Select Page

চট্টগ্রাম নগরীর ২৯টি সিনেমা হলের মধ্যে চালু মাত্র দুটি

চট্টগ্রাম নগরীর ২৯টি সিনেমা হলের মধ্যে চালু মাত্র দুটি

এক সময় জলসা, উজালা, বনানী কমপ্লেক্সের মতো চট্টগ্রামের প্রেক্ষাগৃহে হিট সিনেমাগুলো চলেছিল সপ্তাহের পর সপ্তাহ। শিল্প-কারখানা সমৃদ্ধ এ বন্দর নগরীতে বসবাস করেন দেশের বিভিন্ন জেলার মানুষ। তাদের বিনোদনের প্রধান উপকরণও ছিল চলচ্চিত্র। এ কারণে এখানকার দর্শকদের কদর করতেন নির্মাতারাও। কিন্তু এখন সেইসব শুধুই গল্প।

সিনেমা প্যালেস

দৈনিক পূর্বকোণে প্রকাশিত অনুপম চৌধুরীর সাম্প্রতিক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে চট্টগ্রামে একমসয় ৩৯টি সিনেমা হল ছিল। এর মধ্যে নগরীতে ২৯টি, নগরীর বাইরে ছিল আরও ১০টি সিনেমা হল। এখন অবশিষ্ট আছে শুধুমাত্র ২টি।

নগরীর সিনেমা হলগুলো হলো লায়ন (সদরঘাট), রঙ্গম (কোতোয়ালি), সিনেমা প্যালেস কেসিদে রোড), খুরশীদ মহল (লালদিঘী), উজালা (স্টেশন রোড), আলমাস (চট্টেশ্বরী), দিনার (চট্টেশ্বরী), জলসা (নিউমার্কেট), গুলজার (চকবাজার), নূপূর (স্টেশন রোড), মেলোডি (স্টেশন রোড), বনানী (আগ্রাবাদ), সানাই (বারিক বিল্ডিং), উপহার (আগ্রাবাদ), রিদম (আগ্রাবাদ), অলংকার (পাহাড়তলী), আকাশ (অলংকার), ঝুমুর (কাজির দেউড়ি), কর্ণফুলী (মোহরা), পূরবী (পাথরঘাটা), গুলশান (ঝাউতলা), রেলওয়ে নেভি হল (টাইগার পাস), গ্যারিসন (সেনানিবাস) পতেঙ্গা (নেভি হল), শাহীন (পতেঙ্গা বিমান বাহিনী), বিডিআর হল (হালিশহর), সাগরিকা (নেভি ফ্লিটক্লাব), ক্যান্টনমেন্ট (নতুন পাড়া), চাঁদনী (অক্সিজেন) ও সংগীত (আতুরার ডিপো)।

শহরের বাইরে হলগুলো হলো গ্যারিসন (বিএমএ, ভাটিয়ারি), পরাগ (বাড়বকুণ্ড), রূপালি (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়), ঝংকার (নাজিরহাট), বনশ্রী (পেপার মিল, রাঙ্গুনিয়া), বনলতা (রাঙ্গুনিয়া), বিডিআর (বাইতুল ইজ্জত, সাতকানিয়া), সবুজ (পটিয়া) ও ছন্দা (পটিয়া)।

প্রতিবেদন অনুসারে, চট্টগ্রাম নগরীতে এখন অবশিষ্ট আছে শুধু ২টি। কাজির দেউড়ি এলাকার ঝুমুর (যা পরবর্তীতে নাম পাল্টে হয় সুগন্ধা) এবং কেসিদে রোডের সিনেমা প্যালেস।

চট্টগ্রামের সিনেমা হল প্রসঙ্গে লেখা হয়, চট্টগ্রামের প্রথম সিনেমা হল লায়ন এর অবস্থান ছিল সদরঘাটে হোটেল শাহজাহানের বিপরীতে। লায়ন প্রথমে কোন সিনেমা হল ছিল না। যা ছিল এক জমিদার পরিবারের অধীনে কমলবাবু থিয়েটার নামে একটা অডিটোরিয়াম। ওই অডিটোরিয়ামে বাইরের বিশেষ কেউ এলে অনুষ্ঠান হতো। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও এই কমলবাবুর থিয়েটারে সংবর্ধনা দেয়া হয়। উদয় শংকরও ওই থিয়েটারে নাচের অনুষ্ঠান করে গেছেন। কমলবাবুর থিয়েটার পরে হাত বদল হয়ে আরেক জমিদারের কাছে যায়। তিনি তার বাবার নামে এটির নামকরণ করেন ‘বিশ্বম্ভর থিয়েটার’।

১৯৪৭-এর দেশভাগের পর ঢাকার চলচ্চিত্র প্রদর্শক আব্দুল কাদের সদ্দারের কাছে এই হল বিক্রি করে দেন। ওই সময় তাদের ঢাকায় আরেকটি সিনেমা হল ছিল। যার নাম ছিল লায়ন। ঢাকা সদরঘাটের ইসলামপুর এলাকায় এই হলটি এখনও চালু আছে। কিন্তু আগের পরিসর থেকে কিছুটা ছোট করে, নাম পরিবর্তন করে ‘লায়ন সিনেমাস’ নামে চলছে। সেই লায়নের নামেই বিশ্বম্ভর থিয়েটার হয়ে যায় ‘লায়ন সিনেমা হল’। এই লায়ন সিনেমা হল হয় ১৯২৬ সালে। লায়ন সিনেমা হল হওয়ার পর এটি অডিটোরিয়াম থেকে পূর্ণাঙ্গ সিনেমা হলে রূপ নেয়। এটি ১০-১২ বছর আগে বন্ধ হয়ে যায়।  

নগরের তৃতীয় হল ‘সিনেমা প্যালেস’। যা ১৯৪০ সালে যাত্রা শুরু করে এখনও টিকে আছে। চতুর্থ সিনেমা হল ছিল লালদীঘির পাড়ে ‘খুরশীদ মহল’। মালিক ছিলেন আহমদ ছগির চৌধুরী। এখন ওই জায়গায় মহল কমপ্লেক্স গড়ে উঠেছে। ছগির চৌধুরীর শ্বশুর ছিলেন রিয়াজ উদ্দিন, যার নামে বর্তমান রিয়াজ উদ্দিন বাজার। তিনি একটা সিনেমা হল করলেন বানিয়াটিলাতে (পুরাতন রেল স্টেশনের বিপরীতে), নাম ছিল ‘উজালা’।

১৯৬৭ সালে নগরে টুইন হল ‘আলমাস’ ও ‘দিনার’ চালু হয়। এটাই ছিল চট্টগ্রামের প্রথম আধুনিক সিনেমা হল। মালিক ছিলেন একজন অবাঙালি। তার মেয়ের নাম ছিল-আলমাস আর ছেলের নাম দিনার। তাদের নামে দুটি হলের নাম রাখা হয়। এটি ২০২০ সালে বন্ধ হয়ে যায়। আলমাসে দর্শকের আসন ছিল ৬০০ এর ওপরে। আলমাসে বাংলা ছবি চললেও দিনারে চলত বিদেশি ছবি।

স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম সিনেমা হল নিউমার্কেটের বিপরীতে ‘জলসা’। ১৯৭৩ সালে চালু হওয়া আধুনিক বাংলা নামে সিনেমা হল। জলসা-তে প্রথম ‘স্বীকৃতি’ নামে একটি ছায়াছবি প্রদর্শিত হয়। এই সিনেমা হলের ওপরে ‘সিটি হল’ নামে আরেকটা সিনেমা হল প্রস্তুত করা হলেও নানা কারণে বাণিজ্যিকভাবে চালু করা যায়নি। ১৯৭৪ সালে গুলজার মোড়ে চালু হয় ‘গুলজার’। স্টেশন রোডে চালু হয় ‘নূপুর’। ‘নূপুর’ হলের ওপর তলায় চালু হয় ‘মেলোডি’। ‘মেলোডি’তে বিদেশি ছবির প্রদর্শন হত। আগ্রাবাদে চালু হয় আরও পাঁচটি সিনেমা হল- ‘বনানী কমপ্লেক্স’, ‘সানাই’, ‘উপহার’, ‘সাগরিকা’ ও ‘রিদম’।

‘বনানী’ সিনেমা হলকে বলা হতো এশিয়ার স্বপ্নপুরী। জনশ্রুতি আছে, বনানী ছিল দেশের একমাত্র সবচেয়ে বড় হল। অনেকে যশোরের ‘মনিহার’কে বলত দেশের সবচেয়ে বড় হল। তবে ‘বনানী’তে দর্শকের আসন সংখ্যা ছিল ২ হাজার।

১৯৯৩ সালের বাংলা ভাষায় ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত নাট্য চলচ্চিত্র ছিল পদ্মানদীর মাঝি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে গৌতম ঘোষ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। অভিনয় করেন রাইসুল ইসলাম আসাদ, চম্পা, রূপা গঙ্গোপাধ্যায় ও উৎপল দত্ত।

এই ছবি প্রদর্শনীতে তারা সবাই চট্টগ্রামে আসেন। ওইসময় গৌতম ঘোষ বলেছিলেন, ‘বনানী কমপ্লেক্সের মত একটা সুবিশাল সিনেমা হলে যে আমার সিনেমা রিলিজ দেওয়া হল, এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় স্মরণীয় ঘটনা’।

এই পাঁচটা হলের একটিও এখন অবশিষ্ট নেই। দর্শকের অভাবে একের পর এক বন্ধ হয়েছে পূরবী, সানাই, আকাশ, নূপুর, চাঁদনী, কর্ণফুলী, উজালা, ঝুমুর, নেভী হল, গুলশান, শাহীন, অলংকার, আকাশ, বিডিআর হল, গ্যারিসন, ক্যান্টনমেন্ট, রুপালী, সংগীত, ঝংকার। এছাড়া বন্ধ হয়ে গেছে সীতাকুণ্ডের পরাগ, ফটিকছড়ির ঝংকার, পটিয়ার ছন্দা ও সবুজ, রাঙ্গুনিয়ার বনশ্রী ও বনলতা, বান্দরবানের বনানী ও খাগড়াছড়ির বনশ্রী।

লালদীঘির খুরশিদ মহল সিনেমা হল ভেঙে তৈরি হয়েছে মহল মার্কেট, স্টেশন সড়কের উজালা ভেঙে করা হয়েছে এশিয়ান এসআর হোটেল, আগ্রাবাদের বনানী ভেঙে করা হয়েছে বনানী কমপ্লেক্স, নিউমার্কেটের জলসা সিনেমা হলের জায়গায় হয়েছে জলসা মার্কেট। এভাবে লায়ন, গুলজার, নূপুর ও রঙ্গম সিনেমা হল ভেঙে করা হয়েছে বহুতল মার্কেট।


Leave a reply