Select Page

চমকের পর চমক, থ্রিলে ভরা ‘রেডরাম’

চমকের পর চমক, থ্রিলে ভরা ‘রেডরাম’

সিনেমার বিভিন্ন জনরা নিয়ে যারা অল্পস্বল্প হলেও খোঁজ-খবর রাখেন তাদের কাছে বিশেষ করে এই সময়ের মুক্ত সংস্কৃতির দর্শকদের কাছে থ্রিলার একটি জনপ্রিয় ঘরানা। সোজা বাংলায় কোন গল্প বা ঘটনা যদি মনস্তাত্ত্বিক নানা ঘটনার মাধ্যমে প্রভাবিত হয় তাহলে সেই ঘটনা বা গল্পকে থ্রিলিং সেটিং পদ্ধতিতে বর্ণনা বা উপস্থাপনের ধারাকেই সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার বলে ধরে নেয়া হয়। কোরিয়ান, ফ্রেঞ্চ, হলিউড, বলিউডের পাশাপাশি বিগত কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশেও এই ধারা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে প্রতিনিয়ত। আমাদের দেশে এই জনরা নিয়ে যে কয়জন নির্মাতা নান্দনিক কিছু কাজ ইতিমধ্যে উপহার দিয়েছেন সেই লিস্টে সবার শীর্ষে থাকবে তরুণ কিন্তু দক্ষ নির্মাতা ভিকি জাহেদ।

বেশ কিছু ওয়েব কনটেন্ট, নাটক এবং স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বানিয়ে ইতিমধ্যে নিজের জাত চেনানো ভিকি জাহেদ গতকাল হাজির হয়েছেন তার প্রথম ওয়েব ফিল্ম নিয়ে। এবং প্রথম ওয়েব ফিল্মের গল্প বা প্রেক্ষাপট হিসেবে বেছে নিলেন তার প্রিয় ঘরানা মানে থ্রিলার জনরা।

ভিকি জাহেদের প্রথম ওয়েব ফিল্মের নাম ‘রেডরাম’। ইংরেজি অক্ষরগুলো উলটে দিলেই এটা হয়ে যায় ‘মার্ডার’। এবং গল্পটিও খুন এবং এই খুনের তদন্ত করতে গিয়ে উঠে আসা অতীত এবং বর্তমানের নানা রকম ঘটনা নিয়েই সেলুলয়েডে উঠে এসেছে নান্দনিকভাবে। দেশের এই সময়ের জনপ্রিয় এবং শক্তিশালী অভিনেতা এবং অভিনেত্রীদের নিয়ে ভিকি জাহেদ যে ওয়েব ফিল্মটি উপহার দিলেন তা এককথায় অনবদ্য। এবং ব্যক্তিগতভাবে একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে আমার মনে হয় একমাত্র ভিকি জাহেদই পারতেন এমন থ্রিলার গল্পের এমন জমজমাট উপস্থাপন নিয়ে হাজির হতে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসমেট ভিন্ন ভিন্ন ক্যারিয়ারে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও একদিন একটি মর্মান্তিক ঘটনা তাদের অনেক বছর পরে এক বিন্দুতে এনে দাঁড় করায়। একজন সিআইডি অফিসার, একজন নৃত্যশিল্পী এবং একজন গায়কের ব্যক্তিগত জীবন, তাদের অতীত এবং বর্তমান নিয়েই ‘রেডরাম’ এর গল্প। যার পরতে পরতে আছে চমক, যে চমক আমাদের পরের দৃশ্যের জন্য অপেক্ষা করায় এবং একটি থ্রিলারের সার্থকতা এখানেই। আর এই সমীকরণে নীলা হিসেবে মেহজাবীন, রাশেদ হিসেবে আফরান নিশো সোহেল হিসেবে মনোজ প্রামাণিক, লুবনা হিসেবে নাদিয়াকে নিয়ে বাজিমাত করলেন ভিকি জাহেদ।

এক সকালে একটি বদ্ধ রুমে ঘুমন্ত স্ত্রীর পাশেই মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় স্বামীকে। স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহের তীর প্রথমেই স্ত্রীর দিকে। কিন্তু সমীকরণটা আসলেই কি এতো সহজ!! যদি সহজ না হয় তাহলে কে করলো খুন?? কখন এবং কীভাবে?? এবং সবচেয়ে বড় প্রশ্ন কেন এই খুন?? সেটা জানতে হলে দেখতে হবে ওয়েব ফিল্ম ‘রেডরাম’।

খুনের তদন্তের জন্য আবির্ভাব হয় রাশেদ-রুপী আফরান নিশোর। ‘মরীচিকা’ ‘মাইনকার চিপায়’ দিয়ে ওটিটিতে নিজের ছাপ রাখা আফরান নিশো এবার সিআইডি কর্মকর্তা রাশেদ হিসেবে ‘মরীচিকা’র সেই বিনাশ না হওয়া দানবের পারফরম্যান্স কি ছাপিয়ে যেতে পারবেন এই প্রশ্ন মাথায় নিয়ে ‘রেডরাম’ দেখতে বসলেও এক সেকেন্ডের জন্যও তিনি হতাশ করেন নাই। প্যারালাল ফরম্যাটে এগিয়ে যাওয়া গল্প দুইটা সময়কে তুলে ধরলেও দুটি সময়েই অভিনেতা আফরান নিশো প্রমাণ করলেন তিনি কেন তার সমসাময়িকদের অনেকটা এগিয়ে। এবার আসা যাক ওটিটিতে প্রথম ওয়েব ফিল্ম নিয়ে হাজির হওয়া দেশের এই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং আলোচিত অভিনেত্রী মেহজাবীনের পারফরম্যান্সে। ভিকি জাহেদের পরিচালনায় এর আগেও তিনি উপহার দিয়েছেন তার ক্যারিয়ারের সেরা কিছু কাজ। প্রথম ওয়েব ফিল্মেও মেহজাবীন প্রমাণ করলেন তিনি আক্ষরিক অর্থেই ডাইরেক্টরস আর্টিস্ট। কিছু জায়গায় কমতি বা একটু ভালো হতে পারতো মনে হলেও হতে পারে তবে প্রথম ওটিটি যাত্রায় বাউন্ডারি হাকিয়েছেন মেহজাবীন এ কথা বলা যায় নিঃসন্দেহে। তার পরিশ্রম, দক্ষতা বা ভালো করার অবিরাম প্রচেষ্টা সেলুলয়েডে উঠে এসেছে অসাধারণভাবে। সময়ের অন্যতম আলোচিত এবং দক্ষ অভিনেতা মনোজ প্রামাণিক ওটিটির কল্যাণে নিজের দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন অসংখ্যবার। এবার ভিকি জাহেদের সাথে ‘রেডরাম’ এ তিনি স্বতন্ত্রতার সঙ্গেই নিজের ছাপ রেখেছেন সাবলীলভাবেই। আফরান নিশো বা মেহজাবীনের চরিত্রের মাঝে তিনি হারিয়ে তো যাননি বরং তার চরিত্রটি শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছে মনোজের অভিনয় দক্ষতার কারণে। সালহা খানম নাদিয়া প্রতিনিয়ত নিজের প্রতিভার ঝলক দেখাচ্ছেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তার চরিত্রটি নিয়ে যতটা এক্সপেরিমেন্ট করা যেতো নাদিয়া সেটি করতে সক্ষম হয়েছেন। মূল ভূমিকায় এই চার তারকার পাশাপাশি আজিজুল হাকিম, মাসুম বাশার, নাসির উদ্দিন খান, শিল্পী সরকার অপু, মুকুল সিরাজ, হিন্দোল রয়, ফাইজুর ইয়ামিন, আর এ রাহুল, রাকিবা সুলতানা শর্মী, এহতেশাম আহমেদ টিংকু সবাই যার যার জায়গায় ভালো করেছেন। নাসির উদ্দিন খান, আর এ রাহুল যতটা সুযোগ পেয়েছেন তা কাজে লাগিয়েছেন পুরোপুরি। মূল কথা গল্পে এবং উপস্থাপনে তারা প্রত্যকেই ছাপ রেখেছেন। তবে নব্বই দশকের জনপ্রিয় অভিনেতা আজিজুল হাকিমকে তার পটেনশিয়ালটি অনুযায়ী আরেকটু কাজে লাগানো যেতো কিনা তা নিয়ে একটা প্রশ্ন করাই যায়!!

ভিকি জাহেদের কাজের ব্যাপারে একটা বিষয় উল্লেখ না করলেই নয় যে, ওনার প্রতিটা কাজেই যত্ন এবং রিসার্চ এর একটি কম্বিনেশন লক্ষ্য করা যায়। ‘রেডরাম’ এর ব্যতিক্রম নয়। গল্প, চিত্রনাট্য, সংলাপ, সিনেমাটোগ্রাফি এবং ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর সবকিছুতেই ভিকি জাহেদ নিজের নির্মাণ মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন তার টিমকে সঙ্গে নিয়ে। তার প্রতিটি কাজেই কিছু ব্যতিক্রমী সংলাপ পাওয়া যায় যা মুহূর্তের মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ ভাইরাল হতে দেখা যায়। এ ছাড়া আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হয় বিদ্রোহী দীপনের অসাধারণ ক্যামেরার কাজের কথা। শ্রীমঙ্গলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে থ্রিলারের রহস্য এবং সাসপেন্স ধরে রাখা আলাদাভাবে প্রশংসার দাবিদার। এই ওয়েব ফিল্মের কিছু সংলাপ ইতিমধ্যে ট্রেলার রিলিজের পরে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। যেমন- ‘অনেক সময় মনে হয় যারা মরে যায় তারাই বেঁচে যায়, মুক্ত হয়ে যায়। সময়ের গণ্ডিতে তাদের আটকা থাকতে হয় না।’ বা ‘মানুষ হয়ে জন্মানোর সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, জীবনের বেশির ভাগ কাজ আপনি নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই করবেন।’ এই সংলাপগুলো ওয়েব ফিল্ম দেখার সময় আলাদা মাত্রা যোগ করে এটা স্বীকার করতেই হয়। ‘মিস্টার টুইস্ট’ খেতাবধারী ভিকি জাহেদ এই ওয়েব ফিল্মেও এই খেতাবের যথাযথ মান রেখেছেন। বিশেষ করে শেষের আধঘণ্টা আমাদের সেলুলয়েডে চোখ আটকে রাখতে বাধ্য করে এই টুইস্টের কারণেই।

‘রেডরাম’ এ কোনো কমতি বা খামতি নাই এমনটা নয়। ভিকি জাহেদের বেশির ভাগ কাজেই এখন আফরান নিশোকে দিয়ে ভয়েস ওভারের যে ট্রেন্ড চলছে তা কিছুটা হলেও এখন মাঝে মাঝে একটু খারাপ লাগা তৈরি করে যেটা সামনে হয়তো আক্ষেপ হিসেবে ধরা দেবে। সম্পাদনা বা এডিটিং সেকশন আরও মনোযোগী হলে হয়তো এই ওয়েব ফিল্মটি আলাদা একটা জায়গা নিয়ে নিতে পারতো। এ ছাড়া ওয়েব ফিল্মের ব্যাপ্তি কিছুটা কম হলে হয়তো আরও জমজমাটও হতো। তবে সবশেষে এটাও সত্য যে সাধারণ দর্শকেরা এসব টেকনিক্যাল দিকে নজর দেবার সময়ই পাবেননা রহস্য ঘেরা থ্রিলারটি  উপভোগের সময়ে।

ব্যতিক্রমী কনটেন্ট, ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র, তাদের মধ্যকার টানাপোড়েন, অনেকগুলো প্লট সবশেষে এসে এমনভাবে কানেক্ট হয় যে ‘রেডরাম’ ওটিটিতে বাংলাদেশের থ্রিলার ঘরানার অন্যতম সেরা একটি দেশীয় কনটেন্ট হিসেবে জায়গা করে নিতে যাচ্ছে। ক্যাপ্টেন অব দ্যা শিপ মানে নির্মাতা ভিকি জাহেদ তার প্রথম ওয়েব ফিল্মে দেখিয়ে দিলেন আমাদের দেশেও থ্রিলার ঘরানায় ঠিকঠাক রিসার্চ, ব্যতিক্রমী গল্প এবং চিত্রনাট্যের সঙ্গে দক্ষ অভিনয় শিল্পী এবং কলাকুশলীদের নিয়ে নির্মাণ মুনশিয়ানা দিয়ে যথাযথভাবে পর্দায় সেটা উপস্থাপন সম্ভব এবং খুব ভালোভাবেই সম্ভব। সামনের দিনে তার পরবর্তী কাজগুলো দেখার আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দিলো দেশীয় ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ‘চরকি’র নতুন ওয়েবফিল্ম ‘রেডরাম’।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

আফজালুর ফেরদৌস রুমন

শখের বশে চলচ্চিত্র ও নাটক নিয়ে লিখি

মন্তব্য করুন