চলচ্চিত্রের জীবন্ত আর্কাইভ শফিউজ্জামান খান লোদী
চলে গেলেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জীবন্ত এক আর্কাইভ জনাব শফিউজ্জামান খান লোদী..
‘আমার ছবি
চলমান জীবনের ছবি
আমার ছবি বলে তাদের কথা
মূর্ত করেন যারা মনের কথা
তারাই বলেন কথা আমার ছবিতে
বিনোদিত হই যাদের ভাবনাতে’…♪
বাপ্পা মজুমদারের কণ্ঠে চলচ্চিত্র বিষয়ক চ্যানেল আইয়ের বহুল জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘আমার ছবি’-র ব্যাকগ্রাউন্ড ভয়েস এভাবেই বাজত। অনুষ্ঠানটির উপস্থাপক শফিউজ্জামান খান লোদী। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এ অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেছেন। আজ ১৮ এপ্রিল তিনি মারা গেছেন। তিনি করোনা আক্রান্ত ছিলেন।
‘আমার ছবি’ অনুষ্ঠানটি ২০০০ সালে যাত্রা শুরু করে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রচারিত হয়েছিল। ১৮ বছর ধরে একটানা চলেছে। শফিউজ্জামান লোদী এ অনুষ্ঠানের উপস্থাপনার পাশাপাশি সহ-পরিচালনার দায়িত্বেও ছিলেন। অনুষ্ঠানটির প্রযোজক ছিলেন এ কে আজাদ।
একজন শফিউজ্জামান লোদী-কে কতটুকু তুলে ধরা হয়েছে প্রশ্ন থেকে যায়। অনুষ্ঠানটি যারা দেখেছেন তারা জানেন। তাঁর কথাই শুরু হত এভাবে-‘১৯৯৫ সাল, এত তারিখ, মুক্তি পেল অমুক ছবি, অমুক পরিচালক, অমুক অমুক অভিনয় করেছেন, ছবি হলো সুপারহিট।’ মানে ছবির নাম, পরিচালনা, অভিনয়, অভিনয়শিল্পী, মুক্তির তারিখ, ফলাফলসহ সব তাঁর জানা। একেবারে একটানা বলে যেতেন এত অসাধারণ স্মরণশক্তি ছিল মানুষটির। চলচ্চিত্রের চলমান উইকিপিডিয়া ছিলেন।
তাঁর অনুষ্ঠানে সেকালের সুপারস্টার রহমান, নায়করাজ রাজ্জাক, জসিম, ইলিয়াস কাঞ্চন, টেলি সামাদ, হাসমত, ববিতা, চম্পা, দিতি, মৌসুমী থেকে শুরু করে ২০১৮-র সর্বকনিষ্ঠ তারকাটিও এসেছিল অতিথি হয়ে। পরিচালক, কমেডিয়ান, ক্যামেরাম্যান, সম্পাদক, বিজ্ঞাপন কণ্ঠদাতাসহ চলচ্চিত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রায় সবাই তাঁর অনুষ্ঠানের অতিথি ছিলেন। চলচ্চিত্রের বেসরকারি আর্কাইভ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিল তাঁর ‘আমার ছবি’ অনুষ্ঠানটি। অনুষ্ঠান চলাকালীন সময়ে বিভিন্ন রেয়ার ছবির ফুটেজ দেখানো হত, অনুষ্ঠানের শেষে যে অতিথিকে আনা হত তাঁর ছবির শুটিং, মহরত, পোস্টার ইত্যাদি দেখানো হত। আপনি যদি উৎসাহী হন পুরনো ছবির কালেকশনের জন্য তবে অনায়াসে তাঁর অনুষ্ঠান থেকে পেতে পারেন এসব দুর্লভ জিনিস। পেয়েও যেতে পারেন ‘ভেজা চোখ, চাঁদনী’ রেয়ার এ ছবিগুলোর দু’এক মিনিটের ফুটেজ যা আপনাকে প্রশান্তি দেবে।
তাঁর উপস্থাপনার স্টাইল ছিল হাসিমুখে সহজ ভাষায় অতিথির কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, স্মৃতি জেনে নেয়া। চমকের বিষয় হচ্ছে অনেক সময় অতিথির নিজেরই মনে থাকে না কোনো তথ্য তখন লোদী সাহেব নিজেই মনে করিয়ে দেন এতটা দক্ষ তিনি। এটা বিরল গুণ। দেশের চলচ্চিত্র বিষয়ক বিখ্যাত পত্রিকা ‘চিত্রালী’-র ভক্ত ছিলেন তিনি। তিনি সকাল সকাল উঠে আনতে যেতেন পত্রিকাটি। পত্রিকাওয়ালা ৮টায় দিয়ে যেত তিনি ৮টার অপেক্ষা করতেন না, নিজেই সকাল সকাল হেঁটে যেতেন পত্রিকা আনতে। (তথ্যসূত্র – রঙের মেলা, কালের কণ্ঠ)। এতটা ডেডিকেশন যার ছিল তিনি তো কিংবদন্তি হবেনই এ জগতে। ইউটিউবে ‘আমার ছবি’-র অনেকগুলো পর্ব আছে অনুষ্ঠানটির প্রযোজক এ কে আজাদের চ্যানেলে। কৌতূহলী দর্শক যারা তাকে চিনতে চান, জানতে চান দেখতে পারেন।
একজন শফিউজ্জামান খান লোদী একদিনে তৈরি হন না। অনেকে হয়তো তাঁকে জানবেই না, যে জানবে জানার পর অবাক হবে এত বিরল একজন গুণী মানুষ আমাদের চলচ্চিত্র অঙ্গনে ছিল! এই কিংবদন্তির আত্মার শান্তি কামনা করছি। তিনি তাঁর কাজের মধ্যে বেঁচে থাকবেন বিশেষ করে চলচ্চিত্রের আর্কাইভ্যাল ভ্যালুতে।