Select Page

করোনায় করুণ পরিণতি

করোনায় করুণ পরিণতি

কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারীর কারণে ২০২০ সালে প্রায় সবকিছুই থমকে ছিল। এই বছর সকল শিল্পখাতের মত চলচ্চিত্র শিল্পেও ব্যাপক ধস নামে। চলচ্চিত্রপ্রেমী, অভিনয়শিল্পী বা কলাকুশলী কারোর জন্যই ২০২০ সুখকর ছিল না। সেটা সকল দেশের সকল চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য প্রযোজ্য। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প বা ঢালিউডও এর ব্যতিক্রম নয়। যদিও গত কয়েক বছর ধরেই ঢালিউডে চলচ্চিত্র খরা চলছে। তবে এই বছর তা ১০-এর ঘরে নেমে এসেছে। দেশীয় ও আমদানি করা মিলিয়ে এই বছরে মোট মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের সংখ্যা ১৭, যা মুক্তিযুদ্ধের বছর ১৯৭১-এর পর মুক্তির সংখ্যার দিক থেকে সর্বনিম্ন। ১৯৭১ সালে একটি উর্দু ভাষার চলচ্চিত্রসহ মোট চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছিল ৮টি।

১. এক নজরে ২০২০

বছরের শুরুতে ১০ জানুয়ারি মুক্তি পায় জয়নগরের জমিদার। ২৪ জানুয়ারি মুক্তি পায় আমদানি করা ভারতীয় ছবি হুল্লোরফেব্রুয়ারি মাসের ৭ তারিখ গণ্ডি’, ১৪ তারিখ বীর’, ২১ তারিখ আমদানি করা ভারতীয় বাংলা ছবি রবিবারএবং ২৮ তারিখ হৃদয় জুড়েমুক্তি পায়। মার্চ মাসের ৬ তারিখ মুক্তি পায় তিনটি ছবি – ‘শাহেন শাহ’, ‘চল যাইহলুদ বনি

১৮ মার্চ থেকে কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারীর কারণে দেশের সব সিনেমা হল বন্ধ করে দেওয়া হয়। ৭ মাস বন্ধ থাকার পর ১৬ অক্টোবর থেকে আবার চালু হয় সিনেমা হল। সেদিন মুক্তি পায় সাহসী হিরো আলমছবিটি। পরের সপ্তাহে মুক্তি পায় ঊনপঞ্চাশ বাতাস

ডিসেম্বর মাসের ১১ তারিখ মুক্তি পায় বিশ্বসুন্দরীরূপসা নদীর বাঁকে। ১৮ ডিসেম্বর মুক্তি পায়একজন মহান পিতাসুবর্ণ রেখা। বছরের শেষ সপ্তাহে মুক্তি পায় তুই আমার রাজা আমি তোর রাণীএবং বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষায় নির্মিত গোর

এছাড়া বছরের শুরুতে বৃহৎ পরিসরে মুক্তি পায় আগের বছর স্বল্প পরিসরে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘কাঠবিড়ালী’ এবং ওটিটি প্লাটফর্ম আইথিয়েটারে ১৬ ডিসেম্বর মুক্তি পায় ‘নবাব এলএলবি’। পাশাপাশি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী ও কর্মভিত্তিক ডকুমেন্টারি ‘বায়োগ্রাফি অব নজরুল’ একটি সিনেমা হলে মুক্তি দেওয়া হয়।

২. আলোচিত-সমালোচিত চলচ্চিত্র

বছরের সবচেয়ে আলোচিত চলচ্চিত্র ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’। বছর দুই ধরেই প্রচারণা চলে আসা ছবিটি এই বছরের বহুল প্রত্যাশিত ছবি ছিল। করোনার কারণে ৭ মাস সিনেমা হল বন্ধ থাকার পর হল খোলা হলে ছবিটি দেখতে হলমুখী হয় দর্শক। ডার্ক-সায়েন্স ফিকশন-রোমান্টিক ঘরানার ছবিটি দর্শক সমালোচকসহ বিনোদন মাধ্যমের অনেকের প্রশংসা লাভ করে। বছরের আরেকটি প্রশংসিত ছবি হল ‘গণ্ডি’। বন্ধুত্বের সাথে বয়সের কোন সম্পর্ক নেই সেটাই ছবিটির উপজীব্য ছিল। দর্শক-সমালোচকেরাও গ্রহণ করেছিল ছবিটি।

আলোচনায় ছিল ‘বীর’ ও ‘বিশ্বসুন্দরী’। কাজী হায়াতের অন্যান্য ছবিগুলোর মত ‘বীর’-এও ওঠে এসেছে সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার চিত্র। তবে প্রধান চরিত্রের স্টারডম ছবিটিকে বাস্তবসম্মত হতে কিছুটা একগেয়ে ও আর পাঁচটা ছবির মতই করে তুলেছে। সবমিলিয়ে দর্শকদের জন্য বিনোদনপূর্ণ ছবিটি। অন্যদিকে, রোমান্টিক ঘরানার ‘বিশ্বসুন্দরী’ গত বছর থেকে আলোচনায় ছিল। সুন্দর গান ও পরীমনি-সিয়ামের রসায়ন দেখতে ভিড় করেছে দর্শক। তবে কেউ কেউ ছবিটিতে আরো সিনেম্যাটিক গতি নিয়ে আসার বিষয়টির দিকে গুরুত্ব দিয়েছেন।

করোনা মহামারীর কারণে ঘরবন্দী মানুষের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হয়ে ওঠেছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। তেমনি একটি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আইথিয়েটারে মুক্তি পায় ‘নবাব এলএলবি’। কিন্তু এই দিনে অর্ধ্বাংশ মুক্তি দিলে ও বাকি অর্ধ্বাংশ ১ জানুয়ারি মুক্তি দেওয়ার কথা জানালে দর্শকেরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চড়াও হয় পরিচালক-প্রযোজকদের ওপর। ছবিটি বর্তমান সময়ে আলোচিত সামাজিক সমস্যা ধর্ষণ বিষয়ে প্রতিবাদের চিত্রায়নের জন্য বছর জুড়েই আলোচনায় ছিল।

৩. আলোচিত-সমালোচিত অভিনয়শিল্পী-কলাকুশলী

অভিনেতাদের মধ্যে বরাবরের মতই আলোচনার শীর্ষে ছিলেন শাকিব খান। এ বছর তার তিনটি ছবি মুক্তি পেয়েছে – দুটি সিনেমা হলে ও একটি ওটিটি প্ল্যাটফর্মে। ‘শাহেনশাহ’ ততটা আলোচিত না হলেও ‘বীর’ ও ‘নবাব এলএলবি’ দিয়ে তিনি আলোচনায় ছিলেন। ‘বিশ্বসুন্দরী’ ছবি দিয়ে আলোচনায় ছিলেন সিয়াম আহমেদ। একেক ছবিতে একেক অবতারে উপস্থাপিত হওয়ার জন্য তিনি বেশ প্রশংসিত। এই ছবিতে তার রোমান্টিক অবতারে দেখা যায়। অন্যদের মধ্যে ইমতিয়াজ বর্ষণ ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ ছবিতে তার নির্লিপ্ত চাহনী ও সহজাত অভিনয়ের জন্য প্রশংসিত হন।

অভিনেত্রীদের মধ্যে এই বছর সবচেয়ে আলোচিত হলেন শার্লিন ফারজানা। ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ ছবিতে তার ভবঘুরে প্রেমময় জীবন, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান, ভ্রম – সবকিছু তাকে দর্শক-সমালোচকদের কাছে আলোচিত করে তুলে। পরীমনি বছর জুড়ে তার বিভিন্ন চলচ্চিত্রের ছবি ও ব্যক্তিগত ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করে উষ্ণতা ছড়িয়েছেন। এ বছর তার অভিনীত ‘বিশ্বসুন্দরী’ ছবিটি দর্শক টেনেছে সিনেমা হলে। এছাড়া ‘অপারেশন সুন্দরবন’-এর কাজ প্রায় সমাপ্ত এবং যোগ দিয়েছেন তৌকীর আহমেদের আসন্ন চলচ্চিত্র ‘স্ফুলিঙ্গ’-এ। ধর্ষণ-বিরোধী ‘নবাব এলএলবি’ ছবির বলিষ্ঠ দৃশ্যে অভিনয় করে আলোচনায় ছিলেন অর্চিতা স্পর্শিয়া।

ফাখরুল আরেফীন তার ‘গণ্ডি’ ছবিতে বয়োজ্যেষ্ঠ দুই নর-নারীর মধ্যে বন্ধুত্বের গল্প চিত্রায়ন করে প্রশংসিত হন। কাজী হায়াত তার মাইলফলক পঞ্চাশতম চলচ্চিত্রের ঘোষণা দিয়ে আলোচনায় আসেন। তার পরিচালিত ‘বীর’ ছবিটি মিশ্র সমালোচনা অর্জন করে। টেলিভিশনের জনপ্রিয় দুই পরিচালক মাসুদ হাসান উজ্জ্বল ও চয়নিকা চৌধুরী যথাক্রমে ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ ও ‘বিশ্বসুন্দরী’ দিয়ে প্রথমবার চলচ্চিত্র পরিচালনায় আসেন। উজ্জ্বল তার কাজের জন্য প্রশংসিত হন। অন্যদিকে চয়নিকা চৌধুরীর ‘বিশ্বসুন্দরী’ বছরের শেষে সিনেমা হলে দর্শক টানে। বছরের শেষ মাসে ভিন্নধর্মী দুই চলচ্চিত্র নিয়ে আসেন তানভীর মোকাম্মেল ও গাজী রাকায়েত। বামপন্থী এক নেতার গল্পে ‘রূপসা নদীর বাঁকে’ ও গোর খোদকের গল্পে ‘গোর’ ছবি দুটি এদের বিষয়বস্তুর জন্য দর্শকের কাছে প্রত্যাশিত হলেও প্রয়োজনীয় পরিবেশনার কারণে তার দর্শকের কাছে পৌঁছাতে পারেনি।

আইথিয়েটারে মুক্তি পাওয়া ‘নবাব এলএলবি’ ছবিতে পুলিশকে অশ্লীলভাবে উপস্থাপনের দায়ে ছবির পরিচালক অনন্য মামুন ও পুলিশ চরিত্রে অভিনয় করা শাহীন মৃধাকে পর্ণোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে গ্রেফতার করা হয়। 

৪. লোকান্তরে

২০২০ সালে প্রয়াত হয়েছেন বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট শিল্পী ও কলাকুশলী 

১৬ মে মারা যান বিশিষ্ট সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক আজাদ রহমান তিনি বাংলা খেয়াল গানের প্রবর্তক তিনি দেশাত্মবোধক গান “জন্ম আমার ধন্য হলো মা গো” গানের সুরকার তিনি শ্রেষ্ঠ সুরকার, শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ গায়ক বিভাগে তিনটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন

প্লেব্যাক সম্রাট হিসেবে খ্যাত এন্ড্রু কিশোর গত হন ৬ জুলাই তিনি “হায়রে মানুষ রঙ্গিন ফানুস”, “আমার বুকের মধ্যিখানে”, “সবাইতো ভালোবাসা চায়”, “জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প”সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গানের গায়ক চলচ্চিত্রের গানে প্লেব্যাক করে পেয়েছেন সাতবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার

৯ আগস্ট প্রয়াত হন খ্যাতনামা সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক আলাউদ্দিন আলী ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’, ‘দুই পয়সার আলতা’, ‘স্বপ্নের পৃথিবী’সহ অসংখ্য চলচ্চি্ত্রে জনপ্রিয় গানের সুর ও সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন তিনি শ্রেষ্ঠ সুরকার, শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ গীতিকার বিভাগে সাতটি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন

চলচ্চিত্র জীবনের শুরুটা পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য হলে ধীরে ধীরে খল চরিত্রে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা সাদেক বাচ্চু ১৪ সেপ্টেম্বর কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে মৃতুবরণ করেন দীর্ঘ অভিনয় জীবনের শেষ সময়ে এসে তিনি ‘একটি সিনেমার গল্প’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছিলেন

‘আজ রবিবার’-এর বড় চাচা হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত বিশিষ্ট নাট্যজন ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আলী যাকের কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে ২৭ নভেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ‘নদীর নাম মধুমতী’, ‘রাবেয়া’সহ গুটি কয়েক চলচ্চিত্রে অভিনয় করলেও সংস্কৃতি অঙ্গনে তার অবদান অনস্বীকার্য পেয়েছেন একুশে পদক, শিল্পকলা পুরস্কারসহ শীর্ষ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার

‘কোথাও কেউ নেই’-এর বাকের ভাইয়ের একান্ত সহচর বদি চরিত্রে অভিনয় করা আবদুল কাদের মৃত্যুবরণ করেন বছরের শেষ সপ্তাহে টেলিভিশনের পাশাপাশি তিনি অল্প সংখ্যক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ‘রং নাম্বার’ ছবির বড় ভাই চরিত্রটিও তাকে জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল।

এছাড়া এই বছর প্রয়াত হয়েছেন অভিনেতা কে এস ফিরোজ, পোশাকী চলচ্চিত্রের বিশিষ্ট অভিনেতা সাত্তার, নাট্য ব্যক্তিত্ব মান্নান হীরা, অভিনেত্রী ফেরদৌসী আহমেদ লিনা, জবা চৌধুরী, মুভি মোগল হিসেবে পরিচিত চলচ্চিত্র প্রযোজক একেএম জাহাঙ্গীর খান, জাতীয় পুরস্কার বিজয়ী শিল্প নির্দেশক মহিউদ্দিন ফারুক, জাতীয় পুরস্কার বিজয়ী চলচ্চিত্র সম্পাদক আমিনুল ইসলাম মিন্টু, বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক মতিউর রহমান পানু, চলচ্চিত্র পরিচালক জীবন রহমান, চিত্রগ্রাহক এম এইচ স্বপন প্রমুখ

পরিশেষে, বাংলা চলচ্চিত্রের সংকটকালে করোনা মহামারী আরও সংকটময় করে তুলেছে। বিগত বছরগুলোর মত এই বছরও বন্ধ হয়ে গেছে পুরাতন ও নামী বেশ কয়েকটি সিনেমা হল। কমেছে চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিমাণ। যাই হোক, দর্শকদের চলচ্চিত্র শিল্পে আকৃষ্ট রাখতে সরকারের হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা, অনুদানের সংখ্যা বৃদ্ধি, একই দিনে ভারতীয় ছবি আমদানি ইত্যাদি পদক্ষেপের নেওয়া হচ্ছে। 


মন্তব্য করুন