Select Page

কাইজার: স্মার্ট অ্যান্ড উইটি

কাইজার: স্মার্ট অ্যান্ড উইটি

ট্রেলার দেখে মোটা দাগে গল্প বুঝে যাওয়ার কথা। ডবল মার্ডার কেস সলভ করতে ডাক পড়ে ডিটেকটিভ কাইজারের, যিনি কিনা স্বভাবতই অন্যান্য অফিসারদের চেয়ে একদম আলাদা। ভিডিও গেইম এডিক্ট, রক্ত দেখলে বমি করেন, ডিভোর্সড, নিজের প্রতি ন্যুনতম যত্ন নেন না। নিজের পার্সোনাল লাইফের সমস্ত কনফ্লিক্ট সামলে তিনি কি পারবেন এই ডবল মার্ডার কেস সলভ করতে?

যা যা ভালো লেগেছে: কাইজার সিরিজ প্রথম দৃশ্য থেকেই মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। গাড়ির ভেতর একজোড়া কাপলের আলাপচারিতায় উঠে আসে শিল্প, সাহিত্য, প্রেমের নিবেদন; সব। তখনই পরিচিত হয়ে যাই, সিরিজের লেখকের লেখনীর মুন্সিয়ানার সাথে।

কাইজারের উইটি আর হিউমেরাস রাইটিং এর প্রশংসার আগে অভিনেতাদের নিয়ে কিছু বলতে চাই। মূল চরিত্রে নিশো পার্ফেক্ট চয়েস আর তার ক্যারিয়ারের ওয়ান অফ দ্য ফাইনেস্ট পারফর্মেন্স। কাঁচাপাকা চুল, দাড়ি আর সাথে চরিত্রের জন্য ৫ কেজি ওজন বাড়ানো যিনি কিনা সেই ওজন নিয়ে অপরাধীর পেছনে ধাওয়া করতে গিয়ে তাকে ধরতে পারেন না; সাথে তিনি ধরতে পারেন না সম্পর্কের সমীকরণও। শুধু মেয়ের সাথে কিছুটা বনে তার, এ ছাড়া গেমিং পার্টনার অনন্তের সাথে। ছোটবেলার যে বন্ধুদের নিয়ে গোয়েন্দা গ্যাং খুলেছিলেন, আজ তারা এক্স ওয়াইফ, এক্স ফ্রেন্ড হয়ে গেছেন তার কাছে।

মোস্তাফিজুর নূর ইমরান, দীপান্বিতা মার্টিন, আয়শা খান, শিমু, সুমন আনোয়ার – সবাই চমৎকার। শতাব্দী ওয়াদুদকে অনেকদিন পর পুলিশ ক্যারেক্টর থেকে বের হয়ে ভিলেনিশ কিছু করতে দেখে মন ভরে গেছে, বাচ্চু ক্যারেক্টরের প্রতি ঘৃণা জন্মে শুধুমাত্র তার অভিনয় দেখে। বাট আমার কাছে শো স্টিলার হচ্ছেন ইমতিয়াজ বর্ষণ আর নিশোর মেয়ে নিকিতা চরিত্রে অভিনয় করা মেয়েটা। ব্যারিস্টার ক্যারেক্টার এতটাই ভালো লেগেছে যে শুধুমাত্র এই ক্যারেক্টর নিয়ে আলাদা একটা সিরিজ হওয়া সম্ভব। আলাদা করে উল্লেখ করতে চাই, মজিদ ক্যারেক্টরে অভিনয় করা মনিরুল ইসলাম রুবেলের কথা।

তিন গোয়েন্দা, পাহাড়ে ফেলুদা, বব ডিলান, অস্কার ওয়াইল্ড, কাফকা, মানিক বন্দোপাধ্যায়, এডগার এলান পো, আইয়ুব বাচ্চুর রুপালি গিটার, ব্যোমকেশ বক্সী, আগাথা ক্রিস্টি, কোনান ডয়েল, এপ্রোন পরা ডক্টরসমাজ, দীর্ঘদিন বামপন্থী কারো সাথে প্রেম করে এরপরে সুখের আশায় কোন ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টকে বিয়ে করে ফেলা তরুণী, রোগ হলেই সিঙ্গাপুর দৌড় দেয়া মন্ত্রী— সোশ্যাল, পলিটিক্যাল এরকম বিভিন্ন আলাপ আর পপ কালচারের একের পর এক রেফারেন্স উঠে এসেছে এই সিরিজের সংলাপে। একজন লেখক কী পরিমাণ মেধাবী হলে একটি সিরিজে এই পরিমাণ রেফারেন্স আনতে পারেন সংলাপে, তাও আরোপিত না করে; সেটা অবশ্যই ভাবনার আর প্রশংসার দাবিদার। আয়মান আসিব স্বাধীন এক্ষেত্রে অবশ্যই ফুল মার্ক্স পাবে আর নিঃসন্দেহে এখন পর্যন্ত এটা তার সেরা কাজ।

কিছু সংলাপের কথা আলাদা করে না বললেই নয়:

দাম্পত্যের চেয়ে দাম্পত্যকলহ বেশি টেকসই।

সাবধানের মাইর না থাকলেও মাইরে সাবধান আছে।

থানায় এরপরে টুর দেওয়াবো আপনাকে, আমি ঘোরাবো।

দুনিয়াতে উকিল না থাকলে উকিলের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন পড়তো না।

অন্য সব গল্পের মত এখানেও, যেখানে ভালোবাসা শেষ, সেখানে গল্পের শুরু।

জীবনে আর কিছু না থাকলেও বদভ্যাস থাকা উচিত। তাতে জীবনের সব চলে গেলেও বদভ্যাসগুলো থেকে যায়।

ফ্রেন্ডশিপ একটা সেট মেন্যুর মতো। নিলে সবগুলোই নিতে হবে।

দুটো দৃশ্যের কথা না বললেই না: তন্ময়ের জন্মদিনের পার্টিতে কাইজার আর অম্লানের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের দৃশ্যটা এত বেশি ভালো লেগেছে, মনে হয়েছে পুরো সিরিজের সবচেয়ে যত্নের সিন এটাই। কাইজার বা অম্লান, কেউ কাউকে সেখানে একবিন্দু ছাড় না দিয়ে পারফর্মেন্স করে গেছেন।

ব্যারিস্টারের সাথে অম্লানের প্রথম দেখা হওয়া ও বাক্যবিনিময়ের দৃশ্য ঐ এক দৃশ্যে দুজনের বডি ল্যাংগুয়েজ, ডায়লগ ডেলিভারি দেখে তালি দিয়েছি। টু গুড।

সিরিজের ইন্ট্রোতে এইটিজ আর নাইন্টিজের ঢাকার ফুটেজ দিয়ে শুরু করা, মিউজিকের ব্যবহার এগুলো আলাদা মাত্রা যোগ করেছে সিরিজে আর নিঃসন্দেহে সমসাময়িক অন্য যেকোনো বাংলা সিরিজ থেকে কাইজারকে আলাদা করেছে।

যা যা ভালো লাগেনি: কাইজারের মার্কেটিং ভুল ওয়েতে করা হয়েছে বলে মনে হয়েছে। গেমিং এডিক্ট ডিটেকটিভকে গেম খেলতে সবচেয়ে কম দেখেছি সিরিজে। গেম খেলতে খেলতে কোন ক্লু পেয়ে গেলে বা গেল খেলে খেলে কেস সলভ করলে ব্যাপারটা আরও ইন্টারেস্টিং হতো। অবশ্য এজন্য যে পরিমাণ সময় লেখককে আর যে পরিমাণ বাজেট প্রোডাকশন হাউজকে দেয়া দরকার, সেটা দেয়া হবে কিনা তা প্রশ্নসাপেক্ষ।

ডিটেকটিভ থ্রিলার বলা হলেও কাইজার বেসিক্যালি কাইজার ক্যারেক্টরের জার্নি, আরও মোটা দাগে বললে ড্রামা জনরার সিরিজ। ডিটেকটিভ অংশের থ্রিলের জায়গাটা একেবারেই সাদামাটা, সেখানে নতুন কোন চমক নেই, প্রবল উত্তেজনায় নেইল বাইটিং কোন মুহূর্ত নেই। কাইজার আর তার বন্ধুদের পার্সোনাল লাইফের জার্নি এতটাই উপভোগ করছিলাম যে, একটা সময় মনে হচ্ছিল এটা ডিটেকটিভ থ্রিলার না হয়ে ফ্যামিলি ড্রামা হলেই বরং আরও বেশি খুশি হতাম।

৯ এপিসোড না করে ৭ এপিসোডে সিরিজটা শেষ করলে আরও বেশি প্যাক্ট লাগতো। পার্সোনাল লাইফের জার্নি দেখাতে গিয়ে কেস সলভের জায়গাটায় আসতে অনেক দেরি হয়ে যায়, ততক্ষণে দর্শকের কিছুটা আগ্রহ হারিয়ে ফেলা স্বাভাবিক। চমৎকার সব ডায়লগ আছে আগেই বলেছি তবে এতসব ডায়লগ রাখতে গিয়ে ভিজুয়্যাল ল্যাংগুয়েজের জায়গাটা অনেকটা কমে গেছে বলে মনে হল। তন্ময় চরিত্রটার লেখনী আরও ভালো হতে পারতো বা তাকে আরেকটু স্পেস দেয়া যেত। ভিডিও গেমসের কারণে কীভাবে কাইজারের দাম্পত্যজীবনে প্রভাব পড়েছিল, সেটা অনেকটাই ধোঁয়াশা থেকে যায়।

একশন দৃশ্যগুলোতে আরও অনেক বেশি যত্নের দরকার ছিল, যেমনটা দরকার ছিল গুলি খাওয়ার দৃশ্যে ভিএফএক্সের কাজে।

এত এত আলাপের কারণ একটাই, কাইজার  এখন পর্যন্ত তানিম নূর ও স্বাধীনের সবচেয়ে বেস্ট ওয়ার্ক। স্মার্ট অ্যান্ড উইটি। স্লো বার্ন তবে বোরিং না মোটেও। বর্তমানের সমস্যা যেমন হাইলাইট করেছে, ঠিক তেমনি তিন গোয়েন্দার নস্টালজিয়ায় ভুগিয়েছে। হইচই বাংলাদেশের রিসেন্ট অন্যান্য সিরিজ নিয়ে যে কমপ্লেইন ছিল, সেটা এখানে নেই কারণ প্রোপার একটা ক্লোজার দেয়া হয়েছে এই সিরিজের তাও আবার সেকেন্ড সিজনের ইঙ্গিত রেখে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, আহমেদ রুবেলের যে ঝলক এই সিজনে দেখানো হয়েছে, সেই ঝলকের দ্যুতি পরের সিজনে দেখতে পারলে সবচেয়ে খুশি হব।

যাদের থেকে এই সিরিজের ডিরেক্টর আর রাইটার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন, তাদেরকে সিরিজের শেষে ধন্যবাদ জানানোর ব্যাপারটা ভালো লেগেছে ভীষণ। কৃতজ্ঞতা স্বীকার যেন আমরা ভুলেই গিয়েছি, সেখানে কাজী আনোয়ার হোসেন আর রকিব হাসানকে সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ দেয়া এখনও মনে করিয়ে দেয়, কিছু মানুষ এখনও কৃতজ্ঞতা স্বীকারের ব্যাপারটা ভুলে যায়নি।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

অভিনেতা, শিক্ষক, লেখক ও উদ্যোক্তা

মন্তব্য করুন