Select Page

খোকনের মতো পরিচালক একবারই আসেন

খোকনের মতো পরিচালক একবারই আসেন

বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালি অতীত বলতে যে সময়কালকে বোঝানো হয়, সে সময়ের অন্যতম সফল চলচ্চিত্র কারিগর জনাব শহীদুল ইসলাম খোকন। মৌলিক গল্প, নিত্যনতুন অ্যাকশন, অজানা সব মার্শাল আর্ট আর কুংফু, প্রাণবন্ত কমেডি, টানটান উত্তেজনায় ঠাসা কাহিনি আর মিষ্টি মধুর গানে তার সিনেমায় দর্শকেরা ডুবে থাকতো পুরো আড়াই ঘন্টা। শুধু আড়াই ঘন্টা নয় ছবি শেষ হবার পর তার রেশ থেকে যেতো বহুক্ষণ।

প্রেক্ষাগৃহে বাংলার দর্শকদের ধরে রাখার মন্ত্র জানা এই তুমুল জনপ্রিয় আর মেধাবী কারিগর ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল চলে গেছেন না ফেরার দেশে; মূত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৯ বছর।

ওস্তাদ মানে শহীদুল ইসলাম খোকন… আমরা সে সময় যারা নিয়মিত বাংলা সিনেমা দেখতাম তারা উনাকে ওস্তাদ বলেই ডাকতাম; দীর্ঘ দশ বছর সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন চলচ্চিত্রের আরেক নক্ষত্র অভিনেতা, প্রযোজক, পরিচালক মাসুদ পারভেজ (সোহেল রানা)-এর সহকারী হিসেবে। অনেকেই জানেন, খোকনের প্রথম ছবি ‘রক্তের বন্দি’ আসলে এটি ছিল উনার দ্বিতীয় ছবি। প্রথম চলচ্চিত্র ‘পদ্ম গোখরা’ হিট বা আলোচনায় আসতে পারেনি। দ্বিতীয় ছবি ‘রক্তের বন্দি’ ব্যবসায় মার খেলে উনি বেশ চিন্তায় পড়ে যান আর তখনই গুরু সোহেল রানা এগিয়ে আসলেন।

উনি তখন ছোট ভাই মাসুম পারভেজ মানে রুবেলকে নিয়ে একটি ছবির কথা ভাবছিলেন, আর সে ভাবনা থেকেই রুবেল সঙ্গে তার নতুন ছবিটির দায়িত্ব তুলে দেন শিষ্য খোকনের হাতে। দায়িত্ব পেয়ে গুরুর মান রাখলেন খোকন। সমুদ্র উপকূলের জেলে সম্প্রদায় নিয়ে সে সময়ের সম্পূর্ণ নতুন ধারায় তৈরি করলেন মার্শাল আর্ট ভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘লড়াকু’; যার বাকিটা লেখা থাকলো ইতিহাসে। ভিসিআরে দেখা ব্রুসলির সব অ্যাকশন যেন চলে এলো বাংলার সিনেমা পর্দায়। দেশের দর্শকেরা যেন এ রকম কিছুর জন্যই অপেক্ষায় ছিল। হুমড়ি খেয়ে পড়লো ছবিটি দেখার জন্য, ছবিটি হয়ে গেল বাম্পারহিট। শুরু হলো ওস্তাদ-শিষ্য খোকন-রুবেলের দীর্ঘ্ সফল পথচলা। একে একে নির্মিত হলো বীর পুরুষ, বজ্রমুষ্ঠি, বিপ্লব, উত্থান পতন, অপহরণ, বিশ্ব প্রেমিক, লম্পট, সন্ত্রাস, টপ রংবাজ, ঘাতক, শত্রু ভয়ংকর, গৃহযুদ্ধ, দুঃসাহস, রাক্ষস, ভণ্ড, চারিদিকে শত্রু, পাগলা ঘণ্টা, অর্কমা, ও যোদ্ধার মতো হিট ছবিগুলো।

খোকন ছিলেন তারকা তৈরির কারিগর; যার ছবিতে পেয়েছিলাম ড্যানি সিডাক, ইলিয়াস কোবরা, সিরাজ পান্না, আলেকজান্ডার বো, সিমলা, মিশেলা ও তামান্নার মতো জনপ্রিয় তারকাদের। আর এতসব জনপ্রিয় তারকাদের মাঝে যাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছিল ও যাকে পেয়ে বাংলা চলচ্চিত্র আরও একধাপ উপরে উঠার রাস্তা খুঁজে পেয়েছিল তিনি হচ্ছেন মরহুম হুমায়ূন ফরীদি স্যাহেব।

খোকন সব সময়ই দর্শকদের চমকে দিতে পছন্দ করতেন। যেমন; পানির নিচে মারামারি, চলন্ত প্লেনে অ্যাকশন, হঠাৎ রুবেলের ন্যাড়া মাথা, জ্যান্ত ইঁদুর খেয়ে ফেলাসহ অসংখ্য চমক। ঠিক তেমনি একটি বড় চমক দিয়েছিলেন আল্পনা কথাচিত্রের ‘সন্ত্রাস’ ছবিটির মাধ্যমে, রুবেল, জাফর ইকবালদের সঙ্গে বাংলার দর্শকেরা দেখলো ভয়ংকর এক খল অভিনেতাকে। যার অভিনয়ের যাদুতে মুগ্ধ থাকতো হলভর্তি দর্শক। ফরীদিকে সঙ্গে নিয়ে শুরু হলো রুবেল ও খোকনের আরেক অধ্যায়, যে অধ্যায়ের নাম ছিল শুধুই সফলতার। ফরীদিকে খোকন তার বহু ছবিতে অভিনয় করিয়েছেন, যার মধ্যে টপ রংবাজ, অপহরণ, সর্তক শয়তান, বিশ্ব প্রেমিক অন্যতম।

শুধু রুবেলকে নিয়েই নয় ফরীদিকে নিয়েও দারুণ দারুণ চমক দিয়েছিলেন খোকন সাহেব। ‘অপহরণ’ ছবিতে সম্পূর্ণ ন্যাড়া মাথায় ফরীদিকে পর্দায় তুলে চমকে দিয়েছিলেন আবার বাম্পার হিট ‘বিশ্ব প্রেমিক’ ছবিতে আনলেন সাইকো চরিত্রে। এখানে একটু যোগ করি, আমার জানা মতে, বাংলা চলচ্চিত্রে ‘বিশ্ব প্রেমিক’ই প্রথম ছবি যা সাইকো থ্রিলার সাবজেক্ট নিয়ে খোকন স্যার তৈরি করেছিলেন।

যাই হোক… সাইকো চরিত্রে ফরীদির অভিনয় সঙ্গে নতুন ধারার গল্পে দর্শকেরা আরেকবার ঝাঁপিয়ে পড়লো হল বারান্দা, কাউন্টারে লাগলো দীর্ঘ লাইন। এখানে একটু শেয়ার করি, ‘বিশ্ব প্রেমিক’ আমি প্রথম সপ্তাহে দেখতে পারিনি শুধু কালোবাজারে চড়া দামের কারণে, দেখতে হয়েছিল পুরো এক সপ্তাহ পর।

খোকন বুঝতেন দর্শকেরা আজ কী চায় আর কাল কী চাইবে, কী ধরনের ছবি বানালে দর্শকরা আরও বিনোদিত হবে। খোকনের প্রতিটি ছবিই একটি থেকে একটি আলাদা। যেমন; ‘বজ্রমুষ্ঠি’, আর এটাই সেই ছবি যা মৌলিক গল্পে চীনের মার্শাল আর্টের আদলে বাংলায় পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র, যার দুঃসাহস একমাত্র খোকনের মতো মেধাবীরাই দেখাতে পারতেন।

খোকন শুধু পরিচালনাই করেননি নিজের পরিচালনায় কয়েকটি ছবিতে অভিনয়ও করেছিলেন। যার মধ্যে ১৯৯২ সালে ‘উত্থান পতন’ ছবিতে দ্বিতীয় নায়ক হয়ে অভিনয় করেন আবার ‘সন্ত্রাস’ ছবিতে একজন সাধু চরিত্রে চমকে দিয়েছেন। তবে সবচেয়ে বড় চমকটি ছিল ‘বিষদাঁত’ ছবিতে, যেখানে তিনি মন্দ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এ ছাড়া ‘যোদ্ধা’য় একটি গানে ও ‘লাল সবুজ’ ছবিতে মাহফুজের সঙ্গে কিছুক্ষণ অভিনয় করেছিলেন। তাকে টিভি নাটকেও পেয়েছিলাম অভিনেতা হিসেবে, শহিদুল আলম সাচ্চুর ‘মেগা বন্ড’ ও সৌরজয় চৌধুরী পরিচালিত ‘অবশেষে’ নাটকে অভিনয় করেছিলেন তিনি।

অনেকেই বলেন খোকন শুধু রুবেলকে নিয়েই সফল ছিলেন যা মোটেও সঠিক নয়। রুবেলের বাইরেও তিনি কিছু ছবি বানিয়েছেন। যেমন; মান্নাকে নিয়ে ‘ভেজা বিড়াল’, ‘টাকা’ ছবিতে রিয়াজ, ‘লাল সবুজ’-এ মাহফুজ, আবার ‘চেহারা- ভন্ড ২’ ছবিতে শাকিবকে নিয়েছিলেন। অ্যাকশনের বাইরে জীবন ভিত্তিক অসাধারণ ছবি ‘বাঙলা’, দেশপ্রেম কেন্দ্রিক ‘লাল সবুজ’ তার করা।

আসলে শহীদুল ইসলাম খোকনের কথা বলে বা লিখে কখনই শেষ করা যাবে না। তবু শেষ করতে হয়। বাংলার মূলধারার বাণিজ্যিক ছবির অনন্য কারিগর ছিলেন খোকন সাহেব। তার মতো পরিচালকেরা একবারই আসেন। আমার এই দীর্ঘ্ চলচ্চিত্র দেখার অভিজ্ঞতায় এত মেধাবী পরিচালক আর পাইনি। ওস্তাদ… আজ আপনি নেই, তবে থাকবেন আপনার কাজে ও অসংখ্য মানুষের ভালোবাসায়।‌                                                                                                              


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

আরিফুল হাসান

চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখক

মন্তব্য করুন