Select Page

কেন্দ্র ও পরিধির ‘আম্মাজান’

কেন্দ্র ও পরিধির ‘আম্মাজান’

কাজী হায়াৎ পরিচালিত ‘আম্মাজান‘ ছবির কেন্দ্র ও পরিধি দুটোই আম্মাজানকেন্দ্রিক। এ ছবিতে কেন্দ্রীয় চরিত্র আম্মাজানকে ঘিরে পরিধিও বিস্তৃত হয়েছে। গল্পের গল্প হয়ে ওঠা এবং পরিণতি লাভ করা দুটোই আম্মাজানকে ঘিরে সম্পন্ন হয়েছে।

‘আম্মাজান’ চরিত্রে অভিনয় করা কিংবদন্তি অভিনেত্রী শবনম কেন্দ্রীয় চরিত্র। তাঁর ছেলের চরিত্রে মান্নাকে যদি পরিধি ধরি তাহলে তার সমস্ত কার্যকলাপ ছবিতে আম্মাজানকেন্দ্রিক। ধ্যানজ্ঞান সবই তার আম্মাজান। চরিত্রায়ণে একটা বিপ্লব ঘটে গেছে মা-ছেলের অদ্ভুত সুন্দর স্নেহ-ভালোবাসার বন্ধনে।

কেন্দ্রকে শক্তিশালী করতে পরিধি ভূমিকা রেখেছে। আম্মাজান শবনমের চরিত্রের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য এর পরিধি মান্না সর্বাত্মক নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে। আম্মাজানকে ঘিরে তার আনুগত্য, সম্মান, শ্রদ্ধা, টেলিপ্যাথি, পাগলামি, জীবনদান সবই নির্মিত হয়েছে।
স্টেপ বাই স্টেপ বলা যাক :

১. ছবির নাম রাখা হয়েছে ‘আম্মাজান’। ‘জান’ শব্দের প্রয়োগে পুরো শব্দটি গভীরতা পেয়েছে সম্বোধনে। যেমন ধরা যাক আমরা যেমন বলি ‘বাপজান, বুবুজান’ জাতীয় সম্বোধনগুলো। এগুলোর মধ্যে গভীর শ্রদ্ধাবোধ কাজ করে। মান্না তার মাকে ডাকে ‘আম্মাজান’। এ ডাকের মধ্যেই তার মাতৃভক্তির কেন্দ্রীয় শক্তি নিহিত। তাই এই মানুষটির জন্য তার যাবতীয় চিন্তাভাবনা।

২. বাইশ বছর আম্মাজান মান্নার সাথে কথা বলে না ছোটবেলার একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য। একজন পিয়নের জন্য আম্মাজানকে অসম্মান হতে হয়েছে। এর জন্য আম্মাজান মান্নার সাথে অভিমানে কথা বলে না। মান্না মনে মনে সেই পিয়নকে খোঁজে তারপর একদিন পায় জ্যোতিষী বেশে। জ্যোতিষী সবার ভবিষ্যদ্বাণী করার পর নিজেরটাই আর করতে পারে না কারণ জানে না কী অপেক্ষা করছে তার জন্য। মান্নার হাতে মারা যায় সেই পিয়ন। তার আগে এক ধর্ষককে খুন করে মান্না। যাবার আগে আম্মাজানকে বলে যায়। খুন করার পরেও এসে জানায় আম্মাজানকে। তার চেতনাজগতে আম্মাজানের একচ্ছত্র আধিপত্য। কেন্দ্রকে যেন কোনোভাবেই নড়তে দেয় না পরিধি মান্না।

৩. খুনের পর হাত ধোয়ার পানি চায় নবাবের কাছে। নবাব খুন-খারাপি কবে শেষ করবে এটা জানতে চাইলে উত্তেজিত মান্না অনেক কথা শোনায়। তারপর নিজের চোখ দুটো বড় বড় করে আঙুলে দেখিয়ে বলে-‘আমার আম্মাজান এই চোখের মধ্যে থাকে।’ চোখের মধ্যে যার অবস্থান তাকে তো নয়নমণি করে রাখবেই মান্না।

৪. আম্মাজান ফল খেতে চায়। বাজার থেকে রাজ্যের ফল এনে বাড়ি ভর্তি করে রাখে মান্না। ‘আম্মাজান ফল খাইব’ বলতে বলতে নিজের তৃপ্তি প্রকাশ করে।

৫. শত্রু ডিপজলের সাথে সংঘর্ষ বাঁধে মান্নার। ডিপজল বোমা হামলা করে হত্যা করে নবাবের স্ত্রীকে। সেখানে আম্মাজান হাজির হয়। এ অপরাধে মেয়েটির আত্মা ডিপজলকে অভিশাপ দেবে বলে জানায় আম্মাজান। তারপর ডিপজলের মুখের রক্ত আঁচল দিয়ে মুছে দেয় আম্মাজান। শত্রু যতই সামনে দাঁড়িয়ে থাক না কেন তাকে মাতৃস্নেহের পরশ দেয়া আম্মাজানেরই ধর্ম

৬. বন্যার্তদের ত্রাণ দিতে গিয়ে আম্মাজান প্রথমবার মৌসুমীকে দেখে আর এমন একটি মেয়ে তার পরিবারে দরকার বলে জানায়। এটা শোনার পরেই নবাবকে মান্না জানায় ঘটনা কি। নবাব ঠাট্টা করে বলে ‘তোমার আম্মাজানের তো বুদ্ধি নাই’ এটা শোনার পরপরই মান্না বলে-‘কি কস! আমার আম্মাজানের কত বুদ্ধি তুই জানোস? আমার আম্মাজান এই দেশটা চালাতে পারে।’ পরিবার, সমাজের গণ্ডি পেরিয়ে এখানে মান্না সরাসরি দেশে চলে যায় মায়ের প্রতি তার এতই ভক্তি, শ্রদ্ধা।

৭. আম্মাজানের ইচ্ছাকে পূরণের জন্য এবার মান্না আরো পাগলামি করতে থাকে। মৌসুমীকে তুলে বাড়িতে নিয়ে আসা এবং আম্মাজানের পছন্দ অনুযায়ী বিয়ে দেয়া ছিল তার লক্ষ্য। আম্মাজান ইচ্ছা প্রকাশ করেছে সুতরাং এটা করতেই হবে।

৮. মান্না আম্মাজানের পছন্দের মেয়েকে তুলে আনতে গেলে সেখানে তার জন্ম পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। মান্না জানিয়ে দেয় ‘আমার পরিচয় আছে’ তারপর নিজের পরিচয় দেয় এবং আম্মাজানের দোয়া তার সাথে আছে জানায়।

৯. ডিপজল মৌসুমীকে ফিরিয়ে আনতে গিয়ে গুলি করে আম্মাজান শবনমকে। এ খবর জানার পর মান্না অশান্ত হয়ে ওঠে। মুখে অক্সিজেনের নল দেখে মান্না আরো ভেঙে পড়ে। হাসপাতালে গোলাগুলির পর ডিপজল মান্নাকে পেছন থেকে গুলি করে তখন মান্নার ডায়লগ-‘হায় হায় কালাম (ডিপজল) কি করস? আমাকে আম্মাজানের কাছে যাইতে দিবি না?’ ততক্ষণে আম্মাজানের জ্ঞান ফিরেছে।

১০. আম্মাজানের জ্ঞান ফেরার পর রক্তাক্ত মান্নাকে বুকে জড়িয়ে কথা বলে মান্না। বিস্মিত মান্না বলে-‘আপনি আমার সাথে কথা কইছেন আম্মাজান!’ আম্মাজানের সাথে মৃত্যুর আগে কথা বলে যেতে পারাটাই যেন মান্নার জীবনের একমাত্র পরিপূর্ণতা।

কেন্দ্র শবনমকে ঘিরে পরিধি মান্নার সব আয়োজন। নায়ক মান্নার আধিপত্যের পরেও ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে শবনমই এবং তাকে ঘিরেই ছবির গল্পটা গল্প হয়ে ওঠে,  পরিণতিও তাকে কেন্দ্র করে ঘটে।

‘আম্মাজান’ ওয়ার্ড অফ মাউথ, কাল্ট। অভিনেত্রী শবনমও তাঁর চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারে ‘আম্মাজান’ সম্বোধন দিয়েই সুপরিচিত এখন। একটা প্রজন্মের কাছে এই যে শবনমের ‘আম্মাজান’ হয়ে ওঠা এটাও তাঁর অর্জন। কেন্দ্র ও পরিধি বিস্তৃত হয়ে ‘আম্মাজান’ আরো ছড়িয়ে থাকুক প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র গত শতকে যেভাবে সমৃদ্ধ ছিল সেই সমৃদ্ধির দিকে আবারও যেতে প্রতিদিনই স্বপ্ন দেখি। সেকালের সিনেমা থেকে গ্রহণ বর্জন করে আগামী দিনের চলচ্চিত্রের প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠুক। আমি প্রথমত একজন চলচ্চিত্র দর্শক তারপর সমালোচক হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন দেখি। দেশের সিনেমার সোনালি দিনের উৎকর্ষ জানাতে গবেষণামূলক কাজ করে আগামী প্রজন্মকে দেশের সিনেমাপ্রেমী করার সাধনা করে যেতে চাই।

মন্তব্য করুন