Select Page

চিটাগাংইয়া পোয়া নোয়াখাইল্লা মাইয়া : একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য দেশি কার্টুন!

চিটাগাংইয়া পোয়া নোয়াখাইল্লা মাইয়া : একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য দেশি কার্টুন!

চিটাগাংইয়া পোয়া নোয়াখাইল্লা মাইয়া
পরিচালনা : উত্তম আকাশ
অভিনয়ে : শাকিব খান, শবনম বুবলি, ওমর সানী, মৌসুমী, সাদেক বাচ্চু, কাজী হায়াৎ, মাহমুদুল ইসলাম মিঠু, রেবেকা, শিমু, ববি, ডিজে সোহেল, শাহীন, গাংগুয়া, বাদল, যাদু আজাদ, তানহা মৌমাছি ও উত্তম আকাশ।
রেটিং : ১/ ৫

বিজ্ঞাপনের ভাষায় বললে-‘অসীম ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে চান? জলের মত প্রযোজকের অর্থ বিয়োগ হওয়া দেখতে চান? তাহলে আর দেরি কেন? দেখে আসুন ঈদের ছবি ‘চিটাগাংইয়া পোয়া নোয়াখাইল্লা মাইয়া’ (সংক্ষেপে ‘চিপোনোমা’)।

জীবনের ২ ঘন্টা ২২ মিনিট যে কতটা বিভীষিকাময় হতে পারে, তা জানবার জন্য হলেও অন্তত উত্তম আকাশ পরিচালিত শাপলা মিডিয়া প্রযোজিত এই চলচ্চিত্রটি দেখা সবার জন্য দরকার। এই একই জুটির ফেব্রুয়ারিতে মুক্তি পাওয়া ‘আমি নেতা হবো’ দেখে বিস্মিত হয়ে ভেবেছিলাম, কাহিনী ছাড়া একটি চলচ্চিত্র কী করে নির্মিত হতে পারে? এবার শুধু বিস্ময় নয়, হতবাক হয়ে ভাবছি, ‘আমি নেতা হবো’তে তাও কাহিনীর ছিটেফোঁটা ছিল। কিন্তু ‘চিপোনোমা’ তে গল্পের লেশ মাত্র নেই। বাংলা সিনেমায় ‘কাহিনীর গরু গাছে চড়ে’-এই প্রবাদ বাক্যকে শিরোধার্য মেনেই প্রেক্ষাগৃহে গিয়েছি সবসময়। কিন্তু উত্তম আকাশের নতুন ছবিতে কাহিনীর গরু শুধু গাছেই চড়েনি, রূপকথার যে কোনো কুরুচিপূর্ণ গল্পকেও হার মানিয়েছে।

আমি নিশ্চিত, ‘চিপোনোমা’ চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট বেশিরভাগ সদস্যই (বিশেষ করে অভিনয়শিল্পীরা) এ ছবিটি পূর্ণ সময় ধরে প্রেক্ষাগৃহে দেখার অপরিসীম ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন না। কারণ একটি ছবি যতই নিম্নমানের হোক, দর্শক একটি পূর্ণাঙ্গ গল্প পেলে সবকিছু ভুলে যেতে চায়। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে ‘চিপোনোমা’তে আমি আঁতিপাতি করে কোনো গল্পের প্লট-ই খুঁজে পাইনি। প্রতিটি দৃশ্যে একটু একটু করে চিত্রনাট্যকারের গাঁথুনির সুতো ছিঁড়ে গেছে। আর তার শিকার হয়েছি আমরা নিষ্পাপ (!) দর্শকরা।

একটা সময় পরিচালক ‘উত্তম আকাশ’ নিজেই একটি ব্র্যান্ড ছিলেন। মুক্তির সংগ্রাম, রঙ্গিন রংবাজ, ভণ্ড বাবা, গিরিঙ্গিবাজ, তুই যদি আমার হইতি রে, কে অপরাধী, দানব সন্তান, দুষ্টু ছেলে মিষ্টি মেয়ে, সাব্বাশ বাঙালি, মমতাজ- তার নির্মিত কত চলচ্চিত্র দেখেছি! বিশেষ করে ২০০৬ সালের ২৫ অক্টোবর মুক্তি পাওয়া তার পরিচালিত ‘ঢাকাইয়া পোলা বরিশালের মাইয়া’ (শাবনূর, শাকিব খান) দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। কিন্তু এক যুগ পার করে উত্তম আকাশ যে ‘চিটাগাংইয়া পোয়া নোয়াখাইল্লা মাইয়া’ নির্মাণ করতে গিয়ে সেই ২০০৬ সালেই পড়ে থাকবেন কিংবা দর্শকদের চিরতরে ‘নির্বোধ’ ভাববেন, এটি আশা করা যায় না।

‘ঢাকাইয়া পোলা বরিশালের মাইয়া’ কিংবা শাকিব খান অভিনীত বেশ কয়েক বছর আগে মুক্তি পাওয়া ‘লাভ ম্যারেজ’ ছবিতে দুই ভাষা এবং সংস্কৃতির বিরোধের সুন্দর একটি গল্প আমরা পেয়েছিলাম। কিন্তু উত্তম আকাশের নতুন ছবির নাম কেন ‘চিটাগাংইয়া পোয়া নোয়াখাইল্লা মাইয়া’, তা শেষ দৃশ্য পর্যন্ত দেখেও ঠাওর করতে পারিনি।

প্রেক্ষাগৃহে প্রবেশের আগে ভেবেছিলাম, ছবিতে চট্টগ্রামের ছেলে ও নোয়াখালীর মেয়ের জমজমাট একটা গল্প পাওয়া যাবে। কিন্তু এ ছবির গল্পে মূল চরিত্র তারা কেউই নন। প্রধান চরিত্র একটি নিষ্প্রাণ ‘বেচারী’ (!) পুতুল এবং তার পুচ্ছদেশে থাকা হীরা। পুতুল নিয়ে গল্প। আর এই গল্পে আকবর (সাদেক বাচ্চু) ও জব্বার (কাজী হায়াৎ) নামে দুই বন্ধুর অবৈধ ব্যবসার সাফল্য ও নিজেদের লোভ লালসা চরিতার্থ করতে কিভাবে সন্তানদের অপকর্মে ব্যবহার করা যায়, সে সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়েছে। এই সন্তানদের মধ্যেই আছে চট্টগ্রামের আনজাম (শাকিব খান), বৃষ্টি (মৌসুমী) ও নোয়াখালির রানী (বুবলি) ও নিয়াজ (ডিজে সোহেল)। শুধুমাত্র দুজনের ওপরই যেহেতু গল্পের আলো পড়েনি, হাঙ্গামাপূর্ণ গোঁজামিল গল্পটি যেহেতু সবাইকে নিয়ে, তাহলে ছবির নাম কেন ‘চিটাগাংইয়া পোয়া নোয়াখাইল্লা মাইয়া’ হতে হবে? যদি ‘গিমিক’ হিসেবে নির্মাতার এতই দুই সংস্কৃতিকে তুলে ধরার সদিচ্ছা থাকতো, তাহলে ছবির পোস্টার, প্রচারণা থেকে শিরোনাম গানের চিত্রধারণ সবকিছুতে কেন তিনি আধুনিকতার লেবাস দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন? ‘চিটাগাংইয়া পোয়া নোয়াখাইল্লা মাইয়া’-এই শিরোনামের গানটি কি অন্তত চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর মনোরম লোকেশনে চিত্রায়িত করা যেত না? ব্যাংককের অপরূপ সৌন্দর্য এই গানের চরিত্রের সাথে কতটুকু মানিয়ে গেল-এটি নিয়ে ভাবনার কেউ নেই?

তাছাড়া গান নির্মাণ করতে গিয়ে আধুনিকতা দেখানো গেল, অথচ গল্পে কিংবা নির্মাণে সেই আধুনিকতার ছাপ উধাও-এ বিষয়টি মেনে নেয়া কষ্টকর! একটা সময় উপমহাদেশের চলচ্চিত্রে আমরা অভিনয়শিল্পীদের যে ‘উচ্চকিত’ অভিনয় করতে দেখতাম, সেই অভিনয়ের ধারা কি এখনো তারা লালন করছেন? বলিউডে অমিতাভ বচ্চন কিংবা শুরুর দিকে শাহরুখ খান একটা সময় চিৎকার করে যেভাবে সংলাপ দিতেন কিংবা ওপার বাংলার ছবিতে প্রসেনজিৎ যেভাবে সংলাপ আওড়াতেন, এখনো নিশ্চয়ই সেই ধারাতেই অভিনয় করেন না। কারণ অভিনয়ের ধারা বদলে গিয়েছে। আমরা কেন এখনো দিন দিন দর্শকদের পেছনের দিকে ফিরিয়ে নিতে চাইছি? আদি যুগের ঘুষি দিয়ে কাঁচের দেয়াল মুচড়ে ফেলার দৃশ্য আর কত বছর দেখতে হবে? কেন হৃতিক রোশনের ‘কৃষ’ ছবির মত মুখোশ আমাদের শাকিব খানকে পড়তে হবে? কেন শাহরুখ খানের ‘ম্যয় হু না’র মত করে শাকিব খানকে বাড়ির ছাদ থেকে দৌড়ে হেলিকপ্টার ধরতে হবে? কাহিনীকার কিংবা নির্মাতা চাইলে কি নতুন কিছু দর্শকদের উপহার দিতে পারতেন না?

যতদূর আমি জেনেছি, প্রযোজক শাপলা মিডিয়া জলের মতই অর্থ খরচ করেছেন এ ছবিতে। কিন্তু তার প্রমাণ কি পরিচালক উত্তম আকাশ পর্দায় দেখাতে পেরেছেন? এই ঈদেই এবং অতীতে দুর্বল ক্রোমার ব্যবহার অন্যান্য বাংলা চলচ্চিত্রে দেখেছি। কিন্তু অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে ‘চিটাগাংইয়া পোয়া নোয়াখাইল্লা মাইয়া’ ছবিতে। প্রায় ১২-১৫টি দৃশ্যে ক্রোমার ব্যবহার এতটা শোচনীয় ছিল, একটা পর্যায়ে মনে হচ্ছিলো যেন সি-গ্রেডের পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা কার্টুন ছবি দেখছি। শাকিব খানের শিডিউল পাওয়া সোনার হরিণের মত, এ কারণে ক্রোমার দ্বারস্থ হতে হয়-এমন অভিযোগ প্রায়শ:ই করেন অনেক নির্মাতা। কিন্তু এ ছবিতে অন্যান্য অভিনয়শিল্পীদের দিয়ে ক্রোমায় কাজ করাবার যৌক্তিকতা কতটুকু ছিল? বিমানবন্দরের রানওয়ে’তে নায়িকা শবনম বুবলির প্রথম দৃশ্য কিংবা বিমান উড়ে যাবার দৃশ্য-এসব দৃশ্য সরাসরি রানওয়েতে গিয়ে ধারণ করা কি একজন চলচ্চিত্র নির্মাতার জন্য খুব কঠিন কাজ ছিল?

আজকাল টিভি নাটকেও তো বিমানবন্দরে/ রানওয়েতে/ ককপিটে এমনকি জ্যন্ত বিমানের ভেতরেও অনেক দৃশ্য শৈল্পিক ও বাস্তবিকভাবে ধারণ করা হয় (ব্যাচ ২৭ সিরিজ, এয়ার বেন্ডার ইত্যাদি)। অথচ বিশাল বাজেটের চলচ্চিত্রে এ ধরনের দৃশ্য নির্মাতারা আমাদের দেখাতে পারেন না। এটাকে কী বলবো? ঔদাসীনতা নাকি আন্তরিকতার দৈন্যতা? অবশ্য শুধু বিমানবন্দর নয়, এ ছবিতে ঘর-দোর-বারান্দার পাশে যখন তখন হেলিকপ্টার এসে হানা দেয়। শূণ্যে ঝুলতে থাকে। এই হেলিকপ্টারের ভেতরের আসনগুলো আবার মাইক্রোবাস থেকে কাট-কপি-পেস্ট করা। বদহজম হলেও এটিই সত্যি, হেলিকপ্টারের জানালা প্রায় সবসময়ই খোলা থাকে এবং বিএফডিসির আঙিনা এবং হেলিকপ্টারের উড্ডয়নস্থল প্রায় পাশাপাশি।

ইটের ভাটা হোক কিংবা বাড়ির বারান্দা সর্বত্র দুর্বল ক্রোমার জয়জয়কার। অন্তত এ দৃশ্যগুলো কতটা ভয়াবহ হতে পারে দেখবার জন্য হলেও সবার এই চলচ্চিত্রটি দেখা উচিত। প্রায়ই অনেক নির্মাতা বলেন, পাশের দেশের সঙ্গে আমাদের চলচ্চিত্রের তুলনা করলে হবে না। তাদের বাজেট আর আমাদের বাজেট এক নয়। যুক্তি মেনে নিয়েই বলছি, যদি আমাদের বাজেটেই চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হয়, নাটকে কী করে কম বাজেটে আধুনিকতা দেখানো সম্ভব হচ্ছে? আর যদি চলচ্চিত্রে একান্তই আমরা ওসব দৃশ্য দেখাতে সক্ষম না হই, প্রতিটি দৃশ্যকে দুর্বল ক্রোমার মাধ্যমে গলা টিপে হত্যা করার প্রয়োজনটা কী? ঐ দৃশ্যগুলো না রাখলে কিংবা যে গল্প আমাদের বাজেটের সঙ্গে মানিয়ে যাবে, সে গল্পে চলচ্চিত্র নির্মাণ করলে ক্ষতি কী?

আগেই বলেছি উত্তম আকাশের এই নতুন চলচ্চিত্রে প্লট কিংবা গল্প বলে আসলে কিছু নেই। কাহিনীকার কিংবা চিত্রনাট্যকার যখন যা মনে করেছেন, গলধকরণ করিয়েছেন দর্শকদের। এ ছবিতে কাজী হায়াৎ কিংবা সাদেক বাচ্চুর পরিবার চট্টগ্রাম এবং নোয়াখালীর ভাষায় কথা বলতেই পারেন। কিন্তু গণহারে পুরো দেশবাসীর এই দুটি ভাষাকে ‘জাতীয় ভাষা’ হিসেবে মেনে নেয়ার যৌক্তিকতা কতটুকু? ওমর সানী তো এই দুই পরিবারের সদস্য নন। তাকে কেন চাটগাইয়া ভাষা বলতে হবে? বুবলির প্রেমিককেও কেন নোয়াখালীর ভাষা বলতে হবে? মাদক ব্যবসায়ী বড়দা মিঠু থেকে পুলিশ অফিসার সবাই মাতৃভাষা হিসেবে নোয়াখালীর ভাষাকে কেন রপ্ত করে নিয়েছেন? তাও সান্ত্বনা ছিল সবাই বাংলাদেশের বাংলা ভাষায় কথা বলেছেন। কিন্তু ছবিতে আরেকটি ‘ক্যারিকেচার’ আছেন, যিনি বাংলার ধারে কাছেও ঘেঁষেননি। শুরু থেকে শেষ-পুরোটা সময় হিন্দিতে ‘বাত’ (কথা) করেছেন। যুক্তিটা কী? বড্ড জানতে ইচ্ছে করছে।

অবশ্য যুক্তির দরজায় কড়া নাড়লে প্রায় প্রতিটি দৃশ্যকেই অভিযুক্ত করতে হবে। বুবলির চরিত্র আসলে কী? তিনি কী মডেল? নাকি জনপ্রিয় কোনো মুখ? যদি তারকা না হন, শাকিব খান কী করে ইন্টারনেট প্রবেশ করা মাত্রই আবিষ্কার করলেন বুবলির উচ্চতা ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি, শরীরের ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিক ৩৬-২৪-৩৬? শুধু কী তাই? বুবলির ফোন নাম্বারও প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে ইন্টারনেটে, সে নাম্বারে নায়ক কল করলে বুবলি একবার রিং হবার পরই উত্তর দেন এবং পরিচয় না থাকার পরও সঙ্গে সঙ্গে শাকিব খানের ঠিক করা জায়গায় দেখা করতে সম্মত হন। বিষয়গুলো ভয়াবহ ঠেকছিল। কিছুটা ‘থ্রিল’ অনুভূতি হচ্ছিল। এজন্যই হয়তো রসিক (!) আবহ সংগীত রচয়িতা এ দৃশ্যে মার্ক স্নো’র বিখ্যাত ‘এক্স ফাইল’ সিরিজের সুর হুবুহু চুরি করে বসিয়ে দিয়েছেন। বসাতেই হবে। কারণ এত খরুচে প্রযোজকের ছবিতে নায়ক-নায়িকার দেখা হবার দৃশ্যে নায়িকার প্রিয় খাবার পিৎজা পরিবেশনের নামে যদি ৭০-৮০ টাকার নিম্নমানের পিৎজা পরিবেশন করা হয়, ভীতিকর পরিস্থিতি তো হবেই। প্রোডাকশন ডিজাইন পুরো ছবিতেই সস্তার ওপর কাজ সেরেছে।

নায়িকা অনেক দৃশ্যেই নায়কের সাথে ‘তুমি-আপনি’ সম্বোধনের গোলযোগ বাধিয়ে ফেলেছেন। ওসব খেয়াল করারও কেউ ছিল না ছবিতে। বড় দা মিঠুর ফোন থেকে মৌসুমী শাকিব খানকে ফোন করার পর শাকিব খান কেন ও প্রান্তে বড়দা মিঠুকে ‘আফা’ বলে সম্বোধন করেন সেটিও মাথার ওপর দিয়ে গেছে। বুবলি বিদেশ থেকে ফিরে এসে বেশ কিছুদিন থাকবার পরও শাকিব খান যে ‘ভাবী’ মৌসুমীর আপন ছোট ভাই জানতে পারেন না। কেন?

যাদু আজাদ বুবলির ড্রাইভার হবার পরও শেষ দৃশ্যে মারপিটে অংশ নেন। কেন? তার ক্ষোভ কোথায়? শেষ ক্লাইমেক্সে মায়ের একটি সংলাপ দুইবার ব্যবহৃত হয়। কেন? সম্পাদক কি ছুটিতে গিয়েছিলেন? দুই বাবা এই দৃশ্যে পুতুলের পুচ্ছদেশ নিয়ে এত অশ্লীলভাবে হাতাহাতি করেন। কেন? মূল অপরাধ বড়দা মিঠু করলেও গ্রেফতার হন কাজী হায়াৎ ও সাদেক বাচ্চু। তাও মেনে নিলাম। কিন্তু তারা হাজতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে না করতেই শাকিব খান ও বুবলির ভেতর নিজ নিজ বাবার জন্য নূন্যতম আবেগের ছিটেফোঁটা দেখা যায়নি, উল্টো তারা প্রেমের হিসাব নিকাশ কষতে ব্যস্ত হয়ে যান। কেন?

বিধাতার কাছে প্রশ্ন, এসব ‘কেন’র উত্তর কার কাছে পাওয়া যাবে? ‘নির্মল বিনোদন’-এর নামে পরিচালক উত্তম আকাশ আর কতদিন আমাদের ধোকা দিয়ে যাবেন? যুক্তিবাদী দর্শকদের বাদই দিলাম, কিন্তু মেহনতি শ্রেণী কিংবা নিম্ন আয়ের দর্শকরাও যে প্রেক্ষাগৃহে এতটুকু বিনোদনের আশায় গরমের মধ্যে ঘামতে ঘামতে রীতিমত সংগ্রাম করে ছবিটি দেখেছেন এবং প্রেক্ষাগৃহ ছাড়বার সময় ছবি নিয়ে, আপনাদের নিয়ে ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছেন-আপনি কি তা জানেন? ‘চিটাগাংইয়া পোয়া নোয়াখাইল্লা মাইয়া’ কমেডি ছবি? নাকি রোমান্টিক? নাকি সামাজিক অ্যাকশন? কোন ধারায় আপনি ফেলতে চান? আপনি নিজে কি তা জানেন?

প্রযোজক শাপলা মিডিয়ার চলচ্চিত্রে নিয়মিত অর্থলগ্নীকে স্বাগত জানাই। কিন্তু এত টাকা লগ্নী করছেন, একটি দুর্দান্ত পান্ডুলিপি ও আধুনিক নির্মাণের পেছনে খরচ করতে এত কার্পণ্য কেন?

‘চিটাগাংইয়া পোয়া নোয়াখাইল্লা মাইয়া’ ছবিতে অবশ্য সংগীতের পেছনে প্রযোজক যত্ন দিয়েছেন। ছবিতে গান রয়েছে চারটি। দুটি গানে ভারতীয় শিল্পীরা সুর-সংগীত ও কণ্ঠ দিলেও এ ছবির প্রারম্ভে ক্রেডিট লাইনে শুধুমাত্র রাফাত ও ঐশীর নামই শিল্পী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। রাফাতের সংগীত পরিচালনায়, রাফাত-ঐশীর গাওয়া ও সুদীপ কুমার দীপের লেখা ছবির শিরোনাম গানটির লোকেশন গানের সঙ্গে বেমানান হলেও গানটি পর্দায় শুনতে লেগেছে বেশ। বেশ মজা করেই শাকিব খান ও বুবলি গানে পারফর্ম করেছেন। সঠিক সময়ে গানটির উপস্থাপন হবার কারণে দর্শকও হাত তালি ও শিস দিয়ে বিনোদিত হয়েছেন।

যদিও ‘গোলাপী গোলাপী’ গানটি দেখতে ভালো লাগলেও শুনতে ভালো লাগেনি। ‘সেলফি’ নিয়ে গান আর কত? কনসেপ্টটি বেশ পুরনো হয়ে গেছে। ২০১৫ সালে বলিউডে ‘বাজরাঙ্গি ভাইজান’ ছবিতে সালমান খান এবং ওপার বাংলায় জীত ‘অভিমান’ ছবিতে ‘সেলফি’ নিয়ে গান করেছেন। স্বয়ং শাকিব খান একই বছর ‘রাজা বাবু’ ছবিতে ‘চল তুলি সেলফি’ নামে একটি গান করেছিলেন। পশ্চিমে দ্য চেইনস্মোকার এবং আমাদের এখানে কনা, প্রীতম হাসানসহ আরো অনেকেই সেলফি নিয়ে বহু আগে গান করেছেন। অপ্রাসঙ্গিকভাবে ‘চিপোনোমা’ ছবিতে ‘সেলফি’ নিয়ে গান করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তাছাড়া আকাশ সেনেরই ‘বিজলী’ ছবির ‘পার্টি পার্টি’ গানের সঙ্গে ‘গোলাপী গোলাপী’ গানের মিল খুঁজে পাওয়াটাও দর্শক-শ্রোতার জন্য আরেকটি বিরক্তির বিষয় ছিল। আকাশ সেন বেশ কিছু গানে অতীতে আমাদের মুগ্ধ করেছেন, সত্যি। তবে প্রায় সব ছবিতে এখন নির্মাতারা তার গান কেন রাখতে চান-বিষয়টি স্পষ্ট নয়।

এ ছবিতে আকাশ সেনের সুর, সংগীত ও কণ্ঠে আরেকটি গানও রয়েছে। রবিউল ইসলাম জীবনের লেখা সে গানের কথা ‘কেন আজকাল’। এ গানটি শুনতে বেশ লাগলেও আকাশ সেনের অন্যান্য গানের মতই লেগেছে। কোনো নতুনত্ব নেই। কাহিনীতে এই গানটির সংযুক্তিও অসময়ে। তাছাড়া এ গানে প্রতিটি দৃশ্যে নায়িকার সঙ্গে মিল রেখে নায়ককে কেন ওড়না পড়তে হবে? একটি দৃশ্য হলে মানা যেতো, প্রতিটি দৃশ্যে বিশেষ করে দ্বিতীয় অন্তরায় আকাশী রংয়ের শার্ট, ছাই রংয়ের টিশার্ট, নীল জিন্স, সাদা লোফারের সাথে হলুদ ও টিয়া রংয়ের ‘ম্যাচিং’ ওড়না পরিধান বাহুল্যই মনে হয়েছে। সব মিলিয়ে গানটি দেখতে ভালো লাগলেও পর্দায় কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। নায়িকা তানহা মৌমাছির আইটেম গান ‘সুপার হিরোইন’ ছিল আম জনতার জন্য। তাল-লয়ের কোনো বালাই ছিল না গানে। সুতরাং এ গানটিও কোনোভাবে আবেদন তৈরি করতে পারেনি।

তবে সব আঁধারের বিপরীতে এ ছবির আলোকিত দিক হলো মূল শিল্পীদের অভিনয়। এর আগে শাকিব খানকে ঢাকাইয়া ভাষায় সংলাপ বলতে আমরা দেখেছি। তবে ‘চিটাগাংইয়া পোয়া’র চরিত্রে তিনি যে এভাবে চমকে দেবেন, প্রত্যাশা করিনি। অসাধারণভাবে চট্টগ্রামের ভাষা রপ্ত করেছেন তিনি। ছবি জুড়ে তার পরিপূর্ণ বিস্তার না থাকলেও শাকিব খান যখনই পর্দায় এসেছেন, দর্শক নড়েচড়ে বসেছেন। বিশেষ করে ছবিতে তার আগমনের প্রথম দৃশ্যে দর্শকের শিস ও তালির শব্দে সংলাপই শোনা যায়নি। শাকিব খান চাইলে অনেক বিভাগে পরিবর্তন আনতে পারেন, সে বিশ্বাস রাখি। পরবর্তীতে শাকিব খান কোনো চলচ্চিত্রে চুক্তিবদ্ধ হবার আগে পরিচালকের ট্র্যাক রেকর্ড না দেখে পান্ডুলিপি দেখবেন, যাচাই বাছাই করবেন, অতঃপর সম্মতি জানাবেন-এমন আশা তো আমরা করতেই পারি।

অহংকার, সুপার হিরো ছবির মত ‘চিপোনোমা’ ছবিতেও বুবলি শাকিব খানের সমপর্যায়ের কিংবা কিছু ক্ষেত্রে বেশি অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছেন এবং বলতে দ্বিধা নেই ‘নোয়াখাইল্লা মাইয়া’ চরিত্রে বুবলি সফলও হয়েছেন। নোয়াখালীর মেয়ে বলেই হয়তো বুবলি পর্দায় ছিলেন ভীষণ সাবলীল। এ ছবিতে প্রকৃত অর্থে ‘পাঞ্চ লাইন’ যুক্ত সংলাপ পেয়েছেন বুবলি-ই। অহংকার-এর পর আবারো বুবলি প্রমাণ করেছেন, সুযোগ পেলে নিজের মেধা তুলে ধরতে সক্ষম তিনি।

তবে শাকিব খান-বুবলি জুটি নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমার খেদ আছে। সারা বিশ্বে একটা জুটি যত জনপ্রিয়ই হোক এতটা নিয়মিতভাবে পর্দায় এলে দর্শকের ‘একঘেয়েমি’র শিকার হন। এক ঈদে একসঙ্গে বসগিরি, শ্যুটার, অন্য ঈদে একসঙ্গে অহংকার, রংবাজ, এবার একসঙ্গে সুপার হিরো ও চিটাগাংইয়া পোয়া নোয়াখাইল্লা মাইয়া-স্বাভাবিকভাবেই দর্শকের একঘেয়েমি লাগতে পারে। তাদের রুচি পরিবর্তনের সুযোগ দেয়া দরকার।

সালমান শাহ-শাবনূর কিংবা সালমান শাহ-মৌসুমী জুটিগুলোও কখনো এক ঈদে কিংবা একই দিন একাধিক ছবি নিয়ে দর্শকের সামনে হাজির হতেন না। একটা সময় শাকিব খান-অপু বিশ্বাস জুটি যেমন একঘেয়েমির শিকার হয়েছিলেন, শাকিব খান-বুবলি জুটি অল্প সময়ে সে পথেই হাঁটছে। অথচ সঠিকভাবে ব্যবহার ও পরিচর্যা করা হলে এ জুটিরও যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। নিজেদের জনপ্রিয়তা রক্ষার্থেই নিজেদের নিয়ে নিরীক্ষা করার ব্যাপারে শাকিব খান-বুবলিকে এবং নির্মাতাদের ভেবে দেখবার অনুরোধ জানালাম।

‘চিটাগাংইয়া পোয়া নোয়াখাইল্লা মাইয়া’ ছবির আরেকটি বড় চমক চিত্রনায়িকা মৌসুমী। ‘বৃষ্টি’ চরিত্রে মৌসুমীর অভিনয় দর্শকদের রীতিমত বিস্মিত করেছে। খুলনার মেয়ে হয়েও চাটগাইয়া ভাষায় এতটা দখল! অসাধারণ ছিল মৌসুমীর অভিনয়, বাচনভঙ্গি, সাজ ও পোশাক। শুধুমাত্র ডিজে সোহেলকে তার স্বামীর চরিত্রে বেমানান মনে হয়েছে।

ওমর সানী এ ছবিতে ভিন্ন ধরনের একটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন। নায়িকা মৌসুমীর সঙ্গে তার বেশ কিছু মজার দৃশ্য দেখতে চেয়েছিলাম। পাইনি। মৌসুমীর মত ওমর সানী চাটগাইয়া ভাষা অতটা আপন করে নিতে পারেননি। তবে পর্দায় তার সরল ব্যক্তিত্ব উপভোগ্য ছিল। বিশেষ করে শেষ ক্লাইমেক্সে তার নায়কোচিত আগমনে প্রতিটি দর্শক সজোরে করতালি দিয়েছেন।

এ ছবির অন্যতম বিরক্তিকর দিক ডিজে সোহেলের অভিনয়। বরাবরের মত এ ছবিতেও তিনি ভুলভাল উচ্চারণে ইংরেজিতে সংলাপ বলবার চেষ্টা করেছেন। বিষয়টি অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। তিনি এবার কখনো নোয়াখালীর ভাষা বলেছেন, কখনো ইংরেজিতে। সব মিলিয়ে জগাখিচুড়ি অবস্থা।

কাজী হায়াৎ সে তুলনায় কম সুযোগ পেয়েছেন। আর এটি ছিল দর্শকের জন্য আশীর্বাদ। কারণ কাজী হায়াৎ যতটুকু সময় চাটগাইয়া ভাষা বলেছেন, রীতিমত অত্যাচার করেছেন। একজন নামজাদা পরিচালক কেন একের পর এক ছবিতে চলচ্চিত্রকে যাত্রাপালা ভেবে দর্শকের বিরক্তির কারণ হচ্ছেন, প্রশ্ন থেকেই যায়। সাদেক বাচ্চুও এ ছবিতে নোয়াখালীর ভাষা বলতে গিয়ে প্রায়শ:ই গুলিয়ে ফেলেছেন। তার ‘ওভার দ্য টপ’ উচ্চকিত অভিনয় ছিলেন মস্তিষ্কের বেদনা বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট।

বড় দা মিঠু, রেবেকা, শাহীন, শিমু, ববি, বাদল, যাদু আজাদ এবং অতিথি চরিত্রে উত্তম আকাশ পর্দায় কোনো উত্তাপ ছড়াতে পারেননি। রেবেকা এবারের ঈদের ৩টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। অথচ উল্লেখ করার মত কোনো চরিত্রেই অভিনয় করার সুযোগ পাননি। বিষয়গুলো ভাবনার উদ্রেক করে।

এ ছবির কারিগরি দিক নিয়েও বলবার কিছু নেই। আমাদের দেশে রেজি অ্যাওয়ার্ড (হলিউডে বাজে ছবির জন্য দেয়া হয়) থাকলে এ ছবির কাহিনীকার, চিত্রনাট্যকার, সংলাপ রচয়িতা, পরিচালক এবং বিশেষ করে সম্পাদক অনায়াসে পুরস্কারগুলো পেতে পারতেন। কারণ ছবির শেষ দৃশ্যে শাকিব খান একটি সংলাপ মনে করিয়ে দেন ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’। সত্যিই ঈদের ছবি নির্মাণের নামে অযথাই এ ছবির নির্মাতা এবং অন্যরা লোভ করেছিলেন। যে পাপের ভাগীদার হয়েছি আমরা দর্শকরা, ২০১৮ সালে এসে বড় পর্দায় চলচ্চিত্রের নামে ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য দুর্বল বাংলা কার্টুন’ দেখতে হয়েছে! এ কারণেই হয়তো প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে রাস্তায় আলো-বাতাসের দেখা পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি! জীবন ফিরে পেয়েছি! বাড়িতে ফিরছিলাম আর অস্ফুটস্বরে পরিচালকের উদ্দেশ্যে বলছিলাম, ‘ইবা অন্নে কি কইরলেন, উত্তম আকাশ! অন্নে অ্যা’র জীবনডা ফুরা হ্যাতা হ্যাতা কইরি দিয়ুন!’

*রিভিউটির সংক্ষিপ্ত সংস্করণ সমকাল ২৮ জুন সংখ্যায় প্রকাশিত

 


মন্তব্য করুন