Select Page

২০২৩ সালে দেখা পছন্দের বাংলা সিনেমা

২০২৩ সালে দেখা পছন্দের বাংলা সিনেমা

বেশি হলে মার্কেট বা পাড়া, ইন্ডাস্ট্রি তো কোনভাবেই না…

আদিম: টঙ্গীর বস্তিতে সাত মাস বসবাস করে, এম্বিয়েন্স সাউন্ডে সম্পূর্ণ অপেশাদার অভিনেতাদের দিয়ে অভিনয় করিয়ে অসাধ্য সাধন করেছেন পরিচালক যুবরাজ শামিম। বিনিময়ে পেয়েছেন রাশিয়ার মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পুরস্কার।

রক্তজবা: ঈদের একদিন আগে চুপিসারে আইস্ক্রিন নামের ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পাওয়ায় বেশিরভাগ দর্শক এই সিনেমাটা দেখেন নাই। নিজের মেয়েকে খুঁজে বের করতে যাওয়া একজন বাবার পথসঙ্গী হন একজন ছিনতাইকারী আর একজন পতিতা। এই নিয়েই সিনেমার গল্প। মাত্র দেড় ঘন্টার সিনেমাটার সবচেয়ে দুর্বল জায়গা এ রানটাইম, ইজিলি আরও ১৫ মিনিট বাড়ানো যেতো এবং তাতে আরও চমৎকার হত।

সিনেমার ছোট্ট কিন্তু ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটি রোলে অভিনয় করেছেন জয়িতা মহলানবিশ। আমার কাছে এই মুহূর্তে তাকে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা অভিনেত্রী মনে হয়। সো কল্ড গ্ল্যামার বা ভিউ নেই বলে তার সেভাবে ইন্টারভিউও খুঁজে পাবেন না। গতবছর মুক্তি পাওয়া ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডজয়ী সিনেমা ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’তে তিনি দুর্দান্ত অভিনয় করেছিলেন। শি ইজ এ জেম!

ওরা ৭ জন: মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা এই দেশে বানানো সবচেয়ে রিস্কের ব্যাপার। বেশিরভাগ দেখতে চায় না, বেশিরভাগ ঠিকঠাক বানাতেও পারেন না। খিজির হায়াত খানের সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘মিস্টার বাংলাদেশ’ দেখে ভীষণ আশাহত হয়েছিলাম বলে এই সিনেমাটা দেখার ইচ্ছা ছিল না। তবে দেখে কিছুটা অবাকই হয়েছি। যুদ্ধের সিনগুলো ভীষণ যত্নের সাথে করেছেন পরিচালক। সবচেয়ে ভালো লেগেছে সিনেমার সাউন্ড ডিজাইন, যার পেছনে অবদান রয়েছে সত্যজিৎ রায় ফিল্ম ইন্সটিটিউট থেকে পড়াশোনা করে বের হওয়া কিছু মানুষ। কিছু আননেসেসারি সিন বাদ দিয়ে সিনেমার দৈর্ঘ্য আরেকটু কমালে আর সিনেমার একটা ভালো ট্রেলার বানালে সিনেমাটা আরেকটু রেসপন্স পেতো।

সুড়ঙ্গ: টিপিক্যাল রায়হান রাফীর ফ্ল্যাশব্যাক দিয়ে শুরু হওয়া সিনেমা। তবে প্রথম সিনেমা ‘পোড়ামন ২’ থেকে ‘সুড়ঙ্গ’ সিনেমায় রাফীর উন্নতি লক্ষণীয়। বিশেষ করে আলাদাভাবে প্রশংসা করতেই হয় সিনেম্যাটোগ্রাফিতে সুমন সরকারের, সেট ডিজাইনে শহীদুল ইসলামের, লোকেশনের আর অবশ্যই আফরান নিশোর নিয়ন্ত্রিত পারফরম্যান্সের। হলে উপভোগ করলেও চরকিতে আসার পর ততটা টানেনি সিনেমাটা, সম্ভবত বিগস্ক্রিন এক্সপেরিয়েন্সের ব্যাপারটাই আলাদা বলে।

নারী বা পুরুষকে ভিলেন দেখানোতে আমার আপত্তি নাই, তবে প্রোপার ব্যাকগ্রাউন্ড স্ট্যাবলিশ না করে যেভাবে দেখানো হচ্ছে আর যে উদ্দেশ্যে দেখানো হচ্ছে, সেটা দর্শক হিসেবে দেখতে পছন্দ করি না। সম্ভবত তুফানে সেই ব্যাপারটা থাকবে না।

মানুষ: বাংলাদেশের সিনেমা এটি নয়, তবে বাংলাদেশের ডিরেক্টর সঞ্জয় সমদ্দারের তৈরি সিনেমা। সম্ভবত প্রথমবারের মত কলকাতার কোনো সুপারস্টার নিজের প্রোডাকশন থেকে নির্মিত সিনেমায় বাংলাদেশের একজন ডিরেক্টরকে হায়ার করে নিয়ে গেছেন।

একই টাকা কীভাবে একজন সৎ পুলিশ অফিসারকে অসৎ করতে পারে আর একজন অপরাধীকে সৎ বানাতে পারে- পরিচালকের এই দর্শনটা ভালো লেগেছে। সিনেমাটা জিতের কারণে দেখতে গেলেও মুগ্ধ করেছেন মান্নান চরিত্রে জিতু কমল আর আকবর চরিত্রে সৌরভ চক্রবর্তী। ‘মানুষ’ অনেক অসাধারণ সিনেমা নয়, তবে হলে বসে এনজয় করার মতো সিনেমা, যার মুক্তির আগে কোন ধরনের ওভারপ্রমিজ করা হয় নাই। পরিচালক যা দেখাতে চাইসেন, তাইই দেখাইসেন। আলাদা প্রশংসা পাবে সিনেমার কিছু সংলাপ।

আরো অনেক সিনেমা রিলিজ হয়েছে, তবে কোনটাই পুরোপুরি এঞ্জয় করতে পারিনি। কিছু কিছু অংশ ভাল লেগেছে, পার্টিকুলার কিছু ডিপার্টমেন্ট ভালো লেগেছে কিন্তু কিছু অংশ ভালো লাগা দিয়ে তো আর পুরো সিনেমার প্রতি ভালোবাসা আসে না।

একটা দেশে একটা বছরে বলার মত ১০টা সিনেমা খুঁজে পাওয়া যায় না, এর চেয়ে আফসোসের কিছু দেখি না আমি।

কোথাও ন্যূনতম প্রোফেশনালিজম নাই, মানুষকে দিয়ে কাজ করিয়ে টাকাপয়সা দেয়ার বালাই নাই দিনের পর দিন, ক্যামেরার সামনে এসে মাথা ঠাণ্ডা করে ঠিকঠাক ইন্টারভিউ দেয়ার ক্ষমতা নাই, অন্যান্য দেশের বা রাজ্যের সিনেমা দেখার আর সেখান থেকে শেখার ন্যুনতম সময় নাই, রাইটারকে ন্যুনতম মূল্যায়ন নাই, প্রোডিউসারকে ‘মুরগী’ ডেকে তার কাছ থেকে টাকা খসানোর ধান্দা বেশিরভাগ সময়, চরিত্র হয়ে ওঠার পেছনে সময় দেয়ার মানুষ হাতেগোনা, নিয়মিত সিনেমা সাপ্লাই দেয়া একটা প্রোফেশনাল প্রোডাকশন হাউজ নাই, একটা প্রোপার ইকোসিস্টেম নাই, নিকেতন বা এফডিসি থেকে বের হওয়ার ইচ্ছা নাই কিন্তু মুখে বিশাল বড় বড় বুলি আছে,  ফেসবুক ঝগড়া আছে, পাল্টাপাল্টি স্ট্যাটাস দেয়া আছে, ফোনালাপ ফাঁস আছে, শারীরিক কসরত আছে, ডিবি অফিসে ভাত খাওয়া আছে, কোভিডের সময় কারো পাশে দাঁড়ানোর সময় বা ইচ্ছা নাই কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে দাঁড়িয়ে পুরো দেশের সেবার ইচ্ছে আছে- সেই জায়গায় যে এখনও সিনেমা হয়, সেটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় মিরাকল লাগে। এজন্যই আমি প্রতিদিন শুকরিয়া জানাই।

এটাকে অনেকে আবার ইন্ডাস্ট্রি বলে। হাসি পায় আমার। বেশি হলে মার্কেট বা পাড়া, ইন্ডাস্ট্রি তো কোনভাবেই না।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

অভিনেতা, শিক্ষক, লেখক ও উদ্যোক্তা

মন্তব্য করুন