Select Page

ওমর সানী কমপ্লেক্স

ওমর সানী কমপ্লেক্স

আমরা বরং সেই দম্পতির কেইসটা বোঝার চেষ্টা করি যেখানে স্ত্রী অত্যধিক বিখ্যাত, স্বামীও বিখ্যাত কিন্তু স্ত্রীর তুলনায় ম্রিয়মান। বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় আপাত অপ্রচলিত এসব দৃষ্টান্তে স্বামীর মনোজগতে সংঘটিত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে একটি পরিচিত ফ্রেজ এর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায়, যার নাম ওমর সানী কমপ্লেক্স। রেফারেন্সযোগ্য কোনো গবেষণাপত্রে ফ্রেজটির অস্তিত্ব পাওয়া যাবে না, তবে বাংলা সিনেমা সম্বন্ধে যারা ৫% হলেও জানাশোনা রাখেন এবং মৌসুমীওমর সানী, নামগুলোর সাথে পরিচিত তারামাত্রই ওমর সানী কমপ্লেক্স এর অন্তর্নিহিত বক্তব্য অনুধাবন করতে পারবেন।

ওমর সানী কমপ্লেক্স বুঝবার পূর্বে প্রচলিত বাস্তবতার সারসংক্ষেপটা জানা যাক কনটেক্সট অনুধাবনের নিমিত্তে।

ধরা যাক লায়লা কবির মেহজাবিন নামের তরুণীর বাবার নাম জাকারিয়া কবির, পরিণত বয়সে তার বিয়ে হলো ইরতিজা মাসুদ এর সঙ্গে। ইরতিজা মাসুদ একজন সেলিব্রিটি। কিছুদিন পর যদি লায়লা কবির রূপান্তরিত হয় লায়লা মাসুদ এ, এটা কি বিস্ময়সূচক কোনো ঘটনা?

আমাদের মা-খালা কিংবা তারও আগের যুগে বিয়ের পরে নারীরা স্বামীর টাইটেল ব্যবহার করতেন। অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা, সামাজিক অনুশাসন বা প্রথা, অতিরিক্ত প্রণয় কিংবা স্বামী-স্ত্রী এর মধ্যবর্তী বয়সের বিশাল ব্যবধানসহ বহু কারণই থাকতে পারে।

বিখ্যাত স্বামীর অবিখ্যাত স্ত্রীর ক্ষেত্রে কারণ অবশ্য ভিন্ন হয়ে থাকে। সাম্প্রতিক এক উদাহরণ দেয়া যাক৷

আরও পড়ুন: ‘দুর্ভাগা’ নায়ক ওমর সানীর গল্প

ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান এর স্ত্রীর ফেসবুক আইডি খেয়াল করলাম কিছুদিন পূর্বে, তিনি উম্মে শিশির আল হাসান বা সমধর্মী নাম ব্যবহার করেন। অবিখ্যাত মানুষদের নাম সংক্রান্ত ডায়নামিক্সের সাথে উম্মে শিশিরের ঘটনাটা মিলবে না। কোটি কোটি ফলোয়ারসমৃদ্ধ সাকিব আল হাসানের টাইটেলটি নিজের নামে ব্যবহার করলে অনায়াসেই তাকে কোটি মানুষের মধ্য থেকে শনাক্ত করা যাবে। এখানে নির্ভরশীলতার চাইতে পজেসিভনেস নিয়ামকটিই হয়তবা প্রাধান্য পাবে।

ওমর সানী ও মৌসুমী কারো প্রকৃত নামই জানি না, গুগল করলেই পাওয়া যাবে। তবে এটা নিশ্চিত, ওমর সানী তার নামে মৌসুমীর টাইটেল ব্যবহার করেনি।

সালমান শাহর সঙ্গে মৌসুমীর জুটি হতে পারত ড্রিম প্রজেক্ট, মাত্র ৪টি সিনেমাতেই তা ভেস্তে গেছে। এর বাইরে ইলিয়াস কাঞ্চন, মান্না, রুবেল, ফেরদৌসসহ অনেক নায়কের বিপরীতে মৌসুমীর হিট সিনেমা রয়েছে অসংখ্য, কিন্তু ক্যারিয়ারে মূল নায়ক হিসেবে ওমর সানীর যতগুলো সিনেমা হিট করেছে মৌসুমীর বাইরে অন্য নায়িকার সিনেমা সেখানে অতি নগণ্য। চাঁদের আলো, প্রেমগীত, কুলি, মহৎ (যদিও মূল নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন) মাত্র ৪টি সিনেমা মনে পড়ছে।

আরও পড়ুন: ওমর সানী: নব্বই দশকের অন্যতম তারকা

এমনকি মাঝে দীর্ঘদিন মাদকাসক্তি এবং অন্যান্য কারণে ওমর সানী বিস্মৃত হয়েছিল সিনেমাপাড়া থেকে, প্রত্যাবর্তন করে পৃথুল শরীর যোগে, আমরা তাকে পাই সস্তাদরের ভিলেন চরিত্রে, যদিও মৌসুমী তখনো প্রধান চরিত্রেই অভিনয় করতেন।

নায়ক থেকে বিচ্যুত ওমরকে খুঁজতে হয় সার্কাস এবং যাত্রাপালায়। সিনেমার সংলাপ আউড়ানো আর চটুল নাচ-গানই যেখানে পারফরম্যান্স।

আহমেদ শরীফ, মুনমুন, মিশা সওদাগর, অমিত হাসানসহ অনেক অভিনয়শিল্পীই সার্কাস আর যাত্রাপালায় পারফর্ম করে থাকে। ওমর সানীর সঙ্গে তাদের বাস্তবতা মিলবে না, কারণ এরা কেউ জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিল না অথবা এদের জীবনসঙ্গীরাও সেই অর্থে সিনেমা অঙ্গনের নন। মৌসুমী সার্কাস বা যাত্রায় নাচার সংবাদ পাইনি অদ্যাবধি।

ওমর সানীর কেন প্রয়োজন পড়েছিল? এর উৎস অনুসন্ধান করতে গেলে পাওয়া যাবে প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক নানা হাইপোথিসিস।

নায়ক হিসেবে ওমর সানীর বিশেষত্ব কী ছিল উত্তর দেয়া মুশকিল। সালমান শাহর মতো ফ্যাশনেবল, রুবেলের মতো অ্যাকশন, বাপ্পারাজের বিয়োগান্তকতা বা মান্নার সোশ্যাল অ্যাকশন কোনো জনরাতেই তাকে ফিট করা যায় না। ভারতীয় সঞ্জয় দত্তকে অনুসরণ করার প্রবণতা ছিল, উপরন্তু অভিনয়রীতির কারণে স্বর্ণসময়েও তাকে নিয়ে চলতো তুমুল হাস্য-বিদ্রুপ, এবং অসংখ্য হিট সিনেমার নায়ক হওয়া সত্ত্বেও সেগুলো মূলত মৌসুমীর ক্রেডিটলাইনেই জমা পড়েছে। অনেকটা ৩০০ রানের পার্টনারশিপে এক ব্যাটসম্যান ২৭০ করে অপরাজিত, অন্যজন টেনেটুনে ২০, বাকি ১০ রান অতিরিক্ত খাত থেকে এসেছে!

যে কারণে নায়ক ওমর সানী যখন ধপ করে উধাও হয়ে গেল দর্শক তাকে মিস করেনি, বেঢপ শরীরের ভিলেনরূপেও করেনি গ্রহণ।

তাহলে ওমর সানীর অস্তিত্ব-অনস্তিত্বে কোন অর্থটা বহন করছে?

এহেন ওমর সানীর প্রতি কীভাবে আকৃষ্ট হলো মৌসুমী, এবং ক্যারিয়ারের পিক সময়ে বিয়ে করে মাতৃত্ব নিল— গোলমেলে লাগে না বিষয়টা?

আরও পড়ুন: সালমান শাহর বৈশিষ্ট্যেে ওমর সানী

সিনেমার বাইরে ওমর সানীর কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করলে একটা ক্লু পাওয়া যেতে পারে। চলচ্চিত্রের কেউ অসুস্থ, তাকে দেখতে হাসপাতালে গেছে ওমর সানী। কারো বিয়ে বা জন্মদিন, সেখানে অন্য কেউ থাকুক বা না থাকুক, ওমর সানীকে দেখা যাবেই। অর্থাৎ তার সামাজিকতা বোধ, এবং যোগাযোগ দক্ষতা উন্নত। এরকম একজন ব্যক্তিকে স্বামীর আদলে ম্যানেজার হিসেবে উচ্চভিলাষী কোনো অভিনেত্রী রাখতে চাইতেই পারে।

সানী ম্যানেজার, নাকি কল্পিত সুপারস্টার সেই দ্বিধাগ্রস্ততাই হয়তবা তার মধ্যে সৃষ্টি করেছিল কমপ্লেক্স।

ওমর সানী কমপ্লেক্সে ভোগা পুরুষদের জন্য যথার্থ করণীয় কী আদতে?

সোশ্যাল মিডিয়াতে ওমর সানীর কার্যক্রমে নজর রাখলেই করণীয় সম্বন্ধে ধারণা মিলবে। যোগ্যতার চাইতে বেশি মূল্যায়ন পাওয়া মানুষ কখনো বুঝতেই পারে না ষাঁড়ের সাথে চলাফেরা করলেই ব্যাঙ কখনো ষাঁড়ের গোত্রভুক্ত হয় না।

একজন স্ত্রী যদি বিখ্যাত স্বামীর পরিচয়কে স্পোর্টিংলি নিতে পারে বিখ্যাত স্ত্রীর ক্ষেত্রে অন্যথা কেন ঘটে না সচরাচর? যে কারণে দীর্ঘদিন পর্যন্ত স্কুলে ভর্তির সময় শুধু বাবার নাম লেখার বিধান ছিল, এক্ষেত্রেও ঘটনা অভিন্ন।

ওমর সানীদের প্রত্যাশা তাই সীমিত। একটু আলোচনায় থাকা, নিজের আইডেন্টিটি প্রকাশের সুতীব্র যাতনা। এই গোত্রভুক্ত পুরুষেরা কি সুখি মানুষ? হীনম্মন্যতা নাকি ইগানুভূতি কোনটি তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে অধিকমাত্রায়; তাদের লড়াইয়ের অদৃশ্য প্রতিপক্ষ আসলে কে বা কারা? ওমর সানীর সঙ্গে যদি বিয়ে হত রেবেকা অথবা সোহানার মতো তৃতীয় সারির নায়িকার, যেমনটা করেছিল সি-গ্রেড নায়ক সুব্রত আর প্রয়াত নায়িকা দোয়েল, তখনো কি তার কমপ্লেক্স এভাবেই কাজ করত? অভিনেত্রী আনোয়ারা কন্যা মুক্তির সাথে চাঁদের আলো সিনেমা করার পরে যদি তার সঙ্গেই গড়ে উঠতো প্রেমের সম্পর্ক, এবং গড়াতো পরিণয় অবধি, আমরা কি আলিরাজ বা প্রবীর মিত্রের মতো একজন চরিত্রাভিনেতা পেতাম ওমর সানীর মধ্যে? তাতে কি সানী নিজে সন্তুষ্ট থাকতো? বড়ো ভাই বা বাবার চরিত্রে রূপদানকারী সুব্রতকে কতজন মানুষ গুগল ব্যতিরেকেই পারবেন শনাক্ত করতে?

সামাজিক গতিচিত্র বদলানোর ক্ষেত্রে ওমর সানী কমপ্লেক্সগুলো একধরনের পুষ্টিকর এনজাইমও বটে!


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়

লেখক ও বায়োপিক এনালিস্ট

মন্তব্য করুন