অ্যাডভেঞ্চার অব সুন্দরবন: শিশুতোষ সিনেমায় এক পশলা বৃষ্টি
গল্প বা উপন্যাস অবলম্বনে যখন কোনো সিনেমা নির্মাণ করা হয় তখন যাদের ওই গল্প বা উপন্যাসটি পড়া তাদের মাঝে একটা ভয় বা অস্বস্তি কাজ করে যে, মূল গল্প ঠিক রেখে আসল বিষয়টা স্ক্রিনে উঠে আসবে কিনা!! স্বাভাবিকভাবেই সিনেমাটিক লিবার্টির নানা দিক মাথায় রেখে স্ক্রিনে একজন নির্মাতা অনেক অংশ জুড়ে দিতে পারেন আবার অনেক অংশ ফেলে দিতেও পারেন।
তবে সম্প্রতি মুহাম্মদ জাফর ইকবালের বহুল পঠিত এবং জনপ্রিয় শিশুতোষ উপন্যাস ‘রাতুলের রাত রাতুলের দিন’ অবলম্বনে ‘অ্যাডভেঞ্চার অব সুন্দরবন‘ সিনেমাটি মূল গল্প ঠিক রেখেই উপস্থাপিত হয়েছে বেশ সাবলীলভাবে। ভালো লাগার আরেকটা কারণ— এখন শিশুতোষ সিনেমা নির্মান হয় না বললেই চলে, সেখানে এমন মোটামুটি বিগ ক্যানভাসে এমন একটি গল্প ঠিকঠাকভাবে তুলে ধরা কম কথা নয়।
সুন্দরবনের মাঝে একঝাঁক শিশু-কিশোর নিয়ে এগিয়ে চলা এক লঞ্চ এবং সেখানে উপস্থিত কিছু মানুষের গল্প নিয়েই এগিয়েছে ‘অ্যাডভেঞ্চার অব সুন্দরবন’। যে গল্পে রহস্য আছে, আছে সুন্দরবন, আছে ডাকাত এবং আছে মনোবল আর সাহসের গল্প।
মূল গল্পের বাইরে যেয়ে অনেক কিছু এক্সিকিউশন করা হয়নি যা সিনেমার প্লাস পয়েন্ট। শিশু-কিশোরদের নিয়ে নির্মিত সিনেমার আমেজ ঠিক রাখার চেষ্টায় নির্মাতা এবং তার টিম সফল একথা বলা যায়। সিনেমার কিছু কিছু অংশে সুন্দরবনের সৌন্দর্য্য উঠে এসেছে চোখে মুগ্ধতা ছড়ানো অনুভূতি নিয়েই। তবে ব্যক্তিগতভাবে শেষের দিকের মানসিক টানাপোড়েন এবং ক্লাইম্যাক্স অংশটুকু মনে রাখার মতোই হয়েছে তবে আরেকটু ভালো করার জায়গাও ছিলো।
অভিনয়ে রাতুল চরিত্রে সিয়াম আহমেদ, তৃষা চরিত্রে পরীমনি, নসু ডাকাত চরিত্রে আশীষ খন্দকার, শামস চরিত্রে আবু হুরায়রা তানভীর এবং আজাদ আবুল কালাম যার যার জায়গা থেকে মানানসই অভিনয় করে গেছেন।
মেইনস্ট্রিম সিনেমার সময়ের অন্যতম আলোচিত এবং জনপ্রিয় অভিনেতা সিয়াম আহমেদ ক্যারিয়ারের এই সময়ে এমন একটি শিশুতোষ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য প্রশংসা পাবেন। রাতুল চরিত্রটি একইসাথে আমাদের হাসিয়েছে আবার দরকারের সময় সাহস আর মনোবল যোগানোর বেলাতেও ছিলো সাবলীল। পরীমনিও ভালো অভিনয় করেছেন তবে ব্যক্তিগতভাবে আশীষ খন্দকারকে অভিনয়ের দিক থেকে একটু এগিয়ে রাখবো আমি। নসু ডাকাত চরিত্রটি বইতে যেমন পড়েছিলাম স্ক্রিনে তেমন ভাবেই যেন উঠে আসলো এই গুণী অভিনেতার অসাধারণ সুন্দর পারফরম্যান্সের কারণে। আবু হুরায়রা তানভীর ঠিকঠাক। যতটা সুযোগ পেয়েছেন নিজের দক্ষতার জানান দিয়েছেন। আজাদ আবুল কালাম মানেই সিনেমায় একটা রিলিফ, যতোসময় স্ক্রিনে ছিলেন রোমাঞ্চকর কিছুর দেখা পেয়েছি আমরা। তবে শিশুশিল্পী হিসেবে যাদেরকে নেয়া হয়েছে তারা পুরো সিনেমাতেই তাদের অভিনয় আর উপস্থিতি দিয়ে সেলুলয়েড প্রানবন্ত করে রেখেছে পুরোটা সময়।
মূল গল্প ঠিক রাখা হলেও গল্পে অনেক জায়গাতেই অপ্রয়োজনীয় কিছু অংশ বাদ দেয়া যেতো। তাহলে সিনেমার গল্পের সাথে আরো ভালোভাবে রিলেট করা সহজ হতো। একই কথা গানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সংখ্যা কমানো যেতো বলে মনে হয়েছে। কিছু কিছু সংলাপ বেশ ফিল গুড সিচুয়েশন উপহার দিয়েছে। সুমন সরকারের সিনেমাটোগ্রাফি ভালো লেগেছে বিশেষ করে অপরূপ সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি সুন্দরবনকে স্ক্রিনে দেখতে ভালো লেগেছে। কস্টিউম ছিলো মানানসই। কালার, ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর এবং মিউজিক আরো ভালো করা যেতো বলে মনে হয়েছে আমার।
নির্মাতা আবু রায়হান জুয়েলের ‘অ্যাডভেঞ্চার অব সুন্দরবন’ ক্ল্যাসিক সিনেমা হয়েছে সেটা বলবো না। তবে এই সময়ে এসে শিশুতোষ সিনেমা নির্মাণ যেখানে প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে পুরোপুরি সেখানে মেইনস্ট্রিম সিনেমার শিল্পীদের নিয়ে এমন একটি সিনেমা বানানোর উদ্যোগ নেবার জন্যই প্রশংসার দাবিদার। এমিলের গোয়েন্দাবাহিনী, ছুটির ঘন্টা, দীপু নাম্বার টু, আমার বন্ধু রাশেদের মতো নান্দনিক ধারার সিনেমা আমরা আবার কবে পাবো জানিনা তবে পরিবারের সবাইকে নিয়ে দেখার মতো ‘অ্যাডভেঞ্চার অব সুন্দরবন’ সেই লম্বা অপেক্ষার পথে এক পশলা বৃষ্টির মতো অনুভূতি নিয়ে এসেছে একথা বলা যায় নিঃসন্দেহে।