নকল গল্পকারদের হাত থেকে চলচ্চিত্রকে রক্ষা করতে হবে
লিপস্টিক। ডেডবডি। দরদ। চলতি বছরের তিনটা আলোচিত ছবি। দরদ আর লিপস্টিকের গল্প এক। এটা তো সবাই জেনে গেছেন। কিন্তু ডেডবডির সঙ্গেও যে দরদ ও লিপস্টিকের মিল আছে তা কী জানেন?
এই তিনটা ছবিই রিভেঞ্জ থ্রিলার। তিনটারই জনরা এক। যে ঘটনার প্রতিশোধ নিয়ে তিনটা ছবির গল্প- সেগুলোও এক। তিনটা ছবিতেই নায়িকা সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন।
এরপর…
লিপস্টিকে নায়িকা বেঁচে যান।
ডেডবডিতে নায়িকার মৃত্যু হয়।
দরদে নায়িকা আত্মহত্যা করেন।
এবার দ্বিতীয় মিলে আসেন। দেখ যাক, কীভাবে তিনটা ছবি একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
ডেডবডির নায়িকা প্রেতাত্মা হয়ে ফিরে আসেন প্রতিশোধ নিতে।
দরদের নায়িকা ফিরে আসেন নায়কের হ্যালুসিনেশনে।
লিপস্টিকের নায়িকা স্মৃতি হারিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন।
তিনটা ছবিতে নায়ক কিংবা নায়িকা প্রতিশোধ নেন। লিপস্টিকে নায়ক ধর্ষকদের খুন করেন। ডেডবডিতে নায়কের সহযোগিতায় নায়িকা ধর্ষকদের খুজে বের করে মা-রেন। দরদে মৃত নায়িকাকে হ্যালুসিনেট করতে-করতে নায়ক ধর্ষকদের শায়েস্তা করেন।
তিনটারই গল্প এক। কিন্তু নির্মাণের পর এগুলো হয়েছে-
একটা মার্ডারমিস্ট্রি থ্রিলার (লিপস্টিক)।
একটা হরর থ্রিলার (ডেডবডি)।
একটা সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার (দরদ)।
এখন বছরে ৩০টার মতো ছবি হয়। এরমধ্যে সিনেমা হলকে টার্গেট করে ছবি হয় আরও কম। এগুলোর মধ্যে কাছাকাছি সময়ে মুক্তিপ্রাপ্ত তিনটা ছবির মধ্যে এত মিল থাকলে দর্শক সিনেমা হলে কেন আসবেন আর সিনেমার ব্যবসাই-বা কীভাবে চাঙ্গা হবে?
আমাদের সিনেমায় গল্পলেখকের মারাত্মক সংকট। আগে তবু ভারতীয় ছবির গল্প নকল করে কাজ চলত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নকল ছবি দর্শক প্রত্যাখ্যান করায় লেখকসংকট ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। মৌলিক ছবির লেখার মতো বান্দাই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
এজন্যই কপি গল্পকার আব্দুল্লাহ জহির বাবু এখনও জিন্দা। তিনিই সব অনাসৃষ্টির গোড়া। লিপস্টিক ও ডেডবডির গল্প তার লেখা। দরদের গল্পও তারই লেখা, তবে সেটা আনঅফিসিয়াল। অনেকের ধারণা, অনন্য মামুনের কাছে তিনিই দরদের গল্প তলে-তলে বিক্রি করেছেন।
দরদে নায়কের হ্যালুসিনেট করার যে ব্যাপারটা লিপস্টিক থেকে দরদকে আলাদা করেছে, সেটাও তিনি নিয়েছেন আদর আজাদের আরেক ছবি তালাশ (২০২২) থেকে। তফাৎ শুধু এটুকুই, তালাশে নায়িকা হ্যালুসিনেট করেন আর দরদে নায়ক হ্যালুসিনেট করেন।
জহির বাবু কোনো বিবেচনাতেই লেখক নন। তার লেখার ক্ষমতা নিম্নস্তরের। এখন তার বয়স হয়েছে, আরও বেশি অক্ষম হয়ে পড়েছেন। তা না হলে তিনি ঘুরিয়ে-পেচিয়ে একই গল্প কেন বারবার লিখবেন?
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, এক গল্প থেকে একাধিক ছবি তো অতীতে হয়েছে। ‘ক্ষমা’ (১৯৯২) আর ‘কঠিন পুরুষ’ (২০০৪) একই গল্প। বলিউডের ‘বেনাম বাদশা’ (১৯৯১) থেকে টোকা। কিন্তু ‘ক্ষমা’ মুক্তির ১৪/১৫ বছর পর মুক্তি পেয়েছে ‘কঠিন পুরুষ’।
বলিউডের ‘স্বর্গ’ (১৯৯০) থেকে হয়েছে ‘স্নেহের প্রতিদান’ (১৯৯৬) আর ‘কে আপন কে পর’ (২০১১)। দুই ছবির মধ্যে ব্যবধান ১৭/১৮ বছরের।
‘কঠিন পুরুষ’ আর ‘কে আপন কে পর’ জহির বাবুরই লেখা।
জহির বাবুর জানার কথা, ছবির সাফল্য পেতে হলে একটা গল্পকে পুরনো হতে দিতে হয়, দর্শকের মাথা থেকে হারিয়ে যেতে দিতে হয়। এক বছরে এতগুলো ছবির বিষয়বস্তু এক হলে ছবিগুলো তো ব্যর্থ হবেই।
এক ‘দেবদাস’ থেকে অসংখ্য ছবি হয়েছে। সব ছবিরই গল্প এক। কিন্তু ছবির মেকিং আলাদা, স্টোরিটেলিং আলাদা। অধিকাংশ ‘দেবদাস’ এই কারণেই সফল।
কিন্তু একটা ‘দেবদাস’ মুক্তির পর কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হয় দর্শকদের আগ্রহ ঘনীভূত হওয়ার জন্য। এক বছরে তিনটা ‘দেবদাস’ মুক্তি পেলে লিপস্টিক, ডেডবডি আর দরদের ভাগ্যই বরণ করত, অন্যথা কিছু হত না।
শেষ কথা হচ্ছে, নকল গল্পকারদের হাত থেকে চলচ্চিত্রকে রক্ষা করতে হবে। প্রযোজকদের ধ্বংস করতে যারা বিন্দুমাত্র ভাবে না, তাদেরকে বাতিল করতে হবে। নতুন লেখকদের সুযোগ দিতে হবে। অ্যারেঞ্জার নয়, খুঁজতে হবে স্টোরিটেলার।