক) নামের পরপরই, রীতিমাফিক, তাঁর নামটি লিখিত হয়। তবে তখন বানান ছিল ‘শবনাম’। [১৫] এই সময়ে ছয় দফা ঘোষিত হয়নি ঠিকই, কিন্তু গজায়মান ‘বাঙালিত্ব’ তখনো ঢাকাতে অস্তিত্বমান ছিল। অন্তত জাতীয়তাবাদী যেসব ইতিহাস-লিখন পাওয়া যায় সেগুলোর প্রতি আস্থা রাখলে অবশ্যই তা মানতে হবে; এই মুহূর্তের বাংলাদেশে এই ধরনের ইতিহাস-লিখনের উচ্চকিত হালচাল যদি বিবেচনাতে নাও রাখি। তিনি পরের বছর চান্দা (১৯৬২) ছবির মাধ্যমে সর্ব-পাকিস্তানীয় মহাতারকা হয়ে পড়লেন। সেই ছবিটারও প্রযোজক এহতেশাম, এদফা পরিচালকও। আর সেই ছবিটিও কিন্তু (পূর্ব-পাকিস্তান) এফডিসিতে তৈরি হয়েছিল। খুব শিথিলভাবে বললে ১৯৫৭-তে ঢাকায় ইস্ট পাকিস্তান ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠিত হবার পর (সম্ভবত ১৯৫৭ হলো বিলোত্থাপনের হিসাবে, আর কার্যক্রমের হিসাবে হবে ১৯৫৯) ঢাকা থেকে সর্ব-পাকিস্তানীয় বড় মাপের সফল ছবি এটাই প্রথম। খানিকটা ব্যবসাপাতির হিসাব থেকেই কথাটা বললাম। কারণ পাঠকের মাথায় আসতে পারে জাগো হুয়া সাভেরা (১৯৫৯) [১৬] ছায়াছবির কথা। সেটা অবশ্যই বিরাট প্রকল্প এবং সেটা স্বতন্ত্র কারণে আলোচিত হওয়া দরকার। অন্তত ঢাকা, কোলকাতা, করাচি, লাহোর ইত্যাদি শহরের সাংস্কৃতিক চিন্তকদের মধ্যকার নিবিড় আদানপ্রদানের প্রবণতার স্মারক হিসাবে ছবিটাকে দেখা দরকার। কিন্তু এমনিতেও ঢাকা ও লাহোরের তখনকার সংস্কৃতি কারখানার ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের মনোজগতের সম্পর্ককে রাজনৈতিক প্রপাগাণ্ডার বাইরে দেখতে পারা দরকার। এর জন্য কিছু সংবেদ আর কিছু বিশ্লেষণ সামর্থ্য লাগবে শুধু; অল্প যা উপাত্ত আছে তা দিয়েই সম্ভব।

শবনমের পেশাজীবনে এর পরের অধ্যায় আসলে কল্পকাহিনির মত। পাকিস্তানে তাঁর থেকে বড় কোনো তারকা চলচ্চিত্রে উচ্চারিত হয় না। শবনম-নাদিমের থেকে বড় জুটি প্রবলধারার লাহোর ভিত্তিক চলচ্চিত্র কারখানাতে তৈরি হয়নি। অন্তত সিনে-পত্রিকাগুলোর সামগ্রিক মতামত এরকমই। তিনি পাকাপাকি পাকিস্তানে থাকতে গেছিলেন এই বিপুল জনপ্রিয় ও সফল ক্যারিয়ারের কারণেই; যাতে ঢাকা লাহোর করাচি করার ঝক্কিতে থাকতে না হয়। ১৯৬৮ সাল থেকে কমবেশি তিন দশক তিনি পাকিস্তানে কাটিয়েছেন। তাঁর জীবনে ১৯৭৮-এর ভয়াবহ সেই অধ্যায়টির পরও তিনি পাকিস্তান ছাড়েননি। বরং, বলা উচিত যে শবনমের পেশাগত বন্ধুবান্ধবেরা এরকম একটা পরিস্থিতি তৈরি করতে পেরেছিলেন যেখানে তাঁর পাকিস্তান ছাড়তে হয়নি। বরং, তিনি সগৌরবে এর পরও পনেরো বছরের অধিক পাকিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্পেরই লোক ছিলেন। তার মধ্যে ১৯৮৭ পর্যন্ত তিনি লাগাতার বছরে একাধিক হিট ছবির নায়িকা ছিলেন। পরে তিনি পাকাপাকি বাংলাদেশে আসেন, সেটাও আরো বছর দশেক পরে। আসা যাওয়া এর আগেও তিনি করেছেন। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় সেগুলোকে তাঁর ‘প্রত্যাবর্তন’ বলা চলবে না। বরং, আম্মাজান (১৯৯৯) ছায়াছবিটি যখন বাংলাদেশে তিনি করেন, সেই সময়টাকে তাঁর পুরাপুরি প্রত্যাবর্তন বলা চলে। ছবিটার বিজ্ঞাপনে শবনমের বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে কাজ করার বিষয়টি জোরেসোরে করা হয়েছিল। এই নিবন্ধ লিখতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম ছবিটির প্রযোজক মনোয়ার হোসেন ডিপজল। অন্তত শবনমের নামের বিজ্ঞাপন ইত্যাদির কারণেও ছবিটা দেখতে যাবার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু কোনো এক কারণে পরে আর যাওয়া হয়নি। পরে তিনি ২০১২ সালে পাকিস্তান সরকারের এবং ২০১৯ সালে পাকিস্তান কেন্দ্রিক লাক্সের আজীবন সম্মাননা নিতে যান। ২০১২ সালের সম্মাননার বিষয়টি পাকিস্তানেও ধুমধামের সাথে প্রচারিত ঘটনা। সেটা উপলক্ষেই পাকিস্তান সরকার তাঁকে আলাদা করে নিমন্ত্রণ করেন; সঙ্গীতের জন্য তাঁর স্বামী রবিন ঘোষও সম্মাননা পান। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি তাঁর বক্তব্যে এই দম্পতির পাকিস্তান ত্যাগ করে বাংলাদেশ আসাকে পাকিস্তানের চলচ্চিত্ররাজ্যের জন্য মহাক্ষতি হিসাবে উল্লেখ করেন। [১৭]                 

‘দিল’ চলচ্চিত্রে নাঈম ও আফসানা মিমির সঙ্গে শবনম

তবে এই অংশটিকে, কিংবা খোদ রচনাটিকেও, আমি শবনমের জীবনকাহিনি কিংবা প্রশস্তিগাথা বানাতে বসিনি। কারণ সেটা এই রচনার উদ্দেশ্য নয়, আর তাঁর যশ-খ্যাতি-প্রতিমার বিশাল চেহারা পাঠক নিজেই অতি সহজে খুঁজে নিতে পারবেন। বরং, শবনমের ফারসি নামগ্রহণের প্রেক্ষাপটে দুয়েকটা কথা বলা যেতে পারে। ছোটবেলায় সহপাঠীরা বুঝিয়ে ছেড়েছিল যে, দিলীপ কুমারকে জোর করে দিলীপ কুমার বানানো হয়েছিল। নাহলে তাঁর ‘মুসলমান’ নাম নিয়ে কাজ করতে পারছিলেন না। শৈশবে এই নামপ্রদানকে ভীতিকর বিবেচনা করেছিলাম; এবং কোনো ন্যায্য কারণ ছাড়াই যেন বা ওই জবরদস্তি যেন বা আমি নিজেই করেছি এমন ধরনের একটা অপরাধবোধ করবার দায়িত্বও সেসব শিশুরা দিতেন। চলচ্চিত্র কারখানায়, কিংবা মোটের উপর বিনোদন কারখানাতে নামগ্রহণের ইতিহাস বিষয়ে কেবল বাংলা মুল্লুকের মধ্যবিত্ত শিশুরাই উল্টাপাল্টা বুঝে থাকেন তা নয়। শিশুদের মাতাপিতাদের বোঝাবুঝিও মাথা আউলে দিতে পারে। দিলীপ কুমারের পর, আমি বড় হতে হতে, তপন কুমারের নাম জেনে নিয়েছিলাম। যিনি আদতে তালাত মাহমুদ ছিলেন। চলচ্চিত্রের ‘নায়ক’ হিসাবে হয় বেশিদূর আগান নাই, অথবা চান নাই। যাই হোক তিনি তপন কুমার নামে ‘নায়ক’ ছিলেন; আর তালাত মাহমুদ নামে গায়ক। শাম্মী কাপুর থেকে আফতাব শিবদাসানী রাশি রাশি ফারসি এমনকি আরবি নামের মালিক পাওয়া যাবে। যদি জনৈকা মুমতাজ মধুবালার মত হিন্দুস্তানি ভাষার নাম গ্রহণ করে থাকেন, তাহলে আরেকজন মুমতাজ কয়েক বছর পর মুমতাজ নামেই রইলেন। ওদিকে ফাতিমা নামের অভিনেত্রী এক আরবি ভাষার নাম ছেড়ে পর্দায় নিলেন আরেক আরবি নাম নার্গিস। বৃহত্তর ভারতে বিশেষত ফারসি-ঘেঁষা (ও কিছু ক্ষেত্রে আরবি) নামের বৃহৎ জনপ্রিয়তা, এবং সংস্কৃতি কারখানায় এর প্রয়োগ বিষয়ে আর যাদেরই যা বুঝ থাকুক বাংলা মুল্লুকের লোকজনের বোঝাবুঝি খুবই দুর্বল। এই রচনার সময়ও লক্ষ্য করলাম টাইমস অব ইন্ডিয়ার একজন ব্লগলেখক মাত্র চার বছর আগের নিবন্ধে শবনমকে প্রশংসা জানাতে গিয়ে বলতে ভোলেননি যে তিনি ‘মুসলিম’ নাম গ্রহণ করেছিলেন। [১৮] উর্দুতে সুদক্ষ শবনম নিশ্চয়ই নামের ধর্মপরিচয় নিয়ে বিশেষ ভাবিত থাকেন না।    

রিনা ব্রাউন [১৯] আমাকে আবারো অলিভিয়ার কাছে নিতে গেল

শামীম আখতার [২০] ছায়াছবি বানাতে গেলেই আমি একটা চরিত্র পেয়ে যাই। এটা আমার অভিনয়-যোগ্যতা নাকি শামীম আখতারের আমার প্রতি পক্ষপাত সে নিয়ে বিশদ কখনো ভাবিনি। তাঁর এখন পর্যন্ত সর্বশেষ ছায়াছবি রিনা ব্রাউন-এও আমার একটা চরিত্র ছিল। চরিত্রের আয়তন, সারবত্তা ও বিস্তার আলোচ্য নয়। কাজটা করার কারণে প্রচুর সময় পরিচালকের সাথে, তাঁর মস্তিষ্কপ্রবাহের সাথে কাটানো হয়েছে। চলতি ভাষায় যাকে প্রেমের গল্প বলা হয় তাই নিয়ে বানানো ছবি, মুক্তিযুদ্ধের কালীক ও ঘটনার প্রেক্ষাপটে। এই কাহিনিতে স্যান্ড্রা এক ষোড়শী যিনি দারার প্রেমে পড়েন (দারাও স্যান্ড্রার)। তাঁরা উভয়েই এখন যাকে পুরান ঢাকা বলা হয় এর কোনো একটা এলাকায় কাছাকাছি থাকতেন। যুদ্ধের কিছু আগে দানা-বাঁধা এই অনুভূতির মধ্যেই দারা যুদ্ধে চলে যান। এসে আর কোথাও স্যান্ড্রার পরিবারের খোঁজ পান না। অনেক অনেক বছর পর দারা ও স্যান্ড্রার যোগাযোগ হয় ২০১৬ নাগাদ। এটা সম্ভব হয় সাইবারকালের কোনো একটা সহযোগিতায়, আর আন্তর্জাতিক এনজিওর কোনো এক সম্মেলন থেকে; আমার যতটা মনে পড়ে। এরপর তাঁদের একবার দেখাও হয়। শেষ দেখা। কিংবা চাইলে আপনি প্রথম দেখাও বলতে পারেন। আপাত, এই গল্পে স্যান্ড্রার পরিবারের ‘চলে যাওয়া’টা আমার জন্য আচমকা নয়, আকস্মিক নয়, অপরিচিত নয়। আর আমি বাস্তুচ্যুতির বোধ গাঢ়ভাবে অনুভব সমেতই কাজটাতে গেছিলাম। কিন্তু এতদিনেও স্যান্ড্রাদের এই চলে যাওয়া শান্তি দেয় না। হয়তো ছায়াছবির মধ্যকার একজন হওয়াতে, কেবল দর্শক হলে যা ঘটত তার থেকে গাঢ় অনুভূতি হয়ে থাকতে পারে। যেন বাস্তবে ‘চলে যাবার’ অজস্র ঘটনার থেকেও ছায়াছবির এই যাওয়াটার ভার বেশি হয়ে থেকে যাচ্ছে।

‘রিনা ব্রাউন’ চলচ্চিত্রের দৃশ্য

স্যান্ড্রার পরিবারের পরিচয় নিয়ে এখন ভাবতেই হচ্ছে। বাংলাদেশে সিলভানা-মারিয়া-সোনিয়া-মনিকা এসব নামের পাশে স্যান্ড্রাও টিঁকেই যায়। আমি খসড়াভাবে জানতাম পরিচালক শামীম আখতারের এই নামে, কিংবা অন্য নামে, এমন একজন শৈশব-বান্ধবী ছিলেন। তাঁরা চলেও যান। গল্পের স্যান্ড্রা ওরফে রিনা ব্রাউন কিংবা অগল্পের শামীমের বান্ধবী খ্রিষ্টান ছিলেন এটা আমি না জিজ্ঞাসা করেই জানি। কীভাবে জানি তা ব্যাখ্যা করার চেয়ে জানা সহজ। এর বাইরে আমি কখনো পরিচালককে জিজ্ঞাসা করিনি স্পষ্ট করে যে ওঁরা ‘এ্যাংলো’ ছিলেন কিনা। ওদের এ্যাংলো থাকা না-থাকা দিয়ে আমার কেবল ‘একাডেমিক’ জিজ্ঞাসারও মীমাংসা হবে না। ঢাকায় অজস্র জাতি থাকতেন। তাছাড়া ‘এ্যাংলো’ বলতে কে কী ও কেন বোঝান তার কোনো ধ্রুব মাপকাঠি আছে বলে আমি মানি না। ধর্ম(পরিচয়)নিষ্পত্তির মত জাতি(পরিচয়)নিষ্পত্তি সম্ভব হবে না এখানে। তাছাড়া ‘এ্যাংলো’ জাতিবাচক বিশেষণটি কখন কার উপর কী ধরনের মূল্যমান নিয়ে প্রয়োগ ঘটে তা নিয়ে ব্যাপক ধরনের সংশয় কাজ করতে থাকে আমার। এর মধ্যকার ইঙ্গপনা যদি এখন আর ওই ‘এ্যাংলো’ পরিবারটি ধারণ করতে না থাকেন, কিংবা তাঁদের ধারণকৃত বৈশিষ্ট্যগুলোকে যদি তাঁরা ইঙ্গপনা হিসাবে না দেখেন তাহলে ‘এ্যাংলো’ পরিচয়ে তাঁদের পরিচিত করানোর মধ্যে একটা জবরদস্তি থাকতে পারে। রিনা ব্রাউন ছায়াছবিতে পরিচালনা-সহকারীদের একজন স্বজন মাঝি এর বছর দুয়েক পরে একটা ছোট-ছবি বানান বিসিটিআইয়ের স্নাতক-ছায়াছবি হিসাবে। জীবাশ্মজন [২১] নামের এই তথ্যচিত্রটিতে একজন বহুকাল ধরে প্রবাসী ‘বাংলাদেশী’ ইহুদী ধর্ম-পরিচয়ের মানুষ জোসেফ এডওয়ার্ড পর্দায় উপস্থিত হয়ে বলেন তিনি ধর্মে ‘ইহুদি হলেও নিজেকে বাঙালি’ মনে করেন; এবং মারা যাবার আগে কখনো একবার  চট্টগ্রামে যেতে চান, যেখানে তাঁর যৌবন কেটেছিল। এই ‘ইহুদি হলেও বাঙালি’ আপনাকে না ভাবিয়ে পারবে না।

‘লাল মেম সাহেব’ সিনেমায় অলিভিয়া ও ববিতা

স্যান্ড্রার বাবা-মা [২২] কাহিনিপ্রবাহে, যুদ্ধকালীন একটা সময়ে, টিঁকে থাকার সঙ্কট ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করছিলেন। পরে ২০১৬তে স্যান্ড্রা-দারার যখন পড়ন্ত বয়সে স্মৃতিচারণমূলক অতিশয় ভারী সাক্ষাৎ ঘটে, জানা যায় স্যান্ড্রার পরিবার দেশ ছেড়েছে ১৯৭১-এর স্বাধীনতার পরে। ছবিটার শ্যুটিং চলাকালীন খানিকটা, শেষ হবার পর আরো, আমার অলিভিয়ার কথা মনে পড়তে থাকে। স্যান্ড্রার সাথে তথা রিনা ব্রাউনের ছায়াছবিটির সাথে অলিভিয়ার কোনো সম্বন্ধ নেই। অন্তত বুঝিয়ে বলা যাবে এমন কোনো সম্পর্ক নেই। সেই কারণেও হতে পারে পরিচালক শামীমকে কখনোই বলা হয়নি এই মনে করার কথা। কিংবা বলা হয়নি প্রমা পাবণীকে, যিনি স্যান্ড্রার চরিত্রটি করেছিলেন। অলিভিয়াকে বলার তো সুযোগই হবে না। কিংবা হয়তো, এই অনুভূতিটা, মনে-করাটি, অলিভিয়ার থেকেও বেশি স্পর্শ করতে পারবেন ‘নেটিভ’ [২৩] বাংলাদেশী শবনম। তাঁকে গিয়েও বলা যেতে পারে।

টীকা

[১]     ছন্দ হারিয়ে গেল, পরিচালক: এস. এম. শফি, সঙ্গীত পরিচালক: আনোয়ার পারভেজ, প্রযোজক: এস.এম. শফি ও মোজাম্মেল হক, এফডিসি, ১৯৭২। ছবিটার ইউট্যুব লিংক: https://www.youtube.com/watch?v=BOILEDJQ83M

[২]     হারানো দিন, পরিচালক: মুস্তাফিজ, সঙ্গীত পরিচালক: রবিন ঘোষ, প্রযোজক: এহতেশাম, ঢাকা [ইপি]এফডিসি, ১৯৬১।

ছবিটার ইউট্যুব লিংক: https://www.youtube.com/watch?v=4QZwWSIExbc

[৩]     অজস্র সংবাদের মধ্যে একটা দিচ্ছি ডয়েচে-ভেলে থেকে:

https://www.dw.com/en/lata-mangeshkar-how-the-iconic-singers-death-exposes-indias-communal-rifts/a-60699559

[৪]     করণ-অর্জুন, পরিচালক-প্রযোজক: রাকেশ রোশন, সঙ্গীত পরিচালক: রাজেশ রোশন, মুম্বই, ১৯৯৫। ছবিটার মূল কাহিনি গড়ে উঠেছে পুনর্জন্মকে ভিত্তি করে। ছবিটার ইউট্যুব লিংক: https://www.youtube.com/watch?v=cGedgVJzeT4

[৫]     বহ্নিশিখা, পরিচালক: পীযূষ বসু, সঙ্গীত পরিচালক: হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, প্রযোজক: শ্রী আর. এস. প্রডাকশন্স, কোলকাতা, ১৯৭৬। ছবিটার ইউট্যুব লিংক: https://www.youtube.com/watch?v=WdM0QvdK-vU

[৬]     অনেক সংবাদ যে পাওয়া যায় তা নয়। তবে বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর ০১ জুন ২০২০ সংখ্যাতে একটা প্রতিবেদন ছিল যাতে ববিতার যোগাযোগ থাকার কথাও উল্লেখ আছে:

https://www.bd-pratidin.com/entertainment-news/2020/06/01/534730

[৭]     পাকিস্তানের বিখ্যাত তারকা থাকাকালীন তিনি সেখানে ‘পাকাপাকি’ থাকতেন; আসা-যাওয়া করতেন। নানানসূত্রে বলা হয় নব্বই দশকের শেষভাগে তিনি ‘পাকাপাকি’ বাংলাদেশে ফেরেন। বস্তুত, আম্মাজান (১৯৯৯) ছবিটা করবার সময় তিনি পুরোদস্তুর পুনরায় ঢাকাবাসী বলা যায়।

[৮]     ১৯৭৮ সালের ১৩ই মে পাঞ্জাবের ক্ষমতাসীন পরিবারের জনৈক ফারুক বানদিয়াল ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা লাহোরের বনেদী এলাকা গুলবার্গে শবনমের নিজের বাড়িতে সশস্ত্র অবস্থায় ঢুকে তাঁকে ধর্ষণ করে। এটা বড় ঘটনা। জনচাপে সামরিক শাসক জিয়াউল হক বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে ফাঁসি দেন; আবার রাজনৈতিক চালিয়াতির মধ্যে মওকুফও করেন। তাঁর পেশাগত বন্ধুরা ব্যাপকভাবে শবনমকে সমর্থন যুগিয়েছিলেন। কিন্তু পরিশেষে ফাঁসি মওকুফ হয়। ২০১৮ সালে ওই একই লোক ইমরান খানের রাজনৈতিক দলে ঢুকলে এই ঘটনা সামনে আসে; ইমরানের পক্ষে ফারুককে বহিষ্কার ছাড়া রাস্তা থাকে না। যাহোক, এই ঘটনা নিয়ে বেশ কিছু নিবন্ধ পাওয়া যায়। তবে এটার বর্তমান সংবাদ-পরিবেশন পাকিস্তানের এখনকার জাতীয় ও লিঙ্গ রাজনীতিক প্রেক্ষাপটে হয়ে থাকে। বিশদ না করে একটা লিংক দিই যেখানে :

https://www.thenews.com.pk/print/714237-a-few-most-publicised-rape-cases-in-pakistan

[৯]     সামাজিক (বা অ-সামাজিক) গবেষণা নিয়ে আমার ঠাট্টা-মশকরা এখন সুপ্রতিষ্ঠিত। একটা কারণ নিশ্চয়ই সহজবোধ্য। এটার ‘ভারীত্ব’-‘গুরুত্ব’ প্রচারকারী যে চর্চাটা আছে সেটা আমার বাহুল্য লাগে। আরেকটা কারণ হতে পারে গবেষণার কাণ্ডকারখানা সবই এখন নিয়ন্ত্রিত হয় কিছু দাপুটে উন্নয়ন সংস্থা আর বাণিজ্য সংস্থার সুপারিশে। আরেকটা কারণ হতে পারে, গবেষণাতে ক্রমাগত ইমিরিসিস্ট আধিপত্য এতটা বেড়েছে যে অবরোহী বা ডিডাকটিভ একটাও প্রস্তাবনা করতে পর্যন্ত দিতে চান না ‘প্রতিষ্ঠিত’ গবেষকেরা। সব মিলে ঠাট্টার ভঙ্গিতে অন্তত কিছুটা পরিসর পাওয়া যায়। বাংলা ফোরামগুলোতে কম পাহারাতে এসব নিয়ে আমার কথাবার্তা চলে। তবে ইংরাজি ‘একাডেমিক’ স্বীকৃতিকামী একটা পোর্টালে আমার শ্লেষাত্মক ছোট একটা রচনাও পাশ করে:

Chowdhury, M. (2021). What do you mean by empirical social research / (- method) now these days? Academia Letters, Article 793. https://doi.org/10.20935/AL793

[১০]    নীলমণি সিনেমা হলের নামটা সুন্দর। তবে বানানে সম্ভবত মূর্ধ্য ‘ণ’ ছিল না। মনে পড়ছে না। এর আগে আরেকটা নাম ছিল এই হলের। সেটাও মনে পড়ছে না। সম্ভাবনা আছে যে মালিকানা বদলের কারণে নামবদল ঘটেছে। মেহেরপুরের আদিতম হল এটা কিংবা প্রগতি। বাড়তে বাড়তে পরে চারটা পর্যন্ত হয়েছিল বোধহয়। বহুবছর যোগাযোগ নেই মেহেরপুরের সাথে। কিন্তু সিনেমা হলগুলো আছে কিনা তা বোঝার জন্য মেহেরপুরের সাথে যোগাযোগ থাকা লাগবে না।

[১১]    ১৯৭৮-১৯৮৬’র হিসাবটা এরকম যে আমি ১৯৭৮-এ পঞ্চম শ্রেণীর বৃত্তি পরীক্ষা দিই। এই পরীক্ষার আশপাশে আমি একা (বাবা-মামুক্তভাবে) সিনেমা দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। সুযোগটা চুরি করে নেয়া ছিল না হয়তো, তবে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেলিং থাকতে পারে। আমার রুচিদার বাবা সিনেমা দেখাকে মন্দচর্চা মনে করতেন, যদি না সবাইকে কোলেপিঠে নিয়ে যাওয়ার মতো কোনো ছবি হয়! সামর্থ্যের বিষয়টাও ছিল। ১৯৮৬-তে আমি উচ্চ-মাধ্যমিক দিই ও মেহেরপুর ছাড়ি। অলিভিয়াকে পর্দায় কখন দেখি সেটার একটা কালসীমানা এভাবে সাব্যস্ত করা সহজ। 

[১২]    যদি একান্ত নিরীখ করে ভাবি, তাহলে এর নাম ‘কুনজর’ বা ‘বদনজর’ দিলে ঠিক দেয়া হতো। এই যে এই দুটো উপসর্গের প্রয়োগে শব্দ ব্যবহার করা গেল না তার দায়দায়িত্ব আসলে আমার নয়। এখানে বিদ্যাজগতের ও বাইরের উভয় লোকজনের ভয়েই আমাকে থাকতে হয়েছে। আমি ‘কু’ বা ‘বদ’কে বড়জোর চিন্তাবৃত্তিকভাবে ‘গেইজ’-এর সমানুপাতে প্রয়োগ করতাম। এখন বয়স ১০ হোক বা ১২, আমার মেইল-গেইজকে আমার শনাক্ত করার তো কোনো বাধা নাই। এই গেইজটা আমার যতখানি, ততখানিই কাঠামোগত। উপরন্তু, এই গেইজের/নজরের মধ্যে যেসব অনুভূতির উদ্ভাসই থাকুক না কেন তাঁর সর্বাত্মক ক্রিমিনালাইজেশনের আবশ্যকতা নেই, অনেক মিষ্টতা এখানে অনুসন্ধানীয়; খোদ অলিভিয়া জানলেও পুলিশে দিতে চাইতেন না বলেই আমার প্রত্যয়। হ’লে কী হবে, বিদ্যাজগতের তরবারী বড় তীব্র! মেইল-গেইজ কবুল করার কারণে এক কোপে মাথা কেটে নেবার পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে। অন্যদিকে, অবিদ্যাগত মানুষজনের মনে ‘কু’ নিয়ে এত কুডাক দেয় যে এটাকে প্রয়োগ-অযোগ্য পদ বানিয়ে ফেলেছেন তাঁরা; এবং কেবল গালিযোগ্য পদে পর্যবসন করেছেন। তবে চূড়ান্ত বিচারে দুই পক্ষের মধ্যেই মারাত্মক শুচিবাদিতা, ও কপটতা আমি পরিলক্ষণ করেছি। ‘সু’ উপসর্গ ব্যবহার করাই যেত। শুভ তার থেকে ব্যঞ্জনাময় মনে হলো।    

[১৩]    বাংলাদেশী সিনেমার পর্দায় নায়কের ব্যক্তিত্বের কালক্রমিক বদল নিয়ে আমার সাফ কিছু পর্যবেক্ষণ, ভাবনাচিন্তা, যুক্তি আছে। মুখ্যত কীভাবে ও কখন অত্যাচারী/ধনী-বিরোধী ‘বিপ্লবাত্মক’ (পুরুষ) নায়কের বদলে ক্রমাগত আইনের প্রতি অনুগত ‘দেশপ্রেমিক’ নায়কের আবির্ভাব হয় তা নিয়ে আমার ভাবনা। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম লেখাটা ‘বিদ্যা’পত্রিকাতে লিখি ১৯৯৯ সালে। পরে উচ্চতর ডিগ্রি শিকার করার সময় এই বিষয়ে একটা আস্ত অধ্যায়ও লিখি। এখানে ১৯৯৯ সালেরটা উল্লেখ করি:

মানস চৌধুরী, (১৯৯৯) লড়িয়ে নায়কের ইমেজ সঙ্কট: উদার জাতীয়তাবাদী সমাজের ডিলেমা, সমাজ নিরীক্ষণ, সংখ্যা ৭৩, পৃষ্ঠা ১০০-১০৭।    

[১৪]    একটা ব্যক্তিগত গল্প নিশ্চয়ই পাঠক অনুমোদন করবেন। ২০১০ সাল নাগাদ আমি প্রথমবারের মত বিয়ে করি। আমার স্ত্রীর বড়বোনের নাম জোহরা আখতার লিপি। আমার কিঞ্চিৎ সাহিত্যসেবী ভাষায় তিনিও শ্যালিকা। কিন্তু লোকশ্রুতি অনুযায়ী তিনি জ্যেঠাশ আর শব্দটাকে ধ্বনিগতভাবে আমার একদমই আরাম লাগে না। আমি জোহরাকে নিজেই সেকথা বললাম। তিনি আর জানতে চাননি যে ধ্বনিগতভাবে কী খারাপ লাগে। হয়তো আমার উচ্চারণের সাথেসাথেই তিনিও কিছু একটা বুঝে গেছিলেন। তো, তাঁকে সকলেই লিপি ডাকেন; আর আমি ডাকতে শুরু করি জোহরা। পরিবারের কেউ কেউ পরে জোহরা/লিপিকে জিজ্ঞাসা করেন যে কেন তিনি তাঁদের জোহরা ডাকা বরদাশত করেন না, এবং আমারটা করেন। জোহরার উত্তরও ছিল এটা। সবাই যখন জোহরা ডাকে তখন তা ওর কানে গেলে ওই নামে ডাকশোনার রুচি চলে যায়। আমার মুখেই কেবল জোহরা ওর কানে ঠিকঠাক লাগে।  

[১৫]    https://www.youtube.com/watch?v=4QZwWSIExbc 

[১৬]    কোনো কোনো তথ্যসূত্র মতে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে মনোনীত প্রথম অস্কারগামী ছায়াছবি এটা। তবে আমি উল্লেখ করছি পূর্ব-পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (EPFDC) গঠিত হবার পর বড়সড় একটা উদ্যোগ হিসেবে যা ছিল যৌথতার দুর্দান্ত উদাহরণ। মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের ইংরাজিরূপ করেছিলেন জহির রায়হান। সেটার চিত্রনাট্য করেছিলেন পাকিস্তানের কবি ফায়েজ আহমেদ ফায়েজ। পরিচালনা করেছিলেন লাহোরের পরিচালক এ জে কারদার। অভিনয় করেছেন কোলকাতার তৃপ্তি মিত্র। চিত্রগ্রহণ করেছিলেন জার্মান-ব্রিটিশ ওয়াল্টার লাসালি। পরিবেশন করে করাচি এবং লন্ডনের দুটো প্রতিষ্টান। এবং প্রক্রিয়াজাত হয় মুখ্যত ঢাকা এফডিসি থেকে। উপনিবেশোত্তর উপমহাদেশের মেট্রোপলিস সাংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যকার সম্পর্ক, কিংবা সম্পর্কপ্রচেষ্টা বুঝতে এই ছবিটা খোদ বড় উদাহরণ। সরল করে দেখা যেতে পারে বিভিন্ন শহরের বামপন্থীদের ঐক্য হিসাবে।

অস্কার খবর: https://tribune.com.pk/story/1095386/pakistans-first-oscar-submission-jago-hua-savera-goes-to-cannes

ইউট্যুবে ছায়াছবিটি: https://www.youtube.com/watch?v=z4t145JEBPU

[১৭]    https://www.geo.tv/latest/43420-lifetime-achievement-award-for-shabnam-robin-ghosh

[১৮]    কাণ্ডটা ঘটিয়েছেন প্রিয়াংকা দাশগুপ্ত। তবে এটাকে টাইমস অব ইন্ডিয়া, এমনকি দুই বাংলার মধ্যবিত্তীয় চৈতন্যের প্রতিনিধিত্বমূলক হিসাবেই দেখতে চাই আমি। এখনো নেটে খুঁজতে গেলে মুসলমান বালকের নাম, হিন্দু বালিকার নাম এরকম ইংরাজি খোঁজনসূত্রগুলো পেতে থাকবেন।

https://timesofindia.indiatimes.com/blogs/priyanka-dasgupta-blog/meet-pakistans-biggest-star-from-bangladesh-whom-india-hasnt-celebrated/

[১৯]    শামীম আখতার পরিচালিত, সরকারি অনুদানে নির্মিত ও ২০১৭ সালে প্রদর্শিত ছায়াছবি। ছবিটা, বাংলাদেশের অনেক ছায়াছবির মতই দর্শকপ্রাপ্তি বা মনোযোগ বিশেষ পায়নি।  

[২০]    চলচ্চিত্র পরিচালক, সম্পাদক, লেখক, সংগঠক। ৮০’র দশকে নারী/লিঙ্গসম্পর্ক বিষয়ে সম্পাদক হিসাবে অতিশয় তীক্ষ্ণ এই সংগঠক-সম্পাদক দৈনিক সংবাদের নারী-পাতা দেখা ছাড়াও, নিজে রূপান্তর বলে একটা নারীবাদী পত্রিকা চালাতেন। পরে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক হন। আমার স্মৃতি প্রতারণা না করলে তিনি আহ্বায়কের দায়িত্বও পালন করেছিলেন। কিন্তু সেটা আমার ভুল স্মৃতি হতে পারে; এখন নেটঘাঁটাতে তা পাইনি। তবে তিনি যে পরিচয়ে দীর্ঘকাল নিজে স্বস্তি পেয়েছেন তা হলো চলচ্চিত্র নির্মাতা ও পর্যালোচক। সে (১৯৯২?), ইতিহাস কন্যা (২০০০), শিলালিপি (২০০১), রিনা ব্রাউন (২০১৭) ইত্যাদি তাঁর বানানো ছবি। তবে নেটরাজ্যে তাঁর নামের গুরুতর অনুপস্থিতি লক্ষ্য করলাম।

[২১]    স্বজন মাঝি (শরীফ রেজা মাহমুদ) পরিচালিত ছবিটি বিসিটিআইয়ের স্নাতক ছবি, ২০১৮। ৩০ মিনিটের মতো দৈর্ঘ্যের এই ছবির ইংরাজি নাম রাখা আছে ওয়ান অব মাই ওল্ড ফ্রেন্ডস।

[২২]    অভিনয় করেছেন তানভীর হোসেন প্রবাল এবং শম্পা রেজা। 

[২৩]    উইকিপিডিয়া ইংরাজি সংস্করণে, এখন অবধি, শবনমের দেশে ফেরার বিষয়ে এরকম শব্দপ্রয়োগ আছে।

/ লেখাটি ম্যাজিক লন্ঠন ২০২৩ সংখ্যায় প্রকাশিত


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

মানস চৌধুরী

লেখক, শিক্ষক ও নৃবিজ্ঞানী

মন্তব্য করুন