‘জাওয়ান’ দেখে হতাশ দীপংকর দীপন
বলিউডের শাহরুখ খান এখন বাংলাদেশের সিনেমা হলে সহজলভ্য। তার ‘জাওয়ান’-এর দাপটে কোনঠাসা হয়ে পড়েছে বাংলাদেশী সিনেমা। যার অন্যতম ভুক্তভোগী দীপংকর দীপন ‘অন্তর্জাল’।
তবে দীপন আমদানি বিরোধী নয়। প্রায়শ হিন্দি সিনেমার প্রতি তার মুগ্ধতা প্রকাশ করেন। তবে ‘জাওয়ান’ দেখে এতটাই হতাশ হয়েছেন যে দুই-দুইবার হল থেকে বের হয়ে যেতে চেয়েছেন।
ইন্ডিয়ার রাজনীতি ও সরকার ব্যবস্থার কালো দিক তুলে ধরা ‘জাওয়ান’ বিশ্বজুড়ে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। শুধু বাংলাদেশের মাল্টিপ্লেক্সেই বিক্রি হয়েছে ১২ কোটিও বেশি টাকার টিকিট।
সেই ‘জাওয়ান’ দেখার অভিজ্ঞতা জানিয়ে গতকাল মঙ্গলবার (১০ অক্টোবর) নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে একটি পোস্ট করেন দীপন।
তিনি লিখেছেন, ‘জাওয়ান দেখলাম আজ। জাওয়ান দেখে আমি হতাশ। দুবার বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলাম, মানুষ কেন এত দেখছে সেটা দেখার জন্য শেষ অব্দি ছিলাম। বলবেন, মেইনস্ট্রিম বাণিজ্যিক ছবি–এমনই তো হবে। না ভাই, লোকেশ বা রাজামৌলি এর চেয়ে অনেক ভালো সিনেমা বানায়। তারা তো বাণিজ্যিক ছবিই বানায়।’
নির্মাতা কিছু সিনেমার উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘বিক্রম ভেদা, রাত সাসান, কানতারা, চার্লি, দৃশ্যম, পুষ্পা, বিশ্বরুপম আরও কত কি। সাউথেরই অনেক ভালো সিনেমা। আর মালয়ালম ইন্ডাস্ট্রি তো সেরা। তারা একের পর এক মাস্টারপিস বানিয়ে চলেছে।’
দীপংকর দীপনের ভাষ্য, ‘জেলার দেখেও হতাশ হয়েছিলাম। তামিলে তা-ই হয়, ওটা ওদের কালচার–চলুক। কিন্তু খোদ হিন্দি সিনেমাকে পেছনে টানতে শুরু করেছে তামিল সিনেমা। অথচ হিন্দি ভাষাতেই ওএমজি, ভিকি ডোনার, কাভি আলবিদা না ক্যাহনা, থ্রি ইডিয়টস, পিকে, লাগে রাহো মুন্না ভাই, দঙ্গল, সিক্রেট সুপারস্টার, পদ্মাবত, আন্ধাধুন, বাজরাঙ্গি ভাইজান, হিন্দি মিডিয়াম ইত্যাদি সিনেমা হয়েছে, তা ভীষণভাবে ব্যবসাসফল হয়েছিল। সেখানে এখন সবচেয়ে ব্যবসাসফল সিনেমা জওয়ান। এটা আমার কাছে খুব হতাশাজনক। মিনিংলেস সিনেমা জওয়ান, গরিবের ইমোশন বেচে হাজার কোটি কামিয়ে নেয়া–এখান থেকে ৫০০ কোটি কৃষকের ফান্ডে দিয়ে দাও–তাহলে বুঝব। আমজনতার ইমোশন দিয়ে ধনীদের কাছে পয়সা কামিয়ে নেয়া। আমার তো হালের তু ঝুটি ম্যায় মাক্কারও ভালো লেগেছে। ওটারও একটা খুব ভালো ইমপ্যাক্ট আছে। পশ্চিমবঙ্গের অনেক ভালো ছবি চাপা পড়ে গেল এই জীবনের অধিক অবাস্তবতার জোয়ারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাণিজ্যিক সিনেমা, কিন্তু মিনিংফুল–যা সাব-কন্টিনেন্টের সিনেমা জোর। আসলে আমার মনে হয়, কোভিডের পর মানুষের মনে একটা আজব মিথস্ক্রিয়া ঘটেছে। মানুষের এখন গম্ভীর বা থট প্রভোকিং কিছু ভালো লাগে না। তারা সিনেমা হলে ধুমধাম সাউন্ড, চোখধাঁধানো অ্যাকশন, লার্জার দ্যান লাইফ সিনেমা দেখতে চায়। মারভেল-ডিসির মতো। অনেকটা ঝাল চানাচুর মাখা খাবারের মতো। খেলাম, ভালো লাগে, জিহ্বায় সুড়সুড়ি লাগে। খাবার পরে শেষ, মুখ ধুয়ে ফেললাম, ভুলে গেলাম।’
শাহরুখ খানকে নিয়ে এ নির্মাতা বলেন, ‘প্রিয় শাহরুখ খান এতদিন পর হিট হলো, তা-ও আবার এই জাওয়ান দিয়ে। এখন ডানকি ভরসা। শাহরুখ খান তার জীবনে কিছু অবাস্তব সিনেমা করেছে। জাওয়ান বোধহয় সবটাকে ছাড়িয়ে গেছে। পাঠান আমি দেখিনি। অথচ স্বদেশ, চাকদে ইন্ডিয়া, কাভি আলভিদা না ক্যাহনা, ডিয়ার জিন্দেগি, মাই নেম ইজ খান, ভীর জারা, দিলসে, বাদশা, জো জিতা উহি সিকান্দার ইত্যাদি। আমার প্রিয় শাহরুখ, কষ্ট তো লাগেই।’
এ সময় নির্মাতা ‘সুড়ঙ্গ’, ‘প্রিয়তমা’ সিনেমার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘জাওয়ানের চেয়ে হালের হাওয়া, পরান, প্রিয়তমা, সুড়ঙ্গ ভালো সিনেমা। ‘অন্তর্জাল’ও। বাংলাদেশের সিনেমা ঠিক পথে এগোচ্ছে। অনেক পিছে আছে কিন্তু আফটার কোভিড ভারতের হিট সিনেমাগুলোর মতো ইউটার্ন মারেনি।’
দীপংকর দীপন দর্শকদের উদ্দেশে বলেন, ‘প্রিয় দর্শক, আপনারা বাংলা সিনেমার সাথে ছিলেন থাকুন। আমরা মিনিংফুল কিছু বানিয়েই আপনাদের খুশি করব–অন্তত চেষ্টা করতে থাকব। বিশ্ব চলচ্চিত্র অন্তত বুসান-কান বাংলাদেশের সিনেমাকে গোনে। সাম্প্রতিক হিট হওয়া বাংলা সিনেমা দেখে আশা হয়, আমাদের মেইনস্ট্রিম সিনেমাকেও গুনবে। যেমন, তারা পাত্তা দেয় কোরিয়ান সিনেমাকে। আমরা শিশুর মতো ধীরে এগোচ্ছি, কিন্তু ঠিক পথেই এগোচ্ছি। জওয়ান আর অ্যাটলির পথ ধরে আমাদের আগানোর দরকার নেই। তাতে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি। লারে লাপ্পা এক সময় ফকফক্কা।’
তিনি আরও বলেন, ‘জাওয়ান তো দেখেছেন, অন্তর্জাল দেখুন। হিমেল, রাফী, আরও অনেক নির্মাতা, এদের ছবি দেখুন। আমাদের সিনেমা (বাংলা) দেখুন। একটা মিনিংফুল সিনেমার ধারা শুরু হচ্ছে, বহমান থাকুক। যেখানে গল্পের গরু গাছে উঠবে না। মাটিতেই থাকবে, যে মাটি বাংলাদেশের মাটি। গ্রামের মাটি, শহরের মাটি, বনের মাটি, সমুদ্রপাড়ের মাটি, মেট্রোপলিটন মাটি, পাহাড়ের মাটি। কিন্তু বাংলাদেশের মাটি।