Select Page

সংশয়ী পাঠে ধর্ম ও যৌনতা, এবং নন্দনঘন মগডালে বিকল্প চলচ্চিত্র

সংশয়ী পাঠে ধর্ম ও যৌনতা, এবং নন্দনঘন মগডালে বিকল্প চলচ্চিত্র

 [কেস স্টাডি: বৃষ্টি (২০০০), এবং লালসালু (২০০১)]

অভিভূমিকা

রচনা মাত্রেরই ভূমিকা উপ-শিরোনাম থাকতে হবে এমনটা আমি মনে করি না। কোনো একটা রচনার মাথার দিকের অংশ যে তথাকথিত ভূমিকা আর ল্যাজের অংশটা যে তথাকথিত উপসংহার এটা না-বলা হলে রচনার ব্যাকরণ তামাম কিছু ভুলে গিয়ে পাঠক সেটাকে রচনার উদর হিসাবে পড়তে শুরু করবেন এমন দুর্ঘটনার কথা আমি কল্পনা করি না। তাছাড়া বিদ্যাজগতে রচনার আক্কেলজনিত বেহাল দশা আর বিধি-মূল্যমানজনিত অতিশয় মিলিটারি শাসনের দশা দুইটাই তামাম বিশ্বে উৎকটরূপ ধারণ করার পর রচনার ল্যাজামুণ্ডু বিভাজন আলাদা করে কোনো বড় বিষয় আর নাই। ইংরাজি রচনার বিশ্বশাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হবার পর বাংলায় অন্তত যা কিছু রচনা করতে-পারাই বিপ্লবাত্মক বলে গণ্য করা দরকার। তাছাড়া রচনাকে জৈবদেহের সাথে তুলনা করার দু’চারশ’ বছরের অভ্যাসকেও আমি অপছন্দ করি। জৈবদেহসমূহও হাতির মতো প্রকাণ্ড ও শূঁড়ওয়ালা থেকে শুরু করে কেঁচোর মতো আগাপাছতলা সমরূপ কিংবা বাদুড়ের মতো বদনপায়ু একাকার ইত্যাদি নানাবিধ হয়ে থেকে। ওই ধরে আগানোর সুবিধাই তো তেমন নাই। উপরন্তু ‘অভিভূমিকা’ শব্দটার কোনো অর্থ আগে থেকে ছিল এরকম কোনো প্রমাণও আমি পাইনি। আমি কেবল আশা করছি একটা সমাসবদ্ধ শব্দ হিসাবে ‘অভিভূত করতে পারে এমন একটা ভূমিকা’ হিসাবে একে পাঠক পাঠ করুন, কোনো  সংশয় ছাড়াই।   

‘লালসালু’ চলচ্চিত্রের দৃশ্য

এই শিরোনামে একটা রচনা লিখবার জন্য আমি নিমন্ত্রিত ও প্রতিশ্রুত হই প্রায় ২০ বছর আগে, ২০০৩ সালে। এইভাবে বলাতে ভুল ইতিহাস চর্চা হলো। আসলে আমি একটি চলচ্চিত্র-বিষয়ক রচনা লিখতে নিমন্ত্রিত হই। আর আমি প্রতিশ্রুতি দিই লিখব বলে; আর আমার নিজেরই কল্পিত শিরোনামটি হয় এরকম, যেভাবে এখন মুদ্রিত আছে। চলচ্চিত্র নিয়ে ভাবেন, তখনও ভাবতেন, এমন দুজন সম্পাদক একত্রে একটি বাংলা কিতাব করার প্রাক্কালে এই জগতে আমারও ভাবনা আছে এরকম একটা দয়ালু বিবেচনা থেকে আমাকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। দুজন কাজটি করলেও আমার সঙ্গে নিমন্ত্রণ-উত্তর যোগাযোগ ছিল মুখ্যত একজন সম্পাদকের। তাঁদের কিতাবখানার অনুধাবন/ইনসেপশন ছিল তাঁরা যেসবকে ‘‌বিকল্পধারার চলচ্চিত্র’ বলে ডেকে আসছিলেন সেসব ঘিরে। যদিও আমি এক লহমায় বুঝে যাই যে বিকল্পধারাকে বন্দনা করার অঘোষিত একটা চাকুরিবিধি এখানে থাকবে, তবুও, স্বভাবদোষে, আমি অন্য রাস্তা নিই। হতে পারে শিরোনামেই তা সুষ্পষ্ট। আমার ভাবনা ছিল তিনখানা চলচ্চিত্রতে আমি মনোযোগ দেব। তখনকার শিরোনামের সমান্তরাল সহ-শিরোনাম ব্রাকেটবন্দি ওই তিনখানা ছবির নাম ছিল। এর মধ্যে কীভাবে যেন, তখনকার দিনে, একখানা ছবির সিডি আমি জোগাড় করতে পারলেও অন্য দুটোর জোগাড় আমার সাধ্যে কুলাচ্ছিল না। কখনো একবার চকিত দেখার বদৌলতে রচনাটা আমি আগাতে চাইছিলাম না। ৩০০ শব্দের কিছু অধিক লিখেছিলাম কেবল ‘শুরু করেছি’ এই শান্তি বা সান্ত্বনা পাবার জন্য। অলস লেখকদের নিজেদেরকে নানান উপায়ে উস্কানি দিতে হয়। ওই ৩০০ শব্দ সুযোগ থাকলে এই রচনাতেও ভরে-দেবার ইচ্ছা আমার আছে। তো, তারপর আমি সম্পাদকদের যোগাযোগকারীজনকে অনুরোধ করলাম তিনি কোনোভাবে ছবি দুটি দেখানোর ব্যবস্থা করতে পারেন কিনা। আমি তখন একটা বিটিটিসি তারওয়ালা ফোনের মালিক, আমার জীবনে চতুর্থমাত্র স্থাবর সম্পত্তি, একটা টেবিলসমেত ৪৮৬ কম্পুটার, একটা গোদরেজ ফ্রিজ আর একখানা বিছানার অধিকন্তু। সম্পাদককে দুয়েকটা যোগাযোগে সাবলীল না শোনালে আমি তারপর জিজ্ঞাসাটা করেই বসি: ‘কোনো সমস্যা?’ তিনি জানালেন, যেহেতু তাঁর এই সার্কিটেই চলাফেরা করতে হয়, চিত্র পরিচালকের কাছ থেকে ছায়াছবি চেয়ে নিয়ে এসে আমাকে দেখানোর ব্যবস্থা করার পর তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থে সেই চিত্রের সমালোচনা স্থান পেলে তাঁর জন্য পরিস্থিতিটা ভাল থাকবে না। এরকম কিছু জানার পরও রচনাটি লিখবার আগ্রহ জারি রাখা আমার থেকে নির্দয় বলে পরিচিত এমন লোকের পক্ষেও অসম্ভব হতো। আমারও তাই হয়েছিল। রচনাটি কখনো আর লেখা হয়নি। ওই হতভাগা শ’ তিনেক শব্দকে, যেহেতু কম্প্যুটারে খুঁজে পাওয়াই গেল, কালের গহ্বরে বিলীন হতে না দিয়ে আমি এই রচনার তৃতীয় অংশের পরে মিশিয়ে দিচ্ছি; মানে কৈফিয়ৎটুকুর পরই, কোথাও না কোথাও। ‘বিকল্প’ বিশেষণটি এখন আর তখনকার মত ঠিক ততটা গুরুত্ব দিয়ে চলচ্চিত্রের নির্মাতা-বোদ্ধা-গ্রাহকেরা প্রয়োগ/ব্যবহার করেন না। তুলনায়, স্বাধীন চিত্রনির্মাতা এখন অপেক্ষাকৃত অধিক স্ব-নির্ধারণী বর্গ হিসেবে প্রয়োগ হয়ে আসছে। বৈশ্বিক ভাষাবর্গের প্রভাব আছে তাতে অবশ্যই। সেজন্যই এমনকি ইন্ডিপেন্ডেন্ট বা ‘ইন্ডি’ পর্যন্ত এখন জাগরুক ভাষাবর্গ এখানে। প্রবন্ধের নামে যে ‘বিকল্প’ পদবাচ্যটি সরালাম না, তার কারণ লিগ্যাসিটাকে স্মরণ করা যেমন, আমার (পরি)কল্পিত আদি রচনাটার প্রতি মায়ামমতাও বটে।           

কৈফিয়ৎ

সম্ভবত ইংরাজি রচনাতে এই অংশকে ডিসক্লেইমার বলা হয়ে থাকে। পাঠকদের পক্ষে এখন আমাকে বিশ্বাস করা ছাড়া কোনোই রাস্তা নেই যে এই রচনাটি পুনরায় আমি জিদের বশবর্তী হয়ে লিখতে বসি নাই। এটা কাকতালীয় সংযোগ মাত্র। বর্তমান পত্রিকার সম্পাদক আমাকে রচনায় উদ্বুদ্ধ করলে আমি চলচ্চিত্র বিষয়ে লিখব বলেই প্রাথমিক ভাবনা ভেবেছিলাম। এমনিতে বাংলাদেশের যাসবকে বিকল্প ধারা বলা হচ্ছিল সেসবের মধ্যে যৌনতার বোধ, ধর্মের উপলব্ধি, শ্রেণীর চৈতন্য কিংবা এমনকি জাতীয়তাবাদী প্রকরণ ইত্যাদি নিয়ে দু’চার কথা বলার আগ্রহ আমার বলবৎ থেকে গেছে এই বছরগুলিতে। যখন ও যতটা বলেছি চলচ্চিত্র নিয়ে, এর কোনো না কোনো অনুষঙ্গ আমার বিষয়বস্তু ছিল। তারপরও এই রচনাটার শিরোনাম সমেত ওই শ’ তিনেক শব্দের কম্পু-ফাইলখানা খুঁজে পাওয়া আকস্মিক। অন্য কিছু খুঁজতে গিয়ে চোখে পড়ে। ফলে, যদি কোনো রস এই রচনার প্রেষণা হিসাবে সাব্যস্ত করতেই হয়, তা হবে কৌতুকরস, কিছুতেই জিদরস নয়।

তিনটার জায়গায় দুইটা ছবি হয়ে পড়া খানিকটা আলসেমিজনিত কারণে, খানিকটা হয়তো বার্ধক্যজনিত (বা প্রজ্ঞাজনিত) বাহুল্যবোধ। কারণ, আমি যা বলতে চাই তা দুইটা, একটা, এমনকি একটাও-না ধরে বলা যেতে পারে। আলোচ্য দুটা ছায়াছবির একটি অতি সমাদৃত, অন্যটি বাস্তবে ভুলভালভাবে সমালোচিত ও নিগৃহীত, অবশেষে নিষিদ্ধ, হবার কারণে এক পাটাতনে রেখে আলাপ করা দুরূহ চাপেরও বটে। কিন্তু নিষিদ্ধ হবার কারণে অপেক্ষাকৃত কম দর্শক পেয়েও রুচিশীল মধ্যবিত্তের শিল্পচেতনার মধ্যে দীর্ঘ উদ্যাপনের স্মারক সেটা থাকতে পেরেছে। কেবল সেই বিচারবোধ থেকেই লালসালুর পাশাপাশি বৃষ্টিকে রাখা গেছে। নাহলে, যেমনটা বললাম, ছবি হিসেবে বৃষ্টি যে ধরনের নিগ্রহের অভিজ্ঞতা পেয়েছে, কিংবা এর পরিচালক, আর লালসালু যে ধরনের সমাদর পেয়েছে, বা হালিদুয়েক জাতীয় পুরস্কার, তার আলোকে ছবিদুটোর একত্রিত থাকা বেমানান। আবার দুটির মিলও কম নয়, যে কারণে আমার আলোচ্য বিষয়। দুটোই কথাসাহিত্য থেকে গল্প আশ্রয় করেছে, যথাক্রমে আলাউদ্দিন আজাদ রচিত গল্প এবং সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ রচিত উপন্যাস। দুটোতেই ধর্মপালনকারী প্রটাগনিস্ট বা নায়ক (যদি অপছন্দ করেন অবশ্যই প্রতিনায়ক)। তবে কেইসস্টাডি শব্দটা লেখার সময় পরিহাসমূলকভাবে কেইস কথাটি মনে টোকা দিল। বৃষ্টি ছায়াছবিটি নিয়ে যতদূর মনে পড়ে হৈচৈয়ের একটা কারিগর ইসলামিক ফাউন্ডেশন। মনে পড়ার বিষয় বা যতদূরের প্রসঙ্গ অতিশয় জরুরি এখানে। এমন নয় যে আপনি গুগল করলেই ভুরভুর করে সব তথ্য পেয়ে যাবেন। এমনকি বৃষ্টি ছবি নিয়ে কিছুই না পেতে পারেন এর মুক্তিসন বা কলাকুশলী ছাড়া। তো, মনে পড়ার ভরসায় বলি, ওই সময়ের বাংলাদেশেও ‘ভাবমূর্তি’ কিংবা ‘ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত’ এসব শব্দমালা সরকারসমূহের একই রকম প্রিয় ছিল। তা সত্ত্বেও ঠিক এই ভাষাতে এই ছবির বিরুদ্ধে আগায়নি সরকার। বরং, যতটা মনে পড়ে, পবিত্র কুরআনের আয়াত ও বাণীসমূহকে বিকৃত করার অভিযোগ ছিল ছবিটির বিরুদ্ধে। যতটা মনে পড়ে বলতে হচ্ছে, কারণ এর বিকল্প রাস্তা কেবল ভুক্তভোগী ও বিচার কর্তৃপক্ষের সাক্ষাৎকারগ্রহণ। সেটা আমি এড়িয়েছি বটে। কিছুতেই পাবলিক দলিল হিসাবে খুঁজে কোনো খবর এখন আমার নাগালের মধ্যে নেই। যদি আমার মনে পড়া সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে সেটাও খুব চিত্তাকর্ষক একটা প্রসঙ্গ। ‘নিষিদ্ধ’ হবার পর ছায়াছবিটির পক্ষ থেকে এর নির্মাতা ও তাঁর মানুষজন নিশ্চিত করেছিলেন যে তাঁরা ইসলামিক ফাউন্ডেশন কিংবা এরকম কোনো ‘কর্তৃস্থানীয়’ পক্ষ থেকেই তাঁদের অভিনেতাদের উচ্চারণগুলো সিদ্ধ করিয়ে এনেছিলেন। দর্শক হিসাবে আমি আরবী উচ্চারণ কিংবা অভিনয় কোনোটারই বিচারক হবার ন্যূনতম কোনো যোগ্যতা রাখি না। কিন্তু পর্দার অভিনেতাদের নড়নশীল ঠোঁটের সঙ্গে উচ্চারিত আরবী যে বেখাপ্পা রকমের বেমানান ছিল সেটা বোঝার জন্য এমনকি ওই গ্যেটে ইন্সটিটিউটের প্রদর্শনকালটুকুই যথেষ্ট ছিল। ছবিটার পক্ষে জনসমর্থন আদায়ের ইচ্ছাতে, এবং প্রিমিয়ার হিসাবে, ওই প্রদর্শনীটি হচ্ছিল। ফলে আমি আন্দাজ করেছি যে নির্মাতাপক্ষ যত নিখুঁতভাবেই আরবী উচ্চারণ সিদ্ধ করান না কেন, তা ঘটেছিল স্বরসংযোগের সময়, যাকে ‘ডাবিং’ বলে থাকেন চিত্রজগতের মানুষজন। ক্যামেরার সামনে অভিনয়ের সময়ে ওই সিদ্ধকরণ সাধিত হয়নি। কিন্তু সেটা খোলাসা করে বলতে সরকারপক্ষ অপারগ ছিলেন। হতে পারে, সমস্যাটা তাঁরা আমার মতো করে ধরতে পারেননি। কী যেন একটা গোলমাল ঘটেছে তাঁরা বুঝে থাকতে পারেন, কিন্তু ওই দৃশ্যমান ঠোঁটগুলো যে আরবীর ভার বহন করতে পারেনি, বরং কণ্ঠ পেরেছে এই শ্রুতিদৃশ্যসম্পাদনামূলক ঘোরপ্যাঁচ সরকারী কর্মকর্তারা না বুঝে থাকতে পারেন। বিশেষত, বিভিন্ন সরকারী দপ্তরের লিখিত দস্তাবেজ পড়লে তাঁদের কর্মচারীদের বোঝাবুঝিজনিত একটা ফয়সালা করা যায় বলে এরকমটা মনে হয়েছে আমার।

পরিচালক মোরশেদুল ইসলাম

অ্যাবস্ট্রাক্ট নয়; বরং কংক্রিট পদ্ধতিগত প্রস্তুতি

অভিভূমিকা আর কৈফিয়তের পর আবার করে রচনাতে যা দস্তুর সেই মূলভাব বা এবস্ট্রাক্ট লেখা বাড়াবাড়ি হতে পারে। ফলে আমি কংক্রিট কিছু নিয়ে আলাপের পক্ষপাতী। দর্শকদের কংক্রিট প্রস্তুতি নিয়ে আলাপ চলতে পারে। এই ছবিদুটো দেখার জন্য দর্শকদের নানান রকমের পূর্বপ্রস্তুতি থাকা দরকার। সেটা অবশ্য বৌদ্ধিক-সাংস্কৃতিক উৎপাদের ক্ষেত্রেই সাধারণ একটা সত্য। কিন্তু ছোটকাগজের জীবিত জমানায় যেমন সেগুলোর কোনো-কোনোটার সঙ্গে সম্পর্কস্থাপনের জন্য সাহিত্য-পাঠকের কিছু বাড়তি তোড়জোড় থাকা কাজের হয়ে থাকত, ঠিক তেমনিই এই ছবিদুটোর ক্ষেত্রেও বাড়তি ও স্বতন্ত্র কিছু প্রস্তুতি দর্শককে গুরুতর বৌদ্ধিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।

সাধারণভাবেই ঢাকায় চলচ্চিত্র পর্যালোচনার ক্ষেত্রে এফডিসি-নির্মিত ছবি এবং সংসদকর্মীদের বানানো ছবির মধ্যে পার্থক্য করা হয়ে থেকেছে খুব মোটা দাগ দিয়েই। আমি নিশ্চিত এই রকম মোটা দাগ এই বিভাজনের ক্ষেত্রে জরুরি বটে, আর সেটা নিছক ঢাকাই তৎপরতা মাত্র নয়। এটাও নিশ্চিত যে অধিকাংশ পর্যালোচকের সঙ্গে ফারাক যা কিছু আমার হবে তা বিভাজন প্রক্রিয়া নিয়ে। যাঁরা চলচ্চিত্র নিয়ে আলাপ করেন নান্দনিকতার বরাতে, তাঁদের অন্যতম মুখ্য একটা বক্তব্য হচ্ছে, সেটা তেমন পরিষ্কার উক্ত না যদিও, এফডিসি-চলচ্চিত্র গুরুতরভাবে কিছু নির্দিষ্ট প্রসঙ্গ/থিম আশ্রয় করে সংগঠিত। উল্লেখকৃত প্রসঙ্গরাজির মধ্যে রয়েছে হিংসা, ধর্ম, যৌনতা ইত্যাদি। বছর কুড়ি আগে এই বক্তব্যগুলোর সঙ্গে মানানসই কিছু নথিপত্র জোগাড়ও সম্পন্ন ছিল। অর্থাৎ, এফডিসি-চলচ্চিত্রগুলো নিয়ে নন্দননিষ্ঠ আলোচকদের বচনগুলোর প্রামাণ্য হিসাবে কিছু বস্তু হাতের নাগালে ছিল, যাতে উদ্ধৃতি বা রেফরেন্স দেয়া যেতে পারত। এত বছর পর, এফডিসি প্রায় জাদুঘরীয় একটা প্রতিষ্ঠানে, বা অন্তত সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মর্যাদায়, পর্যবসিত হবার পর, এইসব নথি না-জোগাড় করতে পারার কারণে আমার অনেক ক্ষয়ক্ষতি হবে না। যাহোক, হিংসা-ধর্ম-যৌনতা ইত্যাদি বিষয়বস্তুর উপর এফডিসি-চলচ্চিত্রগুলোর নির্ভরশীলতা বিষয়ক এই বক্তব্যটি গুরুতর পর্যবসনকারী, ও নিরর্থক, বিশেষ। এটা নাকচ করে ফেলে এমন কিছু প্রস্তাবনা যাতে এসব প্রসঙ্গ চর্চাকারী হিসেবে এফডিসি-বহির্ভূত ছবিগুলোকে বিবেচনা করা বিশেষ কঠিন হয়ে যায়। উল্টা বরং, বাংলাদেশে বিকল্প-ব্যবস্থাপনায়-নির্মিত ছবিগুলোর কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে ধর্মকে এবং যৌনতাকে দেখবার পক্ষপাতী আমি। সঙ্গে কোনো না কোনো ধরনের জাতীয়তাবাদকেও গুরুত্ব দিয়ে রাখব। এই প্রস্তাবনার মাধ্যমে আমি অন্যান্য বিষয় বা থিমের ক্রিয়াশীলতা অস্বীকার করি না, কেবল জোরারোপ করতে চাই যে প্রসঙ্গগুলো নিরন্তর অন্তর্প্রবিষ্ট। বর্তমান প্রবন্ধটিতে আমি দুইটা ‘বিকল্প’ চলচ্চিত্রে মনোনিবেশ করবার ইচ্ছা করি যেগুলো দুই দশক আগে শিক্ষিত মহলে জাগরুক ছায়াছবি ছিল। এবং আলাপ করতে চাই কী প্রক্রিয়ায় ও ভাবনায় ধর্ম এবং যৌনতা সেখানে পরিবেশিত; কী দর্শকত্ব উৎসারিত হয় এই ছবিগুলো পাঠে কিংবা দর্শনে। দুইজন চলচ্চিত্রকারের বানানো এই ছবিগুলো ২০০০-২০০৩ এই তিন বছরে ঢাকায়, আমার রচনাটির আদিপ্রস্তুতির সময়কাল পর্যন্ত, এবং তারপরও, আলাপিত বিষয়। তফাৎ এই যে এর মধ্যে লালসালু সাইবারস্পেসে সুলভ, এবং বৃষ্টি সর্বত্রই দুর্লভ। দুটি ছবির বেলাতেই একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এগুলো বেড়ে উঠেছে কথাসাহিত্য থেকে নেয়া কাহিনীর উপর, এবং দুটোই অত্যন্ত পাঠকপরিচিত কাহিনী।

কথাসাহিত্য-কাহিনী বেয়ে ছবি বানানো নিশ্চয় বড় চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। এক্ষেত্রে চলচ্চিত্রকার কাহিনীকারের অনুবর্তী, এবং তিনি তাঁর পূর্বসূরীর থেকে নীতিনৈতিকতা (মর‌্যালিটি) বিষয়ে আরো স্তম্ভিত গোছের হলে কী পরিণতি হতে পারে সত্যজিৎ রায়ের ঘরে বাইরে তার উত্তম দলিল। কেন্দ্রীয় চরিত্রসমূহের রবীন্দ্রনাথ-প্রস্তাবিত বয়সগুলো পর্যন্ত সত্যজিৎ নিরাপদ মনে করতে পারেননি, এহেন গুরুতর, গূঢ় এবং গুহ্য সঙ্কটাদি সামাল দেবার প্রশ্নে। [১] দাম্পত্য মতাদর্শ, যৌনতা, গার্হস্থ্য পরিসর এবং অবশ্যই গত শতকের প্রথমভাগের স্বদেশবোধ এগুলো ঘরে-বাইরের মুখ্য থিম, ট্রিটমেন্টকৃত জায়গা। এখানে সত্যজিতের ছবিখানা আলোচ্য নয়। তবুও কথাটা তুললাম, কারণ ভিন্ন একটা শ্রেণী-পরিসরে এই দুটি ছবিতেই ঘরে-বাইরের অন্তত একটা থিম ক্রিয়াশীল, যৌনতা। মনোযোগ দিলে জাতীয়তাবাদের আকর বৈশিষ্ট্যের জিজ্ঞাসাও। অধিকন্তু ধর্ম একেবারে কেন্দ্রস্থ প্রসঙ্গ এই ছবিদুটিতে। দুটো ছবি দেখার সময়েই দর্শকের জন্য উপকারী হবে স্বীয় স্বীয় কর্মটির চরিত্রগুলোকে সাহিত্যিক দুজন যে সূক্ষ্মতা দিতে সচেষ্ট ছিলেন সেগুলো তাঁরা ছবিগুলোতে বিশেষ যদি আশা না করেন। বৃষ্টি ছবিতে দাড়িওয়ালা কলিমুল্লাহ সাহেবের দাড়ি ওযুকালে ভিজে যে তলোয়ারের মতো সূচাগ্র হয়ে উঠেছে, তা নেহায়েত অযত্নতাড়িত পাটের দাড়ি হবার কারণেই। পর্দার বাইরের আলী যাকের সাহেবের নিজের ব্যক্তিগত দাড়িকেই যে বড় করতে দিলেন না পরিচালক, সেটার নিশ্চয়ই পেশাজগতীয় ন্যায্য কারণ আছে। কিন্তু দর্শক কিছুতেই এরকম তলোয়ার-সদৃশ শক্ত দাড়ির কারণ বুঝবেন না, নির্মাণীয় অযত্ন ছাড়া। একই ভাবে কলিমুল্লাহ-পুত্র খালেদ (আজিজুল হাকিম) অন্তর্বাস-ছাড়া আলখাল্লা (আচকান) কেন পরবেন এই বিষয়ে দুর্ভাবনা না-দিয়েও দর্শকের উপায় থাকে না যেহেতু এইরকম দেহরেখা প্রদর্শনকারী কোনো ইসলামপন্থীকে দেখা দর্শকের জীবনে বস্তু-দুনিয়ায় ঘটে থাকে না। পরিশেষে, দর্শকের মানতেই হবে যে মহৎ কোনো কিছু নির্মাণে এরকম গৌণ বিষয়ে নির্মাণীয় অযত্নকে আমলে আনা চলবে না।

ঠিক সমধর্মী সঙ্কটের মধ্যে লালসালু নিয়ে দর্শকের পড়তে হবে না। বাস্তবজীবনে রাইসুল ইসলাম আসাদ দাড়ির মালিক না হলেও, এই ছবিতে তাঁর দাড়ি এত বাস্তবসম্মত যে ওই দাড়ি গজিয়ে নিয়ে তিনি কাজ করেছিলেন বলেই মনে হয়। এই ছবিতে পৌনে দু’ ঘণ্টা ধরে দর্শকের পারপাস নিয়ে কুস্তি-লড়া করা লাগতে পারে। ছবিতে কী ও কেন দেখানো হচ্ছে তা বুঝতে বুঝতে, এমনকি হয়তো তেমন কিছু না বুঝতে-বুঝতেই, ছবির ক্রেডিটলাইন যে চলে আসবে তার নিশ্চয়তা দেয়া যায়। দৃশ্যগল্প হিসাবে কোনটা অধিক ছড়ানো-ছিটানা, আউলা-ঝাউলা কিংবা কোনটা অধিক সন্তোষবিধান করবে তা নিয়ে নিশ্চিত হওয়া কঠিন হবে মনোযোগী দর্শকের পক্ষে। তাছাড়া এরকম একটা তুলনামূলক ভাবনাচিন্তা করার জন্য দর্শকের জন্য অনুকূল পরিবেশও নেই। লালসালু ইউটিউবে পাবেন দর্শক, বৃষ্টি কোথাওই পাবেন না। এমনকি পরিচালক মোরশেদুল ইসলামের উইকিপিডিয়ার বাংলা পাতাতেও ছবিটির নাম উল্লেখ পাবেন না। তুলনামূলক আলোচনা করতে না-পারার একটা দশার মধ্যে আমার স্মৃতিকে ভরসা করা ছাড়া উপায় ছিল না আমার; আপনাদেরও নাই। তবে সম্ভবত লালসালুর কর্ণবিদারী ‘লোকসঙ্গীত’ আবহের অনাচার বৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণভাবে কম ছিল। এখন, গ্রাম-বাংলাকে বোঝাতে যে ‘লোকসঙ্গীত’ই লাগবে এটা তো আপনারা সাধারণ জ্ঞানেই বুঝতে পারছেন, তাও কিনা ৪০-৫০ দশকের পূর্ব-পাকিস্তানীয় বাংলার গ্রাম, কিন্তু ওরকম উচ্চকিত স্টুডিওকেন্দ্রিক বাঁশি-দোতারাতে ‘জনপ্রিয়’ গানের সুর লাগাতার বাজতে থাকার কারণে ক্লান্তি ও বিরক্তি সামলানো একটা দর্শকীয় চ্যালেঞ্জ। নান্দনিক দিক থেকে এটা বিটিভির লিগ্যাসির সঙ্গে বরং অধিক মানানসই; তানভীর মোকাম্মেল হয়তো সেটাকেই নন্দনের জাতীয় রূপরেখা হিসাবে গ্রহণ করে থাকবেন। তবে আমার ধারণা কিছুটা অত্যাচার হয়তো জাতীয় পুরস্কারের নির্বাচকেরাও বহন করে থাকতে পারেন। নাহলে ৭/৮টা শ্রেষ্ঠ জাতীয় পুরস্কারবাহী এই ছায়াছবির সঙ্গীত বিভাগের পুরস্কারটা ফস্কে যাবার বোধগম্য কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। 

তবে পাঠকের কাছে আমার পরিষ্কার করে বলার আছে যে দুই ছবিরই এই প্রকারের খুঁটিনাটি আমার এখনকার প্রতিপাদ্য কিংবা লক্ষ্য কিছুই নয়। অভিনয়, পরিচালন, শিল্পসম্পাদনা, সঙ্গীত, পরিচ্ছদ/সাজসজ্জা, রূপসজ্জা, সংলাপ, সংলাপে ‘গ্রামভাব’-আনয়ন ইত্যাদি যা কিছু আছে তা আমার আজকের প্রতিপাদ্য নয়। যদি আদৌ কোনোকিছু আমার প্রতিপাদ্য হয়ে থাকে তা হলো গল্পপ্রবাহ, সেটাও এই কারণে যে নির্মাতাদের মূলভাবীয় গতিবিধি তথা থিমেটিক-স্কিমা নিয়েই আমি বলতে চেয়ে রচনাটা শুরু করেছিলাম। এখন আপনারা দুইটা আপত্তি তুলতেই পারেন। প্রথমত, অভিনয় থেকে সংলাপরচনা এগুলো নিয়ে বলবার আমি আদৌ কে? কেউ না, দর্শকমাত্র, মাথা গিজগিজ করে এমন এক দর্শক। কিন্তু আজ বলছি না, একান্ত পরিস্থিতিকালীন আলাপ না হলে। দ্বিতীয় যে আপত্তিটা তুলতে পারেন তা হলো, এখানে থিম/মূলভাব/গল্পপ্রবাহ নিয়ে কীইবা বলার আছে যেহেতু ছবিদুটো নির্মিত হয়েছে যথাক্রমে ৬০-এর দশকে প্রকাশিত আলাউদ্দীন আল আজাদের গল্প এবং ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র উপন্যাস অবলম্বনে। জ্বি না, যখন আরেকটি মাধ্যমে কিংবা কালে পূর্বগল্পটিকেই হাজির করা হয়, তখন নতুন মাধ্যমের চর্চাকারের তাফসির সেই উৎপাদটিতে থরে-থরে সাজানো থাকে। আলবৎ বলার আছে। এমনকি আর কিছু বলার না থাকলেও, যদি লেখকের বোঝাবুঝি ‘অবিকল’ ছবিনির্মাতা হাজিরও করে থাকছেন বলে ভাবা চলে, তারপরও বলা যাবে যে এই এদ্দিন পর এই বস্তু আপনি আনলেন তার হেতু কী!            

ধর্মবোধ: রাশিরাশি চিন্তাবিযুক্ত মানুষের মেলা

দুটি ছবিই তথাকথিত ‘গ্রামে’ স্থাপিত বলে দুই নির্মাতাদেরই ধর্মবোধকে গ্রামাশ্রয়ী হিসাবেই দেখতে হবে। ছবি নির্মাণকালে এমন কোনো হস্তক্ষেপ/ইন্টারভিনশন তাঁরা ঘটান নাই যে তাঁদের নাগরিক ধর্মবোধের কোনো উন্মেষ দর্শকে দেখতে বা টের-পেতে পারবেন। কীভাবে এই ইন্টারভিনশন ঘটতে পারত তা আমরা আশা করি সকলেই বুঝতে পারছি। এটা ঘটতে পারে, সাধারণভাবেই, কোনো না কোনো চরিত্রের উচ্চারিত সংলাপগুলো থেকে। বাস্তবে মোটামুটি আর কোনো রাস্তাই ছায়াছবি বা উপন্যাসে থাকে না। এতটাই সরল, যতই পেঁচিয়ে সাহিত্য-চলচ্চিত্রবোদ্ধারা আলাপ করে থাকুন না কেন। তবে নির্মাতাদের নাগরিক ধর্মবোধকে পাওয়া গেল না বললাম বটে, সেটা আপাতগ্রাহ্যে; বরং যে চৈতন্য থেকে তাঁরা ‘গ্রামের’, হোক তা ৫০-৬০ দশকের গ্রাম, ধর্মপ্রবাহকে চিত্রিত করেন, সেই চৈতন্যটা চিত্রনির্মাণের বৈপরীত্য (এডভার্সিটি) থেকে বুঝতে পারতে হবে। সেখানে দেখা যায় বৃষ্টির অধিনায়কদের সঙ্গে লালসালুর অধিনায়কদের গুরুতর কোনো প্রভেদ নেই। অবশ্যই প্রথমটির তুলনায় দ্বিতীয়টির ধর্মপালনকারীরা কখনো অধিক ক্রূর, কখনো অধিক কৌতূককর, মোটের উপর শিশুতোষ। সেটা আউয়ালপুরের বড়পীর সাহেবের সন্ত্রস্ত হয়ে বৃক্ষারোহণে হয়তো স্বতন্ত্র মাত্রা তৈরি করে থাকতে পারে, তবে নিছক সেটা বিবেচনা করেই বলছি না। ভয়ে বৃক্ষারোহণকারী এই চরিত্রটি রূপায়ন করতে আলী যাকের সাহেবের সম্মত হওয়া আমাকে অনেক ভাবিয়েছিল। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে কেবল বৃক্ষারোহণ বিদ্যা দেখানোর জন্য তিনি তাতে রাজি হননি। তবে নিজের বয়স বাড়তে-বাড়তে আমি বুঝতে পারি মানুষের জীবনে নানান ধরনের ঢেঁকিগেলা ঘটে থাকে, বন্ধুত্বের উছিলায়, আনমনে, অনবধানবশত, কিংবা ঢেঁকির মাপজোখ পুরাপুরি বুঝে-শুনেও। তাছাড়া জাতীয় সংস্কৃতি ও জাতীয় পুরস্কার এই দুইটাও যারতার সাথে যায় না। যাঁদের সাথে যায় তাঁদেরকে মানা-করারও বিশেষ কারণ নাই। ওদিকে লালসালুর মুখ্যনায়কের যাত্রাপথই ছলনার আশ্রয় করে, মূল উপন্যাস থেকেই যেটা এসেছে। তাহলে ছলনা-ক্রূরতা থেকে স্থূ্ল কৌতুকময়তা এই যাত্রাপথে লালসালুর ধর্মচর্চাকারী (গ্রামীণ) জনগণ থেকে গেছেন। 

তুলনায়, বৃষ্টির ধর্মচর্চাকারীগণ খানিকটা গুরুগম্ভীর বা ভাবগম্ভীর। ইংরাজিতে সিরিয়াস কথাটার বাংলা এই দুটারই আশপাশে যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ভাষামালাতে ‘ভাবগাম্ভীর্য’ খোদ এমন একটা তামাশার বিষয়ে পরিণত হয়েছে যে সিরিয়াস আলোচনায় সিরিয়াস কথাটির বাংলা ভাবগম্ভীর করার আর নির্লিপ্ত সুযোগগুলো নেই। ‘ভাবমূর্তি’ বিষয়ক তামাশা হয়তো আরো তীব্র, কিন্তু শব্দটির প্রিফিক্স/উপসর্গটি আলোচ্য শব্দটিকেও আচ্ছন্ন করে আরো ক্ষয়ক্ষতি করেছে। এগুলো বৌদ্ধিক দুনিয়ার নানান দুঃখজনক দুর্ঘটনা হিসাবেই দেখার পক্ষপাতী আমি। যাহোক, বৃষ্টির ধর্মচর্চিয়েগণ অধিক গাম্ভীর্যপূর্ণই শুধু নন, তাঁরা অধিক বিধানপ্রবণও বটে। তবে যুক্তিবিচারে সেটা হবারই কথা বটে। বৃষ্টির চালিকাশক্তি ‘গোঁড়ামি’ আর ‘যৌনতা’; সেখানে ধর্ম আবির্ভূত হয় ‘যৌনতা’র বিরুদ্ধে ‘গোঁড়ামি’ তথা বিধানপ্রদানকারী হিসাবে। সেখানকার চর্চাকারীদের তাই বিধানপ্রণেতাসুলভ তথা সাংসদীয় গাম্ভীর্যবাহী হিসাবে সাধারণ চিত্রকল্পই চিত্রনির্মাতা গ্রহণ করেছেন। কিন্তু এইসব আলাপ করাও খুব অসুবিধাজনক। এখন টেলিভিশনের কল্যাণে বাংলাদেশের সংসদ অধিবেশনের দৃশ্যাবলী ইচ্ছায় বা চ্যানেলবদলানির অভ্যন্তরীণ সময়ে অনেকেরই দেখা হয়ে গেছে। তাঁরা যদি ‘সাংসদীয় গাম্ভীর্য’ বুঝতে না পারেন, দোষ দেয়া যাবে না। ধর্মবোধের সূক্ষ্ম যে পার্থক্যগুলো তাহলে দুই ছবিতে পরিলক্ষিত হয় তা চিত্রনির্মাতা তরফে প্রায়োগিক। লালসালুতে ধার্মিকেরা মোটের উপর (ধর্মীয়) নেতার আনুগত্যবাহী প্রজাবিশেষ ও ছাগল-মুরগি উপহারদাতা। পক্ষান্তরে, বৃষ্টির ধার্মিকেরা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বিধানপ্রণেতা, বা অন্তত শাস্তিপ্রদানের লিপিকার; হালের কোর্টকাটারিতে যা কিনা জুরির ভূমিকা। তাঁদের এই জুরিসম ব্যক্তিত্ব অন্য ছবিটির জুড়িদার ব্যক্তিত্বের সাথে উল্লেখযোগ্য ভিন্নতা। ফলে, তত্ত্বকথার সেবনকারী চিন্তকেরা যাঁকে ‘এজেন্সি’ বলে থাকেন, তা হয়তো তাঁরা বৃষ্টি ছবির ধার্মিক/ধর্মচর্চাকার-দের মধ্যে অধিক ‘মাত্রায়’ পরিলক্ষণ করবেন। আমার সামান্য আগ্রহ যদিও, বলে রাখাই সুবিধাজনক!

বলাই বাহুল্য, দুই ছায়াছবির কোনোটাতেই (নাগরিক) দর্শকমনে ‘সিরিয়াস’ রেখাপাত করতে পারেন এমন কোনো ধার্মিকের আবির্ভাব ঘটে নাই। এখন এটা দোষ দেবার জন্য বললে হয়তো আজাদ বা ওয়ালীউল্লাহ সাহেবকেই দিতে হবে। কিন্তু ধরুন দোষ দিচ্ছি, এবং নির্মাতাদেরই দিচ্ছি। আজাদ সাহেব বা ওয়ালীউল্লাহ সাহেব ক্যামেরা তাক করে সামনের ২০জন ধার্মিকের সংলাপ রচনা করে ধারণ করেননি। উপরন্তু, মূল সাহিত্যে এইরূপ শিশুতোষ/পোলাপাইন্যা চিত্রায়ণ ঘটেছে বলেও আমার মনে পড়ে না।[২]  প্রজ্ঞা ও অনুভবে রেখাপাত করবেন এমন ‘ধার্মিক’ ছবিগুলোতে দেখতে না পাওয়া কোনো দৈবাৎ দুর্ঘটনা নয়; ওগুলোই আসলে এই নির্মাতাদের প্রকল্প, মিশন/প্রজেক্ট। কিছু স্থূল হলেও, প্রকল্পই। ‘দেখো দেখো (গ্রামের) ধার্মিকেরা কেমন হয়ে থাকে’ – এই ধরনের একটা প্রদর্শনী এগুলো। এই ধরনের প্রদর্শনী সূক্ষ্ম-বোধচালিত ও সূক্ষ্ম-রূপাশ্রয়ী হলে এক ধরনের সমস্যা হয়, স্থূল রূপাশ্রয়ী হলে আরেক ধরনের সমস্যা হয়। তবে উভয়ক্ষেত্রেই জনপদের আনাচে-কানাচে বহুবিধ রকমের ধর্মচর্চাকারীদের বাস্তবতা আড়াল হয়ে পড়ে। কিছুতেই তখন আর ওই জনপদ বিবেচনায় রাখা সম্ভব হয় না যেখানে একজন মসজিদের ইমামের কাছে কুমারী মাতা কিংবা ‘চরমপন্থী’ কম্যুনিস্ট আশ্রয় পেয়ে থাকতে পারেন। বাস্তবের বাংলাদেশে ও পূর্ব-পাকিস্তানে সেরকমই বরং ঘটেছে। মানে দাঁড়ালো, দুই নির্মাতাই ধার্মিকদের নানাবিধ রূপ ও অভিব্যক্তিকে উপলব্ধিতে রেখে তাঁদের গল্প হাজির করতে নিরাপদ বোধ করেন নাই। তাঁরা ধরেই নিয়েছেন যে এই পক্ষের লোকদের পর্যাপ্ত কৌতুককর দেখাতে না-পারলে ‘স্বগোষ্ঠী’তে প্রতিপাদ্য হাজির করা যাবে না। আর তা করতে গিয়ে বাস্তবে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় দুটিই কৌতুকপ্রদ কালচারাল-প্রডাক্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে ‘স্বগোষ্ঠী’ অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। নির্মাতাদের নগরের চিত্রসেবকবৃন্দ, তথা ‘সংস্কৃতিমনস্ক’রা, তথা ‘স্যেকুলার’বৃন্দ, তথা আমরা। এতকিছুর মধ্যেও উল্লেখ করে রাখছি যে বৃষ্টির জনপদীয় ইসলাম অনেক লিপিকেন্দ্রিক ইসলাম (স্ক্রিপচুয়েল), লালসালুর ইসলাম মাজার ও পীরকেন্দ্রিক। গত দুই আড়াই দশকের বাংলাদেশে লাগাতার ধর্মপালনের রূপান্তর ও লিপি-বিধির আধিপত্যের ইসলাম বিস্তারের মধ্যে এই ফারাকটি, আনমনে হলেও, মনে রাখার মতো।         

পরিচালক তানভীর মোকাম্মেল

যৌনতা: পিচ্ছিলতার রহস্যভরা কর্মকাণ্ড

কলিমুল্লাহ তাঁর নতুন স্ত্রীর সঙ্গে সম্মিলিত হবার বাসনা বোধ করছেন। নতুন স্ত্রী, সম্ভবত তৃতীয়া। তো তিনি আলিঙ্গনে স্ত্রীকে আবদ্ধ করতে যাচ্ছিলেন প্রায়। এমন সময় পিছন থেকে গুলিবিদ্ধ হবার মতো আর্তনাদ করে কঁকিয়ে উঠলেন। এই দৃশ্যকল্পের মাধ্যমে কলিমুল্লাহ’র পিঠে-ব্যথাকে দর্শকের সামনে হাজির করলেন চিত্রনির্মাতা। আর এই পিঠে-ব্যথার কারণে তিনি আর নতুন তরুণী স্ত্রীর সঙ্গে যৌনমিলনে যেতে পারলেন না। যেতে যে পারলেন না সেটা অবশ্য আলাদা করে সংলাপে বা পর্দায় ক্যাপশন দিয়ে জানালেন না পরিচালক, ওটুকু ভরসা তিনি দর্শকদের উপরে রেখেছেন। পিঠে-ব্যথাকে একটা সাধারণ অর্থোপেডিক-নিউরোলজিক্যাল সমস্যা হিসাবে দেখার অনেক সুযোগ নাই। দৃশ্যকল্প তথা গল্পপ্রবাহে একে দেখতে হবে অবশ্যই কলিমুল্লাহ’র ‘বার্ধক্য’ হিসাবে। ফলত, বার্ধক্যপীড়িত, মোটামুটি ৬০ ধরা যায়, কলিমুল্লাহ যে তরুণী স্ত্রীর সঙ্গে যৌনমিলনে অকার্যকর হলেন এটাও একটা সাধারণ নৈমিত্তিক প্রস্তাব হিসাবেই হাজির হয়েছে। গল্পকার আজাদ এই দৃশ্যটা প্রস্তাব করেননি, এটা বৃষ্টির চলচ্চিত্র-নির্মাতার নিজস্ব আবিষ্কার। তবে আজাদ ‘মৃতলোকের’ মতো শুয়ে থাকার বিবরণী পাঠককে জানিয়েছিলেন।

বস্তুত, বৃষ্টি ছায়াছবিটি প্রায় গল্পটির চিত্রপ্রবাহ ধরে আগায়। সেটা সম্ভব হয়েছে আলাউদ্দীন আল আজাদের দুর্দান্ত চিত্রায়নের কারণে, এবং ওটা ছোটগল্প বলেও। একটা উপন্যাসে যদি দারুণ চিত্ররূপ থাকেও সেগুলো একরৈখিকভাবে চলচ্চিত্ররূপ দিতে থাকলে পরিচালকের হেইম্যাট [৩] বানাতে হবে। তারপরও আজাদের প্রায় ছবির-মতো-দেখতে দৃশ্যরূপগুলোর বাইরে দু’চারটা জায়গায় সার্বভৌম দৃশ্যরচনা চিত্রপরিচালক করেছেন বলেই মনে পড়ে। আবারো পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিই যে এই ছবিটা দেখার কোনোরকম ব্যবস্থা চারপাশে আর নাই। স্মৃতিপাত্র থেকে উছলিয়া যা মনে পড়ছে তাতে ওই কলিমুল্লাহ ও জোহরার আলিঙ্গনকালীন বিপুল আর্তনাদটার কারণে মনের মধ্যে খোদাই হয়ে আছে, এমনকি ২০ বছর বাদেও, এমনকি একবার মাত্র পর্দাদর্শন সত্ত্বেও। আরেকটা দৃশ্য অন্তত রেখা কেটে গেছে মনে। সেখানে নবীনা জোহরা কলপাড়ে (টিউবওয়েল নাকি কূয়া তা ভুলে গেছি) বাসন বা কাপড় ধুচ্ছিলেন। তখন খালেদ, অর্থাৎ প্রথম পত্নীর গর্ভে পাওয়া হাজী কলিমুল্লাহর সেজ সন্তান, সেখানে সমীপবর্তী হন। বাসন (বা কাপড়) ধোবার গুণগত বৈশিষ্ট্যের কারণেই, সম্ভবত, জোহরার পোশাকের নিম্নাঞ্চল হাঁটুর কাছাকাছি পর্যন্ত উন্মুক্ত করে ফেলেছিল। সেদিকে খালেদের দৃকপতন ঘটে। অন্তর্বাসহীন আলখাল্লা পরিহিত খালেদ সেদিকে যেভাবে তাকিয়ে থাকেন সেই তাকানির গুণ ২০ বছর ধরেই আমার মনের মধ্যে স্থায়ীভাবে প্রোথিত হয়ে আছে। আবারও, স্বীকার করি, নির্মাতাবৃন্দ কিছুতেই ক্যাপশান আকারে লিখে দেন নাই যে ‘নতুন মায়ের পায়ের অনাবৃত অংশ দেখিয়া খালেদের মনে বাসনার উদ্রেক হইল’। কিন্তু একথা আমি জোর দিয়ে বলতে চাইব না যে ওই লিখে দেয়াই বরং অধিক সূক্ষ্ম বা আরামদায়ক হতো কিনা। বরং দৃশ্যপ্রস্তাবে জোহরার জঙ্ঘাঞ্চলের নিম্নভাগ উন্মোচন ও খালেদের সেই দিকে লোভাতুর দৃষ্টিনিক্ষেপ/-পতন আমৃত্যু মনে রাখতে পারার মতো এক ভিজ্যুয়াল নির্মাণ। এই কিসিমের কোনো কল্পদৃশ্য (বা দৃশ্যকল্প) আজাদ প্রস্তাব করেন নাই বলে মনে পড়ে। তিনি যদি তা করেও থাকতেন তার এই প্রকারের গরু-এঁকে-গরু-লিখে দেবার মতো হবার সম্ভাবনা কম থাকত। অর্থাৎ, দর্শকদের নির্মাতা ‘বুঝিয়ে-দেবার’ দায়িত্ব নিয়েছিলেন যে কী-কী উপায়ে বিভিন্ন লিঙ্গের সমবয়স্করা পরস্পর (যৌন) আকর্ষিত হতে পারেন। ফলে খালেদের দৃষ্টিনিপতন আর খালেদপিতার পৃষ্ঠবেদন দুইটা কাঠামোগতভাবে সম্পর্কিতভাবে যৌনযুক্তি সরবরাহ করেছে। আলাউদ্দীন আল আজাদ বরং একটা জায়গায় ‘কপোতের বুকের মতো উষ্ণ’, ‘প্রবালের মতো কোমল’ ‘কীসের মধ্যে যেন’ খালেদের হাতের আঙুল সঞ্চালিত হয়ে যাবার বার্তা দিয়েছেলেন। এতে ‘কীসের মধ্যে’টা নিয়ে পাঠকের একটা সুলাহ হয় বটে। নতুন মায়ের (জোহরা) কোল থেকে পুরাতন মায়ের ছোটপুত্রকে, নিজের ছোটভাইকে, নিতে গিয়ে খালেদের আঙুলের ছোঁয়া, জোহরার স্তনে লেগে থাকতে পারে। আজাদ সাহেবের প্রবালের কোমলত্বটা একটু চ্যালেঞ্জিং, কিন্তু মোটের উপর এই স্বল্পমাত্রা ও সীমিত পরিসরের দৃশ্যায়নের ছন্দ আজাদের ছিল। লক্ষ্য করবেন পাঠক, আমি ‘সংযম’ বলছি না, ‘ছন্দ’ই বলছি, কারণ আমার বিশেষ কোনো ‘রুচিভারের’ সমস্যা নাই। এখানে আলোচ্য হচ্ছে কোনো একটা বিষয়বস্তু, ধরা যাক যৌনতা, পরিবেশন করতে গিয়ে কীসব হামানদিস্তা পূর্বকল্প/এসাম্পশন নির্মাতারা হাজির করছেন সেটা।

বৃষ্টির যৌনতা-অনুধাবন/পরিবেশন যদি বয়সবাদী, গোঁজামিল আর সরল (স্থূল আন্দাজ অর্থে) হয়ে থাকে, লালসালু’র যৌনতা তাহলে অদৃশ্য-থাকতে-হবে এই দায়ে অপসৃতপ্রায়। কিন্তু আন্দাজ/পূর্বকল্পগুলো আগাপাছতলা একই। উপন্যাসের নায়ক, তথা খলনায়ক, মজিদ একাধিকবার নারীদেহপানে তাকান। পরিচালকও একাধিকবার মজিদের গেইজে ক্যামেরা তাক করেন। স্ত্রী হবার আগে রহিমার পিছনেও ক্যামেরা তাক করা হয়েছিল বার দুয়েক অন্তত। এর বাইরে সালুঘেরা মাজারে আসা ভক্তিশীলাদের কারো কারো প্রতি, বাড়িতে আশ্রিতার প্রতি, কিংবা খালেক বেপারীর স্ত্রী আমেনার প্রতি। মজিদের এই দৃকপতনে ‘যৌনলালসা’ বোঝাতে তাঁর দৃষ্টিকেই অবলম্বন করতে হয় নির্মাতার। তবে মোটের উপর এগুলোর কোনো বিস্তার নাই ছায়াছবিতে। এমনকি কখনো কখনো বেখাপ্পা রকমের অব্যক্ততার আশ্রয় করা হয়েছে। খালেক বেপারীকে ফুঁসলে তাঁর স্ত্রীকে তালাক দেয়ানো মজিদকে বিশেষ কোনো কর্মকাণ্ড করতে দেখা যায় না, এমনকি ভাবতেও দেখা যায় না সেই তালাকপ্রাপ্তা সম্বন্ধে। এটা ঠিকই যে অন্যপুরুষের স্ত্রীর প্রতি যৌনাকর্ষণের কারণে সেই অন্যপুরুষকে যৌনাকর্ষণকারী পুরুষের তালাক-দিতে-উৎসাহকরণ উপন্যাসেই আছে, চলচ্চিত্র পরিচালকের অনেক কিছু হয়তো করার ছিল না; তবে এই ফুঁসলানোর যুক্তিসিদ্ধ কারণ বস্তু-দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া মুস্কিল। সেটা অন্য আলাপ। বস্তুত, মজিদের দ্বিতীয় স্ত্রী জমিলাকে হাজির করেও লালসালু যৌনতার গুরুতর কোনো উদ্ভাস রাখেনি দর্শকের মনোজগতে। জমিলা বরং ‘ধর্মদ্রোহী’ কেবল। সারাংশে, মজিদের ‘কুদৃষ্টি’ (সাহিত্যে যেহেতু এই শব্দ দিয়ে নানান লোকে নানান কিছু বুঝে এসেছেন তাই বলা) ব্যতিরেকে পুরুষের বহুস্ত্রীগ্রহণ পর্যন্ত এই ছবির যৌনতার পরিমণ্ডল। বিশেষ কোনো গোঁজামিলের ব্যাপার নাই। অসহনীয় সারল্য আছে বড়জোর।

টীকা

১। অন্যের কথাসাহিত্য ভর করে ছবি বানানো সত্যজিতের একদম মৌলিক বৈশিষ্ট্য, একদম শুরুর সময় থেকেই। এগুলোর মধ্যে আমার বিবেচনায় গণশত্রু আর ঘরে বাইরে তাঁর দুর্বল এবং/বা দ্বিধাগ্রস্ত এবং/বা আদর্শের ভারবাহী কাজ। দুটোর মধ্যে ঘরে বাইরে আবার যৌনতা ও জাতীয়তাবাদ দুইটা গুরুভার উপজীব্য আশ্রয় করেছে। এই ছবি অবলোকন করে সত্যজিৎকে রবীন্দ্রনাথের তুলনায় ভাবলেও অধিক যৌনসন্ত্রস্ত মনে হয়। তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাবিত বয়সগুলোতে, যথাক্রমে ২২, ২৬ ও ২৮, থাকতেও আরাম পান নাই। যৌনতাকে আরো মুরুব্বিদের কাজকর্মের এলাকা হিসাবে দেখেছেন। বিমলা ও সন্দ্বীপের চুম্বনে অভিনেতারা অধিক মনোবেদনায় ছিলেন নাকি পরিচালক নিজে তা নিয়ে জিজ্ঞাসাবোধ না করে দর্শকের চলচ্চিত্রসেবন অসম্ভবপ্রায়। আর বিমলার ‘পাপবোধ’ প্রায় পরিচালকীয় ঐশীবিধানের মতো অনুভূত হয়েছে, যার থেকে রবীন্দ্রনাথের ‘ট্রিটমেন্ট’ কম মর‍্যালিস্ট ছিল বলে দাবি করি। সব মিলে সত্যজিতের নিকৃষ্ট ছবিসমূহের একটা হিসাবে ঘরে বাইরে বারংবার আমার উদাহরণে আনতেই হয়।  

২। এরকম ‘সিরিয়াস’ ধার্মিক তানভীর মোকাম্মেলও অন্তত একবার চিত্রিত করতে পেরেছেন বলে মনে পড়ে; একাধিকবার করে থাকলে আমার দেখাদেখির দুনিয়ার বাইরে থেকে গেছে। রাবেয়া ছায়াছবিতে (২০০৮), এন্টাগোনিস্ট/খল/পাকিস্তান রাষ্ট্রপন্থী মামা (আলী যাকের) মানসিক টানাপড়েনে অগ্রজ প্রাজ্ঞের কাছে যান। সম্ভবত আমিনুল হক করছিলেন এমন এক চরিত্র। তিনি যাকের সাহেবের অত্যন্ত কঠিন টানাপড়েনের সামনে প্রজ্ঞা ও প্রসন্নতার রাস্তা বাতলাতে থাকেন। সাইবাররাজ্যে তথ্যাবলী যারপরনাই কম, ফলে স্মৃতি থেকে বলতে গিয়ে চরিত্রগুলোর নাম বলতে পারলাম না। ছবিটা ইউট্যুবে পাওয়া যায়। দেখা যেতে পারত, কিন্তু রচনা শেষ করার আগে দেখিনি আর। প্রসঙ্গত, আন্তিগোনের কাঠামোতে তৈরি একটা স্থানীয় গল্পরূপ রাবেয়া তানভীর মোকাম্মেলের খুবই পোক্ত একটা কাজ বলে আমি বিবেচনা করি।    

৩। ঘণ্টা ৬০ দৈর্ঘ্যের এক জার্মান ছায়াছবি। পাঁচটুকরা ছবির প্রথমটি ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত হয়। ক্যাম্পাস জীবনে চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মধ্যে সাব্বিরভাই জহির রায়হান চলচ্চিত্র সংসদ থেকে প্রায় ১৬ ঘণ্টার ছবিটি ক্যাম্পাসে দেখানোর বন্দোবস্ত করেন। সেটা দেখতে বসেছিলাম ১৯৮৯ সালে সম্ভবত; সেটুকু মনে পড়াতে এই ছবির নাম নেয়া। এইসব দুরূহ মালামাল দেখানোতে সাব্বির ভাইয়ের কৃতিত্ব বলার জন্য একটা টীকা পর্যাপ্ত নয়। তিনি কিছুকাল জাহাঙ্গীরনগরের ইংরাজি বিভাগে শিক্ষকতাও করেছিলেন। তবে চলচ্চিত্র সংগ্রাহক, সঞ্চালক, সমঝদার, সেবনকারী ছাড়া আর কোনো পরিচয়ে হয়তো নিজেকেও তিনি দেখেন নাই কখনো। 

(আদাবর, ঢাকা। ৬ জুন ৮ আগস্ট ২০২১। প্রকাশ: তত্ত্বতালাশ, দ্বিতীয় সংখ্যা, অক্টোবর ২০২১)


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

মানস চৌধুরী

লেখক, শিক্ষক ও নৃবিজ্ঞানী

মন্তব্য করুন