Select Page

জাওয়ানের চেয়ে কাজী হায়াতের ঐসব সিনেমার জোর অনেক বেশি

জাওয়ানের চেয়ে কাজী হায়াতের ঐসব সিনেমার জোর অনেক বেশি

“যে মশার কয়েলের আয়ু মাত্র ৫ ঘন্টা, সেই কয়েল কেনার আগে আপনি শত শত প্রশ্ন করেন।

কয়েল ভালো হবে তো?

ধোঁয়া কম হবে তো?

মশা মরবে তো?

তাহলে যে সরকারকে আপনি ৫ বছরের জন্য নির্বাচন করেন, তাকে কেন প্রশ্ন করেন না? তার বেলায় কেন আপনি চুপ থাকেন? আপনি কেন তাকে প্রশ্ন করেন না, আপনার কর্মসংস্থানের জন্য সরকার কী করবে? আপনার ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য কী করবে? আপনি অসুস্থ হলে আপনার ট্রিটমেন্টের জন্য কী করবে? দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কী করবে আপনার নির্বাচিত সরকার?

প্রশ্ন করুন, এটা আপনার অধিকার। আপনার ভোট আপনার সবচেয়ে বড় শক্তি”

জাওয়ান সিনেমায় শাহরুখ খান যখন সরাসরি দর্শকের দিকে তাকিয়ে (সিনেমার ভাষায় বললে ফোর্থ ওয়াল ব্রেকিং) বলেন তখন কিছুটা হলেও অবাক হই বৈকি!

অন দ্য ফেস এরকম রাজনৈতিক বক্তব্য শাহরুখ খান আগে তার কোন সিনেমায় দিয়েছেন বলে আমার মনে পড়ে না। তবে সিস্টেম রিলেটেড ইস্যু নিয়ে সিনেমা তিনি আগেও করেছেন। ফির ভি দিল হ্যায় হিন্দুস্তানীতে টিভি চ্যানেলের টিআরপি ব্যবসা, হে রাম সিনেমায় সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পের বিরুদ্ধে বলা, দিল সে সিনেমায় নর্থ ইস্টের লোকজনের ওপর সেনা সদস্যদের অত্যাচারের বর্ণনা- পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সুপারস্টারদের একজন হয়েও এই ধরনের সিনেমা ক্যারিয়ারের পিক টাইমে করা নি:সন্দেহে সাহসের ব্যাপার।

তবে জাওয়ান সিনেমার আড়াই মিনিটের স্পিচ যেন সাহসের এই মাত্রা পূর্বের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেকটাই ছাড়িয়েছে। গত ১০ বছরে বলিউড আর ইন্ডিয়ার বেশিরভাগ টিভি চ্যানেলের যে তোষামোদি আচরণ, সেখানে জাওয়ান অবশ্যই ব্যতিক্রম। ভোটপ্রদান ছাড়াও এক বছরে ১০,২৮১ জন কৃষকের আত্মহত্যা, সামরিক ও স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি, পরিবেশ দূষণ, ইভিএম ভোটিং-  এ ধরনের অনেক টপিকেও আলো ফেলে এই সিনেমা। কমন পিপলের সমস্যা নিয়ে কথা বলেছে দেখেই সম্ভবত এই সিনেমা নিয়ে এই মুহুর্তে এত উন্মাদনা!

যে সাহস জাওয়ান টিম দেখিয়েছে, সে সাহস কি এই মুহুর্তে আমরা আমাদের দেশীয় কনটেন্টে দেখাতে পারব? দেখালেও তা কি ছাড়পত্র পাবে? ওটিটিতেও কি পারব দেখাতে? পারলেও কয়জন? অথচ জাওয়ানে বলা এইসব সংলাপ আমাদের দেশের সাথেও খুবই রিলেটেবল।

এই সাহস আমাদের ছিল একসময়। নাইন্টিজ আর আর্লি টুইন্টিজে কাজী হায়াৎ তার সিনেমায় রাষ্ট্রের বিভিন্ন দুর্নীতির বিষয়ে যেভাবে আলাপ তুলেছেন, ২০২৩ এ এসে দেখলে কিছুটা বিস্ময় জাগে বৈকি! গল্পের দিক থেকে বললে জাওয়ানের চেয়েও কাজী হায়াতের ঐসব সিনেমায় গল্পের জোর আরও অনেক বেশি ছিল বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি।

কাজী হায়াতের কথা বাদ দেই, কাজী হায়াতের চেয়েও মেকিং এ পিছিয়ে থাকা পরিচালক নাদিম মাহমুদের কথা বলি। রুটি নামের একটি সিনেমা বানিয়েছিলেন তিনি যার কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন গণমানুষের নায়ক মান্না। এই সিনেমার একটি সংলাপ হচ্ছে,

‘স্বাধীনতা দিবস! বিজয় দিবস! এইডা দিয়া কি আম‌গো পেট ভরব?’

এরকম কোন সংলাপ আমরা বর্তমানে কোন কন্টেন্টে দেখাতে পারব কি? রাইটার লিখলেও সেটা সেন্সর পাবে কিনা? সেক্ষেত্রে প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে ক্রিয়েটিভিটির দিক থেকে আমরা কি আসলে আগাচ্ছি না পেছাচ্ছি?

খুব বেশি দূরের কথা না। ২০১৪ সালে মুক্তি পাওয়া সৈকত নাসির পরিচালিত ‘দেশা দ্য লিডার’ সিনেমায় জাওয়ান সিনেমার মতই নির্বাচন নিয়ে সংলাপ ছিল। ৪ মিনিটের সংলাপের এক মিনিট সেন্সর বোর্ডের কাঁচির নিচে পড়ে হারিয়ে যায়।

জাওয়ান ওভার দ্য টপ সিনেমা, অনেক বেশি সাউথের মাসালা ট্রিটমেন্ট, ১৬৯ মিনিটের সিনেমায় প্রায় ৭০০ বার স্লো মোশন আর ১০০ বার এন্ট্রি সিন(লিটারেলি না, ফাজলামো করে বলা সংখ্যা), অনেক লুপহোল, ডেপথে না গিয়ে অনেক দ্রুত গল্প বলে যাওয়া- এসবকিছুই সত্য।

তবে সবচেয়ে বড় সত্য হচ্ছে এই সিনেমার কেন্দ্রীয় ম্যাসেজ যা অনেকদিন ধরে বলিউডের মেইনস্ট্রিম সিনেমায় অনুপস্থিত( যদিও সাউথের বেশিরভাগ সিনেমায় এগুলো নিয়ে আলাপ তোলা খুবই সাধারণ ব্যাপার)। এই আলাপ তোলাটা ভারতের আসন্ন নির্বাচনের আগে তোলাটা ভীষণ জরুরি ছিল। এখানেই জাওয়ান আলাদা।

মিড নাইন্টিজে বলিউডের বেশিরভাগ আর্টিস্ট যখন আন্ডারওয়ার্ল্ডের হুমকি ধামকিতে ভয় পেত আর তাদের কথামতো তাদের পছন্দের প্রোডিউসারের সাথে কাজ করতো; তখন একমাত্র শাহরুখ খান তাদের কথায় তাল মেলান নাই। নিজের যাদেরকে পছন্দ তাদের সাথেই কাজ করে গেছেন। কুখ্যাত ডন আবু সালেমকে তিনি ফোনে সরাসরিই বলেছেন,

‘গুলি করতে চাইলে গুলি করে দেন, সমস্যা নাই। আমি আমার পছন্দের লোকদের সাথেই কাজ করে যাব।

আমি যেহেতু আপনাদের বলে দেই না, কাকে গুলি করবেন আর কাকে করবেন না; সেক্ষেত্রে আমাকেও বলতে আসবেন না কার সাথে সিনেমা করব আর কার সাথে না’

নাইন্টিজের সেই ঘাড়ত্যাড়া শাহরুখ খান যে ২০২৩ এ এসেও চেঞ্জ হন নাই, সেজন্য তার ফ্যান হিসেবে আমি গর্ববোধ করি।

পুনশ্চঃ ১-

যুবক শাহরুখের চেয়ে বুড়ো শাহরুখকেই আমার বেশি পছন্দ হয়েছে, জাওয়ান দেখার পর আমার মত বেশিরভাগ এই কথাই বলবেন। বিক্রম রাঠোর তার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা একটি ক্যারেক্টর হয়ে থাকবে।

পুনশ্চঃ ২- জাওয়ানের ডায়লগ লিখেছেন সুমিত আরোরা। এর আগে তিনি ফ্যামিলি ম্যান, গান্স এন্ড গুলাবস, ৮৩, স্ত্রী আর এই বছরের অন্যতম সেরা ওয়েবসিরিজ ‘দাহাড়’ এর সংলাপও লিখেছেন। শাহরুখের মুখে শোনা সাহসী বুলির মূল ক্রেডিট এই মানুষটার।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

অভিনেতা, শিক্ষক, লেখক ও উদ্যোক্তা

মন্তব্য করুন