Select Page

ইশতিয়াক জিকোর সিনেমা ও বাইক্কা আলাপ

ইশতিয়াক জিকোর সিনেমা ও বাইক্কা আলাপ

ইশতিয়াক জিকো

 

ইশতিয়াক জিকো। বাংলাদেশি তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা, প্রশিক্ষক, প্রযোজক ও সংগঠক। তার পরিচালিত ৭২০ ডিগ্রি ইতালির ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে মনোনীত বাংলাদেশের প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্র ভাষায় নতুনত্বের জন্য ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের এইচবিও পুরস্কার পান তিনি। সিনেমাটি রট্যারড্যাম, শিকাগোসহ পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়।

সম্প্রতি তিনি তরুণতর চলচ্চিত্র নির্মাতা ও কর্মীদের নিয়ে শুরু করেছেন সংগঠন বিড়ালপাখি সিনে ক্লাব। প্রতি মাসে আয়োজন করে যাচ্ছেন বিড়ালপাখির মজমা। সেখানে জমায়েত হয় সারাদেশের নবীন নির্মাতারা। ইশতিয়াক জিকো সংগঠনটির মাধ্যমে প্রথাগত ফরম্যাটের বাইরে নিরীক্ষাধর্মী চলচ্চিত্র ভাষার অনুশীলন করছেন।

জিকো ঘুরেছেন ও কাজ করেছেন বিশ্বের নানা দেশে। প্রশিক্ষণ দিয়েছেন শ’খানেক নবীন চলচ্চিত্রকর্মীদের। পাশাপাশি তরুণদের নিয়ে নির্মাণ কর্মশালার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।

বাংলা মুভি ডেটাবেজের পক্ষ থেকে ইশতিয়াক জিকোর মুখোমুখি হয়েছেন স্থপতি-নির্মাতা নাজমুল হক নাঈম। আসুন জেনে নিই কী কথা হলো তাদের—

একটু দায়সারা ভাবে শুরু করি, আছেন কেমন?

ধরেন, রাস্তায় বা ফেসবুকে হাঁটতে গিয়া মহল্লার মুরুব্বি এই প্রশ্নটাই করল। হয়তো বলতাম— ভালো, চলতেছে, আপনার কী খবর? তিনিও একই উত্তর— আছি ভালোই। আইসো বাসায়। তারপর যে যার রাস্তায়। আমরা তো নিত্যবেলা এরকম রিচ্যুয়ালগুলা পালন করি, তাই না? কারণ, এর উল্টা বললেই অস্বস্তি শুরু। দুই পক্ষেই। দ্বিতীয়, তৃতীয়, ক্রমাগত প্রশ্নের দায়ভার নিতে হয়। খারাপ থাকা নিয়া দুঃখপ্রকাশ করতে হয়। দায়সারা থাকাটা দায় হইয়া দাঁড়ায়। ভারসাম্যহীন দশা। তবে ‘কেমন আছেন’-এর আনুষ্ঠানিকতার দায় সারলে, কিম্বা কাগজে স্পেস স্বচ্ছলতা থাকলে, আলাপটা বিস্তার করতে পারি আমরা।

বিস্তারের দুই পিঠ পাই। যখন সমকাল কিম্বা সমস্থান নিয়া চেতন থাকি, কী হইতেছে চারপাশে, মাঝে মাঝে খুব আপসেট লাগে। অস্থির লাগে। অস্তিত্বের অর্থহীনতারে যাপন করতে কষ্ট লাগে। কাছের মানুষ দূরের মানুষ সবাইরে দ্বিমাত্রিক তলের বাসিন্দা মনে হয়। অনেক ‘কেন’ বোধ তাড়া করে। নিজের সঙ্গে, নিজের মনে, ক্ষণে ক্ষণে লড়াই চলে।

অন্য পিঠ, যখন মহাকাল বা মহাস্থানের চেতনা ভর করে। তখন মগ্ন থাকার চেষ্টা করি তুচ্ছ কাজে। মানে, অকাজে। আকামে। যেই কাজে টাকা, সম্মান বা সাংসারিক উদ্দেশ্য সাধন হয় না, তারেই তো লোকে অকাজ বা আকাম বলে, নাকি? তো, আমি সেই অকাজ করি। এই তুচ্ছতায় বা অকাজে নিবিষ্ট থাকার যে আনন্দ, তার সঙ্গে মনে হয় পলায়নপরতা বোধের তফাৎ আছে। অকাজেও দায় থাকে। পলিটিক্যাল দায়। কিন্তু পালায়া যাওয়ার বোধ বা প্রবৃত্তি যেন পলিটিক্যাল দায়গুলা এড়াইতে চায়। বাঁইচা থাকার লড়াইটাতো পলিটিক্যাল। আমি এমনে দেখি।

সমকালের কথা বলতেছিলাম। ইনস্ট্যান্ট কাল। এর চাপ উতরাইতে পারলে মনে হয়, শান্তিতে আছি। স্বান্তনা পাই এই ভাইবা— আর্থিক অনিশ্চয়তার পথ বাইছা নিছি স্ব-সম্মতিতেই, তার দায়িত্বও আমার। লোকদেখানো সমাজ সেবার আড়ালে মুনাফা বাড়ানোর ফিকির করতেছি না। টাকার কাছে পুরাপুরি না সঁইপাও যে শান্তিতে বাঁইচা থাকা যায়, এইটার জন্য বোধহয় লড়াই করি। তবে এইরকম বাঁচার কিছু কাফফারাও গুণতে হয়। সেইটারে জায়েজ করি গাণিতিক বাস্তবতার মতো। ভাগফলের পর ভাগশেষ অশূন্য হইলে কি তা মাইনা নিই না?

আচ্ছা, আলাপটা খুব ভারি শুনাইলে প্রকাশনার সময় কিছু ইমোটিকন বসায়া নিয়েন। আমরা দিন দিন টাইম-অস্বচ্ছল হইয়া উঠতেছি। যেন এক হাইপারলিংক দোষে। 😉

পলিটিক্যাল অকাজ বা আকাম করার এই সিদ্ধান্ত নিজের গরজেই নিছেন নিশ্চয়ই। পালাইতে না চাওয়ার কুফল হিসাবেই চেপে বসছে হয়ত ঘাড়ে। 🙂 মুনাফা বাড়ানোর ধান্দায় নামেন নাই, সমকাল ছাইড়া মহাকাল নিয়াও ভাবেন। সেই আপনি আবার একাধারে নির্মাতা, সংগঠক, শিক্ষক। জিকোবাজি নামে লেখালেখি করেন ব্লগে। কোন পরিচয়টি সবচেয়ে পছন্দের?

সব কাজই পছন্দের। এই পছন্দের কোনো চিরন্তন হায়ারার্কি নাই। তবে পরিচয় বলতে মনে হয় বিশেষণ বা তকমাটারে ইঙ্গিত করতেছেন। গায়ে তকমা চাপানোর আগে নিজের কাজকাম নিয়া ভাবা যাক। ধরেন, করতেছিটা কী? পাবলিক স্পেসে কৃতকর্ম বলতে— একটা বড় দৈর্ঘ্যের সিনেমা তৈরির ফাংশনাল প্রস্তুতি নিতেছি। বিড়ালপাখি সিনে ক্লাবের মজমায়-পাঠচক্রে হাজিরা দিতেছি। সুযোগ পাইলে নবীনদের প্রশিক্ষণ দেয়ার নামে নিজেই শিখতেছি। আর ইদানিং ফেসবুকে এইটা ওইটা খুব পোস্ট দিতেছি।

দিনশেষে নিজের সম্মতিতে সম্পাদিত যেইসব ক্রিয়া বা কর্ম ‌‘হোক সেইটা একসিডেন্টাল বা ইনসিডেন্টাল’ সেইটা দিয়াই আমি আইডেনটিফাইড হইতে চাই কিনা, সেই প্রশ্নটা কিন্তু উঠতেছে না। দেখেন, কর্ম আর তকমার সেতুটা কত লিনিয়ার আর সিম্পলিফাইড কইরা ফেলছি। যেহেতু সিনেমা পরিচালনা করছি, তাই জিকোরে ‘নির্মাতা’র তকমা পড়াও। এই তকমা পড়ানোয়, পড়নে কষ্ট কম। স্টেরিওটাইপিং বেশি। মানে, তকমাঅলা ফোল্ডারে চালান দিলেই যে একটা ফাইল তার নিজের পরিচয় পাবে, তার গ্যারান্টি কী? 🙂

দ্বিতীয়ত, পরিচয়ের খাতিরে যত তকমা আমি স্বীকার করতে থাকি, তত যেন নিজের ঘাড়ে নতুন নতুন ভার নিতে থাকি। ভার নিতে না চাইলেও টেকনিক্যাল কারণে তকমা স্বীকার করা লাগতেছেই। রোজগারি দুনিয়ায় তকমাহীন থাকা মানে বেওয়ারিশ, অবৈধ এবং যেন অনৈতিকও। এইটারে আমি বলব, পরিচয়ের পরিহাস বা আয়রনি অব আইডেনটিটি!

[su_note note_color=”#ecf0f5″ text_color=”#ffffff” radius=”5″]

এই লেখাটি বিএমডিবি ঈদ সংখ্যা ই-বুক ২০১৭ এর অংশ। পুরো ই-বুক টি ডাউনলোড করুন এখানে

ডাউনলোড করুন[/su_note]

 

তৃতীয়ত, যাবতীয় তকমা এক বা একাধিক পাবলিক ইমেজ নির্মাণ করে। ইমেজ মানে তার একটা ফ্রেমও থাকা। ধরেন ‘নির্মাতা’ তকমাটা। এই তকমা শুনলে চোখে ভাসে, একটা মানুষ, ক্যামেরা হাতে, শুটিংরত। কিম্বা এডিটিংরত। আমৃত্যু বর্তমান বা প্রেজেন্ট ইনডেফিনিট অ্যাকশনের ইমেজ।
মানুষটা হয়তো সব সময় শুট-এডিট করে না। হয়তো তার প্রস্তুতি বলতে জীবিকা-যাপন সামাল দিয়া জীবনবোধ পোক্ত করা, চেনা-জানা জিনিসগুলা আনলার্ন করতে থাকা, কিম্বা ভারি কাজের জন্য একটু দম নেওয়া। এগুলা কিন্তু ফ্রেমের বাইরে রাখা হইতেছে।

প্রডাকশনের আগে যে দীর্ঘ, ক্লান্তিকর, পেইনফুল দিন ও রজনী গুজরান করে মানুষটা, তার হিসাব কিন্তু পাবলিক ইমেজে নাই। ‘ও, তুমি সিনেমা বানাইতেছো না, তাইলে তোমার তকমা তো ব্যাকডেইটেড, প্রবলেমেটিক।’ সেইটা নির্মাতা বলেন, শিক্ষক বলেন, সংগঠক বলেন; সব তকমা সেলফের ইমেজ প্রডিউস কইরা খালাস, কিন্তু সেলফ নিয়া তার কনসার্ন নাই। নিষ্ঠুর তকমার ভার তো বইতে তো হয় সেলফকেই।

আবার যদি খেয়াল করেন, তিনটা বিশেষণের পর আপনি কিন্তু আমারে ব্লগার ডাকেন নাই। বলছেন, ব্লগে লেখালেখি করি। তিনটা তকমা। একটা কাম। হয়তো, ব্লগার তকমা দিলে ভাবতেছেন, আগামীকাল আমার হেফাজতের ভার কে নিবে, এই ভালোবাসায় আপনি কাম বা কর্মটারেই হাইলাইট করছেন।

আচ্ছা, হঠাৎ মনে পড়ল, বিয়া পড়ানো ছাড়া অন্য কোনো কাজ করলে— ধরেন ক্রিকেট খেললে তারে কিন্তু কাজী ডাকেন না। আবার কাজী তকমা শুনলে মাথায় ‘কাজের লোক’ ইমেজও তৈরি হয় না। ফলে আমি তকমা থেইকা কাজকামটা নিয়া বেশি আগ্রহী, চিন্তিত এবং কৌতুহলী।

বেওয়ারিশ না থাকার জন্য তাইলে এত তকমা পড়তেছেন। আবার মনে হইল, অদৃশ্য অনেক কার্যকলাপ রয়ে যাইতেছে ফ্রেমের বাইরে। যাকে আপনি তকমা লাগাইতেছেন প্রস্তুতি পর্ব হিসেবে। এই প্রস্তুতি পর্ব কিন্তু অনেক বড় ভূমিকা রাখে ফ্রেমের সাইজ ও শেইপ তৈয়ারিতে। হেফাজতের হাত থাইকা হেফাজত করার জন্যই হোক আর আপনার নিজের ভেতরের অন্য তকমার শক্ত অবস্থানের কারণেই হোক, আপনাকে ব্লগার তকমাটা দিতে চাই নাই। 😀 আরো সফল তকমা লাগবে আপনার গায়ে। লাগুক আরো। তাতে আখেরে লাভ সবার।
একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। চলচ্চিত্র নির্মাণে আসার পেছনের গল্পটা বলেন। কাকে দেখে আসা? কার অনুপ্রেরণা ছিল পেছনে? যদি খুইলা বলতেন।

পেছনের গল্প মানে কত পেছনে যাবো? ধরেন, শৈশব বা কৈশোরে প্রায়ই মায়ের কাছে, খালার কাছে মামার (মসিহউদ্দিন শাকের, সূর্যদীঘল বাড়ী-র দুই নির্মাতার একজন) গল্প শুনতাম। মামার আর্কিটেকচারে পড়ার গল্প। সিনেমার গল্প। সূর্যদীর্ঘল বাড়ি-তে জয়গুনের (ডলি আনোয়ার) কাস্টিংয়ের গল্প। মামা কিন্তু নিজের মুখে আমারে তার সিনেমার গল্পগুলা বলেন নাই। এমনকি আমি তখনো সিনেমাটা পুরাপুরি দেখি নাই। কৈশোর পর্যন্ত সিনেমাতে আমার তেমন আগ্রহও ছিল না। সিনেমার চেয়ে বরং আগ্রহ ছিল মামার লেখায়-আঁকায়। আমার মনে আছে, মামার আঁকা একটা বস্তির স্কেচ। হয়তো কয়েকটা টান কিন্তু ভয়ানক ইমপ্যাক্ট তৈরি করছিল মনে। পত্রিকাটার নাম খেয়াল নাই।

যেইটা বলতেছিলাম, আমার সিনেমায় কাজ করার পেছনে মামার সরাসরি কোনো অনুপ্রেরণা নাই। অনুপ্রেরণা বলতে পাইছি, পরিবারের মৌন সম্মতির। মানে, সিনেমায় ‘নামা’টা যে উচ্ছন্নে যাওয়া না, এই আইডিয়া খাওয়াইতে কোনো বেগ পাইতে হয় নাই। সেই রাস্তা পরিবারে মসৃণ করার জন্য অবশ্যই মামার পরোক্ষ ভূমিকা তো ছিলই।
অনুপ্রেরণা বলতে বড় দুই ভাইয়ের কথা মনে পড়তেছে। আমরা তিন ভাই। আমি সবার ছোট। রাহাত সবার বড়। আমার থেকে সাড়ে বারো বছরের বড়। নব্বইয়ের শুরুর কথা। সে তখনই ইলেকট্রনিক্স সরঞ্জাম বানায়, বিজ্ঞান ক্লাব করে, আবার ছবি আঁকে, গান শোনে, গান গায়, নামে-বেনামে লিখে, আবৃত্তি করে, প্রাইজ পায়, ঘুরেফিরে নিজের মতো। ভাইয়ার এই মাল্টিডিসিপ্লিনে ঘোরাফেরাটা আমাকে খুব মোটিভেইট করছে।

মেঝ ভাই যিনি, ইফতেখার, আমার থেকে সাড়ে সাত বছরের বড়; তার আবার অন্য স্বভাব। সে খুব দাবা খেলে, খুব বই পড়ে, বাম রাজনীতি করে, মহল্লার ওয়েলফেয়ার করে। তার বড় একটা গুণ দেখতাম, সামাল দেওয়া। ম্যানেজমেন্ট। যে কোনো জাগতিক ঝামেলা সামাল দিতে সে আগায়া যায়। এই মেঝজনই আমারে নিয়ে যাইতো স্টেডিয়ামের ম্যারিয়েটা বইয়ের দোকানে, দিলকুশার ইউসিসে, পুরানা পল্টনের ফুটপাতে বইয়ের দোকানগুলায়, রাশান কালচারালে সারেং বৌ দেখতে। স্কুলের টেক্সটবইয়ের বাইরে নতুন দুনিয়া।

দুই ভাইয়ের দুইরকম ভঙ্গি। একজন এমন— নতুন আইডিয়ায় নতুন কিছু করতে থাকো। আরেকজনের ভঙ্গি— একা কইরো না, সবাইরে নিয়া করো। বড় দুই ভাইয়ের বাহারি তৎপরতার জন্য বোধহয় আব্বু বা আম্মুর কাছে আমার ইনিশিয়েটিভগুলা ডালভাত লাগত। ডালভাতের প্রতি সম্মান জানায়াই বলতেছি। ভাইদের কথা বললাম। আম্মু আর আব্বুর কথা আপাতত বাদ রাখি। নিজের সঙ্গে এত স্যাচুরেটেড সেগুলা, এই আলাপ তাইলে শেষ হবে না।

আর বিজ্ঞান ক্লাবের কথা বলতেছিলাম না? ছোটবেলায় বড় দুই ভাইয়ের মতো আমিও বিজ্ঞান ক্লাবে যাওয়া শুরু করি। অনুসন্ধিৎসু চক্র। বাংলা নাম। প্রতি শুক্রবার সভা হইতো। বহুজনের সঙ্গে মিশতাম। বাহারি কাজ করতাম, দেখতাম। মানে, মিডিওক্রেসির স্টেরিওটাইপিং অনেকটা ভাঙছে অনুসন্ধিৎসু চক্র করতে গিয়া। আবার আমি স্বভাবে চাপা, তবু ডায়াসে উঠলে যে ডরাই না, এই যে আমি এক-আধটু লিখতে পারি, ইমোশনালিটির বাইরে র‌্যাশনালিটির প্রলেপটা এপ্রিসিয়েইট করতে পারতেছি, গল্প শুনলে তার কাঠামোগত তুলনা করতে পারি, তার জন্য বিজ্ঞান ক্লাবটারও কিন্তু অনেক অবদান আছে। এগুলাই হয়তো আমার বেইজলাইন, অদৃশ্য অনুপ্রেরণা।

টিনএইজে আরো অনেক কিছু করছি। স্মৃতি থেইকা বলতেছি। ননলিনিয়ার হবে। গোপনে প্রেম করা, জ্ঞানগম্ভীর চিঠিপত্র চালাচালি করা, ছ্যাঁকা খাওয়া, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শেখা, ওপেন সোর্সে ইনিশিয়েটিভে যুক্ত হওয়া, ওয়েব ডিজাইন করা, সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি নেওয়া, টাইপোগ্রাফির নেশায় পড়া, লেখক হইতে চাওয়া, দার্শনিক হইতে চাওয়া এবং কিছু কূলকিনারা না পাইরা বা চারপাশের মিডিওক্রেসি দেইখা সবকিছুর প্রতি বিতৃষ্ণা জাগা। টিনএইজ কাল চিন্তা করলে ভাবি, কী স্পিরিট ছিল আমার।

তারপরের গল্প বিশ্ববিদ্যালয় উঠার পর। ভর্তি হইছিলাম প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতে। পরিবারের আপত্তি সত্ত্বেও মাঝে কলকাতায় চইলা যাই। অখ্যাত একটা কলেজে ভর্তি হই। টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। মন টিকে নাই পরে। ঘাওড়ামি বাদ দিয়া ঘরের ছেলে ঘরে। ঢাকায় ফিরা আবার গণিতে। গণিতে আমি কখনই মেধাবী ছিলাম না। তবে গণিতের যে একটা দার্শনিক বেইজ আছে, সেইটার খুব মোহ ছিল। ভক্তি ছিল। আমি তখন টমাস কুন, পল আরডস, রামানুজন, বাগোডেলের নাম শুনছি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের উইঠা দেখি কেইস ভিন্ন। এই গণিত পাঠদান তো ভাই ভীষণ আনরোমান্টিক। তারচেয়ে বড় কথা, ফিলোসফিহীন। চোথাসর্বস্ব। থিওরেম মুখস্থ করো, আর উগরাও। মন বসতো না ক্লাশে। ক্লাশরুম যে কতটা ডিমোটিভেইটিং আর নিরস হইতে পারে, তা হাড্ডিমজ্জায় টের পাইলাম গণিত পড়তে আইসা। স্কুল-কলেজ লাইফেও এমনটা হয় নাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে খালি অমল হালদার স্যারের পেডাগজি স্টাইলটা আমার মনে ধরছিল। একটা বিষয়কে পরিবেশনা দিয়া কেমনে আগ্রহী করানো যায়, যেইটা চোখে পড়ত।

যাই হোক, চোথার চাপে নিজেরে যেন হারায়া না ফেলি, তার কাউন্টার করতে গিয়া আবার নতুন কিছু করার ফন্দি করা। তখনই সিনেমা মাধ্যমটা আবার পাওয়া। তার সঙ্গে নতুন কইরা সম্পর্ক তৈরি। পাবলিক লাইব্রেরিতে সিনেমার উৎসবগুলা এটেন্ড করা, সিনেমা দেখা, বুলেটিনের লেখা সম্পাদনা করা। সিনেমার যে সর্বগ্রাসী শক্তি আছে, অডিয়েন্সকে একই সঙ্গে ইমোশনালি আর ইন্টেলেকচুয়ালি জারিত করার ক্ষমতা আছে, সেইটা টের পাইতেছিলাম।

বাসায় দেখার আয়োজন ছিল না। সহপাঠী জাকির ছিল পার্টনার ইন দ্য ক্রাইম। শহীদুল্লাহ হলে তার রুমে বইসা ভাড়া করা সিডি, ডিভিডিতে প্রথম সিটিজেন কেইন দেখা, ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ দেখা, ডেকালগ দেখতাম। তখন কাক বইলা একটা প্রতিষ্ঠান ছিল সাইন্সল্যাবে। তারা সিনেমা দেখাইতো নিয়মিত। রাজেন তরফদারের পালঙ্ক, ঋত্ত্বিকের অযান্ত্রিক, মৃণালের আকালের সন্ধানে, এরকম সিনেমার সঙ্গে পরিচয় শুরু। সব যে বুঝতাম— তা তো না। হয়তো দেখার চেয়ে বেশি তাকায়া থাকতাম, ভাবতাম অন্য কিছু, এক চিন্তা থেকে অন্য চিন্তায় চইলা যাইতাম। রিসেন্টলি মৃণাল সেনের অন্য কাজগুলা দেখতেছিলাম। নতুন নতুন জিনিস আবিস্কার করতেছি। আগে দেখলে বদহজম হইতো নির্ঘাৎ।

আমি তখন পার্ট টাইম লেখালেখির চাকরি করতাম বেঙ্গল ফাউন্ডেশনে। কাজের ফাঁকে অফিসের প্রিন্টার দিয়া সিনেমা নির্মাণসংক্রান্ত যা পাই, প্রিন্ট কইরা বই বানায়া পড়ি। আজিজে (মার্কেট) সিনেমার বই খুঁজতাম। মার্কেজের চিত্রনাট্য কর্মশালার উপর লেখা বই কেমন করে গল্প হয় আর সত্যজিতের বিষয় : চলচ্চিত্র মনে হয় আমার পড়া প্রথম উপাদেয় সিনেমা বিষয়ক বাংলা বই। গাস্ত রোবের্জের লেখাও ভালো লাগতো।

পরে একটা ছোটদৈর্ঘ্যের অনুশীলন সিনেমায় হাত দিই। জাকির ফোন কইরা একদিন বলে, শাহবাগে বাসচাপায় এক স্টুডেন্ট মারা গেছে। হ্যাপি নাম। সে একটা ইমেজের কথা বলে, ধরো হ্যাপিকে না, একটা ফুল চাপা দিতেছে একটা বাস। এই মেটাফোরিক ক্লিশে ইমেজটাই কী কারণে যেন ইনস্ট্যান্ট প্রোভোক করছিল আমারে। মানে, চোখে ভাসতেছিল তৎক্ষণাৎ, শটের পর শট, সিনের পর সিন। তত্ত্বকথার বাইরে মাঠে গিয়া অনুশীলনে নামলাম। বুঝলাম, দেখা এক, বানানো আরেক। হাতে-কলমে অভিজ্ঞতা না থাকায় পাঁচ মিনিটের একটা মামুলি প্রডাকশনের সিনেমাটা শেষ করতে লাগল এক বছর। এই এক বছরটা আমি মনে করি, ফিল্মমেকিংয়ে আমার প্রথম টেকনিক্যাল স্কুলিং।

মামার কথা শুনে হোক, দেখে হোক একটা ইমেজ দাঁড়াইছে আপনার মনে— নির্মাতার। যা গতানুগতিক না নিশ্চয়ই। এমন একজনের প্রভাব পাইছেন যার কাজ ঘরে-বাইরে সমালোচকদের দৃষ্টি কাড়ল কিন্তু সিনেমা হলে চললে না। তথাকথিত ইন্ডাস্ট্রি যাকে তকমা লাগায় ফ্লপ হিসেবে। আবার দুই ভাইয়ের প্রভাব ছিল আপনার স্ট্রাকচারড বা লিনিয়ার, নন-লিনিয়ার জীবনবোধ নির্মাণের পিছনে। সিনেমার নানান শিক্ষা নিজ তাগিদে জোগাড় করসেন নানা মাধ্যম থাইকা। একাডেমিক পড়াশোনা গণিতে হলেও সিনেমা নিয়েই আপনার ক্যারিয়ার। কেন? চোথার গৎবাঁধা সুত্রে আটকা পড়তে চান নাই, সেটাই কি কারণ?

আসলে সিনেমা নির্মাণের জন্য যে একাডেমিক জ্ঞানটা বাধ্যতামূলক না, সেইটা তো আঁচ করছি ছোটবেলার গল্পেই। মামা মসিহউদ্দীন শাকেরের একাডেমিক পড়াশোনা স্থাপত্যে। কিন্তু বানাইছেন সিনেমা। বানাইতে পারছেন তো। কেমনে পারলেন?

অনেকে বলবেন, আর্কিটেকচারের সঙ্গে সিনেমা ডিসিপ্লিনের গভীর বোঝাপড়া। আমার বিশ্বাস— ডিসিপ্লিন যাই হোক, আপনি তার কতটা নিলেন, সেইটা জরুরি। কারো একাডেমিক ডিসিপ্লিন যদি পালি ভাষাও হয়, তাও সমস্যা নাই। কারণ, প্রতিটা ডিসিপ্লিন আপনারে খালি জেনেরিক টুল ধরায়া দিবে। ডিসিপ্লিনগুলা বলবে, কীভাবে জগতরে একটা পার্সপেক্টিভ থেইকা এনালাইসিস করা যায় মাত্র। এর বাইরে ভিন্ন যে পার্সপেক্টিভ, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, বোধ, প্রজ্ঞা— সেইসব আসে একাডেমির বাইরে থেকে।

ফলে, দুশ্চিন্তার কিছু নাই। বহুবছর গণিতের একাডেমিক সঙ্গ পাওয়ায় যে লাভটা হইছে, কিছু ডিসিপ্লিনারি টুলগুলার এপ্রিসিয়েশন আর এপ্লিকেশন ধরতে পারছি। সিনেমা ডিসিপ্লিনেও সেই টুলগুলাই কিন্তু প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কাজে লাগে। মূল ঘটনাটা, প্যাশনটা কোথায়। প্যাশনটাই তাড়া দেয় গভীরে উঁকি দিতে, অভিজ্ঞতা করতে, যাপন করতে। সিনেমা প্রডাকশনে শ্রম দিলেও সিনেমারে খালি ক্যারিয়ারের উছিলা হিসাবে দেখতে চাই নাই, চাইবও না। সিনেমার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা বোধ হয় অসংজ্ঞায়িত।

প্যাশন এর তাড়নায় ছুটসেন সিনেমার অলিগলিতে। অসংজ্ঞায়িত সম্পর্কে জড়াইসেন। গণিতের জ্ঞান পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখছে ডিসিপ্লিনারি টুলের বোঝাপড়ায়। নিজ তাগিদে সিনেমার অ্যাপ্রিসিয়েশন আর অ্যাপ্লিকেশনের নানান তরিকা আয়ত্ত করে অনুশীলন কাজ করলেন কয়েকটা। আচ্ছা, ৭২০ ডিগ্রি নিয়া সিনেমার আন্তর্জাতিক উৎসবে আপনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন। উৎসবের অভিজ্ঞতাটা কেমন?

বিনয়সহ বলতে চাই, প্রথম প্রতিনিধিত্ব করি শিল্পকর্মটার, সিনেমার। তারপর নির্মাতা হিসাবে নিজের। তারপর বাংলাদেশের। দেশ আর রাষ্ট্রের কনসেপ্টও তো আলাদা। দেশটা দেখি ভৌগলিক-সাংস্কৃতিক জন্মভূমি বা নিবাস হিসাবে। আর রাষ্ট্রটা পলিটিক্যাল সংগঠন। এমনও হইতে পারে, শিল্পকর্মে প্রতিনিধিত্বে রাষ্ট্রীয় লেয়ারটা আমার জন্য বেশি চাপের, বেশি ভারি। এখনো এই রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিত্ব বুঝি না পুরাপুরি।

উৎসবের অভিজ্ঞতা মিশ্র। র‌্যানডম কয়েকটা বলি। ধরেন, ভেনিসে গিয়া দেখি, ৭২০ ডিগ্রি-টা বাংলাদেশের একমাত্র সিনেমা। কিন্তু ভেন্যুতে কোথাও দেশের পতাকা নাই। বাকিদের পতাকা উড়তেছে। উৎসব অফিসে জানাইলাম। তারা ভুল স্বীকার কইরা ক্ষমা চাইয়া কয়েকদিন পর পতাকা দিল। আমার তখন হয়তো ব্যক্তি বা শিল্পকর্মের চেয়ে রাষ্ট্রীয়বোধটা বেশি চাপছিল।

আবার রটারড্যামের এক অডিয়েন্স বলে, ‌‘তোমার সিনেমাটা খুব ন্যাশনালিস্টিক।’ আমি তো অবাক। একটু কাউন্টার করতে যাই। সে বলে, ‘তোমার সিনেমায় ইমেজটা খেয়াল করব। যেমনে বৃত্তে বন্দি কইরা পরিবেশন করছো, লাগে ঠিক বাংলাদেশের পতাকার মতো।’ আমি হাসি। বলি, বাহ এইটা তো ডিফরেন্ট রিডিং। মনে মনে বলি, তাইলে জাপান কী দোষ করল?

আবার জাপানের এক উৎসবে দেখাইতে গিয়া উপলব্ধি করি, উৎসবের ঘনঘটা আছে খুব, আমার সেবা আছে, বাংলাদেশের পার্টিসিপেশন আছে, শুধু সিনেমাটা নাই।

বড় উৎসবে গিয়া নবীন ইন্ডিপেনডেন্ট নির্মাতারা মনে হয় একটু কোণঠাসায় থাকে। যেমন; আমার কোনো সেলস এজেন্ট ছিল না। আমারেই প্রচারণায় নামতে হইছে। ‘ভাই, আইসেন, দেইখেন।’ ক্যানভাসারের মতো দশা। সম্ভাব্য প্রডিউসারের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলা। তারকোভস্কির একটা ইন্টারভিউ ক্লিপ দেখছেন না— যেখানে সে বলতে থাকে, সিনেমা এখন সিগারেট বা আট-দশটা পণ্যের মতো বেচতে হয়। উৎসবে ঘুরতে ঘুরতে ওই অনুভূতিটা উপলব্ধি করছি অনেকবার।

আমার অভিজ্ঞতায় বলে, উৎসবের মনোনয়ন বা পুরস্কার উৎসাহ দেয় ঠিকই। কিন্তু তা নবীন নির্মাতারে পঙ্গুও কইরা দেয়। সেলফটা হারায়া যায়। সেলফের ইমেজটা বড় মনে হইতে থাকে। নিজের ভিতর সেন্সরশিপ আসে। ব্লক আসে। উৎসব তকমার একপেশে ভার বইতে হয় দীর্ঘকাল বা আজীবন। বড়াই আসে মনে। সিনেমার সঙ্গে ইনোসেন্ট সম্পর্কটা আর থাকে না। আমার এমন হইছে। এইটা কাটায়া উঠতেই এত বছর হয়তো লাগতেছে।

তবু উৎসবরে সবসময় উপেক্ষা করা যায় না। দুনিয়াতে সিনেমার তকমাঅলা উৎসবগুলারে এখন অ্যাপ্রিশিয়েট করি একটা বাজার হিসেবে। যৌথ প্রযোজনার মিলনমেলা হিসেবে। বহুদেশের শিল্পী-অশিল্পীদের সঙ্গে নেটওয়ার্কিংয়ের উছিলা হিসেবে। কারখানার অংশ হিসেবে।

উৎসবে গিয়া আরেকটা লাভ হইছে, সিনেমার উৎসব নিয়া মোহ/মিথ ভাঙতেছে অনেকটা। সিনেমাটা ভালো না খারাপ লাগা উচিত, তা আর উৎসবের লরেল পাতা গুইনা বিচার করতে বসি না। সিনেমার মতো উৎসবের ভালো-খারাপও খুব সাবজেক্টিভ আর বৈচিত্রময়। সিনেমা মাধ্যম অন্য মাধ্যমের সঙ্গে টিকে থাকার লড়াই করতেছে, উৎসবগুলাও যে যার মতো কৌশল পাল্টায়া টিকে থাকার লড়াই করতেছে। এগুলা নিয়া সচেতন হইতে পারলে, দূরত্ব রাখলে একটু বোধহয় নির্মোহ হওয়া যায়; তকমার আড়ালে মগ্ন থাকা যায় নিজের কর্মেও।

তার মানে আপনি উৎসবকে একরকম বাজারি পারপাসে দেখছেতেন। উৎসবের পিছনেও ছুটতেসেন না, আবার মূলধারার কারখানার পণ্যের মতো কনটেন্টও জোগান দিতে চাচ্ছেন না। ইনোসেন্ট সম্পর্ক রাখতে গিয়া আবার নতুন তকমা লাগাইতে যাচ্ছেন। টি-টোয়েন্টি না খেলে টেস্ট ম্যাচে আগ্রহ বেশি আপনার। ধরেন, এ দেশে অনেকে সিনেমা বানানোর আগে টেলিভিশন ফিকশনে কাজ করেন। কিন্তু আপনি সিনেমা ছাইড়া এই পথে আসেন নাই। কেন?

টেলিভিশনে ঢুকি নাই না। ঢুকতে পারি নাই। তবু একসময় মনে হইছিল, এত এলিটিপনার কী আছে। জীবিকার জন্য কত মানুষ কত কী করে। কনটেন্ট পরিচালনা করলাম না হয় টিভির জন্য। চেষ্টা করছিলাম, কুলায়া উঠতে পারি নাই। আমি ভালো হুটোপুটি-কাড়াকাড়ি খেলতে পারি না। পাশাপাশি, দূর থেইকা ফলো করতাম তারেক মাসুদের যাপনরে। তিনিও একটা অনুপ্রেরণা ছিলেন হয়তো।

আমি ঢুকি নাই, কিন্তু আমার সময়ে অনেকেই ঢুকছে। একেকজনের পরিস্থিতি, পথ আলাদা। টেলিভিশন চ্যানেলগুলাও তখন তরুণদের পালস বুইঝা লেনদেনের সুযোগ তৈরি করতে পারছিল। অন্যদিকে, সিনেমার লোকাল কারখানাগুলা কিন্তু তরুণদের পালসগুলারে পাত্তা দেয় নাই। ধরেন, এফডিসি। আমলাতন্ত্রের আখড়া। সিন্ডিকেটে ভরা। আমি সেইখানেও চেষ্টা করছি ঢুকতে। খুব কঠিন তো ঢোকা।

টেলিভিশনের মেকানিজমটা সিনেমার থেকে আলাদা। তার পলিসি এমন— কর্পোরেট স্পন্সরদের কাছ থেকে সময় কিনো। যেটুকু সময় বাঁচবে, সেটুকু পূরণ করো চটকদার কনটেন্ট ঢুকায়া। তাদের কৌশলটা দেখেন। নিজেরাই সিনেমার প্রযোজকের মুখোশ পইড়া নাইমা গেছে। ওই যে বললাম, বাজারের চাহিদা বোঝা। পালস ধরা। তরুণ মুখোশটা দেখছে— সিনেমা বানাবো সেলুলয়েডে, ক্ষতি কী? টাকা আছে, ঢালো, সেইটা টিভিতে প্রিমিয়ার করো বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে। পয়সা উসুল। এইখানে সিনেমার বৈচিত্র কই, নির্মাতার নিজের স্বর কই, বাণিজ্যের বাইরে শিল্পকর্মের রসটা কই?

টিভিতে না ঢুকতে পারার আরেকটা কারণ, টিভির ভঙ্গিটা। টিভি মিডিয়ামের প্রাকটিসটা খুব মনোলিথিক। টেলিভিশন গড়পরতা যেইভাবে হাজির করতে চায় অডিওভিজুয়ালি, সেইভাবে আমি নাও চাইতে পারি। এই হাজিরাটা শটের আকার বা টিভির স্ক্রিন সাইজ নিয়া না। এই হাজিরা বলতে মানুষ-সময়-স্থানের রেপ্রিজেন্টেশন বুঝাইছি। টিভিতে হাজিরাটা অসংবেদনশীল। টিভিতে কনটেন্ট প্রোগ্রামিং হয় স্পন্সরের এজেন্সি অনুমোদিত টার্গেট অডিয়েন্সের রুচির টলারেন্স অনুমান কইরা। ফলে আমি কী চাই বা না চাই, তা নিয়া টিভির মাথাব্যথা নাই। কারণ টিভির ফরম্যাট-স্ট্যান্ডার্ড বুইঝা বাজারে কনটেন্ট সাপ্লাই দেয়ার লোক তো অনেক।

ধরেন, আমি চাইলাম— সমপ্রেমী যুগলের সামাজিক পরিচয় সঙ্কট, তাদের মানসিক টানাপোড়েনটা দেখাবো। ডিজাইনে রাখলাম ক্লোজআপ শট কিন্তু দীঘল টেক, সংলাপময় কিন্তু ননডায়াজেটিক মিউজিকহীন, ন্যারেটিভ স্ট্রাকচারটা একটু অ্যান্টিড্রামাটিক, ইমেজের টোনটা সাদাকালো আন্ডারএক্সপোজড এবং তা ব্রডকাস্টের সময় কোনো বিজ্ঞাপন বিরতি থাকবে না। টিভি মিডিয়াম কি এই শর্তগুলা মানবে? আইডিয়াটা অ্যাপ্রিসিয়েট করা দূরের থাক, অনুমোদন করবে? সিনেমা মিডিয়ামটা করবে। এমনকি কোনো না কোনো প্রযোজক-পরিবেশক-প্রদর্শক আগায়া আসবে এর জন্য। ২০০৬-২০০৭ এ আমি চেষ্টা করছি টিভিঅলাদের সঙ্গে বাহাস করার এই বিষয়ে। পরে বুঝলাম, কবি ওইখানে নীরব।

সিনেমা ডিসিপ্লিনটা যত চর্চা করতেছি, তত উপলব্ধি করতেছি টিভির চেয়ে এই মাধ্যমটা অনেক ইনক্লুসিভ। অনেক কনটেমপ্লেটিভ, সংবেদনশীল, কিম্বা সহনশীল। আমিও হয়তো এই গুণগুলাই খুঁজতেছিলাম এতদিন কোনো না কোনো প্রকাশ মাধ্যমে। তাই সিনেমার খেদমত করার সিদ্ধান্তে আসা।

দীঘল টেক, মিউজিকহীন, অ্যান্টিড্রামাটিক স্ট্রাকচার, সাদাকালো আন্ডারএক্সপোজড, বিরতিহীন সম্প্রচারের শর্তে রাজি হইল টিভিঅলারা। তাইলে কী টিভি ফিকশনে আসতেন বা আসবেন? এ দেশে সিনেমা নির্মাণ নিয়া আপনার ভাবনা কী? যৌথ প্রযোজনার হাতে মূলধারার সিনেমা। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী কাজ করলেন জাজ মাল্টিমিডিয়ার সাথে। আপনি কেমন দেখেন ব্যাপারগুলা?

টিভি যদি এতই উদার হয়, আমার তখন বানাইতে এলার্জি নাই। তবে আমি এখন অনলাইনের জন্য নির্মাণগুলায় আগ্রহ পাইতেছি। ন্যারেটিভ ও নিরীক্ষার স্বাধীনতা বেশি।

আমার সময়ে সিনেমার মাধ্যমগত যে চর্চা দেখছি, তাতে মনে হয়— আমরা বোধহয় সিনেমা মিডিয়ামটারে খালি সাহিত্যিক ন্যারেটিভ ফাংশন মিটানোর জন্যই টানাটানি কইরা গেছি। যেই কারণে ভ্রম কাটে না নির্মাতাদের বা অডিয়েন্সের— কোনটা একান্তই সিনেমাটিক, কোনটা ড্রামাটিক, আর কোনটা থিয়েট্রিকাল?

আইডিয়ালি বললে, যে কোনো ধারায় বা যূথচারিতায় আপত্তি নাই। আমি বৈচিত্র্য ভালো পাই। প্রযোজনা করতে আসুক না ভারত বা সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর বা লাটভিয়া। যৌথ প্রযোজনায় শ্রমের বাজার বাড়ে, লেনদেন হয়, হইতে দেন না।
প্রাকটিক্যাল কথা হইল, প্রযোজিত সিনেমার কনটেন্ট-ফরম্যাটগুলা কেমন হইতেছে? সবগুলা কি ছাঁচে ফেলা, কপিপেস্ট? ধরেন, ইনায়া বিনায়া টালিউডি ভূত? কিম্বা কনটেন্টগুলা কোন বাজারে কেমন শেয়ারে পরিবেশিত হইতেছে? নামে যৌথ, কামে একপেশে বা বৈচিত্র নাই, শিল্পচেষ্টা নাই— তাইলে তো বিপদ।

আমার মনে হয়, খালি জাতীয়তাবাদী চর্চা করতে যারা সিনেমা মাধ্যমটা ব্যবহার করতে চান, তারা বরং আরো লোকাল কনটেন্ট বানাক লোকাল উপায়ে। দেশে-বিদেশে সাপ্লাই দিক। আবার খালি অ্যান্টি-ভারত কইরা যে জাতীয়তাবাদী জোশ পাইতেছি আমরা, সেইটা কি বেশ উগ্র মনে হয় না?
তার মানে যৌথ প্রযোজনায় চুলকানি নাই আপনার। আপনার টেনশন গন্ধ লইয়া, মানে জিনিসটা কী দাড়াইলো সেটা মুখ্য। 🙂 আপনার নয়া সিনেমা সিনেমা, সিটি অ্যান্ড ক্যাটস নিয়া বলেন। লোকার্নো ঘুইরা আসলেন।

লোকার্নোর অভিজ্ঞতাটা আমার জন্য নতুন। পিচ করতে গিয়া বুঝছি, আমি কতটা অপ্রস্তুত আর এলোমেলো। আবার লোকাল কনটেক্সটগুলা ঠিক টোনে বুঝাইতে পারাটাও ঝক্কির বিষয়। আন্তর্জাতিক প্রযোজনায় অনেক সময় লাগে। আপাতত দুই দেশের দুই প্রযোজনা সংস্থা অন-বোর্ড হইছে। সিঙ্গাপুরের আকাঙ্গা এশিয়া, বাংলাদেশের খনা টকিজ। প্রডাকশন ফান্ডিংয়ের জন্য আরো প্রযোজক খুঁজতেছি। সময় লাগবে।

প্রস্তুতি পর্বে আপাতত দম নিতেছি। নয়েজ থেকে সিগন্যাল আলাদা করার চেষ্টা করতেছি। শিক্ষক রোলে যা পড়াইছি এতদিন, তা আসলে ডিসিপ্লিনটার বেসিক বোঝাপড়া। তার বাইরে আমার জীবনবোধ বা সিনেমা মাধ্যম নিয়া আর কী বোঝাপড়া আছে, তা আবিষ্কার করার চেষ্টা করতেছি। পছন্দের সিনেমা বা নির্মাতার আছর যেন না লাগে, তার এন্টিবডি গ্রো করতেছি। একান্ত আমার তরিকায়। আমার মনে হয়, তাড়াহুড়ার কিছু নাই। অন্য কাজ থেইকা মুক্ত হইয়া আরেকটু ডুব দেয়া লাগবে এখন। প্রজেক্টের যে টাইমলাইন নিছি, তাতে ২০২০ লাইগা যাবে। ততদিন ঠিকঠাক বাঁইচা থাকার লড়াইটা চালাইতে হবে। প্রত্যেকটা মানুষের বাস্তব পরিস্থিতি আলাদা। এইখানে আমার কম্পিটিশনটা, বোঝাপড়াটা, লড়াইটা নিজের পরিস্থিতির সঙ্গেই।

আপাতত চাইতেছি, নিজের অভিজ্ঞতায় ঢাকা শহরের কিছু মানুষ আর সম্পর্কের স্কেচ ধরতে। আমার জন্ম, বাইড়া ওঠা সব ঢাকা শহরেই। এত বিচিত্র মানুষ, তাদের রি-লোকেশন বা মাইগ্রেশন, সেইখানে আমি কোথায় কতটুকু বিলং করতেছি? আরবান আইডেনটিটি সিনেমাটার একটা সেন্ট্রাল থিম হয়তো। খুঁজতেছি, আমার মতো আর কোন চরিত্র আছে কিনা, যারা শহরের সঙ্গে অসংজ্ঞায়িত সম্পর্ক নিয়া ঝুইলা আছে। যাদের যাপনের কর্ম আর জীবিকার তকমার সেতুটা অত সরল না। অ্যানথ্রপলজিক্যাল অ্যাপ্রোচ আছে হয়তো। যাই হোক, যা এখনো তৈরি হয় নাই, সেইটা নিয়া কম বকবককরাই ভালো না?

ভালো বলছেন। একেবারে ইমেজ-শব্দের নির্মাণটা দেখাই ভালো, রিলিজের পর।:D তবে আরেকটা কৌতুহল— দুই ধরনের অ্যাপ্রোচ দেখা যাইতেসে এদেশের সিনেমা প্র্যাকটিসে। কেউ খালি বাইরের ফেস্টিভ্যাল টার্গেট করতেসেন, কেউ মূলধারায় বাণিজ্যিক সিনেমা বানাইতেসেন। আপনি নতুন পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমায় কী কী বিষয় মাথায় রাখতেসেন ?

মূলধারার বাণিজ্যিক সিনেমার বিশেষণ যেইটা দিলেন, সেইটা কি এফডিসি-ইমপ্রেস-জাজ প্রযোজিত প্রডাকশন বিবেচনা করব? সেই প্রডাকশনগুলার সঙ্গে আমি মনে হয় অ্যাসোসিয়েট করতে পারি না। ধরেন, মাধ্যম নিয়া কোনো নিরীক্ষা নাই। প্রডাকশনের টেকনিকসগুলা, ফরমুলাগুলা খুব চেনা, বারবার ব্যবহৃত। মানুষ বা সম্পর্কগুলার হাজিরা খুব প্লাস্টিক, রঙিন আর দ্বিমাত্রিক। অডিয়েন্স কখন কেমনে আবেগতাড়িত হবে, সেগুলা খুব আঙুল দিয়া দেখায়া দেওয়া। এগুলায় আমার মন বসে না।

আর ফেস্টিভ্যাল টার্গেট কইরা সিনেমা বানানোটা যেন অন্ধকারে ঢিল ছোড়া। যারা বাইরের উৎসবগুলার অভিজ্ঞতা নেন নাই, তারা মনে হয় এমন টার্গেট করেন। কারণ, ফেস্টিভ্যালও তো লাখ লাখ, বাহারি তার প্রোগ্রামিং। আর কান-ভেনিস-বার্লিনের মতো পুরান ব্রান্ডের উৎসবগুলার কার্যক্রমও যদি ফলো করেন, দেখবেন তারা নিজেরাই নিজেদের টার্গেট রিভিশনে ব্যস্ত। নিজেরাই নিরীক্ষা করতেছে। কখনো ক্রস মিডিয়ারে জায়গা দিতেছে, কখনও লো-বাজেটকে প্রমোট করতেছে, কখনো তাদের জিওপলিটিক্যাল ইস্যুগুলারে সামনে আনতেছে, কখনো দুই আন্তঃমহাদেশীয় হাটবাজার খুইলা বসতেছে, কখনো লোকাল কনসালটেন্ট দিয়া কনটেন্ট কিউরেট করতেছেন। খুব আনপ্রেডিকটেবল, আনসারটেইন। উৎসবের জেনেরিক ফরমুলা তো নাই যে তা ফলো করলেই সিনেমাটা নিয়া নিবে উৎসবগুলা।

প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমার প্রস্তুতিতে যেইটা মাথায় রাখতে চাইতেছি, লোভটা সামলানো। ইনোসেন্ট থাকা। সিনেমাটা আমার আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের মাপে হবে কিনা, চিন্তায়-ভাবনায় ডিজাইনে সেইটা চেক দেওয়া। মোটিভেশন ছাড়া টেকনিকস যেন না প্রয়োগ করি। পছন্দের উৎসবের কয়েকটা সিলছাপ্পড়মারা স্যাম্পল সিনেমা এনালিসিস কইরা একটা খিচুড়ি যেন না হয়। আমজনতার সঙ্গে যোগাযোগ করতে গিয়া আমি যেন না হারাই। সবাইকে খুশি কইরা, সবার মন জুগায়া সিনেমা করার চেষ্টা তো ক্লান্তিকর। মানে, মাথায় রাখা, নির্মাতা হিসাবে যেন নিজের সিনেমাটার প্রতিনিধিত্ব করতে পারি।

সিনেমার প্রাকটিসে চাইব, অঁতর ইন্ডিপেনডেন্ট তকমার সিনেমাগুলাও দেশ-বিদেশে বাণিজ্য করুক। টাকাপয়সা যদি উঠে, প্রযোজকরা অখুশি হবে না আশা করি। তবে আমার আত্মবিশ্বাস বলে, আমার বেলায় উঠবে না। কারণ লগ্নিকৃত টাকা উসুল করার বাণিজ্য করতে গেলে ন্যারেটিভে যে মাত্রায় আপোষ করা লাগে, সেইটা আমি চাই না। তবু হয়তো দুয়েকজন প্রযোজক রিস্ক নিতে আসবে। হয়তো তাদের আশা— সিনেমাটা কোনো উৎসবে মনোনয়ন পাবে, তাতে তাদের পোর্টফোলিওটা ভারি হবে। সুখের কথা, এখন পর্যন্ত আমার প্রডিউসাররা কোনো বাণিজ্য বা উৎসবের চাপ দেয় নাই। তাদের প্রতি শুকরিয়া।

আপনাকে বলা হইত ছোট সিনেমার কারবারি। বড় সিনেমা ধরলেন কেন?

আমি যে ছোট সিনেমার কারবারি, এই শিরোনামে প্রথম পরিচয় করাইছেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ভাই। প্রথম আলোর এক লেখায়। কয়েক বছর আগে কোনো এক আলাপে উনারে বলতেছিলাম, ছোটদৈর্ঘ্যের সিনেমাই বেশি এনজয় করি। তখন সাউথইস্ট লাভস বইলা পাঁচ দেশের একটা অমনিবাসে প্রজেক্টে ছিলাম।পরে হয় নাই আর। আবার ভেনিসে তখন গেল ৭২০ ডিগ্রি। এগুলা বিচার কইরা হয়তো এই তকমা দিছেন তিনি।
সত্যিটাও তাই। ছোটদৈর্ঘ্যটা খুব চ্যালেঞ্জিং লাগে। কাউন্টার এস্টাবলিশমেন্টের অনুশীলন বেশি করা যায় ছোটদৈর্ঘ্যে। তবে সব অভিজ্ঞতা আর উপলব্ধি এক দৈর্ঘ্যে প্রকাশও করা যায় না। যেমন, টুরিন হর্স সিনেমাটা পাঁচ মিনিটে প্রকাশ করতে কি একই ইমপ্যাক্ট হইত?

বড়দৈর্ঘ্য করার সিদ্ধান্ত নিলাম, কারণ যেই শহরের-মানুষের-সম্পর্কের টাইম-স্কেচটা আঁকতে চাই তার জন্য বড়দৈর্ঘ্যটাই জুতসই মনে করতেছি। আর নিজের পরিচয়রে দৈর্ঘ্য বা ফরম্যাটের তকমা থেইকা মুক্ত করার ইচ্ছাটাও ছিল, আছে।

আহ। টুরিন হর্স। বড় ক্যানভাসের এত সুন্দর পরিবেশনা সম্ভবত তারকোভস্কির পর করলেন বেলা সাহেব। লাভ ডিয়াজ করতেসেন তার মতো করে। আর অমনিবাস প্রজেক্ট নিয়া বলায় মনে পড়ল, আপনি বিড়ালপাখির ব্যানারে অমনিবাস প্রজেক্ট চালু করসিলেন গত বছর। তার কী খবর? আর সিনেমা স্কুল বা স্কুলিং নিয়া আপনার ভাবনা কী?

চাকা বারবার যেন না আবিষ্কার করতে হয়, তার জন্য স্কুলে আসো। টেকনিকস শিখো, ক্রাফট শিখো, নিজের গল্প বলো। সিনেমার স্কুলগুলা, ইনস্টিটিউটগুলা, একাডেমিগুলা তো এইভাবেই প্রচারণা চালায়।

সিনেমার ফরমাল স্কুলিংটা আপনারে কারখানা অনুমোদিত ও ব্যবহৃত কৌশলগুলা শিখায়। এইটা আপনার সময় বাঁচাবে হয়তো। কিন্তু ঠেইকা শিখার মজাও আলাদা। নয়তো কারো কারো বেলায় মগজটা অলস হইয়া যাইতে পারে। ন্যারেটিভ বা ননন্যারেটিভের নতুন বা নিজস্ব কৌশল-ভাষা-ভঙ্গি-প্রথা খুঁজতে যে যন্ত্রণাটা লাগে, কল্পনাশক্তিটা লাগে, শ্রমটা লাগে— তা হয়তো একাডেমিক স্কুলিংয়ের সিলেবাসে নাই।

তবে এখন সিনেমার স্কুল বা স্কুলিংয়ের ভূমিকাও বদলাইতেছে। কারিগরি ইনফরমেশন উপচাইতেছে সবখানে। স্কুলগুলা নামছে তাই নলেজ কিউরেট করতে। সবাই খুব নেটওয়ার্কিংয়ে জোর দিতেছে। নিউ মিডিয়ার ভাষা-ভঙ্গি আয়ত্ত্ব করতেছে। আগামীতে এইটার রাজত্ব থাকবে বইলা অনুমান। আগে যেমন সৃজনশীল প্রকাশ মাধ্যম ছিল থিয়েটার, এখন সিনেমা, পরে হয়তো গেইম বা অ্যাপ্লিকেশন হবে। বাজারও চায় নিত্য নতুন অভিজ্ঞতা দিতে। থ্রিডি সিনেমা আর অগমেন্টেড রিয়েলিটির অভিজ্ঞতা তো নতুনই। বাজারের লোকজনও তাই প্যাট্রনাইজ করতেছে পশ্চিমা দেশের স্কুলগুলারে তার স্কুলিং মেথড ঠিক করতে।

তবে ফরমাল স্কুলিং সবার দরকার, এমনটা মনে হয় না। এর বিকল্প তরিকাও আছে। যেমন, আনস্কুলিং। এর ফিলসফিটা হলো— কোনো কারিকুলাম নাই। ভবিষ্যতে কোন জ্ঞানটা লাগতে পারে, তা অনুমান কইরা আগেভাগেই সব শিখানোর তাড়া নাই। যখন যেইটা দরকার, তখন সেইটা। যেমন; ইউনাস মেকাসের স্কুলিং মেথডটা মনে হয় আনস্কুলিং।
আর বিড়ালপাখির অমনিবাস এখন পোস্টে। আগামী বছর আসতেছে।

আনস্কুলিং বা আনলারনিং যাই বলেন এটা ব্যক্তির নিজের পরিসর বাড়ানোর জন্যই দরকার। আমার মনে হয়, প্রথা বা রীতির বাইরে চিন্তার বিকাশের জন্য লাগে এই আনলারনিং। একটা স্টেরিওটাইপ প্রশ্ন করতাম, কাদের সিনেমা নির্মাণ ভালো লাগে? দেশে বা বাইরে।

ভালো লাগা বদলায়। দেশের ভিতর ফেলোদের মধ্যে মেহেদী হাসানের কাজ ভালো লাগে। তবে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা প্রজেক্ট শুরু করতে যাদের সিনেমা আমাকে ভাবাইছে, ভাবাইতেছে তাদের মধ্যে অন্যতম রয় এন্ডারসন, মৃণাল সেন, বেলা টার, লাভ ডিয়াজ, সাই মিং লিয়াং, মিশাইল হানাকে, পেদ্রো কস্তা, হো ৎসু নিয়েন, সিয়োন সোনো, জাফর পানাহি, জিম জারমুশ। এদের সিনেমাটিক টাইম-স্পেইস ডিজাইন আর ন্যারেটিভ হ্যান্ডেলিং ইন্টারেস্টিং। ঘটনাটা খালি দেখায়া দেওয়ার তাড়া নাই। সাসপেন্স আর জাদুর ছলচাতুরি দিয়া সেই সিনেমার চল শুরু হইছে সবখানে, সেগুলা ঠেকা দেয় এদের সিনেমা।

তার মানে টাইমস্পেস নিয়া যারা স্লো ডেলিভারি কইরা ভালো খেলতে পারেন, তাদের ম্যাচ উপভোগ করেন বেশি। মেহেদী হাসানের আই এম টাইম দেখা হইসে। উনার কাজেও নিরীক্ষা পাই। আচ্ছা নেটফ্লিক্স, ইউটিউব বা অনলাইন স্ট্রিমিংয়ের যুগে সিনেমার নয়া আঙ্গিক কী হবে? যারা আগামীতে সিনেমা বানাইতে চায়— তারা কী করবে? কী করা উচিত?

নিজেরে যদি বলি, তাইলে এইভাবে নোট রাখব :

১. নৃতাত্ত্বিক জায়গা থেকে দেখলে, সিনেমাটা মানুষের জন্য। মানুষকে কোনো না কোনো অভিজ্ঞতা দেয় সিনেমা। বোধ জাগায়। তাই মানুষের বোধগুলা আগে ধরতে হবে। সব মানুষ যে এক না এবং সবারই গুরুত্ব আছে— এইটা বুঝলে ভালো। তার সংস্কৃতি, সভ্যতার অনন্য ইতিহাস আছে। তার রেপ্রিজেন্টেশন নিয়া সচেতন থাকতে হবে।

২. মিডিয়ামটার রস নেওয়া দরকার আগে। সীমাবদ্ধতা কোথায়, শক্তি কোথায়, অন্য মিডিয়াম থেকে কোথায় মিল, কোথায় তফাৎ— এগুলা নিয়া পরিস্কার ধারণা রাখা দরকার।

৩. প্রযুক্তিটাই সিনেমা না। তবু সিনেমা নির্ভর করতে হয় প্রযুক্তির উপর। আজকে অনলাইন স্ট্রিমিং। কালকে আসবে হলোগ্রাফিক ইন্টারঅ্যাকটিভ প্রজেকশন। পরশু অন্য কোনো ডিস্ট্রিবিউশন বা প্রজেকশন আসবে। প্রযুক্তির কারণে মাধ্যমের অভিজ্ঞতাটা বদলায় নিশ্চিত। কেমনে কতখানি বদলায়, তা নিয়া সজাগ থাকতে হবে, ভাবতে হবে। যতই বলি, চলেন সিনেমা হলে। তবু লোকেরা ফোনে, ট্যাবলেটেই (বড়ি অর্থে না) সিনেমার স্বাদ নিবে। ফলে কোথায় কীসে দেখানো হবে, কীসে শোনানো হবে, সেইসব সরঞ্জাম নিয়াও ধারণা রাখা দরকার।

৪. সিনেমাটারে ইন্টারঅ্যাকটিভ ডিজাইন হিসাবে দেখতে হবে। ওয়েবসাইট বা সফটওয়্যারের মতো। ডিজাইন বদলাইলে ইউজার এক্সপেরিয়েন্স বদলায়। তবে ওয়েবসাইটের লিংকটা প্রাইভেটও হইতে পারে।

ইন্টারঅ্যাকটিভ ডিজাইন মানে তো অনেকটা গেমের মত ট্রিট করা। প্রযুক্তির বাইরে সিনেমার রস আস্বাদনে আপনি বিশ্বাসী। বাউন্ডারিটা পুশ করতে চান। তাহলে কী দাঁড়াইলো— সিনেমার কোন ধারায় আপনি বিশ্বাস করেন? শোনা যায়, অনেক এক্সপেরিমেন্টাল বা নিরীক্ষাধর্মী পছন্দ করেন।
ধারা মানে সেই তকমা, জঁরা, লেবেল, ট্যাগ। আমি জাস্ট সিনেমাতে বিশ্বাস করি। যেই সিনেমা তার সংজ্ঞা, সীমা পাল্টাইতে নিরীক্ষারত। আমার ভালো লাগে যখন তকমার বেড়াগুলা ভাঙতে থাকে। ফিকশন আর ননফিকশনের বেড়া। লাইভ অ্যাকশনের আর অ্যানিমেশনের বেড়া। ন্যারেটিভ আর ননন্যারেটিভের বেড়া। সেলুলয়েড আর ডিজিটালের বেড়া। বেড়াগুলা ভাঙলেই নিরীক্ষার শুরু। নিজের সিনেমাটিক কাজ খুব একটা নাই। তবে অন্যদের নিরীক্ষামূলক কাজ উপভোগ করি। ক্রিটিক্যালি পাঠ করার চেষ্টা করি। নিরীক্ষার আলামতগুলার কী মানে তৈরি করে, কেমন অনুভূতি সঞ্চার করে— এইগুলা বিবেচনা করি।

বিড়ালপাখি সিনে ক্লাব নামে একটা সংগঠন চালাইতেছেন। কেন এই নাম? কেমন সাড়া পাইতেসেন?

প্রশ্নটা অনেকেই করেন। বিড়ালপাখি নামকরণের ইশতেহারটা রিপিট করি বরং; বিড়ালপাখি একটা নয়াপুরাণ। সমকালীন হাইব্রিড মাল। সুকুমারের যেমন হাসজারু। বকচ্ছপ। সিংহরিণ। হাতিমি। আদিপুরাণের ইউনিকর্ন। বোরাক। মারমেইড। স্ফিংক্স। কিম্বা গণেশ। বিড়াল কৌতূহলী। পাখি উড়ুক্কু। বিড়ালপাখি এদের মন্তাজ। বিড়ালপাখি সিগনিফায়ার। সিনথেসিস। গুরুচণ্ডাল ভাষা। বিড়ালপাখি একটা প্রস্তাবনা। প্রস্তাবিত সিনেমাটিক ঈশ্বর।

বিড়ালপাখিতে ভালো সাড়া পাইছি। প্রথম বছরে আমরা ১২টা মজমা করলাম। ৪টা কর্মশালা। ২টা পাঠচক্র। সামনে আসতেছে প্রকাশনা। সরকারি নিবন্ধনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হইল। ৭০ জন নির্মাণশ্রমিক কর্মী হওয়ার আবদার করছেন। আশার কথা, মজমার উছিলা কয়েক শো অনুশীলন স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা বানানো হইছে। সেগুলার উদ্বোধনী প্রদর্শনী করছি মজমাতে।

বিড়ালপাখি সিনে ক্লাবটা প্রথমত খালি দর্শকের না; নির্মাতাদের। নির্মাণশ্রমিকদের। তরুণ নির্মাণশ্রমিকদের সংগঠন এইটা। আমরা একটা নেটওয়ার্ক গড়তে চাই সিনেমা নির্মাতাদের, নির্মাণশ্রমিকদের, নির্মাণপ্রেমিকদের নিয়া। যারা নতুনতর ভাষায় গল্প বয়ানের নিজস্ব, দেশজ, অব্যয়, সামান্য তরিকা খুঁজতেছেন। আপাতত এই, বাকিটা কাজ করলে বোঝা যাবে।

তার মানে এই ক্লাব দর্শক না, নির্মাতা নিয়া ভাবে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী এই ক্লাব নিয়া?

চলতি বছরের পরিকল্পনা এমন— মজমা, প্রশিক্ষণ কর্মশালা আর পাঠচক্র চালু রাখা। একটা রেসিডেন্সির উদ্যোগ নেয়া। একটা সিনেমা জার্নাল বের করা। ওয়েবসাইট চালু করা। গতবছর শুরু করা অমনিবাস সিনেমা প্রজেক্টটা শেষ করা।

শুভ কামনা রইল, আপনার জন্য, বিড়ালপাখির জন্য। ধন্যবাদ জিকো ভাই, মুল্যবান সময় দেয়ার জন্য। ভালো থাকবেন।

থাকব। আপনিও। বাসায় আসবেন।

আসব। আপনার রান্নার রুচিও ভালো হবে, সন্দেহ নাই। আরেকটা তকমা লাগানোর সুযোগ পাইলে মন্দ হয় না।:D

ছবি তুলেছেন : মেহেদী হাসান ও আহমেদ শাফি চৌধুরী।


মন্তব্য করুন