২০২৩ সালের উল্লেখযোগ্য ২৪ নাটক
বাংলা নাটকের সুদিন এখন অতীত। ওটিটির উত্থান, জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী-প্রখ্যাত নির্মাতাদদের অনুপস্থিতি, বাজেট সমস্যা, ভিউয়ের কারণে চটুল নির্ভর নাটকের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া মিলিয়ে বাংলা নাটক যুগ সন্ধিক্ষণের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।
তবুও নাটক দেখা অনেকদিনের অভ্যেস, সবচেয়ে প্রিয় মাধ্যম। খারাপ বা অ্যাভারেজ নাটকের সংখ্যা অনেক বেশি সত্যি, তবে কিছু নাটক ভালোও হয়েছে। যদিও ভিউয়ের দিক থেকে পিছিয়ে বলে অনেকের নজরে পড়েনি।
২০২৩ সালে আমার দেখা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নাটক। তবে তালিকাটা ক্রমানুসারে নয়—
এক অসুখে দু’জন অন্ধ: ক্লোজআপ কাছে আসার গল্পে আমরা যার কবিতা শুনতে পাই, সেই কবি পুলক অনিলের নাটক। কবির নাটক পুরোটাই ছিল কাব্যিকতায় ভরা, মাসুদ হাসান উজ্জ্বলের নাটক মনে করিয়ে দিয়েছিল। ঘটনাক্রমে দেখা হাসপাতালে দেখা দুই তরুণ-তরুণীর ভালোবাসার জটিলতা নিয়েই এ নাটক। এই অস্থির সময়ে এমন নাটক নির্মাণ ভাবনার অতীত। খায়রুল বাসার ও সাফা কবির দুজনই ভালো করেছে, তবে সব ছাপিয়ে গেছে পুলক অনিলের নির্মাণের আবহ।
সময় সব জানে: গল্পটা অপরিচিত না, আমরা গত দুই যুগে এমন কাছাকাছি গল্প দেখেছি। তবে এ গল্প সব সময় প্রাসঙ্গিক, এখানেও কিছুটা অপ্রাপ্তি থেকে গেল গল্পের বিশালতার অনুপস্থিতির জন্য। তবে সাকিব ফাহাদ খুব সুন্দর নির্মাণ করেছেন, সংলাপ গুলো খুব ভালো। স্নিগ্ধ তটিনী আরো জোরালো উপস্থিতির জানান দিয়েছে অভিনয়ে, নবীন শাশ্বত দত্ত বেশ চার্মিং। অরুণা বিশ্বাসের উপস্থিতি চমকপ্রদ, কামরুল হাসান খসরুর ক্যামেরা বরাবরের মতো ভালো। শেষটা একটু ব্যতিক্রম, তবে বাস্তব সম্মত।
জায়গায় খায় জায়গায় ব্রেক: নামটা অদ্ভুত, এই নামের কারণে অনেকেই নাটকটি দেখতে চাইবে না। আমারো প্রথমে ইচ্ছা জাগেনি। পরে প্রিয় মোশাররফ করিমের নাটক, তাই দেখা শুরু করলাম। ভালোই লেগেছে। সাধারণত মোশাররফ করিমের সঙ্গে নতুন অভিনেত্রীরা অভিনয়ে পেরে উঠতে পারেন না, কিন্তু তানিয়া বৃষ্টি পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন। জুয়েল এলিনের রচনায় এই নাটকের পরিচালক জাকিউল ইসলাম রিপন।
বৃষ্টির অপেক্ষায়: কোরিয়ান ড্রামা ‘ওয়েটিং ফর রেইন’ থেকে অনুপ্রাণিত। নির্মাতা এল আর সোহেলের উপস্থাপনা বেশ ভালো লেগেছে। খায়রুল বাসার- সাদিয়া আয়মান এই মুহূর্তে নাটকে সবচেয়ে সুন্দর জুটি। সঙ্গে বিদ্রোহী দীপনের সিনেমাটোগ্রাফি ও অর্পণের মিউজিক। একটু ধীরগতির, তবে ভালো লাগবে।
কবর: সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত নাটক। অনাগত সন্তানের পৃথিবীতে আগমন নিয়ে দুই স্তরের দুই দম্পতির অপেক্ষা ও প্রত্যাশা নিয়ে এ নাটক। যোবায়েদ আহসানের চিত্রনাট্যে রাফাত মজুমদার রিংকুর পরিচালনায় তাসনিয়া ফারিণের রূপক চরিত্রে দ্বৈত অভিনয়ের জন্য সাধুবাদ দিতে হয় সংশ্লিষ্টদের, জোভান বেশ ভালো করছে।
প্রণয়: ইয়াশ রোহান-তটিনী জুটির নাটক। এই জুটির রসায়ন বেশ ভালো লেগেছে। প্রেমিক-প্রেমিকার পালিয়ে গিয়ে বিয়ের গল্প, তবে শেষটা অন্যরকম। যার জন্য প্লটহোল থাকলেও দেখতে ভালো লেগেছে। নাসির খানের চিত্রনাট্যে পথিক সাধনের নাটক।
শহরে অনেক রোদ: মিজানুর রহমান আরিয়ানের দীপ্ত প্লের ফ্ল্যাশ ফিল্ম। সোহাইল রহমানের রচনায় গল্প অনিক নামের এক ভবঘুরে ছেলেকে ঘিরে, যার হঠাৎ নীতু নামের মেয়েকে ভালো লেগে যায়। বেশ ভালো লেগেছে এটা। নজর কাড়বেন খায়রুল বাসার, সঙ্গে সাবিলা নূর। বিশেষ করে বলবো তানিয়া আহমেদের কথা, তিনি এই কাজটা আরো জমিয়ে দিয়েছেন, সঙ্গে নাদের চৌধুরী। শাওন গানওয়ালার গানটা সুন্দর।
সুখ-অসুখ: মেডিকেল পড়ুয়া এক মানসিক রোগী ছেলের গল্প, যাকে গ্রামে আনা হয় বিয়ের জন্য। চাচীর লোভের কারণে বিয়ে ঠিক হয় সাধারণ মেয়ের সাথে। তাদের ভালোবাসা ও সম্পর্কের জটিলতা নিয়ে এই গল্প। নাসির খানের চিত্রনাট্যে পথিক সাধন পরিচালিত এই নাটকে অভিনয় করেছেন খায়রুল বাসার-সাদিয়া আয়মান, দুজনই ভালো করেছেন। শিল্পী সরকার অপু নেগেটিভ চরিত্রে দারুণ, গানটাও ভালো।
কাছের মানুষ: পারিবারিক নাটক, বাবার মৃত্যুর পর একটা পরিবারে নেমে আসে নানান জটিলতা, যার জন্য সম্পর্কে জটিলতা হয়,দূরত্ব সৃষ্টি হয়। শেষটা তাড়াহুড়ো হলেও অপূর্ব-তৌসিফ-মনিরা মিঠুদের অভিনয় ও চরিত্রগুলোর টানাপড়েনের জন্য দেখা যায়। তবে তানিয়া বৃষ্টির চরিত্রটি সঠিকভাবে বিকশিত করতে পারেননি নির্মাতা ইমরাউল রাফাত।
নোঙর: নাটকে এখন গতানুগতিকতার বাইরে তেমন কিছুই ভাবা হয় না, উঠতি নির্মাতা রাফাত মজুমদার রিংকু ভাবেন বলেই ভিন্ন ভিন্ন গল্প পাওয়া যায়। নোঙর তেমনই একটা নাটক। ফারিণ খুবই ভালো করেছে, বক্তব্যটাও সাহসী। দেশের চিকিৎসা খাতের অপরাধ নিয়ে গল্পটা। যদিও একটু নাটকীয় লেগেছে। রোমান্টিক চরিত্রের বাইরে গিয়ে জোভান চেষ্টা করছে ভিন্ন কিছু করার, দেখা যাক কতটা ভালো করতে পারে। পিন্টু ঘোষের গানটা বাড়তি পাওনা।
বিদেশ: কাজল আরেফিন অমির নাটক। গল্পের বিষয়বস্তু অবৈধপথে বিদেশে পাড়ি জমানো। পুরো সন্দ্বীপে চিত্রায়িত হয়েছে এই নাটক। শুরুর দিকে অমির চিরচেনা স্ক্রিপ্ট হলে মধ্য অংশের পরেই চিত্র পাল্টাতে থাকে। ব্যাচেলর পয়েন্ট টিম নিয়ে অমি যেই নাটক বানান সেখানে গল্প-চিত্রনাট্যে আগের চেয়ে মনোযোগী হয়েছেন। পলাশ-পারসা ইভানার রসায়ন গুডবাজ থেকে ভালো লাগে। ব্যাচেলর পয়েন্ট টিমের বাইরে আছে কারাগার-খ্যাত জিসান, যার অভিনয় বাদবাকিদের থেকে পুরো আলাদা।
পুতুলের সংসার: তানজিন তিশার দ্বৈত অভিনয়, গল্পটা মা ও মেয়ের। মেয়ের মাকে খুঁজে বেড়ানোর গল্প। শেষটা তাড়াহুড়ো ও গতানুগতিক হলেও রাফাত মজুমদার রিংকু ভালো করার চেষ্টা করেছেন। তানজিন তিশার অভিনয়ের উন্নতি লক্ষ্যণীয়, চিত্রলেখা গুহকে আঞ্চলিক কমেডির বাইরে দেখতে পেয়ে ভালো লেগেছে। সোহেল মণ্ডল আছেন বিশেষ চরিত্রে।
আজ আকাশে চাঁদ নেই: হুমায়ূন আহমেদের নাটক দেখে যারা বড় হয়েছেন তাদের কাছে খুবই পরিচিত ঘরানার নাটক। নির্মাতা মারুফ হোসেন সজীব চেষ্টা করেছেন কিন্তু তখনকার মতো পার্শ্ব অভিনয়শিল্পীরা তো এখন নেই। তবে সংলাপ ও সাদিয়া-বাসারের অভিনয়ের জন্য দেখা যায়।
পুনর্জন্ম অন্তিম পর্ব: ভিকি জাহেদকে স্বাতন্ত্র্য করেছে এই সিরিজ। আফরান নিশো-মেহজাবীন অভিনীত এই ঈদের একমাত্র নাটক, দৈর্ঘ্য সিনেমার মতোই। সিরিজ নিয়ে আগ্রহ থাকলেও দ্বিতীয় কিস্তি থেকেই মান পড়তে থাকে,অন্তিম পর্বটাও বেশ জট পাকিয়ে ফেলেছিল।
সারপ্রাইজ: ২০০০ সালের দিকে বিটিভিতে প্যাকেজ আকারে কিছু পারিবারিক রম-কম হতো, ফেরদৌস হাসানরা বানাতেন, কিছু বছর আগেও আশফাক নিপুণরা বানাতেন। এটা তেমনই নাটক। যদিও গল্পটা বর্তমান প্রেক্ষাপটে যায় না, তবে উপভোগ্য। সাবিলা নূরের দ্বৈত অভিনয় ও অপূর্বর অভিনয় বেশ হাসিয়েছে। সোহাইল রহমান ও জয়নাল আবেদীনের চিত্রনাট্যে পরিচালক ছিল মাসরিকুল আলম।
আঁধার: ভিকি জাহেদের এই নাটক নিয়ে আলোচনা কম, তুলনামূলকভাবে ভালোই। শেষ চমক আগে বুঝতে পারলেও দেখতে আগ্রহ কমে যায় না। তৌসিফ-তানজিন তিশা চেষ্টা করেছেন নিজেদের চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতেন।
শেষ ঘুম: পরিচালকের নাম না কেউ দেখলে নির্দ্বিধায় সবাই বলে দিবে এটা ভিকি জাহেদের নাটক। তবে এই নাটকের পরিচালক ভিকি নন, রাগিব আহসান পিয়াল নামের একজন। পুরোটাই ভিকি জাহেদকে অনুপ্রাণিত মনে হলো। তবে ভালোই লেগেছে। তৌসিফ মাহবুব নিজেকে আকর্ষণীয় রেখেছেন,তটিনী অল্পদিনেই কঠিন চরিত্র পেয়ে গেলেন, ফলাফল স্বাভাবিকভাবেই মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়েছে।
কষ্টের নাম মায়া: গল্পের গভীরতা না থাকলেও পথিক সাধনের চিত্রনাট্য, মেকিংয়ের কারণে দেখতে ভালো লেগেছে। তৌসিফ মাহবুব, সাদিয়া আয়মান কে আবারো একসাথে দেখা গেল। শাহবাজ সানীকে ভাইয়ের চরিত্রের চেয়ে বাইকার চরিত্রে বেশি মানাতো।
শব্দ প্রেম: ২০১৯ সালে ঘটে যাওয়া সত্য কাহিনী থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বানানো ভিকি জাহেদের নাটক। ভিকি জাহেদের চিত্রনাট্য যেমন জটিলতায় পূর্ণ থাকে তেমনি। তৌসিফ মাহবুব বেশ ভালো করছে, নির্মাতা গল্প ভালো হলে তার চেষ্টাটা আসলেই বুঝা যায়,ফারিণ ও ভালো করেছে। তবে এই নাটকের সমস্যা হচ্ছে এর দৈর্ঘ্য। কোনোভাবেই এটা ৪০-৪৫ মিনিটের বেশি দাবি করে না,চ্যানেলের দাবি মেটাতেই হউক বা অন্য কারণে বাড়াতে গিয়ে ভীষণ ধীরগতির হয়ে গেছে, যাতে মনোযোগ সরাতে বাধ্য।
কদমবনে বৃষ্টি: নাসির খান দুটি গল্পকে একত্রিত করে অপূর্ব-সাবিলা নূর নিয়ে নতুন নির্মাতা মাসরিকুল আলমের নাটক। প্রথম অংশ গ্রাম্য মিষ্টি প্রেমের গল্প, দ্বিতীয়ার্ধে নিজেদের জীবনের জটিলতা। সাধারণত দুটি গল্পকে একত্র করলে খেই হারায়, এখানে সংযোগ থাকায় তত অসুবিধা না হলেও প্রথমার্ধের মতো শেষে উপভোগ্য হয়নি। সাবিলা নূর,অপূর্ব যথাযথ।
বিরতিহীন যাত্রা: শারীরিক প্রতিবন্ধী সুনয়নার গল্প। যিনি মাইলের পর মাইল ছুটে মানুষের হাতে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে বই পৌঁছে দেন। তার এমন অদম্য প্রচেষ্টায় সমাজের সাধারণ মানুষ মুগ্ধ হলেও এলাকার চেয়ারম্যান বাঁধা হয়ে দাড়ায়। শেষ পর্যন্ত কে জেতেন সেটাই নাটকের গল্প। গল্পটি লিখেছেন আহমেদ তাওকীর। সাবিলা নূর প্রধান চরিত্রে দারুণ অভিনয় করেন।
পথে হল দেরী: বিশাল বাজেটে জাকারিয়া সৌখিনের রোমান্টিক নাটক, অপূর্ব -তটিনী এরা ভালোই। তবে এই গল্পের জন্য বাজেটের পরিমাণ অপচয়ই মনে হলো। এই বাজেট আরো সুন্দর গল্পের জন্য তোলা থাকলে পূর্ণতা পেত। তবে সুন্দর রোমান্টিক আবহ সব সময়ই উপভোগ্য হয়,দেখতে ভালো লাগে। এটাও তেমনই।
লাভ সেমিস্টার: প্রবীর রায় চৌধুরীর নাটক মানেই বড় ক্যানভাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের জীবন,যেখানে প্রেমই মূল আকর্ষণ। গল্প অনুযায়ী স্ক্রিনটাইম একটু বড় হলেও ভালো লেগেছে দেখতে,যার কারন গ্ল্যামারাস মেকিং। উনার নাটকে জোভানকে দেখা যায় বিশেষ ভাবে,এটা বলার কিছু নেই। নাজনীন নীহা এখন নতুন সেলিব্রিটি ক্রাশ। তানভীর ইভানের তোমাকে চাই গানটা দারুণ।
কাজলের দিনরাত্রি: বছরের শুরুতেই ভিকি জাহেদ মেহজাবীনকে কেন্দ্র করে এই দারুণ নাটকটা নির্মাণ করেছিল। সঙ্গে ছিল তৌসিফ মাহবুব।