Select Page

দেলুপি: জল–মাটি–মানুষের লুকানো জীবনালেখ্য

দেলুপি: জল–মাটি–মানুষের লুকানো জীবনালেখ্য

একটি ধীর, সংযত ও পর্যবেক্ষণ নির্ভর গল্প নিয়ে ‘দেলুপি’ উপহার দিয়েছেন পরিচালক মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম। এটা পরিচালকের প্রথম চলচ্চিত্র। আর সেখানে তাওকীর যে বাস্তবধর্মী গতি বেছে নিয়েছেন তা অনেকটা আন্দ্রেয়া আর্নল্ডের ফিশ ট্যাংক বা আবদেররাহমান সিসাকোর তিমবুক্তু-এর ডকু-ফিকশন ধারার মতো; যেখানে গল্পের শক্তি আসে পরিবেশের গভীরতা থেকে, সংলাপের বাহুল্য থেকে নয়। কিন্তু এক বড় পার্থক্য আছে—ওই ছবিগুলো চরিত্রকে প্রায় দার্শনিক স্তরে তুলে ধরে, দেলুপি সেখানে থেকে যায় মাটির কাছেই। ফ্রেমগুলো আপনাকে ভাবাতে বাধ্য করে, কিন্তু দর্শনের বিমূর্ততায় হারিয়ে দেয় না।

ছবির মেরুদণ্ড গ্রামীণ খুলনা। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের এক প্রত্যন্ত জনপদ, খুলনা জেলার পাইকগাছার দেলুটি ইউনিয়ন ঘিরে জল, মাটি, ঝড়, রাজনীতি, ভালবাসা ও অনিশ্চয়তায় বোনা এক ভূগোল। এটা সেই ধরনের গ্রাম, যাকে আমরা সাধারণত দারিদ্র্য বা ট্র্যাজেডির প্রতীক হিসেবে দেখি। কিন্তু পরিচালক এখানে গ্রামে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আলো-আঁধারিতে দর্শকদের দুঃখ দেখানো সিনেমা বানাননি—বরং দেখিয়েছেন মানুষের জীবনকে, তার নীরব সংগ্রামকে। দেখিয়েছেন অধরা একতাকে ছুঁয়ে দেখা ও না-দেখার অনিশ্চয়তা।

স্থানীয় মুখদেরই ব্যবহারের সিদ্ধান্ত এ সিনেমার সবচেয়ে বড় শক্তি। চিরঞ্জিত বিশ্বাস, অদিতি রায়, রুদ্র রায়—প্রত্যেকেই গল্পটিকে বাস্তবের মধ্যে টেনে এনেছেন। এখানকার মানুষরা সিনেমাটিক চরিত্র নয়—তারা যেন বাস্তব জীবনের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা একেকটি মুখ। সিনেমার ফরম্যাটের সঙ্গে অনভিজ্ঞদের অভিনয়ে সঙ্গত কারণেই তাই কোনো নাটকীয় কৃত্রিমতা নেই; বরং দৃশ্যগুলোকে মনে হয় গ্রাম্য জীবনের আড়ালে লুকানো ক্যামেরায় ধরা কিছু মুহূর্ত।

চিত্রগ্রহণে রয়েছে এক কাঁচা সৌন্দর্য। মেঘলা আকাশ, কাঁদামাটির পথ, হাটের কোলাহল, নদীর ঘোলা জল—সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে এক ‘দেলুপীয়’ ভিজ্যুয়াল ভাষা। ড্রোন-শটের অযথা প্রদর্শন নেই। ক্যামেরা কখনো চমক দিতে যায়নি। বরং ক্যামেরা যেন মানুষের চোখের স্তরে থেকে গল্পটি বোঝার চেষ্টা করেছে।

ছবিটি মূলত তিন স্তরে কাজ করেছে—গ্রামের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং মানুষের ভেঙে পড়া ও উঠে দাঁড়ানোর সংগ্রামের সঙ্গে এ সিনেমার মূল স্রোতের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো যাত্রাশিল্পীদের জীবন ও সংগ্রাম। একসময় বিনোদনের প্রধান মাধ্যম হলেও, আধুনিক প্রযুক্তির ভিড়ে কীভাবে এই শিল্প এবং এর শিল্পীরা বিলুপ্তির পথে—তা এখানে বেদনার্তভাবে চিত্রিত। প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজস্ব শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে লড়াই করেন চরিত্ররা। তাদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনের টানাপোড়েন প্রমাণ করে, শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখাটা কখনো কখনো জীবনের সবচেয়ে বড় সংগ্রাম হয়েও দাঁড়ায়।

তাওকীর এ ছবিতে কোনো বাহুল্য দেখাননি। দক্ষিণ এশিয়ার চলচ্চিত্রের মূল ধারার সাপেক্ষে কোনো মেলোড্রামাও নেই। আছে কেবল কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার সাহস। ক্যামেরার লেন্স স্থানীয় রাজনীতি, ঋণের বোঝা এবং পারিবারিক দায়িত্বের চাপ—সবকিছুকেই এক স্থির নিরপেক্ষতায় ধারণ করেছে। বিশেষ করে, জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার মানুষজন যখন বারংবার নিজের ভিটেমাটি হারায়, সেই দৃশ্যাবলিতে অনুভব করা যাবে দার্শনিক রূঢ়তা।

‘দেলুপি’ এক সাহসী চলচ্চিত্র। এটি সেই চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে পড়ে, যা বাণিজ্যিক সাফল্যের চেয়ে শিল্পের দায়িত্ব পালনে বেশি মনোযোগী। একটি ইউনিয়নের গল্পও যে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মানব-সংগ্রামের এক শক্তিশালী উদাহরণ হতে পারে, তারও সাক্ষর রেখেছে দেলুপি-টিম।

‘দেলুপি’ দেখার পর আপনি হয়তো কেবল একটি সিনেমা দেখে বের হবেন না, বরং আপনি বাংলাদেশের এক বিস্মৃত কোণের মানুষের দীর্ঘশ্বাসও সঙ্গে নিয়ে ফিরতে পারেন। আর দেশজোড়া বিভাজনের সুর-বিশৃঙ্খলের মাঝে নিশ্চিতভাবেই অনুভব করবেন এক আনকোড়া ঐকতান।


About The Author

মঞ্জুরুল ইকরাম

সাংবাদিক, লেখক ও সমালোচক

Leave a reply