Select Page

‘আব্বাস’ ও ছবি যেভাবে বানাতে হয়

‘আব্বাস’ ও ছবি যেভাবে বানাতে হয়

বাণিজ্যিক ছবি বানানো কি সোজা?
অনেকের কাছে সোজা আবার অনেকের কাছে নয়। যারা অনেকদিন ধরে ভেবে রেখেছে ছবি বানাবে দেখা যাবে মনে মনে তাদের একটা ঝুঁকি আছে। যদি ছবিটা সময়ের সাথে খাপ না খায় বা তারা বানাতে না পারে! দর্শক ছাড় দেবে না। আবার অনেকে আছে সময় যেমনই হোক ছবি একটা বানালেই হলো যারা দেখার তারা দেখবে এ নীতিতে বিশ্বাসী। তাই, ছবি শেষ পর্যন্ত ছবি হয়ে ওঠে না।

নতুন মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘আব্বাস’ নিয়ে কথা বলার আগে পুরান কাসুন্দি ঘাঁটার দরকার পড়ল। কথায় কথায় আবার ‘আব্বাস’-এ ফেরা যাবে।

আপনি চিরাচরিত বাণিজ্যিক ছবি বানাতে চান তারও একটা ভাষা কিন্তু আছে। খেয়াল করলে দেখবেন আমাদের বাণিজ্যিক ছবির অনেক লিজেন্ডারি পরিচালক বা শিল্পীরা চিরাচরিত ছবি কম করেন নি। তারপরেও দর্শক দেখেছে। কেন দেখেছে জানেন? কারণ, সেগুলো ছবির মতো ছবি ছিল। ভাষা ঠিক ছিল। কোথায় কি দরকার মেকানিজমটা ঠিক থাকত। আজকের সময় গড়ানো ডিজিটাল ছবিতে সেই বাণিজ্যিক ছবির ভাষা ঠিক থাকছে না। পয়েন্ট করে বললে অনেকের কাছে ক্লিয়ার হয়ে যাবে –
* একটা ছেলে মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের দিন নতুন বাবার কাছ থেকে বিতাড়িত হয়ে সমাজের প্রচলিত অপরাধের সাথে মিশে গেছে।
* ছেলেটা এলাকার ত্রাসে পরিণত হয়েছে। তার নামে এলাকা কাঁপে।
* ছেলেটার গডফাদার আছে যে তাকে ছোটবেলা থেকে পোষে আবার স্বার্থে আঘাত লাগলে চোখ উল্টায়।
* পুলিশ স্টেশনে উপর মহলের ফোনে ছেলেটিকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় কর্তব্যরত পুলিশ।
* নায়িকা ভুল বুঝে নায়ককে গুণ্ডা, বদমাশ বলে। নায়কের কাছের মানুষেরা নায়িকার ভুল ভেঙে দেয়, জানিয়ে দেয় নায়ক কাদের জন্য কাজ করে। নায়িকা অপরাধবোধে নায়কের জীবন কাহিনী শুনে তার প্রেমে পড়ে।
* এলাকার আধিপত্য, গডফাদারের ব্যক্তিগত স্বার্থ এসবের জন্য নতুন কারো প্রয়োজন পড়ে। নায়ক আরো আসে। দুই নায়কে বাঁধে যুদ্ধ। তারপর নতুন ঘটনা।
পয়েন্টগুলো জাস্ট মিলিয়ে দেখেন তো ৩৫ মিলিমিটারের বাণিজ্যিক ছবির সময়ে এসব চর্বিত চর্বণ কিনা। মানলাম আপনি ঐ ফর্মুলাতেই ডিজিটাল ঘরানায় একটা ছবি বানাবেন তো সেটার প্রেজেন্টেশনটা কেমন হতে হবে বুঝতেই পাচ্ছেন। যারা ঘরে বসে দুনিয়ার বিনোদন পাচ্ছে তাদের কাছে চিরাচরিত ছবিটাকেই ভালো মেকিং দিয়ে প্রেজেন্ট করলেও তো তারা দেখবে। কিন্তু তা যদি না হয় তাহলে ছবি কিভাবে বানাতে হবে সেই লেসনটা তো শিখতে বলা যেতেই পারে।

‘আব্বাস’-এ ফিরে আসি। যে পয়েন্টগুলো বলা হলো তার সবকিছুই আব্বাসে আছে। স্পয়লার সতর্কতার জন্য ফিনিশিং বা গল্পের কোনো বিশেষ মুহূর্তটা না বলি। বাকিটাকে ঐ ৩৫ মিলিমিটারের ছাঁচে ফেললে কি কি দরকার পড়বে? ঐ সময়ের মতো বিশ্বাসযোগ্য অভিনয় লাগবে, সিনের সাথে পারফেক্ট ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক লাগবে, রোমান্সের সময় রোমান্টিকতা ফুটিয়ে তুলতে হবে, অ্যাকশনে দর্শককে নায়কোচিত কিছু উপহার দিতে হবে, ডায়লগের সাথে সিচুয়েশনের ব্যাখ্যা থাকতে হবে এসবই তো। কিন্তু যদি না থাকে এ জরুরি বিষয়গুলো হতাশ তো হতেই হবে।

‘এই শহরে আব্বাস বিশ বছর ঘুমায় না’ এই যে ডায়লগ এর প্রতিফলন ঘটানোর জন্য নীরবের জীবনের প্রেজেন্টেশনে বিশ বছর না ঘুমানোর পেছনে কোনো টাচি কিছু দেখানো হয় নি। যেটুকু দেখানো হয়েছে তাও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, দুর্বল অভিনয়ে মাঠে মারা গেছে। অথচ ‘পুরান চাল ভাতে বাড়ে’ নামে যে কথাটা প্রবাদে আছে তাকেই ফুটিয়ে তুলেছে অল্প সময়ের আলেকজান্ডার বো। মনে হয়েছে তাকেই ছবির মূল ‘আব্বাস’ বানালে ছবিটার ধরণ পরিবর্তন হয়ে যেত। সোহানা সাবা-র মতো ন্যাচারাল অভিনেত্রীও অভিনয়টা দেখানোর সুযোগ পায় নি কারণ চরিত্রই তাকে সে সুযোগ দেয় নি। আর মাল্টিস্টারার কাস্টিং-এ ইলোরা গহর, জয়রাজ, ডন, শিবা সানু, সূচনা আজাদ তাদেরকেও দুর্বল উপস্থাপন করা হয়েছে। ঢাকাইয়া ভাষার ব্যবহার অনেক ছবিতে আছে। সেগুলো দেখলেও প্রাণ্ঞ্জলভাবে ভাষাটা উপস্থাপন করা শেখা যায়। কিন্তু ভাষার টান বা বলার স্টাইল যদি পানসে হয় তবে মজাটা গোড়াতেই শেষ। শাকিব খানের ‘ঢাকাইয়া পোলা বরিশালের মাইয়া’ ছবিটা দেখলেও বোঝা যায় ঢাকাইয়া ভাষার প্রাণ্ঞ্জল উপস্থাপনটা কেমন হতে পারে। পরিচালক সাঈফ চন্দন-কে অনেক পরিশ্রম করতে হবে পরিচালনা জগতে।

এখন যে সময় চলছে নাটক, ওয়েব সিরিজ-এর নির্মাণ আধুনিক হয়ে গেছে। সেখানে চলচ্চিত্রের নির্মাণ ভাষা যেভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে দুশ্চিন্তার বিষয়। ইউটিউবে নব্বই দশকের গুরুত্বপূর্ণ পরিচালকদের ছবিগুলো দেখলেও বাণিজ্যিক ছবির ভাষাটা শেখা যায়। অর্থ, সময় ব্যয় করে যে দর্শক সিনেমাহলে গরম, ছারপোকা সহ্য করে আড়াই ঘণ্টার ছবিটি দেখবে তাকে তার প্রাপ্যটুকু দিতে যাতে পারেন সেই আহবান থাকবে আজকের পরিচালকদের কাছে।


মন্তব্য করুন