Select Page

ঈদুল আজহা ২০২১: সাত দুগুণে বহুগুণ বিনোদন

ঈদুল আজহা ২০২১: সাত দুগুণে বহুগুণ বিনোদন

এই ঈদে সেরা কাজ যদি বেছে নিতে হয়, নির্দ্বিধায় নেবো ‘সাত দুগুণে চৌদ্দ’ সিরিজ। নতুন নির্মাতারা যেভাবে তাদের ভালোবাসা ও চেষ্টায় নিজেদের প্রথম কাজ সফল করেছেন, তা সত্যিই অনুপ্রেরণামূলক, তারা এখনো সিনেমা নিয়ে মাত্র পড়াশোনা করছেন কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।

চৌদ্দটি শর্টফিল্ম নিয়ে সাজানো এই সিরিজের প্রতিটি শর্টফিল্ম দেখা শেষে তৃপ্তির হাসি মিলবে, সবগুলোই যে কম বেশি ভালো লাগার তালিকায় থাকবে সেটা কল্পনাতীতই ছিল। দর্শকদের কাছে তাদের সৃষ্টি পৌঁছে দেবার জন্য এগিয়ে এসেছেন অভিনেতা ও শিক্ষক মনোজ প্রামাণিক। তিনি তার চৌদ্দজন ছাত্র নিয়ে সাধুবাদের কাজটি করেছেন। মনপাচিত্রের বাস্তবায়নে এগিয়ে এসেছিলেন প্রযোজক শাহরিয়ার শাকিল। দীপ্ত টিভির পর ছবিগুলো এসেছে বায়োস্কোপে, দেখা যাবে একদম ফ্রি।

কাউয়া: ১৯৪৩ সাল। শহরের তুলনায় গ্রামে অপেক্ষাকৃত কম ছড়িয়েছে দুর্ভিক্ষ। সব হারিয়ে গ্রামে আসে এক আগন্তুক। যার ওপর ভর করে মহামারি, জেগে ওঠে প্রতিশোধের স্পৃহা। যার সঙ্গে মিলে যায় এই সময়। গোলাম মুনতাকিম ফাহিম প্রথম নির্মাণেই মেধার পরিচয় দিয়েছেন। সাদাকালো ফরম্যাটের নির্মিত এই শর্টফিল্মকে প্রাণ দিয়েছে সোহেল রানার অসাধারণ অভিনয়। আরো আছে মনোজ প্রামাণিক।

জুজু: কাজের প্রতি একাগ্রতা থাকে তাহলে বাজেট কোনো ইস্যু না তা প্রমাণ করলেন নির্মাতা সিজু শাহরিয়ার। ড্রাইভার ও তার সহকারী লাশ নিয়ে যাচ্ছেন কুড়িগ্রামে, পথের মাঝে ঘটে রাতে অতিপ্রাকৃত সব ঘটনা। সেই ঘটনা সামলে ফিরতি পথে আরেক চমক! অতিপ্রাকৃত বা হরর গল্প আমাদের দেশে তেমন হয় না, হলেও দুর্বল হয়। তবে সিজু সাহস দেখালেন, পুরো ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন। আবহ সংগীত পুরো গল্পটাকে আরো জমিয়ে দিয়েছে, যে কেউই ভয় পেতে বাধ্য। অভিনয়ে অশোক বেপারি বেশ ভালো লেগেছে আর শেষ ছক্কা হাঁকিয়েছেন অ্যালেন শুভ্র।

আনোয়ারা মনোয়ারা: রেল লাইনে থাকা মা-মেয়ের গল্প। মা সারাদিন কাজ করে আর অন্ধ মেয়ে সারাদিন কাটে পুরনো ট্রেন আর রেল লাইনে। একদিন সকালে ঘটে অবাক করা ঘটনা— মেয়ের পায়ে নূপুর, আরেকদিন চুড়ি। সে এইসব কোত্থেকে পায়, মায়ের সন্দেহ হয়! তারপর মা নিজেও উপহার পায়, কিন্তু কীভাবে! ইকবাল হাসান খানের নির্মাণে মেহেদী উল্লাহর গল্প ভাবনা এত ভালো লাগলো, আরো বেশি ভালো লেগেছে নির্মাণ জ্ঞান। শেষের দিকে দারুণ আবহ তৈরি করলো, আর অভিনয়ে শাহনাজ খুশী ও তাসনুভা তিশা, নতুন করে তাদের প্রতিভা দেখা গেল।

বিড়াল তপস্যা:  মাসুম বাসার ও শিল্পী সরকার অপুর সংসার, পড়াশোনার জন্য থাকে অপুর বোনের মেয়ে তাসনিয়া ফারিণ আর একটি বিড়াল। ছিমছাম সুখের সংসার, কিন্তু এখানেও নেমে আসে মুখ ও মুখোশের জীবন। শেষ পর্যন্ত এই গল্পের মূল ভাব দাঁড়ায় এই সমাজের একটা ব্যাধিতে, বিড়ালটা ছিল প্রতীকী! ইশতিয়াক জিহাদের এই শর্টফিল্ম সরলরেখায় না টেনে দর্শকদেরও ভাবতে দিয়েছে। ফারিণ, অপু ও মাসুম বাশার সবাই যথাযথ অভিনয় করেছেন।

দেজাভ্যু: অভীক চন্দ্র তালুকদারের শর্টফিল্মে এসেছে বাবা ও ছেলের দুই প্রজন্মের গল্প, সময়ের প্রয়োজনে তারা পরস্পরের পরিপূরক হয়ে ওঠে, শুধু অবস্থান পরিবর্তন হয়। অভিনয়ে দারুন শাহাদাত হোসেন ও সায়েদ জামান শাওন, শিশুশিল্পী আরিশ ছিল প্রাণবন্ত।

ভূগোল+: সদ্য আঠারোতে পা দেয়া এক ছেলে শিক্ষিকার ওপর বিশেষভাবে দুর্বল। কিন্তু শিক্ষিকা ততটাই দৃঢ়চেতা, তাই একপক্ষীয় ভালোবাসা সেখানেই থেমে যায়। পাঁচ বছর পর আবার তাদের দেখা। পরের অংশ কিছু সিনেমাটিক লাগলেও তবে নাম যেহেতু ‘ভূগোল +’, তাই প্রয়োজন ছিল। মানব মিত্রের নির্মাণে আরশ খানের অভিনয় বেশ লাগলো, স্পর্শিয়াও নজর কেড়েছেন।

সহজ সুন্দর: এক হতাশাবাদী ছেলের গল্প, জীবনের সব ক্ষেত্রে যে ব্যর্থ। জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা থেকে কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়। অন্যদিকে এক ছোট্ট মেয়ে ফুল বিক্রি করে। স্বপ্ন বাড়ি বানাবে, মায়ের ভালোবাসায় বড় হবে। কিন্তু! ‘দুখের তুলনা’ কবিতার কথা মনে পড়ে গেল শর্টফিল্মটা দেখে। গল্প হিসেবে অসাধারণ কিছু নয়, তবে সাধারনের মাঝেই থাকে আমাদের গল্প। সেটাই তুলে ধরেছেন জিডি মজুমদার। অভিনয়ে খায়রুল বাসার, মারিয়া বেশ, আরো আছেন জয়িতা মহালনবিশ।

চৌদ্দ শিষ্যের সঙ্গে মনোজ প্রামাণিক

ঝিলিক: ইরফান সাজ্জাদ ড্রাইভার, তার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। মডেল মালকিনকে জরুরি কাজে নিয়ে যেতে হয় ঢাকার বাইরে। একদিকে স্ত্রী প্রসব বেদনায় হাসপাতালে অন্যদিকে মালকিন নিজের সন্তানকে পৃথিবীতে আসার আগে নষ্ট করতে চায়! শফিকুল সাজীবের নির্মাণটি ভালো প্রচেষ্টা। ইরফান সাজ্জাদ অনেক শুকিয়েছেন, ভালো করেছেন। তবে সনিকার আরো ভালো করার সুযোগ ছিল।

মধুচক্র: মফস্বলে নাচ শেখান তারিন, তার একমাত্র মেয়ে তন্দ্রা ওরফে চমক। বখাটের প্রস্তাবে সাড়া না দেয়ায় চমকের নামে বাজে লিফলেট ছাপিয়ে পুরো মহল্লায় ছড়িয়ে দেয়া হয়। এতে তাদের জীবনে নেমে আসে দুর্বিষহ যন্ত্রণা! নির্মাতা হাসিব আহমেদ প্রথম নাটকেই মুগ্ধ করেছেন, ভালো লেগেছে তারিনকে, চমক যথাযথ। স্বল্প সময়ে আরশ খান, মিলন ভট্টাচার্য এরাও আছেন।

শুক্রবার: ছুটির দিরের গল্প, একটি পরিবারের গল্প। সদস্য চারজন, এর মধ্যে বিবাহযোগ্য মেয়ে থাকলে মায়েদের যা হয়, তাইই দেখানো হয়। একমাত্র মেয়ে সাবিলা নূরকে দেখতে এসেছে বরপক্ষ, তাদের পছন্দ হয়ে যায়। কিন্তু সাবিলা নূর এই বিয়েতে রাজি নয়, সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়, দিয়ে যায় এক হোয়াটস অ্যাপ ভিডিও। তবে মন খারাপ করার মতো কিছু নয়, শেষের চমকে এক চিলতে হাসিতে হা হয়ে থাকার মতো। ওটার জন্যই বেশি ভালো লাগলো। নির্মাণ সাদামাটা, তবে এই ধরনের গল্পে কাহিনী-সংলাপই মূল সম্পদ। হুমায়ারা স্নিগ্ধার নির্মাণে সাবিলা নূর সাবলীল, বেশি ভালো লেগেছে প্রথম চেনা মার্জিয়া আক্তারের অভিনয়, কাজের বুয়ার চরিত্রে রীনা রহমানকে অনেকদিন পর দেখে ভালো লাগলো। শেষে বিশেষ একজনের অতিথি উপস্থিতি আরো আকর্ষণ বাড়িয়ে দেয়।

সেমিডেট: বাবা-মা গ্রামে চলে যাওয়ায় ফাঁকা বাসায় প্রেমিকাকে বাসায় আনে ছেলে। তবে ডেটের জন্য প্রেমিকার রয়েছে একাধিক শর্ত, ছেলে থাকে বাহানার আশায়। তবে এক সময় সেই প্রেমিকাই তার কাছে এসে ধরা দেয়, তারপর! মুনসিফ উজ জামান মিমের এই শর্টফিল্মের গল্প আধুনিক সমাজের তরুণ-তরুণীকে ঘিরে। ইয়াশ রোহান বেশ সাবলীল, প্রিয়ন্তী উর্বিকে এই প্রথম দেখলাম।

জসুয়া সূর্যসেন জডার্ণ বাসকে: এক গোবেচারা আনস্মার্ট ছেলের গল্প। মার্কেটিং জবে সুবিধা করতে না পেরে দায়িত্ব পড়ে টিয়া পাখিকে কথা শিখানোর। শেষ অব্দি কী হয়! অন্য ছবিগুলোর তুলনায় কিছুটা ধীরগতির, তবে পলাশের অভিনয় ভালো লেগেছে। নির্মাতা ছিলেন আহসাবুল ইয়ামিন রিয়াদ।

গ্যাঁড়াকল: রাশেদ মামুন অপু, নাসিরউদ্দিন খান ও মুকিত জাকারিয়া। তিনজন দক্ষ অভিনেতা একই ফিকশনে পাওয়া দর্শকদের জন্য খুশির খবর, ওটিটি প্রজন্মে সম্প্রতি তিনজনই আলোচনায় এসেছেন। সেটাই করে দেখালেন রাহিল রহমান এ শর্টফিল্মে। তিনজন মানুষ, আছে লোভ-বাসনা। আর সেইজন্য তারা পড়ে যান গ্যাঁড়াকলে, আর কারণ তারা তিনজনই। তবে গল্পের খাতিরে একজনের জয়, আর বাকিদের! ভালো লেগেছে বেশ।

নওমহল: ক্রিকেট খেলা নিয়ে জুয়ার খবর ভাইরাসের মতো ছেঁয়ে গেছে। কেউ কেউ হয়তো বাজিতে জিতে যান তবে অনেকেই সর্বস্বান্ত হন। তেমনি এক গল্প নিয়ে সাজানো হয়েছে এই শর্টফিল্ম। এবি মামুনের নির্মাণে ভালোই, বিশেষ করে শেষ দৃশ্যটি চমকপ্রদ। অভিনয়ে মনোজ প্রামাণিক, রিফাত চৌধুরী ও তুহিন অবন্ত যথাযথ।

সবশেষে আলাদা করে বলতে হয়, শর্টফিল্মগুলোর আবহ সংগীতের কথা। প্রতিটা কাজেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে আবহ সংগীত, দুর্দান্ত করেছে। দায়িত্বে ছিল স্টুডিও এলকেজির কর্ণধার লাবিক কামাল গৌরব, উনাকে বিশেষ ধন্যবাদ। সবার জন্য শুভকামনা রইলো।


মন্তব্য করুন