
উৎসব: তেলাপিয়া মাছের দোপেয়াজা
[স্পয়লার সংক্রান্ত রিজার্ভেশন থাকলে আমার ফিল্ম বিষয়ক লেখালেখি পড়তে কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করছি]
বাঙালির রাজকীয় খানাপিনা হয় সাধারণত দুটো উপলক্ষে- বিয়ে এবং দাওয়াত। বিয়ের মেন্যু টেম্পলেট – পোলাও, রোস্ট, বিফ/খাসি, কাবাব, বোরহানি, দই/জর্দা। এর বাইরে অঞ্চলভেদে কেউ মাছ, চাইনিজ সবজি কিংবা অন্য কোনো আইটেম যুক্ত করে।

দাওয়াতের আইটেম নির্ভর করে ইকোনমিক স্ট্যাটাসের উপর। যদি গেস্ট এবং হোস্ট স্ট্যাটাসের দিক থেকে কাছাকাছি লেভেলের হয় অথবা গেস্ট হোস্টের চাইতে হয় খানদানি সেখানে বিয়ের আইটেমের বাইরেও পদ্মার ইলিশ, গলদা চিংড়ি, রূপচাঁদা মাছ, পিঠা সহ অনেক কিছুই যুক্ত হয়৷
ভুরিভোজ করানো আমাদের কালচারে আতিথেয়তার চূড়ান্ত বহি:প্রকাশ।
দাওয়াত নয় প্রতিদিনকার ঘরোয়া খাওয়া-দাওয়াতেই রন্ধনশৈলীর উৎকর্ষ বুঝা যায়। এমন একটি কারি আইটেম হলো তেলাপিয়া মাছের দোপেয়াজা৷ ঈদের ফিল্ম ‘উৎসব’ দেখাকালীন বৃহদাংশই আমার মনে ভরাসীন ছিল তেলাপিয়ার দোপেয়াজা!
মেটাফরটিকে ব্যাখ্যা বা ব্যবচ্ছেদ করলে অনুভূতির উপস্থাপন বোধগম্যতা লাভ করবে।
যে কোনো পারফরমিং আর্টে শ্রেষ্ঠ দর্শক কমপ্লিমেন্ট- পয়সা উসুল।
আপনি ৭০০টাকার টিকেট কিনে স্টেডিয়ামে গেলেন বাংলাদেশের খেলা দেখতে, দল ৫৪ রানে অলআউট হলে রাগে নিজের চুল ছিড়তে ইচ্ছা করবে। অন্যদিকে ম্যাচ চলাকালে দফায় দফায় বৃষ্টি হলো, আপনি ভিজে কাক, কিন্তু বাংলাদেশ হারিয়ে দিল ভারতকে— আপনার এতক্ষণকার দুর্ভোগ বিস্মৃত হবে মুহূর্তেই।
পারফর্মিং আর্টে সাবস্ক্রাইবারের জন্য পয়সাটা গৌণ, মূখ্য নিয়ামক সময়ের উপযোগ উসুল হওয়া। সাবস্ক্রাইবার এক বান্ডিল সময় পারচেজ করে মূলত স্টিমুলেশনের আশায়। যদি স্টিমুলেশনের তীব্রতা অনেক বেশি হয়, অর্থাৎ ৫-১০ বছর পরেও তার রেশ রয়ে যায় সেটা মনে গভীর রেখাপাত করে। কোনো কোনো স্টিমুলেশন পারফরম্যান্স শেষের ১-২ ঘন্টার মধ্যেই মিইয়ে যায়৷ স্টিমুলেশনের ব্যাপ্তি এবং স্থায়িত্বের উপরেই নির্ভর করে পারফরম্যান্সের উৎকর্ষ লেভেল।
হুমায়ূন আহমেদের নাটক ব্যতীত কোনোপ্রকার টিভি নাটক সমগ্র জীবনেই দেখিনি, তবে ফিল্মের নেশা শৈশব থেকেই। এ যাবৎকালে দেখা বাংলা, তেলুগু, ইংরেজি মিলিয়ে ফিল্মের মধ্যে স্টিমুলেশন লেভেল বিবেচনায় শীর্ষ ৫ এ রয়েছে
১.সত্যজিত রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’
২. মনিকা বেলুচ্চি অভিনীত ‘ম্যালেনা’
৩. রাসেল ক্রো অভিনীত ‘দ্য বিউটিফুল মাইন্ড’
৪. ব্র্যাড পিট অভিনীত ‘সেভেন’
৫. আমজাদ হোসেনের ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’
স্টিমুলেশনের সাথে ফিল্ম ভালো লাগা বা মন্দ লাগা কোনোভাবেই সম্পর্কযুক্ত নয়।
যেমন সঞ্জয় দত্ত-মাধুরি দীক্ষিতের ‘খলনায়ক’ ফিল্মটি তেমন ভালো লাগেনি, কিন্তু এর দ্বারা স্টিমুলেটেড ছিলাম দীর্ঘদিন। বিপরীতক্রমে জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়া, অপর্ণা সেনের 15 park avenue, কিউব্রিকের ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ যথেষ্ট ভালো লাগা সত্ত্বেও স্টিমুলেশন স্থায়ী হয়নি বেশিক্ষণ।
উৎসবের স্টিমুলেশন আমার মনোজগতে ৭-১০ দিন পর্যন্ত কার্যকর থাকবে অনুমান করি। এরপর রিপ্লেসড হবে অন্য কিছুর দ্বারা।
স্বল্পমেয়াদী এ স্টিমুলেশনের মেজর ফ্যাক্টর দুটো-
প্রথমত নির্বিচারে অন্ধ অনুকরণের কারণে হলটাইমে মনে হয় বাংলা ডাবিংয়ে নিম্নমানের তেলুগু ফিল্ম দেখছি। একটা জাতির ফিল্মে কোনো সিগনেচার টোন থাকবে না, নিজেদের গল্প বা ভিজুয়াল থাকবে না— এর চাইতে লজ্জাজনক আর দৈন্য হওয়া সম্ভব নয়৷ প্রতিটি বাংলা ডাবিং-বাংলাদেশী আর্টিস্ট দিয়ে নির্মিত অখাদ্য তেলুগু প্রোডাক্ট আদতে আমাদের কালচারাল মার্কেটে নিরাময় অযোগ্য বন্ধ্যাত্ম এবং নপুংসকতাকে স্বীকার করে নেয়। বাংলা ডাবিংয়ে তেলুগু ডেলিভার করা ডিরেক্টরদের আমি বলি লোকাল ডিস্ট্রিবিউটর৷
উৎসব শতভাগ স্থানীয় ইমোশন, লাইফস্টাইল, যাতনা আর ব্রিদিং স্পেসের গল্প। তাদের প্রমোশনাল লাইন- পরিবার ছাড়া দেখা নিষেধ, এর সাথে কোনোভাবেই একমত না হলেও লোকাল হেরিটেজ কনটেক্সট এ ফিল্মটা স্টিমুলেশনযোগ্য।
কেন প্রমোশনাল লাইনের সাথে একমত নই। একই পরিবারের কেউ রুনা লায়লার গান পছন্দ করে, কেউ মেটাল ফ্যান, কেউবা হিন্দি। কারো পছন্দ ছোট মাছ, কারো ইলিশ, কেউবা ভক্ত গরুর মাংসের। প্রতিটি চয়েজ এবং টেস্টের ভিন্নতা যদি অনিবার্য হয়, ফিল্মে তবে অভিন্নতা কেন! টাইটানিক যখন বাংলাদেশে ভিসিআর যুগে আসে,বড় বোনেরা, কাজিনেরা এমনকি তাদের বন্ধুরাও দেখেছে।।তখন পড়ি ক্লাস সিক্সে। ফিল্মের নেশাবশত তাদের সাথে বসেছি, প্রথমে শান্তভাবে পরে বকেঝকে অন্য রুমে ঠেলে পাঠিয়েছে। সহপাঠীদের থেকে জানতে পারি এই ফিল্মে নাকি নায়িকার উন্মুক্ত বক্ষের ছবি আঁকার দৃশ্য আছে! অনেক ফিল্মে রক্তারক্তির দৃশ্য থাকে, বাচ্চারা ভয় পায়। ফিল্ম সবসময়ই নিজস্ব ব্যক্তিরুচি নির্ভর, পরিবার যুক্ত করা মানেই স্ব আরোপিত সেন্সর বোর্ড যুক্ত করা।
দ্বিতীয়ত, ইউটিউবে নায়ক আলমগীরের এক সাক্ষাৎকার পাওয়া যায়। আক্ষেপ করে বলেছেন অমিতাভ বচ্চন এই বয়সে এসেও সেন্ট্রাল চরিত্র পান। আমাদের এখানে ফারুক, উজ্জ্বল ভাই বা আমাকে ভেবে স্ক্রিপ্ট করে না কোনো ডিরেক্টর। এটাই অন্য ইন্ডাস্ট্রির সাথে আমাদের পার্থক্য।
নায়ক-নায়িকারা একটু বয়স্ক হলে যখন তাদের আরো ম্যাচিউর অভিনয় করার কথা, তখনই আমাদের লোকাল ডিস্ট্রিবিউটররা মার্কেটের দোহাই দিয়ে তাদের বাপ-মা অথবা ভাই-ভাবী চরিত্রে কাস্টিং করে।
উৎসবের প্রধান স্টিমুলেশন এর কাস্টিং ব্রিলিয়ান্স। বাংলা নাটকে জাহিদ হাসান কত বড় নাম, ৯০ দশকে জ্ঞান-বুদ্ধি হওয়া মানুষমাত্রই জানে। সেই সময়ের বাংলাদেশে একজন স্কুল বা কলেজ পড়ুয়া মানুষও হয়ত পাওয়া যাবে না যার বাড়িতে টেলিভিশন আছে, অথচ জাহিদ হাসানকে চেনে না৷ বর্তমানের ষাট বয়সী প্রৌঢ় জাহিদ হাসানকে ফোকাসে রেখে ফিল্ম বানানোর চিন্তা করতে পারাটাই ব্যতিক্রমী ব্রিলিয়ান্সের লক্ষণ।

জাহিদ হাসানের সাথে সবচাইতে জনপ্রিয় জুটি ছিল বিপাশা হায়াত, এরপরে শমী কায়সার। তৃতীয়তে আফসানা মিমি। প্রথমজন আমেরিকায় সেটেলড, অন্যজন সরকার পতনের কারণে নাজুক৷ আফসানা মিমিকে পাওয়ার ক্ষেত্রে সে জটিলতা ছিল না। চঞ্চল চৌধুরি-জয়া আহসান দুই বাংলায় জনপ্রিয়তা পেলেও তাদের শুরু নাটকে। বিপাশাদের পরের প্রজন্মে অপি করিম-রিচি এ দুজন অভিনেত্রী নাটক মিডিয়ায় খ্যাতি পেয়েছিলেন। আরবান এবং সাব-আরবান প্রিভিলেজড শ্রেণির কাছে এই মুখগুলোর আবেদন আছে। তাদের পকেটে পয়সা, বিনোদনের জন্য চাহিদা আছে, নেই শুধু এই বিশাল মার্কেটে চালানোর মতো কনটেন্ট। ৯০ দশকের কিশোর-তরুণরাই যেহেতু এখনকার ইকোনমিতে ডিসিসন মেকার স্তরে উন্নীত হয়েছে, তাদের ‘কালেক্টিভ নস্টালজিয়া’ উৎসবের প্রধান কাঁচামাল।
স্টিমুলেশন কীভাবে পরিব্যাপ্ত হলো।
যে কোনো ইন্টারভিউতে একটা কমন প্রশ্ন থাকে- যদি আবার সুযোগ পান জীবনের কোন ভুলটি সংশোধন করতে চাইবেন।
আমরা জানি সে সুযোগ কখনোই আসবে না, তবু কোনো একটা উত্তর দিই। যদি সত্যিই সুযোগ আসত?
কিংবা ইমপ্যাথির জনপ্রিয়তম সংজ্ঞা- ‘put yourself into someone else’s shoes’, যদি কখনো আসলেই অন্যের জায়গায় নিজেকে বসাতে পারে মানুষ?
আমাদের জীবন যত দীর্ঘ হয় আমরা তত বেশি নিজের এবং অন্যের ব্যাপারে ভুল পারসেপশন তৈরি করতে করতে একসময় নি:সঙ্গতায় ভুগতে থাকি।
প্রতিটি বয়স্ক বদরাগী মানুষের থাকে বেদনাদায়ক ব্যাকস্টোরি। আমরা স্টোরিটা জানতে পারি না, দেখি কেবল অসংলগ্ন আচরণ।
এক লাইনে উৎসবের থিম ‘এমন যদি হত’, যার সম্প্রসারণে এসেছে ইমপ্যাথি, আত্মশুদ্ধি আর অতীত গমন। স্টোরিটেলিং টেকনিক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে কমিকাল প্রেতাত্মা।
এমন অতিব বেসিক থিমের ফিল্ম সঙ্গত কারণেই স্টিমুলেশন দীর্ঘমেয়াদে বজায় রাখতে পারেনি আমার মনোজগতে।
সময়ের উপযোগ উসুল হওয়া যদি বলি তার বৃহদাংশই হয়েছে একটিমাত্র দৃশ্যের কল্যাণে- দীর্ঘ ২০ বছর পরে ঈদের দিনে জাহিদ হাসানের সাথে প্রাক্তন স্ত্রী আফসানা মিমির সাক্ষাৎ, বর্তমানে সে ২য় সংসারে আছে। আলাপের পরিক্রমায় জানা গেল তাদের একটি কন্যা সন্তান আছে, সেই কন্যা ঈদের দিন সন্ধ্যায় জাহিদ হাসানের কমিউনিটি সেন্টারে আসে, গাড়িতে বসা আফসানা মিমি, কন্যাকে নিয়ে জাহিদ হাসান ভেতরে ঢুকলো, গাড়ির গ্লাস নামিয়ে মিমি তার দিকে তাকালো, এরপরে গাড়ি গেল চলে। হানাহানি, পজেসিভনেস আর টক্সিসিটিময় জীবনে এ যেন নায়াগ্রা জলপ্রপাত। এ ধরনের দৃশ্য তৈরিতে খুবই সংবেদনশীল একটা শিল্পমন লাগে। পরিচালক তানিম নুরের তা আছে মনে হলো। ইতোপূর্বে তার দুটো ওয়েবসিরিজ দেখেছিলাম- কনট্রাক্ট এবং কাইজার৷ প্রথমটা ইনোসেন্ট এমেচার, ২য়টা সংলাপের গুণে মচমচে, কুড়মুড়ে।
উৎসব এ এসে তিনি Seasoned Campaigner হলেন।
একজন ফিল্মপ্রেমি যে উদ্দেশ্যে ফিল্ম দেখে, লেখক বা পর্যবেক্ষকের ফিল্ম দেখার কার্যকারণ তার চাইতে অনেক বেশি আলাদা।
তাই উৎসবের স্টিমুলেশন কেন ৭-১০ দিনেই সমাপ্ত হলো, কেন ৩-৪ বছর না, তার কয়েকটা পয়েন্টে আলোকপাত করা যেতে পারে। এগুলো দর্শক পয়েন্ট অব ভিউ থেকে নয়, টেকনিকাল বা মেকার পারসপেক্টিভ থেকে:
প্রথমত, জাহিদ হাসান প্রথম সংলাপেই ইন্তেখাব দিনারকে জানায় সে ৯০ দশকে ছিল। সৌম্যজ্যোতি-সাদিয়া আয়মানের যে চিত্রায়ণ তাতেও ক্যালেন্ডারে ১৯৯৮ দেখা যাচ্ছে। অথচ ব্যাকগ্রাউন্ডে আর্টসেলের ধূসর সময়, লেভেল ফাইভের গান বাজছে। স্ক্রিপ্ট রাইটারের বয়স কম, বা তানিম নুর নিজে আর্টসেল ফ্যান, এ গানের ইনভলভমেন্টে জেনজি বা আরবান প্রিভিলেজড গ্রুপকে উদ্বেলিত করা গেছে, কিন্তু ডিরেক্টর’স গ্রাউন্ডে এটা মারাত্মক ভুল। আর্টসেল বা লেভেল ফাইভ কি ৯০ দশকে এক্সিস্ট করত? বরং মাইলসের
কতটা তুমি হারালে বন্ধু কেঁদেছে অন্তর
জানো না তুমি হারানোর ব্যথা, জানে পলাশীর প্রান্তর
গানটা সিকুয়েন্সের সাথে অধিক এলাইন করে৷ কাউন্টার লজিক দিয়ে বলতে পারেন প্রেতাত্মা স্থান-কাল-পাত্র জয় করতে পারে, দুটো পৃথক সময়ের ওভারল্যাপিং হয়েছে। মিউজিক দৃশ্যের সাথে ইন্টেগ্রাল কম্পোজিশনাল পার্ট৷ আপনার কম্পোজিশনে ওভারল্যাপিংয়ের কোনো ইঙ্গিতই নেই। সুতরাং এটা টেকনিকাল বড় ত্রুটি, দর্শক আর্টসেল শুনেই বিগলিত হতে পারে, মেকারের জায়গায় তা বিচ্যুতি।
দ্বিতীয়ত, চঞ্চল-জয়া-অপি কে যদি তিনটা পৃথক বা স্বতন্ত্র পারসপেক্টিভ হিসেবে দেখি, অপির পারসপেক্টিভটা ওয়েল অর্গানাইজড৷ সে ইমপ্যাথি, মনের সুপ্ত ইচ্ছা, আত্মশুদ্ধির ব্যাপারগুলো নিয়ে ডিল করেছে। চঞ্চল আর জয়া আহসানের পারসপেক্টিভে সিগনিফিক্যান্ট পার্থক্য নেই। শাহরুখ খান নিজেকে নিয়ে মকারি করার টেকনিককে জনপ্রিয় করেছে। চঞ্চল আর জয়ার ক্ষেত্রেও সেই সেল্ফ-মকারি তত্ত্ব৷ চঞ্চল স্টোরিতে কেবল প্লেইন ইনফরমেশন দিয়ে গেছে, সেটা ক্যারেক্টারের বিল্ড আপ এর জন্য সাপোর্টিভ ডেটা হিসেবে কাজ করেছে। জয়ার অংশটাও সেই ধারাতেই এগিয়েছে। সে একটামাত্র এঙ্গেল যুক্ত করেছে- ছকে বাঁধা জীবনে মৃত্যুও একটা ছকমাত্র। চঞ্চল এবং জয়া স্ক্রিন টাইম বেশি পেলেও গল্পের ট্রানজিশন এবং ক্যারেক্টার ডিজাইন সুচিন্তিত লাগেনি। একজন ফিল্মাসক্ত মানুষ হিসেবে স্ক্রিনে আমি সবসময়ই সিকুয়েন্সে নজর দিই, আর্টিস্টে নয়।।আর্টিস্ট সিকুয়েন্সের চাইতে বড় হয়ে গেলে সেটা ডিরেক্টরের ব্যর্থতা গণ্য করি।।চঞ্চল এবং জয়ার প্রেজেন্সে আমি সিকুয়েন্স নয় বারবার ব্যক্তি চঞ্চল আর জয়াকে প্রমিনেন্ট হিসেবে পাচ্ছিলাম। এছাড়া ৩ জনের সাথে জাহিদ হাসানের মিথস্ক্রিয়াতেও তেমন বৈচিত্র্য রাখা হয়নি। এতে জাহিদ হাসানের ক্যারিশমা কিছুটা কম্প্রোমাইজ হয়ে গেছে।
তৃতীয়ত নস্টালজিয়া, ইমোশন যেসব ফিল্মের প্রধান উপজীব্য সেখানে আর্ট ডিরেকশন ভীষণভাবে ম্যাটার করে। সিনেমাটোগ্রাফিতে সিম্বলিজমের প্রাধান্য থাকলে আমরা আরো একীভূত হই। ধরা যাক একটা প্রকান্ড গাছ ভেঙ্গে পড়লো, সেই সময়ে প্রটাগনিস্টের কোনো একটা বিপর্যয় ঘটলো। দুটো কম্পোজিশনাল কোহেরেন্স তীব্র হবে যদি ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক এবং কালার টোনে ভারসাম্য থাকে। উৎসবে এরকম সিম্বলিক সিকুয়েন্স বেশ কয়েকটি ছিল, কিন্তু মন্তাজধর্মী কোনো চেষ্টা দেখিনি। এতে ইমোশনটা স্পর্শ করে গেছে দাগ ফেলতে পারেনি।

চতুর্থত, অতিপ্রাকৃতিক ঘটনাকে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে নিউট্রালাইজ করার পরে আচমকা এমন কিছু দেখানো হয় যাতে মনে হয় অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা সত্যিই ঘটেছিল। হুমায়ূন আহমেদের অসংখ্য নাটকে এই ফরমুলা প্রয়োগ করা হয়েছে৷ এই মুহূর্তে মনে পড়ছে উইজার্ড বোর্ড, পিশাচ মকবুল, কালা কইতর, বৃক্ষমানব, পক্ষীরাজ। তানিম নুরও চেনা সে পথেই হাঁটলেন। চঞ্চল,জয়া, অপি কে অন্তিম দৃশ্যে ম্যাজিক রিয়েলিজম আকারে দেখিয়ে গল্পে কোনো শ্রীবৃদ্ধি হয়নি, বরং পরিমিতি হানি ঘটেছে।
পঞ্চমত, গল্পে সবচাইতে ইনফ্লুয়েন্সিয়াল ক্যারেক্টার তারিক আনাম। জাহিদ হাসানের সাথে তার আরো কয়েকটা সিকুয়েন্স না থাকায় জাহিদ হাসানকে আমরা রেলিশ করলাম এযাবৎকালে দেখা তার নাটকের সুত্রে তৈরি হওয়া ইমেজ দিয়ে। যে ব্যক্তি জাহিদকে চিনে না, তার কাছে ক্যারেক্টারটা ওয়েল ইকুইপড মনে হবে না।
এগুলো কি অনেক বড় কোনো ফ্ল?
এর উত্তর দিব ব্যক্তিগত জীবন থেকে। আমি তখন ক্লাস সেভেনে, আমার ইমিডিয়েট বড় বোন টেনে। সে সব সাবজেক্টে কোনোমতে পাশ করেছে, আম্মু খুশিতে আত্মহারা হয়ে তাকে নতুন পোশাক কিনে দিয়েছিল, আমি ম্যাথে ৯৭ পাওয়া সত্ত্বেও ভীষণ বকাবকি করেছিল। ২৬ বছর আগের ছোট্ট ঘটনাটা আমার জন্য গভীর লাইফ লেসন হয়ে আছে আজও।
স্টিমুলেশনের আরেক উপলক্ষ সুনেরাহ বিনতে কামাল। দাগীতে তার অভিনয় দক্ষতা ছিল ভীষণ ইমপ্রেসিভ। উৎসবেও ক্যামিও প্রেজেন্স এ দ্যুতি দেখা গেল৷ গজাখিচুরি শব্দের ডেলিভারিটা অনবদ্য পাঞ্চিং হয়েছে। সে প্রফেশনাল ক্যামিও ক্যারেক্টার না হয়ে পুরোদস্তুর প্রটাগনিস্ট হওয়ারই পটেনশিয়ালিটিযুক্ত। নায়ক বা নায়িকার এক্স ফ্যাক্টর Aura ক্রিয়েট করা, সুনেরাহ এর মধ্যে তা বিপুল মাত্রায় বিদ্যমান।
প্রক্সি ক্যারেক্টার হিসেবে সাদিয়া আফসানা মিমির সাথে মানিয়ে গেছে। সৌম্যজ্যোতিকে জাহিদের প্রক্সিতে মানায়নি। দুজনের বডি ল্যাঙ্গুয়েজে বিস্তর ফারাক৷ কেবল প্যান্ট ইন করে পরাটুকুতেই যা মিল।
তানিম নুরের কাজগুলোতে সংলাপগুলো টসটসে হয়। এখানেও তা পুরোমাত্রায় উপস্থিত। তবে অতিচর্চিত ‘মুরুব্বি’ ফ্রেজটা এনে অহেতুক গড্ডালিকায় গা ভাসিয়েছেন।
উৎসবের মতো ফিল্ম বাংলাদেশে আরো হবে কিনা নির্ভর করছে ব্যবসা কতটা করছে সে শর্তের উপর। প্রসেনজিত-ঋতুপর্ণা জুটি ১৫ বছর কাজ করেনি, তাদের কামব্যাক স্টোরি নিয়ে নির্মিত হয়েছিল প্রাক্তন। সৌমিত্র- শ্বাতীকে প্রাধান্য দিয়ে বেলা শেষে, বেলা শুরু। গল্পনির্ভর এ ফিল্মগুলো ব্যবসা করেছিল৷
আমরা উৎসব কত দূর নিতে পারব, সময়ের অপেক্ষা। তবে তেলাপিয়া মাছের দোপেয়াজা যারা খেয়েছেন, তারা রিচফুডে তৃপ্তি নাও পেতে পারেন, উপরন্তু কোলেস্টরেল বেড়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি।