Select Page

কনডেম সেলের পাথর দেয়াল বা আমাদের ব্যান্ড সংগীত

কনডেম সেলের পাথর দেয়াল বা আমাদের ব্যান্ড সংগীত

 ১৯৮২ সালের ১২ জুন হত্যাপরাধে বাকেরের প্রাণদণ্ড দেয়া হয়। ১৯৮৩ সনের শেষ দিকে তার মার্সিপিটিশন অগ্রাহ্য করা হয়। বাকেরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় ১৯৮৫ সনের ১২ই জানুয়ারি বুধবার ভোর পাঁচটায়১

 এই রাত এখানে থমকে গেছে কনডেম সেলের পাথর দেয়ালে, প্রতি নিঃশ্বাসে মৃত্যুর দিন আমি গুনছি…জেল থেকে আমি বলছি।

উপন্যাস এবং গানটি রচনার সময়ের ব্যবধান ৫-৭ বছরের। তবে উপন্যাসের নাট্যরূপ এবং গান দুটি প্রায় কাছাকাছি সময়ে। এখন আমরা আমরা যদি জেমসের গানকে হুমায়ূন আহমেদের ‘কোথাও কেউ নেই’ এর বাকের ভাই এর সাথে মিলিয়ে পাঠ নেই তাহলে আমরা হয়ত বাঙালি (বিশেষ করে বাংলাদেশী) মধ্যবিত্ত তারুণ্যের সে মনোভাবকে, যে মনোভাব গড়ে উঠেছিলো মূলত যুদ্ধ পরবর্তী মধ্যবিত্তের নতুন ক্ষমতায়ন, সামরিক শাসন এবং নয়া অর্থনৈতিক বলয়ের ভিতরে। সে বলয়ে তাকে পাঠ করতে পারব। অবশ্য ঠিক যে অবস্থানে আজম খান ব্যান্ড মিউজিক শুরু করেছিলেন সেটি বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় আর সেখানে স্থির ছিলোনা। পরবর্তী বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন, চাপ-তাপ ব্যান্ড সংগীতকে বহুলাংশে প্রভাবিত করেছিলো। এছাড়া তৎকালীন পাশ্চাত্য ধারার রক মিউজিকও বাংলা ব্যান্ডকে নতুন পথ দেখিয়েছিলো। আমরা আরো পরে দেখব যে পাশ্চাত্য ভাবধারার সাথেই বাংলা ব্যান্ড তার অবয়ব গড়ে নিয়েছিলো। যুক্ত হয়েছে হেভিমেটাল, অর্ল্টানেটিভ রক, সাইকাডেলিক রক, হার্ড রক, ট্র্যাস মেটাল, ডেথ মেটালসহ বিভিন্ন ব্যান্ডীয় ধারা-উপধারার সাথে। এখন এসে আমরা দেখছি বাংলা ব্যান্ড মূলত কয়েকটি ধারায় ভাগ হয়ে গেছে। একটি ধারায় লিরিক্যাল জায়গার বদলে ইন্সট্রুমেন্টের প্রধান্য বেড়েছে। আবার অন্য একটি ধারা লিরিক্যাল ধারাকেও সমান প্রাধান্য দিয়ে নিজেদের গান বাঁধছে। তবে আরো একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো বাংলাদেশি ব্যান্ডগুলোর মধ্যে কোন কোন ব্যান্ড বাংলার সহজিয়া, বাউল, মরমী ঘরানায় নিজেদের যুক্ত করছে। যদিও সেসব কতটুকু যৌক্তিক ও শুদ্ধ সে প্রশ্নও দেখা দিয়েছে। তবে সত্যি কথা হলো ব্যান্ড মিউজিক গত প্রায় ৪ দশক ধরে বিভিন্নভাবে বাংলা গানে নিজেদের জায়গা করার জন্য লড়াই-সংগ্রাম জারি রেখেছে। যেহেতু শুরু থেকেই ‘অপসংস্কৃতি’ নামক একটা ট্যাগ তাকে বহন করতে হয়েছে তাই এই ডিসকোর্সের সাথে লড়াইটাও অতো সহজ ছিলোনা।     

 দুই.

একাত্তর পরবর্তী সময়ে আমাদের জাতীয় চেতনার ঐক্যবদ্ধ একটা চরিত্রের প্রয়োজন ছিল, তা যে হয়ে উঠেনি সেটা স্পষ্ট। মূলত যুদ্ধ পরবর্তীতে সেটা যে কেন হয়নি সে আলোচনা বিস্তারিত করার সুযোগ নেই। অনেকেই অনেকভাবে ব্যাপারটা নিয়ে বলেছে। তবে মোটাদাগে বলতে যদি বলতে হয় তবে একরৈখিক জাতীয়তাবাদ, ৭৫ এর পট পরিবর্তন, সামরিক শাসন, স্বাধীনতা বিরোধী ও রাজাকারদের পুনর্বাসন এসবের কথা বলাই যায়। এই বিষয়গুলো আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনে সুদূর প্রসারী প্রভাব ফেলেছে। তার কিছু ফল আমরা বর্তমান সময়ে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে দেখতে পারব। তবে আমি কথাবার্তা শুধু বাংলা ব্যান্ড ও জেমসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাইছি বলে সেদিকে আর যাব না। তবে সেক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিকভাবে আরও কিছু কথা উঠে আসবে। আসাটাই স্বাভাবিক।

 আজম খান

তিন.

যে জাতীয় চরিত্র নির্মিত হয়নি সে না হওয়া থেকে হাইকোর্টের মাজার দিয়ে বেরিয়ে আসলো স্বাধীনতা পরবর্তী বাঙলা গানের অন্যতম পীর আজম খান। প্রথমত তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের একজন সক্রিয় যোদ্ধা। আজম খান যে শুধু গান নিয়ে হাজির হয়েছিলেন সেটা বললে নেহায়ৎ কম বলা হবে। তিনি মূলত বেশ কিছু প্রশ্নের জবাবও দিয়েছিলেন।  বিশেষ করে বাঙলা গানের রবীন্দ্রায়ন যে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়ে গানের জগতকে শাসন করছিলো এবং সেইসাথে শিল্পের পবিত্রতা বলে যেসব টেক্সট রবীন্দ্রবাদীরা হাজির করছিলো সেসব প্রশ্নের উত্তরও তিনি হয়তো দিতে চেয়েছিলেন। কারণ সে সময় যুদ্ধবিধস্ত একটি দেশের তারুণ্যের যে হতাশা তা ধারণ করার ক্ষমতা রবীন্দ্রসংগীতের আদৌ ছিল কি? যথারীতি আজম খানের পাশ্চাত্য ভাবধারার গানও তাদের মনে চাবুকের মতো করে আঘাত ‘হেনেছিল’। আমার মনে হয় সে সময়েই প্রথমবারের মতো অথবা তাৎপর্যপূর্ণভাবে ‘অপসংস্কৃতি’ ডিসকোর্সটি বেশ ঘটা করে সামনে এসেছিলো। শুরু হলো সংস্কৃতি আর অপসংস্কৃতির এক অমিমাংসিত দ্বন্দ্ব। শুদ্ধতাবাদীরা রীতিমত তলোয়ার নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। যা এখনো চলছে। তার বেশ কিছু উদাহরণ পাওয়া যাবে সে সময়ের ফিডব্যাক এবং এখনকার ঢাকা ব্যান্ডের  লিডার রক লিজেন্ড মাকসুদের ‘আমি বাংলাদেশের দালাল বলছি’ বইটিতে। বাংলা ব্যান্ডের এক যোদ্ধার লড়াইয়ের দলিল হয়ে আছে সেই বইটি। আসলে কি বলতে চেয়েছিল সেই গানগুলোয় আজম খান? আজম খান বলেছিল ‘হায়রে হায় বাংলাদেশ’ বাংলাদেশ শব্দটি এত হতাশা নিয়ে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আর কোন গানে এভাবে উচ্চারিত হয়েছিল কি? সে সময়ে যে অস্থিরতা এবং স্বপ্ন ভঙ্গ নাগরিক জীবনকে গ্রাস করে নিয়েছিলো মূলত তা খানিকটা বেসুরো হয়ে তীব্রভাবে আঘাত করেছিলো সময়টাকে। এছাড়া ‘ওরে সালেকা, ওরে মালেকা’ কিংবা ‘হাইকোর্টের মাজারে’ গানগুলি লিরিক্যালি যে রক সংস্কৃতির ধারা তৈরি করছিলো তা রবীন্দ্রসংগীত কিংবা তার পূঁজারীরা কখনো ধরতে পারবে কি? এসব গানে তরুণরা রীতিমত যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। তারা নিজেদের প্রকাশের একটি আশ্রয় পেয়ে গেলো। সেইসময় বাংলা ব্যান্ডের উত্থান ও বিকাশে আজম খানের ভূমিকা নিয়ে পশ্চিম বাংলার খ্যাতিমান শিল্পী কবীর সুমনের করা মন্তব্য টুকে দেওয়া যেতে পারে। পুরো অধ্যায়টা প্রাসঙ্গিক হলেও আমি আপাতত প্রাসঙ্গিক কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি। বাকিটা পাঠক নিজ দায়িত্বে পড়ে নেবেন।

দশ বারো বছর আজম খান ছিলেন বাংলাদেশের একচ্ছত্র রকসম্রাট। তারপর তিনি আর গান করেননি। কিন্তু আজও তিনি  যদি গান করতে মঞ্চে উঠেন তো দর্শক ও ভক্ত সমাগম যা হবে তা দুই বাংলার অন্যকোন শিল্পীর ভাগ্যেই জুটবে না। তার অসংখ্য ভক্তের কাছে তিনি আজও ‘গুরু’। লক্ষ লক্ষ বাঙালির মনে তাঁর অদ্ভুত আবেদনের কারণে ক্ষীণকায়, লম্বা, আপনভোলা, প্রতিষ্ঠানবিমুখ, প্রচারনিস্পৃহ আজম খান সিরিায়াস গবেষণার বিষয় হতে পারেন। সঙ্গীত ও সমাজের সম্পর্ক বাংলার বিদ্দজনদের মস্তিস্কে তেমন গুরুত্ব পায়নি (ফলে এই মস্তিষ্কটি আমার মতে গবেষণার বিষয় হওয়া উচিত)। আর আধুনিক সঙ্গীত ও তার সামাজিক ভূমিকা বিষয় হিসেবে ব্রাত্যই থেকে গেল। তাই আজম খানের সঙ্গীত, পরিবেশনার আঙ্গিক ও তার গণআবেদন নিয়ে গবেষণাধর্মী তেমন কোন কাজই হলো না। অকল্পনীয়রকম জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও আজম খান বাংলাদেশের সমাজে প্রান্তবাসীই থেকে গিয়েছেন। ২ 

চার.

এরপরে আরো অনেকে এগিয়ে এসে রকের ভাষায় নিজেদের গল্প বলতে শুরু করল। একইসাথে ওই গানগুলো প্রচলিত ভিক্টোরিয়ান নৈতিকতা এবং কলোনিয়াল ‘আমি ভালো ছেলে’ টাইপের সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্র নিয়ে হাজির হয়েছিলো। আমি রবীন্দ্রসংগীতের বিপক্ষে না। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জাতীয় চরিত্র নির্মাণের প্রক্রিয়ায় এবং স্বাধীনতা যুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ এর সৃষ্টি যে একটা ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছিলো তা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। তবে সেইসাথে এটাও মনে রাখা দরকার যে আইয়ূব খানের শাসনের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ এর সৃষ্টির ভূমিকা যতটুকু সাংস্কৃতিক তারচেয়ে বেশি রাজনৈতিক। মূলত তৎকালীন পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করার প্রতিক্রিয়ায় রবীন্দ্রনাথ গুরুত্বপূর্ণভাবে সামনে চলে আসেন। কিন্তু পরবর্তীতে তথাকথিত জাত-পাত বিরোধী আন্দোলনকারী বুদ্ধিজীবীরা ও তথাকথিত রবীন্দ্রনাথের বেলায়াত প্রাপ্তরা কেন জানি এক অজ্ঞাত কারণে ব্যান্ড সংগীতকে আঘাত করবার তাগিদে রবীন্দ্রনাথকেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিলো তা আজো অজানা। কেন যে তাদের মনে হলো রবীন্দ্রনাথ ও ব্যান্ড পাশাপাশি থাকতে পারেনা তার উত্তরও পাওয়া যায়নি। আর সেসময়ে তাদের অবস্থান এতটা বির্তকের উর্ধ্বে ছিলোনা যে তাদের কথা বিনাবাক্যে মেনে নেয়া যায়। ওইসময়ে লেখা মহাত্মা আহমদ ছফার ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ বইটি পড়লে সেসময়ে বুদ্ধিজীবীদের অবস্থা সম্পর্কে জানা যাবে। আমি পারলে পুরো বইটাই উদ্ধৃতি হিসেবে দিয়ে দিতাম। তবে এই মুহূর্তে সে সুযোগ না থাকায় এখানেও অল্পকিছু অংশ টুকলিফাই করে ক্ষান্ত দিবো।

কোথাও কেউ নেই ধারাবাহিকের দৃশ্য

 বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। এখন যা বলছেন শুনলে বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোর আমূল পরিবর্তন হবে না।

আগে বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি ছিলেন বিশ্বাসের কারণে নয়- প্রয়োজনে। এখন অধিাকাংশ বাংলাদেশি হয়েছেন সেও ঠেলায় পরে। কলাবরেটরদের মধ্যে এমন অনেকে আছেন যারা ইসলাম পাকিস্তান ইত্যাদি সত্যি সত্যি বিশ্বাস করে। আবার স্বাধীন বাংলাদেশে চতুঃস্তম্ভের জয়ধ্বনি দিচ্ছেন, এমন অনেক বুদ্ধিজীবী রয়েছেন যারা সারাজীবন কোনকিছুতে যদি নির্দিদ্বিধায় বিশ্বাস করতে পেরেছেন- সে বস্তুটির নাম সুবিধাবাদ।”৩

যাই হোক ধান ভাঙতে শীবের গীত বহু গাওয়া হয়েছে। হয়তো আমি ভুলেই গিয়েছিলাম গান নিয়ে লিখতে বসেছিলাম। সেইসাথে এসেছিলো হুমায়ূনের বাকের ভাই। আরো একটা উল্লেখযোগ্য লক্ষনীয় বিষয় হলো হুমায়ূনকেও একইভাবে ধ্রুপদীরা বাজারী বলে গালাগাল করেছিলো। ব্যান্ড সংগীত কিংবা হুমায়ূন সমাজ ও রাজনীতির নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটের ভিতর দিয়ে বেড়ে উঠেছে সে দিকটা ধ্রুপদী ইন্ট্যালেকচুয়ালরা কেন যে গুনায় ধরেনি সে এক অত্যাশ্চর্য বিষয়! জনপ্রিয়তা কখনোই কোনকিছু ভালো কিংবা মন্দ হওয়ার মানদন্ড হতে পারেনা। জনপ্রিয় জিনিসও যেমন মানোর্ত্তীণ হতে পারে তেমনি অজনপ্রিয় যেকোন কিছুর মানোত্তীর্ণ হতে কোন দুষ আছে বলে হয়না। কিন্তু আমাদের দেশের ধ্রুপদধারা সবসময় জনপ্রিয় যেকোন কিছুকে সন্দেহের চোখে দেখে এসেছে। সে ধারা এখনো বিদ্যমান।

ব্যান্ড সংগীত বাঙালিও প্রগতিশীল মননে কিভাবে আঘাত করেছিলো তার জন্য আমি প্রিয় কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘সংস্কৃতির ভাঙা সেতু’ প্রবন্ধের কিছু অংশের উদ্ধৃতি দিয়ে এই অংশ শেষ করছি। তবে বলে রাখা ভালো আমি মনে করি বামপন্থী ছাত্র রাজনীতির জন্য এত উপকারী প্রবন্ধ আমি খুব কম পড়েছি। আমার সৌভাগ্য এটি আমি ছাত্র রাজনীতিকালীন সময়েই সেটা পড়তে পেরেছিলাম। সেইসাথে নিশ্চিতভাবেই আমি নিচের অংশের সাথে একমত নই-

আগে বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি ছিলেন বিশ্বাসের কারণে নয়- প্রয়োজনে। এখন অধিাকাংশ বাংলাদেশি হয়েছেন সেও ঠেলায় পরে। কলাবরেটরদের মধ্যে এমন অনেকে আছেন যারা ইসলাম পাকিস্তান ইত্যাদি সত্যি সত্যি বিশ্বাস করে। আবার স্বাধীন বাংলাদেশে চতুঃস্তম্ভের জয়ধ্বনি দিচ্ছেন, এমন অনেক বুদ্ধিজীবী রয়েছেন যারা সারাজীবন কোনকিছুতে যদি নির্দিদ্বিধায় বিশ্বাস করতে পেরেছেন- সে বস্তুটির নাম সুবিধাবাদ।৩

যাই হোক ধান ভাঙতে শীবের গীত বহু গাওয়া হয়েছে। হয়তো আমি ভুলেই গিয়েছিলাম গান নিয়ে লিখতে বসেছিলাম। সেইসাথে এসেছিলো হুমায়ূনের বাকের ভাই। আরো একটা উল্লেখযোগ্য লক্ষনীয় বিষয় হলো হুমায়ূনকেও একইভাবে ধ্রুপদীরা বাজারী বলে গালাগাল করেছিলো। ব্যান্ড সংগীত কিংবা হুমায়ূন সমাজ ও রাজনীতির নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটের ভিতর দিয়ে বেড়ে উঠেছে সে দিকটা ধ্রুপদী ইন্ট্যালেকচুয়ালরা কেন যে গুনায় ধরেনি সে এক অত্যাশ্চর্য বিষয়! জনপ্রিয়তা কখনোই কোনকিছু ভালো কিংবা মন্দ হওয়ার মানদন্ড হতে পারেনা। জনপ্রিয় জিনিসও যেমন মানোর্ত্তীণ হতে পারে তেমনি অজনপ্রিয় যেকোন কিছুর মানোত্তীর্ণ হতে কোন দুষ আছে বলে হয়না। কিন্তু আমাদের দেশের ধ্রুপদধারা সবসময় জনপ্রিয় যেকোন কিছুকে সন্দেহের চোখে দেখে এসেছে। সে ধারা এখনো বিদ্যমান।

ব্যান্ড সংগীত বাঙালিও প্রগতিশীল মননে কিভাবে আঘাত করেছিলো তার জন্য আমি প্রিয় কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘সংস্কৃতির ভাঙা সেতু’ প্রবন্ধের কিছু অংশের উদ্ধৃতি দিয়ে এই অংশ শেষ করছি। তবে বলে রাখা ভালো আমি মনে করি বামপন্থী ছাত্র রাজনীতির জন্য এত উপকারী প্রবন্ধ আমি খুব কম পড়েছি। আমার সৌভাগ্য এটি আমি ছাত্র রাজনীতিকালীন সময়েই সেটা পড়তে পেরেছিলাম। সেইসাথে নিশ্চিতভাবেই আমি নিচের অংশের সাথে একমত নই-

 একই ব্যক্তির মধ্যে যখন ধ্রুপদ সংগীত, রবীন্দ্রসংগীত, ডিসকো গান ও পপগানের প্রতি সমান ভক্তি দেখা যায় তখন বোঝা যায় যে সংগীত জিনিসটা তার ভেতরে ঢোকে না, গানের ব্যাপারে তার ভালোলাগা বলে কিছু নেই, এটার সাহায্যে সমাজে তিনি রুচিশীল ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হতে চান। সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান বা বায়োনিক উওম্যান সিরিজের ছবি দেখার জন্য ব্যক্তি একুশে ফেব্রুয়ারি কী পয়লা বৈশাখে কারুকাজ করা পাঞ্জাবী পরে বাংলা প্রেম দেখাতে বের হন। অর্থ্যাৎ কোনোটাই তার স্বভাবের অর্ন্তগত হতে পারেনি। ৪

পাঁচ.

আজম খান যদি বাংলা ব্যান্ড গানের জনক হন তবে তার বিকাশ পর্যায়ের সবচেয়ে বড় নির্মাতার নাম ফারুক মাহফুজ আনাম ওরফে জেমস। আসলে এখানে প্রতিটি ব্যান্ড ধরে ধরে এগুনো সম্ভব নয় বলেই আমি জেমসকে ‘নজির’ হিসেবে নিচ্ছি। নচেৎ আমি প্রতিটা ব্যান্ড নিয়ে আলাদা আলাদা করে লিখতাম। জেমস এখানে মূলত আজম খান পরবর্তী ব্যান্ডের চরিত্রকে উপস্থাপন করবে। জেমস এর গানগুলো অবশ্যই জেমস লিখেননি। তার অনবদ্য গানগুলো লিখেছিলেন প্রিন্স মাহমুদ, দেহলভী, মারজুক রাসেল, শিবলী তার বিখ্যাত একটি গান ‘তারায় তারায়’ এর রচয়িতা কবি শামসুর রাহমান। তবে কৈশোরে আমরা জেমসের গান হিসেবেই শুনেছি সেই গানগুলো। তাই গানগুলো জেমসের গান। তার গায়কী, সুর, কথা, প্রেজেন্টেশন সব মিলিয়েই জেমস। সেইসাথে ব্যক্তি জেমস এই গানগুলোকে নিয়ে গিয়েছিলো অনন্য উচ্চতায়। তাই এসবকে আলাদা করে বিবেচনা হয়না। শহরে এখনো জেমসের কনসার্ট মানে তারুণ্যের উপচে পড়া ঢল। বাংলাদেশের ব্যান্ডের অন্যতম বড় বিজ্ঞাপনের নামও জেমস। মফস্বলের চায়ের দোকান থেকে বলিউডের মেট্রোলাইফ সর্বত্র জেমস তার সুরত নিয়ে হাজির আছেন। তবে সবকিছু ছাপিয়ে জেমসের স্বর আমাদের নাগরিক তরুণ্যের মন ও মননের প্রকাশ হয়ে আছে অনেকদিন ধরে।

ছয়.

আবার ফিরে যাচ্ছি সেই ওপরের অংশে যেখানে জেমসের একটি গান এবং হুমায়ূনের বাকের ভাইকে পাশাপাশি রেখে আসা হয়েছিল। হুমায়ূন যদি তখন ‘হাওয়া মে উড়তা যায়ে’র বদলে অথবা পাশাপাশি সেখানে ‘ঝর্ণা থেকে নদী’ কিংবা ‘তারায় তারায়’ বসিয়ে দিতেন তবে কি বাকের ভাইয়ের চরিত্রায়নে খুব কি সমস্য হতো? মনে হয়না। হয়তো তখন সেটি বাকের ভাইয়ের চরিত্রটিকে আরেকটি নতুন ডাইমেনশনে খাঁড়া করতো। যেখানে বাকেরের আর্বান উপস্থাপন আরো খানিকটা তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ফুটে উঠতো। হুমায়ূনের উপন্যাসটি যখন নাট্যরূপ পেল তখন বাকেরকে বাঁচানোর জন্য রাস্তায় মানুষ নেমে আসলো কিন্তু উপন্যাসটি পড়ে কিংবা গানটি শুনার পর সেরকম কোন প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়নি (তবে নিঃসন্দেহে সেগুলোও তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিলো। অবশ্য মনে রাখা প্রয়োজন গানটির সাথে উপন্যাস কিংবা নাটকের কোন সম্পর্ক নিতান্ত কাকতাল। পুরোপুরি আমার কল্পনা।) এটিও বাংলা মধ্যবিত্তের চরিত্রগত ভেরিয়েশনের একটি উদাহরণ বটে। মূলত আসাদুজ্জামান নূরের অবয়বে বাকের ভাই একটা ‘আকার’ পেয়ে গিয়েছিলো। বাঙালির চরিত্রে এই ‘আকার’ বরাবরই উল্লেখযোগ্য ফেক্টর হয়ে থেকেছে। আর মধ্যবিত্ত চরিত্রে সেটি শহীদ মিনার হোক বায়তুল মোকাররম কিংবা মানুষ বাকের ভাই রূপে বারবার সামনে এসেছে। সব জায়গায় আকারের প্রাধান্য। সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া একটি বিষয়ে আলো ফেললে আমরা ব্যাপারটা খানিকটা বুঝতে পারব। এক টকশো বুদ্ধিজীবীর মৃত্যু পরবর্তীতে তাকে শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়া এবং না নিয়ে যাওয়ার বিরোধিতা থেকেই এই বিতর্কের সূচনা। এটি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রেক্ষাপটে একটি অভূতপূর্ব ঘটনা। কারণ এমনটা আগে দেখা যায়নি। এখন এই প্রশ্ন যখন উঠলই তখন দেখা যাচ্ছে এটার কোন সোজাসাপ্টা উত্তর হয় না। শুধুমাত্র জাতীয়বাদী কিংবা দলীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে এই ঘটনাকে পাঠ করা ভুল হবে। এর ভিতর এক সুক্ষ্ম রাজনীতির যে খেল রয়েছে তাও বুঝা গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম কথা হলো শহীদ মিনারের স্পিরিটের সাথে কোন মানুষ বা দল যদি সহমত না হয় তবে সে মৃত্যুর পর শহীদ মিনারে যেতে চাইবে কেন? এই চাওয়া কি স্রেফ চাওয়া নাকি গত ৪০ বছর ধীরে ধীরে তৈরি বিভ্রান্তীতে জনতাকে আরো ঠেলে দিয়ে একটা রাজনৈতিক ভজঘট সৃষ্টি করে সুবিধা আদায় করা। তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মৃত ব্যক্তিটি আদৌ মৃত্যুর পর শহীদ মিনারে যেতে চেয়েছিলো কিনা? এই সবের মূল কারণ কিন্তু সেই রেখে আসা অমিমাংসিত সমস্যা। যা বর্ধিত আকার নিয়ে সামনে আসছে। এই দেশে বহু বিষফোঁড়া অতীতে রেখে আসা হয়েছে। যা ক্যান্সার আকারে ইতিমধ্যে ছড়িয়ে গেছে। তাই সমাধানও ঠিক অতো সহজ নয়। স্বাধীনতার বিপক্ষ মতাদর্শীরা কেন এই সময়ে এসে শহীদ মিনারে যেতে চাইছে। এই চাওয়ার সুযোগ কিভাবে তৈরি হয়েছে? এসব প্রশ্ন একেবারেই অবান্তর নয়। একদিকে যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায় হচ্ছে। যা আজ থেকে বছর দশেক আগেও কেউ হয়ত কল্পনা করেনি। এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। আমার মনে হয় এই বিচার বাঙালি জাতীর ভবিষ্যতের দিনগুলোতে কিংবদন্তিতুল্য প্রভাব ফেলবে। তবে তাদের লায় দিয়ে মাথায় তুলে রাখার ক্ষতিপূরণও আজ সমানে দিতে হচ্ছে। এখনো একটি দল যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসনে কাজ করে যাচ্ছে। তাই আপাতত আমাদের ঐক্যবদ্ধ জাতীয় চরিত্র নির্মাণ প্রক্রিয়া আরো বহুদিন রদ থাকবে তা নিশ্চিত করে বলা যায়। আর একটু অন্যভাবে দেখলে আমরা দেখছি একই ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধা আবার একইসাথে জামাতের রাজনীতি করছে এই সমস্যার সমাধান কি হতে পারে? এখন এই স্বীকৃতি বা খারিজের অথরিটি কার? কাকে শহীদ মিনারে যেতে দেওয়া যাবে কিংবা যাবেনা সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অথরিটিইবা কার? শহীদ মিনারে কেন শুধু বুদ্ধিজীবীদের (জাতীয় সংকটকালে যাদের বারবার আপোষ করতে দেখা গেছে) নেওয়া হবে? ভাষা সংগ্রাম কিংবা মুক্তিযুদ্ধে প্রান্তিক ও নিম্নবর্গের মানুষের অংশগ্রহণ ছিলো স্বঃতস্ফূর্ত তাদের শহীদ মিনারে এক্সেস কোথায়? এসব প্রশ্নের মোকাবেলাও এই সময়ে এসে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে।

এসব ঘটনার ভিতর দিয়েই আমরা দেখব বাংলা ব্যান্ড যারা মূলত মধ্যবিত্ত নানা ঘাত-প্রতিঘাতের প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়েছে তারা নিজেদের মতো করে বাংলার এই ব্রাত্য, মরমী ও প্রান্তিক ঘরনার সাথে একধরনের বোঝাপড়া চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এমনকি যে রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে তাদের আক্রমণ করা হয়েছিলো সেই রবীন্দ্রনাথকেও তারা নিজেদের মতো করে পাঠ করে নিচ্ছে। সেক্ষেত্রে ‘লালন ব্যান্ড কিংবা বাঙলা ব্যান্ড’ এবং ‘শিরোনামহীনের রবীন্দ্র সংগীত’ গাওয়াকে নজীর হিসেবে নেওয়া যেতেই পারে। যদিও সেসবের ‘শুদ্ধতার’ প্রশ্নে বিতর্ক এখনো মুছে যায়নি। তবে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো এই বোঝাপড়াও এখনো পর্যন্ত অনেকটা তাদের নিজেদের মধ্যেই অর্থাৎ মধ্যবিত্ত সমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এখানে বাংলার প্রান্তিক ও সাবঅর্ল্টান জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ খুব একটা নেই ।

 সাত.

যাই হোক জেমসের গানের কথাই আসা যাক। এইসব পরিস্থিতি ও দুদোল্যমান মানসিক ডামাডোলের ভিতরেই বাংলা ব্যান্ড তার রাস্তা করে নিয়েছে। মধ্যবিত্তকেই সে তার মূল ভোক্তা হিসেবে তৈরি করেছে। সে ‍অনুযায়ী গানের চরিত্র, বিষয় এবং ভাব নির্মাণ করেছে। কখনো সেই গান মিছিলের স্লোগান হয়েছে আবার কখনো কখনো অনেকটা নিজের সাথে নিজের কথোপকথনের মতো করে অস্তিত্ব ও আত্ম সংকটকে সামনে নিয়ে গান বেঁধেছে। সে গানগুলো যেন নিজেই নিজের সাথে বোঝাপড়া। গানগুলো যেমন নেতিকরণের চাপ বহন করে তেমনি একটা নতুন রাষ্ট্রের মধ্যে নতুন একটা কাঠামো তৈরির যে বাস্তব প্রতিক্রিয়া তরুণ্যের উপর ভর করে তার নিদর্শনও বহন করে। এসব গান একটা ভেঙে পড়া রাষ্ট্রের সবচেয়ে সংবেদনশীল গোষ্ঠীর বেঁচে থাকা কিংবা মরে যাওয়ার প্রেরণা হয়ে উঠে। হয়তো জেমসের এই ‘জেল থেকে বলছি’ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বা তারপর আরও কয়েক দশক ধরে নগরের যুবক বাউলের মনস্তাত্বিক চরিত্রের একটা দালিলিক প্রমাণ হয়ে থাকবে। তবে সেইসাথে মনে রাখা দরকার সে সময় ব্যান্ড গানে সাময়িক বিনোদনমূলক চটুল গান এবং কোন কোন ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণও বাদ যায় নি।

আট.

তবে এতকিছুর পরও গানগুলো গত ৩০-৩৫ বছর ধরে নাগরিক তারুণ্যের মনকে শাসন করে গিয়েছে। নিয়ন্ত্রণ করেছে তার সামাজিক চরিত্রের বেশ খানিকটা দিক। একসময়, না এখনো জেমসের আদলে নির্মিত ইমেজকে আমাদের রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত সামাজিক ডিসকোর্সে বখাটে হিসেবে চিহ্নিত করেছে। মধ্যবিত্তের নিজেদের শ্রেণির মধ্যেই তৈরি করেছে একটা আদর্শিক দ্বন্দ্ব। নতুন নতুন নামকরণও হয়েছে নিয়মিত। ঝিল্লি, ভাণ্ডরী, ঝাকানাকা এইরকম অনেক শব্দ দিয়ে জেমসীয় ঘরানাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে তাতে জেমসের এতটুকু ক্ষতি হয়নি। জেমস এখনো বহাল তবিয়তে তার ‘ঝিল্লি’ ইমেজ নিয়ে গান করে যাচ্ছেন। মধ্যবিত্ত মূল্যেবোধ কিংবা ‍ক্লাসিক্যাল সামালোচনা জেমস কিংবা তার ভক্তরা থোড়াই কেয়ার করেছেন। তাদের চিন্তা, রুচি কিংবা স্টাইল সবখানে জেমস এখনো সমানভাবে তার সুরত মোবারক নিয়ে হাজির হয়ে আছেন।

 টুকাটুকি:

 ১.           হুমায়ূন আহমেদ,‘কোথাও কেউ নেই’, পৃ:২৭৩

 ২.          কবীর সুমন,‘কোন পথে গেলো গান’,পৃ:৭৩

 ৩.          আহমদ ছফা,‘সাম্প্রতিক বিবেচনা,বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’পৃ:৪৯

 ৪.          আখতারুজ্জামান ইলিয়াছ,‘সংস্কৃতির ভাঙা সেতু’পৃ:৩২

*লেখাটি ২০১৯ সালে ওয়েব ম্যাগাজিন ‘লালজীপের ডায়রী’তে প্রথম প্রকাশ হয়।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

মন্তব্য করুন