Select Page

তীব্র তাপে জ্বলছে নিজেই হাওয়া

তীব্র তাপে জ্বলছে নিজেই হাওয়া

হাওয়া নামের একটা সিনেমা বের হইছে এই বছর। সিনেমার পরিচালক মেসবাউর রহমান সুমন। বাংলা সিনেমার ইতিহাসের এখনও পর্যন্ত সেরা সিনেমাগুলির একটা হইতেছে হাওয়া। হাওয়া নিয়া লেখার জন্য অনেকদিন ধইরাই হাত চুলকাইতে থাকলেও লেখা হইতেছিলো না। ছবিটা আবারও আরাম কইরা দেইখা নিয়া লিখবো – এই মনে কইরাও লিখতেছিলাম না।

জেলা শহরের খারাপ পরিবেশের হলে দেখার কারণে বার বার মনোযোগ কেটে গেছে। সিনেমা দেখার সময় ডিস্টার্ব মানে যে ভয়াবহ মানসিক নিপীড়ন এইটা জাইনা শুইনাই কি এরা এরকম করে! সে যা-ই হোক। তারপর মনে হইলো, সাত মণ ঘি-ও পুড়বে না, রাধাও নাচবে না। আবার কবে দেখা হবে! তার চেয়ে লিখেই ফেলি। সিনেমা নিয়া না লিখলেও সিনেমার গানটা এবং সিনেমা নিয়া আলোড়নটা সম্পর্কে তো লেখাই যায়।

সিনেমা দেখার সময় খারাপ অডিয়েন্স থাকলেও একটা মজা হইছিলো। সাদা সাদা কালা কালা গানটা যখন শুরু হয়, পুরা হল গলা মিলায়া গাইতে থাকে। গানটা আগেই রিলিজ এবং হিট। গান হিট করলেই সিনেমাও ব্যবসাসফল হবে এমন কোন কথা নাই। কিন্তু হাওয়া সবদিকেই সফল ছবি।

গানটা আমি ক্যামনে দেখলাম! কুরবানী ঈদের দিন সম্ভবত হাওয়ার গান ‘সাদা সাদা কালা কালা’ রিলিজ হয়। গানটা ইনবক্সে পাঠাইছিলেন এক বন্ধু। চালায়া দেখি আরও চেনা মুখ দেখা যায়। গানের ভিজুয়ালাইজেশন বেশ ইন্টারেস্টিং। ইট’স এ ম্যান’স ওয়ার্ল্ড ধরণের একটা ঘটনা। সাগরে ভাসন্ত দুইটা নৌকার দেখা হয়। বুঝা যায় তারা অনেকেই অনেকের পূর্ব পরিচিত অথবা মাঝি বা জেলেরা পেশাগতভাবেই পরস্পরের সঙ্গে আত্মিক যোগাযোগ বোধ করে, পূর্ব পরিচয়ের প্রয়োজন হয় না। তারা সবাই কাছাকাছি আসে, এটা সেটা বাজাইয়া তাল তোলে, মদ খায়, বিড়ি খায়, নাচে গায়।

মানুষের ইতিহাসে শিকার কবে থাইকা পুরুষের একচ্ছত্র হইয়া গেছে এটা কে বলবে? কিন্তু মাছ ধরা নৌকায় নারীর কোন স্থান নাই। ছোটবেলায় একটা গল্পে পড়ছিলাম, হাতি শিকার করতে যাওয়ার আগে নানা রকম নিয়ম কানুন পালন করতে হয়, এর মধ্যে একটা হইলো, নারীসঙ্গ করা যাবে না। কিন্তু দেখা যায় বড় নৌকাটায় একটা মেয়ে আছে, সে জানালা দিয়া নৃত্যরত পুরুষদের দেখতেছে, তার মুখে মৃদু হাসি। সে মজা পাইতেছে। একসঙ্গে এত পুরুষকে একসঙ্গে নাচগান করতে দেখলে যে কোন নারী মজা পাবে। সিনেমার পর্দায় দেইখাও আমি মজা পাইছি। বাস্তবে হইলে তো কথাই নাই। শাকরাইনে পুরান ঢাকায় গেলে পুরুষদের উদ্দাম নাচ দেখতে পাওয়া যায়, ঢাকাইয়া পোলারা দারুণ নাচে। এই গানটা দেখলে মনে হইতে পারে, সিনেমার তত্ত্ব মাইনা ডেলিবারেটলি একটা ফিমেল গেয হাজির করা হইছে।

পর্দার মধ্যে পুরুষ দৃশ্য আর নারী দর্শক। আজীবন ধইরা এর উল্টাটা হইয়া আসতেছে। নারী নাচে, নারী পুরুষ সবাই দেখে। এইখানে পুরুষ নাচে, হলের মধ্যে নিশ্চয়ই নারী পুরুষ ও অন্যান্যরা দেখে, কিন্তু একজন গোপন নারী দর্শক খোদ পর্দায় হাজির হয় ভয়ারিস্টিক প্লেজার নিয়া। একই সঙ্গে সে নিজেও দৃশ্য বটে।

শুরুতে যে বললাম, খারাপ পরিবেশে সিনেমা দেখার কথা। পরিবেশটা খারাপ কোন অর্থে? পর্দায় নায়িকাকে দেখানো মাত্র সুর করে চিৎকার, ওওওও- বা এরকম কিছু একটা। নারী দৃশ্য এবং পুরুষ দর্শক। এই ধারণাপ্রসুত এই চিৎকার। যদিও এই সিনেমার গানটা অন্তত উল্টা কথাই বলে। এই গানে নানা রকম পুরুষ শরীর দেখা যায়। হাওয়া ছবিতে ক্লাস রেপ্রেজেন্টশন নিয়াও আলাপ চোখে পড়লো। সত্য বটে, এই সব নানা রঙঢং, লুঙ্গি তুইলা নাচের ভঙ্গির শ্রমিক পুরুষ আমার ক্লাসের না।

বাস্তবে ট্রাকের ছাদে ঘুমাইতে থাকা আন্তঃজেলা শ্রমিক যাত্রীদের পেশল শরীর আমি কয়েক মুহূর্তের বেশি দেখি না। পর্দায় ঘামে ভেজা মদ্যপ পুরুষ শরীরগুলো আবেদনময়। বম্বের সিনেমায় যেমন দরিদ্র ওয়াটার ওয়াইফদের খুবই অ্যাসথেটিক, মাথা ঢাকা, মুখ দেখা যায় না, ঊর্ধ্বাঙ্গে কাঁচুলি, নিম্নাঙ্গে লেহেঙ্গা পরা মাথায় পিতলের কলসী নিয়ে চলতে দেখা যায়। প্রেমের আবহে দৃশ্যের মধ্যে যৌন আবেদন আনার জন্যই মুখহীন ওইসব শরীরকে পর্দায় হাজির থাকতে হয়।

গানটা সুপার ডুপার হিট করলেও, সিনেমাটা নিয়া শুরু থাইকাই কেমন জানি কনট্রোভারসি শুরু হইলো। একদল লোক বলতে শুরু করলো, হাওয়া কোন মৌলিক ছবি না। একটা কোরিয়ান সিনেমার নকল। যারা কোরিয়ান ছবিটাও দেখছে, তারা বললো, সমুদ্রের মধ্যে গল্প- এই ছাড়া আর তেমন কোন মিল নাই। তা সমুদ্রের মধ্যে গল্প নিয়া তো হাজারে বিজারে ফিল্ম থাকতে পারে! এটা কোন গ্রাউন্ড হইলো? এরপর জানলাম, নায়ক রাজ রাজ্জাক অভিনীত একটা বাংলা ছবি আছে, অভিযান। হাওয়া নাকি তারই নকল! ইউটিউব থাইকা অভিযান দেখলাম। পুরাটা দেখি নাই। তবে মিলের জায়গাটা পাওয়া গেলো। একটা জাহাজে সবাই পুরুষ আর একজন মাত্র নারী। এই হইলো মিল।

আমি আরও একটা মিল বাইর করলাম মনে মনে। হাওয়া গল্পে একটা নৌকার মধ্যে এক এক কইরা সবাই মইরা যাইতেছে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ইংরেজি সাহিত্যে আমাদের পাঠ্য ছিলো, দ্য রাইম অফ এনশিয়েন্ট মেরিনার অবলম্বনে একটা গল্প। এক মাঝি একটা পাখি মাইরা ফেলে তারপর অভিশাপ লাগে। একে একে সবাই মইরা যাইতে থাকে। খাওয়ার পানি শেষ হইয়া যায় – এই রকম। সেই হিসাবে হাওয়াকে এনশিয়েন্ট মেরিনারের নকলও বলা যায়।

হাওয়া ছবিতে পুরা দৃশ্যাবলীতে কোথাও গুলতি ছাড়া আর কোন নারী চরিত্র নাই। অনেকেই চড়া মেকআপের নিন্দা জানাইলেও এই কথা বলতেই হবে বেদের মেয়ে হিসাবে নাজিফা তুশিকে স্বাভাবিক মনে হইছে। বেদের মেয়েরা আরও অনেক সুন্দরী হয়। ধারালো চেহারা আর শক্তিমতী শরীর বেদের মেয়েদের বৈশিষ্ট্য। তারা ঘুইরা ঘুইরা হাঁইটা হাঁইটা অভ্যস্ত হইলেও তাদের এক একজনের গায়ের রঙ হয় দুধে আলতায়, রোদের তাপের চড়া প্রলেপও সেই দুধে আলতা রঙ ঢাকতে পারে না। ক্যামনে কে বলবে? একটা সিনেমায় একমাত্র নারী চরিত্র যার মুখে সংলাপ অনেক কম, প্রায় নাই বললেই চলে, শুধুমাত্র এক্সপ্রেশন দিয়া, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়া অভিনয় কইরা যাওয়া সহজ কথা না।

চরিত্রটা রহস্যময়ী কিন্তু তাকে সাদামাটাভাবে রাইখা রহস্যের আবরণ ঘন করা হইছে। শিল্প সাহিত্য নাটক সিনেমা এইসবে নারীই কেন সবসময় রহস্যময়ী? এই প্রশ্ন করা যাইতে পারে। নারীকে দেবী বা ডাইনি যা-ই বানানো হোক না কেন, বানায় তো পুরুষরাই। এই ছবিতে বরং গুলতির মায়াবিনী বৈশিষ্ট্য চাপাইয়া রাখা হইছে, রক্তমাংসের মানুষের মতন তাকে পুরুষের আগ্রহ আর কামনার কেন্দ্রবিন্দুতেই রাখা হইছে। অনেক পুরুষের মধ্যে এক এক জনের সঙ্গে এক এক রকম সম্পর্কও পরিষ্কার দেখা গেছে। কারো সাথে বৈরিতা, বিদ্বেষ, কারো সঙ্গে নিখাদ বন্ধুত্ব আর একজনের সঙ্গে প্রেম বা প্রেমের মতন কোন নৈকট্য।

এরপর হাওয়া সিনেমার বিরুদ্ধে বন্যপ্রাণী ও পশুপাখী সংরক্ষণ আইনে মামলা করা হইলো। শালিখ পাখির মাংস খাওয়া দেখানো হইছে তাই। সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পাওয়া একটা সিনেমার বিরুদ্ধে এই রকমের মামলা করা যায় এটা জানা ছিলো না।

সিনেমার ডিসক্লেইমারে বন্যপ্রাণী বিষয়ক একটা বক্তব্য ছিলো বইলা মনে পড়ে। কোন পশুপাখির ক্ষতি করা হয় নাই ইত্যাদি লেখা। ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর– এর মতন স্বাভাবিক ভাবছি ঘোষণাটাকে। গল্পের প্রয়োজনে চরিত্রদের মাদক সেবনের মতনই মাংসও খাইতে দেখা গেছে। এটা মামলা করার মতন গুরুতর বইলা মনে হয় নাই।

হাওয়া নিয়া আরও একটা অ্যালিগেশন শুনলাম, এটা নাকি সরকার বিরোধী সিনেমা। একটা নৌকা এবং পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে চাওয়া এক নারী নাকি বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের মেটাফোর! কিন্তু এত প্রবল সরলীকরণ কি আদৌ সম্ভব?

যদিও সিনেমার মধ্যে প্রতীকের মাধ্যমে অনেক কিছু দেখানো যায়, কিন্তু যেমনটা আগেও বললাম, হাওয়া ছবির গল্প এমন সাবলীল যে মিল পাওয়া যাইতে পারে অনেক কিছুর সঙ্গেই। সাহিত্যের ভাষায় যাকে বলে অ্যালিউশন। এই সিনেমার গল্পকে অনেকে জঁরা হিসাবে বলতেছে জাদু বাস্তবতা। সেটাও বলাই যায়!

বাস্তবের মধ্যে কই জানি বইসা থাকে রুপকথা! কিম্বা বাস্তবের মতন গতি নিয়া আগানো গল্পে রুপকথা পথরোধ কইরা আইসা দাঁড়ায়, পাঠক বা দর্শক ভাবে- ক্যামনে কী? এইটাও এই সিনেমায় আছে।

সিনেমার প্রচার প্রচারণা বেশ অনন্য ছিলো। এই সিনেমার পরিচালক মিউজিক ব্যান্ড মেঘদলেরও সদস্য। সিনেমার মিউজিক করছে মেঘদলই। কাছাকাছি সময়ে হাওয়া শিরোনামে একটা গানও রিলিজ করে মেঘদল। ওই গানের কনসার্ট সিনেমার প্রচারণাকে বাড়তি গতি দিলো।

তবে সবকিছুর মধ্যে সাদা সাদা কালা কালা গানটা হইলো সেরা। এই গানের গীতিকার সুরকার মাহমুদ হাশিম ভাই গানটার কারণে তার প্রাপ্য জনপ্রিয়তা পাইলেন, এইটাও একটা দারুণ বিষয়।

একটা কবিতার লাইন আছে, তীব্র তাপে জ্বলছে নিজেই হাওয়া। হাওয়া শব্দটা অদ্ভুত সুন্দর। হাওয়া অর্থ বাতাস আবার হাওয়া হইলেন আদি নারী, যাকে বলে ইভ। ওই কবিতায় হাওয়া ছিলো বাতাস অর্থে। বসন্ত কালের বর্ণনায় তাপের তীব্রতা বুঝাইতে বলা হইছিলো, এমন তাপ যে বাতাসও জ্বলতেছে। হাওয়া সিনেমার ক্ষেত্রে আমার এই রকম মনে হইলো। সিনেমা তো অতি চমৎকার বটেই, সিনেমাটাকে নিয়া যা সব ঘটনা ঘটতেছে সেই সবও অতি চাঞ্চল্যকর। ঠিক যেন তীব্র তাপে জ্বলছে নিজেই হাওয়া।

*রচনাকাল: ঢাকা, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২

*প্রথম প্রকাশ: দেয়াল, ১৯ জানুয়ারি ২০২৩


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

জন্ম- ১৯৮৪ ময়মনসিংহ শহরে। পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ এ স্নাতকোত্তর এবং জার্নালিজম, মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন নিয়ে পরবর্তী মাস্টার্স। আগ্রহের জায়গা - মিডিয়া, ফেমিনিজমস, ফিল্ম, কবিতা, সমাজ আর সময়। পেশা- সাংবাদিকতা এবং গবেষণা। এক সন্তানের জননী, বিবাহ বিচ্ছিন্ন একলা মানুষ।

মন্তব্য করুন