
জাফর ইকবাল-ববিতার মাঝে প্রেম ছিল তবে প্রতিশ্রুতি ছিল না
‘ববিতার সঙ্গে আমার সম্পর্কও ভালো ছিল। ঠিক এটাকে প্রেম বলা যায় না। সত্যি বলতে কী ৩০ বছরেও ববিতাকে আমি চিনতে পারি না।’ এক সাক্ষাৎকারে ববিতা সম্পর্কে এমনটা বলেছিলেন সোহেল রানা। যেখান থেকে এ নায়িকার চরিত্রের রহস্যময় দিকটি উঠে আসে। অবশ্য ঢালিউডে যে কয়েকটি সম্পর্ক এখনো অতিচর্চিত তার একটি ববিতা-জাফর ইকবালকে ঘিরে। এ নিয়ে সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে প্রথম আলো ববিতা বলেও ছিলেন, প্রেমের সম্পর্ক থাকলেও দুজনে কখনোই বিয়ে নিয়ে ভাবেননি। কোনো ধরনের কমিটমেন্টে তাঁরা কখনোই ছিলেন না।
সম্ভবত ১৯৭৪ সালে মুক্তি পাওয়া সাইফুল ইসলাম কাশেম পরিচালিত ‘অন্তরালে’ জাফর ইকবাল ও ববিতা জুটির প্রথম সিনেমা। এরপর হারজিৎ, ফকির মজনু শাহ, সূর্যগ্রহণ, এক মুঠো ভাত, প্রেমিক, লায়লা আমার লায়লা ও অবুঝ হৃদয়সহ ৪০টি সিনেমায় কাজ করেন তারা।

ববিতার ভাষ্যে, ‘একেবারে অল্প বয়সে আমি আর ইকবাল একসঙ্গে ছবিতে অভিনয় করি। একটানা অনেক ছবিতে অভিনয় করেছি। সেই সময় আমার বয়স ছিল ১৫-১৬ বছর। ওই বয়সে কিশোর-কিশোরী মন, যা দেখি সবই ভালো লাগে—এ রকম অবস্থা। জাফর ইকবাল ছিল মোস্ট হ্যান্ডসাম বয়। খুব ভালো গান গাইত। এককথায় সুপার স্মার্ট যাকে বলে সেটাই ছিল সে। একই সঙ্গে খুব ভদ্রও। ওই সময় একসঙ্গে কাজ করতে ভালো লাগত। দর্শকেরাও আমাদের খুব পছন্দ করতে শুরু করল। পত্রপত্রিকাও আমাদের নিয়ে লেখালেখি করতে মজা পেত। আমরাও এসব বেশ এনজয় করতাম। একটা সময় সহকর্মী থেকে বন্ধুত্ব, বন্ধুত্ব থেকে প্রেম-ভালোবাসায় সম্পর্ক গড়ায়।’
নায়ক পরিচয়ে মূলত গায়ক হিসেবেই শোবিজে আবির্ভাব জাফর ইকবালের। ‘রোলিং স্টোন’ নামের একটি ব্যান্ডও ছিল তার। পরবর্তীতে তিনি সিনেমায় আত্মপ্রকাশ করেন প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে। ১৯৬৯ সালে ‘আপন পর’ সিনেমার মাধ্যমে নায়ক হিসেবে পর্দায় আসেন তিনি। জাফর ইকবালের বোন ছিলেন বিখ্যাত গায়িকা শাহনাজ রহমতুল্লায় ও ভাই আনোয়ার পারভেজ। জাফর ইকবালের গাওয়া বেশ কয়েকটি গান ক্লাসিকের মর্যাদাও পেয়েছে।
‘পিচ ঢালা পথ’ ছিল ব্যান্ড গড়ে তোলার পর জাফর ইকবালের প্রথম গাওয়া গান। ভাই আনোয়ার পারভেজের সুরে নায়করাজ রাজ্জাক অভিনীত ‘বদনাম’ ছবিতে প্রথম গান করেন ‘হয় যদি বদনাম হোক আরও/আমি তো এখন আর নই কারও’। প্রথম প্লেব্যাকেই ব্যাপক প্রশংসা কুড়ান এই অভিনেতা। এরপর সুরকার আলাউদ্দিন আলী তাঁকে দিয়ে অসংখ্য চলচ্চিত্রে কাজ করিয়েছিলেন। তাঁর জনপ্রিয় কিছু গানের মধ্যে ‘সুখে থেকো ও আমার নন্দিনী হয়ে কারও ঘরনি’, ‘তুমি আমার জীবন, আমি তোমার জীবন’, ‘হয় যদি বদনাম হোক আরও’ অন্যতম। নিজের কণ্ঠে ‘কেন তুমি কাঁদালে’ শিরোনামে একটি অডিও অ্যালবাম প্রকাশ করেন আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের যুগে ‘সুখে থাকো নন্দিনী’ গানটি গেয়ে দারুণ সাড়া ফেলেছিলেন। এরপর বাংলাদেশ টেলিভিশনের ২৫ বছর উদযাপন বিশেষ অনুষ্ঠানে গেয়েছিলেন ‘এক হৃদয়হীনার কাছে হৃদয়ের দাম কি আছে’ গানটি। পরে শিল্পী রফিকুল আলমও গেয়েছিলেন।

শাহনাজ রহমতুল্লাহ ও জাফর ইকবাল
আলাউদ্দিন আলীর সুর ও সংগীতে এবং মনিরুজ্জামান মনিরের লেখা ‘সুখে থাকো ও আমার নন্দিনী, হয়ে কারও ঘরণী’র প্রেক্ষাপট নিয়ে আজো কথা হয়। কারও কারও মতে, ববিতার সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার কারণে গানটি গেয়েছিলেন এই নায়ক। এমন প্রশ্ন ববিতাকেও অনেকবার শুনতে হয়েছিল।
‘দেশ স্বাধীনের পর আমরা কাজ করতে থাকি। একটানা অনেক ছবিতে অভিনয় করতে লাগলাম। কাজ করতে ভালো লাগত, দুজনের দুজনকেও ভালো লেগেছিল। হয় কি, অল্প বয়সের এমন ভালো লাগা কিন্তু সবারই হয়। আমি মোটেও অস্বীকার করছি না, আমাদের দুজনেরই দুজনের প্রতি ভালোবাসা ছিল না। তবে তা মোটেও একতরফা ছিল না। এটাও ঠিক, আমরা কিন্তু কোনো দিন বিয়েশাদি করব, এমন চিন্তা করিনি। বন্ধুত্ব, ভালো লাগা, ভালোবাসা এসব ঠিক আছে। একটা সময় আমাদের দুজনের ভুল–বোঝাবুঝি তৈরি হয়। এরপর ইকবাল তার মতো ছবি করতে থাকে অন্য নায়িকার সঙ্গে, আমিও অন্য নায়কদের সঙ্গে অভিনয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। অভিমানও হয় আমাদের। ওই সময়টায় ইকবাল গেয়েছিল “সুখে থাকো ও আমার নন্দিনী, হয়ে কারও ঘরণী” গানটি। প্রকাশের পর গানটা সুপারহিট হয়। অনেকে ভেবেছিল, এটা আমাকে ভেবেই গেয়েছিল। কিন্তু বিষয়টা মোটেও এমন ছিল না। আমি ইকবালকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “সত্যি করে বলেন তো, এ গানটা আমাকে ভেবে গেয়েছেন আপনি?” তখন ইকবাল বলল, “বিশ্বাস করেন, মনিরুজ্জামান মনির ভাইয়ের লেখা গানটা আলাউদ্দিন আলী সুর করার পর আমাকে বললেন, তোমাকে দিয়েই গানটা গাওয়াব। তোমাকে দিয়ে গাওয়ালে মানুষ মনে করবে, এটা ববিতার জন্য গাইছ। এই হচ্ছে আসল কাহিনি।”’ বললেন ববিতা।
সাধারণ শুটিং অবসরে সমসাময়িক অন্য নায়ক-নায়িকারা আড্ডায় মেতে থাকলেও ববিতা-জাফর ইকবাল গানে গানে ব্যস্ত সময় পার করতেন। জানালেন, ইকবাল এমনিতে এলভিস প্রিসলির ভীষণ ভক্ত ছিল। প্রায়ই তাঁর গাওয়া গান গাইত।
সেই সময়টার কথা মনে করে ববিতা বললেন, ‘ইকবালের গাড়িতে সব সময় একটা গিটার থাকত। পথে যেতে যেতেও গিটার বাজিয়ে গাইত। আবার ইকবাল আর আমি কোনো আউটডোর শুটিংয়ে আছি। শুটিংয়ে সব আয়োজন চলছে। আমরা অপেক্ষা করছি। তখন আমাকে বলত, “আপনি গান গাইতে থাকেন আমি বাজাই।” এ রকম করতে করতে শিখতে শিখতে একটা সময় পুরো গানটা শিখে ফেলি। সেই গানটার কথা ছিল এ রকম, “ইট ইজ দ্য ইভিনিং অব দ্য ডে, আই সিট অ্যান্ড ওয়াচ দ্য চিলড্রেন প্লে”। মঞ্চে যখন আমরা গান গাইতাম, দর্শকেরা মনে মনে ভাবত, ববিতা-জাফরকে ইকবালকে ভালোই লাগে। গান গাইলে আরও খুব ভালো। হাততালি দিয়ে উৎসাহ দিত।’

ঢাকাই সিনেমার জাফর ইকবাল আশির দশকেই যে ফ্যাশন, স্টাইল দেখিয়েছেন, তা আজও অনেকের কাছে ভাবনার বাইরে। ববিতার মতে, সবকিছু মিলিয়ে ইকবাল ছিল সত্যিকারের হিরো। তিনি বললেন, ‘কিছু শিল্পীর অভিনয় খুব ভালো থাকে, কিছু অভিনয়শিল্পীর আবার অন্য গুণ থাকে কিন্তু ইকবালকে আমার সবকিছু মিলিয়ে ভালো লাগত। কমপ্লিট প্যাকেজ ছিল। অনেক গুণে গুণান্বিত। ওই সময় আমাদের বয়সও কম ছিল। শুটিং ও শুটিংয়ের বাইরে ইকবালের সঙ্গ ভালো লাগত; কারণ, গিটার বাজিয়ে গান শেখাত। এই গান শেখানোর বিষয়টি আমার বেশ ভালো লাগত। এমনটা আমার সঙ্গে অন্য কোনো নায়কের ঘটেনি।’
জাফর ইকবালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন সংগীতশিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ। এক স্মৃতিচারণায় প্রথম আলোকে কুমার বিশ্বজিৎ বলেন, ‘জাফর ইকবাল দারুণ স্মার্ট ছিলেন। শুধু পোশাকআশাকে না, ওর রুচিবোধ, ইন্টেলেকচুয়াল হাইট, ফ্যাশনসচেতনতা সবই ছিল নজরকাড়ার মতো। এই অঙ্গনে আর কারও মধ্যে এ রকম দেখিনি। আমি নিজেই দেখেছি তার বাসার ‘শু’ র্যাকে তিন শ রকমের জুতা। জুতা রাখার আলাদা একটা কর্নার ছিল। জুতার সঙ্গে মিল রেখে ড্রেস পরতেন। এখনকার কোনো নায়কের মধ্যেও এমন ফ্যাশনসচেতনতা আছে কি না, জানি না।’
সম্পর্ক নিয়ে প্রথম আলোর সাক্ষাৎকারে খুবই খোলাখুলি ছিলেন ববিতা। তিনি বললেন, ‘সবার সামনে আপনি বলতাম। অন্য সময় তুমি বলতাম। (হাসি)।’
তবে সব সম্পর্কের উত্থান-পতন থাকে। ববিতা-জাফর ইকবালের প্রতিশ্রুতিহীন ভালোবাসা তার বাইরে নয়। ববিতা বলেন, ‘আমাদের সম্পর্ক যে শেষ হয়ে গিয়েছিল, তা নয়। শেষের দিকে আমাদের একসঙ্গে ছবি করা কমে গেল। আমিও ভাবলাম ইকবালের সঙ্গে সব ছবি করা যাবে না। রাজ্জাক ভাই, ফারুক ভাইসহ অন্য শিল্পীদের সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। ইকবালও অন্য নায়িকাদের সঙ্গে কাজ শুরু করল। বন্ধুত্ব তো আর শেষ হয় না। আবারও বলছি, আমাদের প্রেম-ভালোবাসা ছিল ঠিকই, কিন্তু কোনো কমিটমেন্ট ছিল না।’
অনেকে বলে, আপনার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ভাঙার কারণে জাফর ইকবালের জীবনটা বিধ্বস্ত হয়ে ছিল—এমন প্রসঙ্গ উঠতেই ববিতা বললেন, ‘এটা ভুল কথা। আমরা কমিটমেন্টে থাকলে বিয়েই করতাম। আমরা কোনো দিন বিয়েটিয়ে নিয়ে ভাবিনি। আমাদের একটা সম্পর্ক ছিল। মানুষের বন্ধুত্ব হয়, ভালো লাগা হয়, প্রেম হয়—হলেই কি বিয়ে করতে হয়? রাজ কাপুর কি নার্গিসকে বিয়ে করেছিল? অমিতাভের সঙ্গে কি রেখার বিয়ে হয়েছিল? এটা এ রকমভাবে বলা যায় না। তবে আমাকে ইকবাল সব সময় ভীষণ শ্রদ্ধা করত। ভালোবাসার পাশাপাশি শ্রদ্ধাটা আমার বেশি লাগত। আমার আগেই কিন্তু ইকবালের বিয়ে হয়ে গেল। এরপর বাচ্চা হলো। ওদের স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদও হয়। দুজনের সংসারে খুব অশান্তি ছিল। এরপর আমারও বিয়ে হয়, আমার মতো করে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।

কোনো এক কারণে ভেঙে যায় জাফর ইকবাল ও ববিতার প্রেম। ওই সময় গুঞ্জন ছড়িয়েছিল যে ববিতার সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙার কারণে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যান জাফর ইকবাল, যা তাঁর পারিবারিক জীবনেও প্রভাব ফেলে। পরবর্তী সময়ে অগোছালো, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনসহ নানা কারণে ক্যানসারে আক্রান্ত হন এই নায়ক।
ববিতা বললেন, ‘একটা সময় আমি ইকবালের ওপর কিছুটা হতাশ হলাম। শুটিংয়ে সে অমনোযোগী হয়ে ওঠে। ওই সময়টায় কয়েকজন পরিচালক বলল, “আপনাদের দুজনকে ছবিতে নেব। ইকবাল আর আপনাকে গল্পের সঙ্গে দারুণ মানাবে। কিন্তু ইকবাল তো শুটিংয়ে অনেক দেরি করে আসে। এতে প্রযোজকের অনেক ক্ষতি হয়।” সত্যি সত্যি তখন ইকবাল খুব খামখেয়ালি জীবন যাপন করতে শুরু করে। তখন আমি তাদের বলি, “ঠিক আছে, আমি ইকবালকে বলব সে যেন সমস্যা না করে। শুটিংয়ে দেরি করে না আসে।” পরে দেখলাম জীবন নিয়ে সে আরও বেশি উদাসীন হয়ে পড়েছে। যত দূর মনে পড়ে, দুজন শেষ শুটিং করেছিলাম বাদল খন্দকারের একটা ছবির। সেবার অনেক দিন পর দেখা আমাদের। তখন তাঁকে খুব অন্য রকম দেখাচ্ছিল। অগোছালো। অসুস্থ মনে হচ্ছিল। জিজ্ঞেস করলাম, “আপনাকে এমন কেন দেখাচ্ছে? অসুস্থ নাকি?” ওই দিনের শুটিংয়ের দৃশ্যটাও ছিল এ রকম, সে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে, আমি চিকিৎসক। পরে জানতে পারি, ওই সময়টা সে সত্যি সত্যি অসুস্থ ছিল। ক্যানসার হয়েছে। সেবার দুদিন আমাদের শুটিং হয়। এরপর আর আমাদের শুটিং হয়নি। পরে শুনলাম, অসুস্থ হয়ে ইকবাল হাসপাতালে ভর্তি। আমি দেখতে যাব যাব করেও যাওয়া হলো না। এরপর একদিন শুনি, ইকবাল মারা গেছে। তারপর মরদেহ এফডিসিতে নিয়ে আসে। তখন গেলাম। সেখানেই শেষ দেখা।’
রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থানে সমাহিত হন জাফর ইকবাল। এ নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে ববিতার মতে। কয়েক বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘জাফর ইকবাল একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু তাকে আজিমপুরে সাধারণ কবরস্থানে সমাহিত করা হয়েছে। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাকে ভালো কোনখানে কবর দেওয়া যেত। কেন দেওয়া হয়নি জানি না। এই বিষয়গুলো নিয়ে মন খারাপ হয়। খুব মনে পড়ে তার কথা!’