Select Page

খালিদ হাসান মিলু : স্টাইলিশ শিল্পীর গল্প

খালিদ হাসান মিলু : স্টাইলিশ শিল্পীর গল্প

মিলু
কণ্ঠ যার মধুভরা..

আমরা বাংলাদেশী শিল্পীর মধ্যে যাদের গান শুনে বরাবরই মুগ্ধ হয়ে এসেছি শৈশব থেকে তাদের একজন খালিদ হাসান মিলু। মিলুর গান শুনলে মনে হয় মধুর কোনো সুর কানে বাজছে নির্ণিমেষ।

মিলুর জন্ম ১৯৬০ সালে। পেশাদার কণ্ঠশিল্পী হবার সাধনা করেছেন সারাজীবন। অ্যালবাম ও সিনেমার গান মিলিয়ে গান প্রায় ৫০০০। অ্যালবাম ছিল ১২ টি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘শেষ খেয়া, নীলা, প্রতিশোধ নিও, শেষ ভালোবাসা, আয়না, মানুষ। ‘শেষ খেয়া’ অ্যালবামটি যে পরিমাণ হাইপ তুলেছিল সমসাময়িক অনেক অ্যালবামই তা পারেনি। দালানকোঠা থেকে রেলস্টেশন পর্যন্ত মানুষের কাছে এ অ্যালবামের গানগুলো পৌঁছে গিয়েছিল।

ফোক গান ছিল সব যেগুলো আগে গাওয়া হয়েছিল এরপর মিলুর দরদী কণ্ঠে আবারও জনপ্রিয়তা পায়। গানগুলো ছিল – কতদিন দেহি না মায়ের মুখ, নিশীথে যাইও ফুলবনে, আমায় এত রাতে ক্যানে ডাক দিলি, ভুবন মাঝি আমায় তুমি ইত্যাদি। অ্যালবামের গানের মধ্যে ‘নীলা, তুমি ফিরে এসো’ জনপ্রিয়। ‘সজনী, আমি তো তোমায় ভুলিনি’ এ গানটা তরুণ প্রজন্মের মুখে মুখে ছিল এবং আজও জনপ্রিয়। লাইনগুলো ছিল –
‘সজনী আমি তো তোমায় ভুলিনি
এ বুকে তুমি আছো
আগেরই মতোই আছো
তুমি ছাড়া এ জীবন আজও ভাবিনি।’
এ গান নিয়ে একটি গল্প আছে। গানটি একই সময়ে খালিদ হাসান মিলু ও কুমার শানু দুজনের কণ্ঠেই নেয়া হয়। কিন্তু শ্রোতারা মিলুর কণ্ঠে বেশি গ্রহণ করেছিল। কোম্পানি মিলুর গানটাই ফাইনাল করেছিল। এটা নিয়ে কুমার শানু ভারতীয় পত্রিকায় বলেছিলেন-‘বাংলাদেশে মেলোডি গানের দরদভরা কণ্ঠ যদি থাকে তো খালিদ হাসান মিলু-‘র ছিল। ঘটনাটি বেশ আলোচিত ছিল। কিশোর কুমারের ‘একদিন পাখি উড়ে’ গানটি মিলুও গেয়েছিলেন এবং খুব জনপ্রিয় হয়েছিল।

প্রত্যেক পেশাদার শিল্পীরই ছবির গানের প্রতি আলাদা টান থাকে। ছবির গানের মাধ্যমে খুব তাড়াতাড়ি মানুষের কাছে পৌঁছানো যায় এবং গান দর্শক পছন্দ করলে সেগুলো অমর হয়ে যায়। মিলুরও ছবির গানই তাঁকে অমর করে রাখবে। অসংখ্য জনপ্রিয় ক্লাসিক গান আছে। ছবির গানের সংখ্যা ২৫০টি। ১৯৯৪ সালে ‘হৃদয় থেকে হৃদয়’ ছবির গানের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর অনেক গানের মধ্যে কিছু গানের কথা বলছি –
আমার মতো এত সুখী – বাবা কেন চাকর
সেই মেয়েটি – মৌসুমী (লিপ – নাদিম হায়দার)
চারিদিকে শুধু তুমি – মৌসুমী (নাদিম হায়দার)
রুবি – হিংসা (লিপ – জসিম)
রুবি ও আমার জান – শাসন (লিপ – অমিত হাসান)
শুধু একবার বলো ভালোবাসি – দেন মোহর (লিপ – সালমান শাহ)
চিঠি লিখলাম – স্নেহ (লিপ- সালমান শাহ)
তুমি যেখানেই থাকো – স্নেহ (লিপ – সালমান শাহ)
সাথী তুমি আমার জীবনে – চাওয়া থেকে পাওয়া (লিপ – সালমান শাহ)
বন্ধু তুমি আমার – বিক্ষোভ (লিপ – সালমান শাহ)
অন্তরে অন্তরে পিরিতি বাসা বান্ধেরে – অন্তরে অন্তরে
প্রেম কখনো মধুর – মহৎ (লিপ – ওমর সানী)
শোনো শোনো ও প্রিয়া প্রিয়া গো – রাক্ষস (লিপ – আলমগীর)
তুমি যদি ডাকো আমায় – প্রেমপ্রীতি (লিপ – তপু রায়হান)
যে প্রেম স্বর্গ থেকে এসে – প্রাণের চেয়ে প্রিয় ( লিপ – রিয়াজ)
যত ভুলে যেতে চাই – হৃদয় থেকে হৃদয় (লিপ – আমিন খান)
ওগো মা তুমি শুধু মা – দিল (লিপ – নাঈম)
তোমায় আপন করে রাখব বলে – দিল (লিপ – নাঈম)

যারে আমি দেখিলাম এইবার চিনিলাম – দিল (লিপ – নাঈম)
আমি পাগল প্রেমে পাগল – দিল (লিপ – নাঈম)
পাগল এ মন মানে না যে আর মানা – সাক্ষাৎ (লিপ – নাঈম)
চোখে চোখে চোখ রেখে জাদু করেছ তুমি – চোখে চোখে
পৃথিবীকে ভালোবেসে সুরে সুরে – হৃদয় আমার (লিপ – আমিন খান)
তুমি আমার হৃদয়ে যদি থাকো – হৃদয় আমার (লিপ – আমিন খান)
স্বর্ণালী সঙ্গিনী গো – হিংসার আগুন (লিপ – সোহেল চৌধুরী)
এসো এসো কাছে এসো – লজ্জা ( লিপ – ওমর সানী)
কতদিন দেহি না মায়ের মুখ – প্রেমের কসম
অনেক সাধনার পরে আমি – ভালোবাসি তোমাকে (লিপ – রিয়াজ)
যে প্রেম স্বর্গ থেকে এসে – প্রাণের চেয়ে প্রিয় (লিপ – রিয়াজ)
কত ভালোবাসি কী যে ভালোবাসি – কে অপরাধী (লিপ – ওমর সানী)
যেও না যেও না সাথী – লাট সাহেবের মেয়ে (লিপ – ওমর সানী)
প্রেমেরও গীত হয়ে এলো রে – তুমি সুন্দর (লিপ – ওমর সানী)
এসো এসো কাছে এসো – লজ্জা (লিপ – ওমর সানী)

জীবনে বসন্ত এসেছে – নারীর মন (লিপ- রিয়াজ, শাকিল খান)
তোমাকে ভুলতে গিয়ে – বিদ্রোহ চারিদিকে (লিপ – রিয়াজ)
লিখিনি প্রেমেরই চিঠি দেইনি গোলাপ – নরপিশাচ ( লিপ – আলমগীর)
সুন্দর মেয়ে কাছে এলে – সোনিয়া (লিপ – নাঈম)
ও সাথী আমার তুমি কেন চলে যাও – আমার অন্তরে তুমি (লিপ- বাপ্পারাজ)
অপরূপা রূপ তোমার – অবুঝ মনের ভালোবাসা (লিপ – শাকিল খান)
আমি আপনার আব্দুল্লাহ – আব্দুল্লাহ (লিপ – দিলদার)
এই রাত যেন ভোর না হয় – বিরাজ বৌ (লিপ – ফারুক)
চাঁদনী রাতে বাঁশি শুনে – চাঁদনী রাতে (লিপ- সাব্বির)
এক দুই তিন চার – ঘাত প্রতিঘাত (লিপ – আনোয়ার হোসেন, জসিম, ওমর সানী)
শোনরে সুমন শোন – মহাগুরু
কেঁদো না ব্যথা পেলে কেঁদো না – ঘৃণা
ভালোবাসার দারুণ ফাগুন – আজকের ফয়সালা
প্রেম চিরদিনই পাগল এমন – মহা সম্মেলন
অপরূপা রূপ তোমার ভ্রমর কালো চোখ – অবুঝ মনের ভালোবাসা (লিপ – শাকিল খান)

সবগুলো গান কালজয়ী। মিলুর ভয়েস সালমান শাহ, ওমর সানী, নাঈম, আমিন খান তাদের সাথে খাপ খেত সবচেয়ে বেশি।

মিলু ভীষণ স্টাইলিশ ছিলেন। তাঁর কস্টিউম সিলেকশন একটা নায়কোচিত ইমেজ তুলে ধরত। সবসময় ফিটফাট দেখা যেত। চশমা, স্যুট-টাই পরে পারফেক্ট জেন্টেলম্যান হতেন। স্বল্পভাষী ছিলেন। মিলুকে হানিফ সংকেত-এর জনপ্রিয় ‘ইত্যাদি’ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে প্রায়ই দেখা যেত। বেশকিছু গানও করেছেন। লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হবার পর যখন কেউ খোঁজ নেয়নি হানিফ সংকেতই ‘ইত্যাদি-র মাধ্যমে দেশবাসীকে জানান তাঁর অবস্থা। ঐ পর্ব-তে মিলুকে দেখে চেনাই যায়নি। চিকিৎসার জন্য অর্থ সাহায্যও করেছিলেন হানিফ সংকেত। পরে তো মিলু চলেই গেলেন ২৯ মার্চ ২০০৫ সালে।

মিলুর দুই ছেলে প্রতীক হাসান ও প্রীতম হাসান। দুজনই গানের সাথে আছে। প্রতীক ইতোমধ্যে তার ইমেজ গড়ে তুলেছে। নিয়মিত সিনেমার গান, অ্যালবামের গান ও মিউজিক ভিডিও করে যাচ্ছে। প্রতীক প্রথমদিকে ‘ইত্যাদি’-র ব্যানারেই অ্যালবাম আনে ‘ভালোবাসা চাই’ নামে। বাবার জনপ্রিয় গানগুলো গেয়েছিল নতুন করে। তার কণ্ঠে বাবার সুরের প্রভাব অনেক তবে নিজস্বতাও আছে। আর প্রীতম রক মিউজিকে আগ্রহী। তার ‘আসো মামা হে, লোকাল বাস, গার্লফ্রেন্ডের বিয়া’ গানগুলো ইতোমধ্যে খুব জনপ্রিয়। যোগ্য বাবার যোগ্য সন্তান তারা।

 


মন্তব্য করুন